নির্বাসনে যাবার আগে।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ১০/০১/২০০৮ - ৪:৩৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মা রান্নাঘরে ছিলেন।
চুলোর উপরে টগবগ করে কি যেন ফুটছে। আগুনের আঁচে মায়ের ফর্সা মুখটি লালচে লাগছিল।
"মা, তোমাকে বলতে এলাম। আমি যাচ্ছি।"
মা আমার দিকে ফিরে তাকান।
"এই অবেলায় কোথায় যাচ্ছিস আবার? সারাদিন টোটো করে না ঘুরলেই কি নয়?"
"আমি নির্বাসনে যাচ্ছি মা। আর দেখা হবে না তোমার সাথে। ক্ষুদিরামের গানটি মনে আছে মা? একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি। ব্যাপারটা অনেকটা সেই রকম। শুধু আমি আর ফিরে আসবো না। ওয়ান ওয়ে টিকিট।"
মা হাসেন। "কোথায় যাচ্ছিস বললি?"
আমি হালকা রাগ দেখাই। "তুমি আমার কথা মন দিয়ে শুনছো না। আমি নির্বাসনে যাচ্ছি।"
মা এবার আরো হাসেন। হাসতে হাসতে প্রায় গড়িয়ে পড়েন। আমি এবার সত্যি সত্যি রেগে উঠি। আমার কথা কেউই সিরিয়াসলি নেয় না।
একসময় মায়ের হাসি থামে। আঁচল দিয়ে তিনি মুখ মোছেন। তারপর বলেন, "তোর কথা শুনলে এতো হাসি পায়।"
আমি গম্ভীর হয়ে বলি,"আমি কি কোন মজার কথা বলেছি যে এতো হাসতে হবে?"
মা বলেন, "মজার কথাই তো। তুই নির্বাসনে যাবি কিভাবে? আমরা সবাইই তো নির্বাসিত। যা-ভাল করে হাতমুখ ধুয়ে আয়, ভাত খাবি। আমার রান্না শেষ।"

বজ্রাহত মানুষের মতো আমি রান্নাঘরের চৌকাঠে বসে থাকি। মা কি কথা বলে গেলেন?

সুনীল গাংগুলির একটি প্রিয় কবিতার লাইন অনেক আওড়েছি এক সময়। "যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অংগুরী ছোঁয়াবো, আমি বিষপান করে মরে যাবো।" তখন নির্বাসন শব্দটির অর্থ ছিল দূরদূরান্তর পেরিয়ে কোন এক অজানা স্থানে চলে যাওয়া। যেখানে পরিচিত কোন কিছু নেই। এখন বুঝি, নির্বাসন মানে অচেনা কোথাও চলে যাওয়া না, এর অর্থ পরিচিত, প্রিয়, ভালবাসার জিনিসগুলোকে হারিয়ে ফেলা। এখন বুঝি প্রকৃতই আমরা এক এক জন নির্বাসিত মানুষ। প্রতিদিনই আমরা একটু একটু করে আমাদের প্রিয়জনদের কাছ থেকে, প্রিয় জিনিসের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।

আমাদের বাড়ীর সামনে একটি বিশাল হাসনুহানার ঝোপ আছে। সেই ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি। শীতকালে স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলে বাড়ী ফিরতে দেরী হোত। তখন পা টিপেটিপে লুকিয়ে ঘরে ঢুকতাম। হাসনুহানার গন্ধে সারা মন অবশ হয়ে যেত, মনে হোত কোন এক স্বপ্নের জগত লুকিয়ে আছে ঝোপটির ওপাশে। হাসনুহানার ঝোপটি এখনও সেইখানেই আছে। এখনও তেমনি ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। কিনতু আমি তার পাশ দিয়ে চলে যাবার সময় আর তেমনভাবে অবশ হইনা। এখন মনে হয় ঝোপটি অনেক খানি জায়গা নষ্ট করছে। বিদায় তোমাকে, হে হাসনুহানা! আমি তোমার কাছ থেকে চলে গেলাম।

একই ভাবে বিদায় জানিয়েছি ঈদের দিনে ভোররাতে উঠে দিদিমার সাথে পোলাওয়ে দেবার জন্য মটরশুঁটির খোসা ছাড়ানোকে। বিদায় জানিয়েছি চকচকে একটি আধুলী পাবার আনন্দে নির্ঘুম সারা রাতকে, বিদায় জানিয়েছি নিজের নামে আসা প্রথম চিঠিটি বারবার পড়ার আনন্দকে, বিদায় জানিয়েছি পড়ন্ত বেলার রোদে দেখা লাল চটি পরা একজোড়া ফর্সা পায়ের পাতাকে। বিদায়, বিদায় তোমাদের সবাইকে। তোমাদের কাউকেই আমি আর কাছে পাইনা। নির্বাসনে চলে গিয়েছি আমি।

এখন বুকের মধ্যে একধরণের ভয় নড়াচড়া করে। আজকে কোন জিনিসটি হারিয়ে ফেলবো? তাই আশপাশের সব কিছুকে আরেকবার ভাল করে দেখে নেই। পাশে শুয়ে থাকা মানুষটির ঠোঁটের উপরের সৌন্দর্য্যময় তিলচিহ্নটিকে গোপনে ছুঁয়ে দেখি। আর যদি দেখা না হয় কোনদিন? আর যদি এমন ভাবে না দেখি? শিশুটির গায়ের সুবাসটি কি আমি কালকেও আবার পাবো এমনি করে? জানিনা। তাই আজই কোলে তুলে নেই তাকে। শিশুটি হাসে কোনকিছু না বুঝেই। তাকে বুকের মধ্যে নিয়ে বসে থাকি। শিশুটি বোঝেনা জাহাজঘাটে অপেক্ষা করছে জাহাজ। যে কোনদিন বেজে উঠবে ঘন্টা। চিরতরে হারিয়ে যাবে তার হাসিটি।

সুনীল গাংগুলি, আপনি কি বলতে পারবেন কতখানি বিষ পান করলে আমরা আমাদের দুঃখ ভুলতে পারবো?

-নির্বাসিত


মন্তব্য

নিঝুম এর ছবি

আরো একজন চমতকার লেখক কে পাওয়া গেলো।আশা করছি শীঘ্রই সচল হবেন।

লিখা নিয়ে মন্তব্য আর করতে হবে?
--------------------------------------------------------
যাগায় খাইয়া যাগায় ব্রেক...

---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন

ss এর ছবি

অনেকদিন পর------------- একঘেঁয়ে বিষণ্ণ লেখার মাঝে-------------- ভীষণ নাড়িয়ে দিলো আপনার লেখা-----------
আমারও ঠিক একই অনুভব--- মনে পড়ছে খুব ছোট্টবেলায়---------- বাড়ীর উঠোনে হাসনুহেনা গাছটার তীব্র সুগন্ধ। এখনও,এক যুগ পরেও মাথার ভেতরে ঘোরে তার তীব্রতা।।শুধু,ছোঁয়া যায়না আর, হারিয়ে ফেলা সেই দিন গুলোকে।
ss

উত্তীও এর ছবি

হারিয়ে যেতে হবে আমায়
ফিরিয়ে পাব তবে ।
সন্ধাতারা যায় যে চলে
ভোরের তারায় জাগবে বলে ।

ধুসর গোধূলি এর ছবি
রানা মেহের এর ছবি

"এখন বুঝি, নির্বাসন মানে অচেনা কোথাও চলে যাওয়া না, এর অর্থ পরিচিত, প্রিয়, ভালবাসার জিনিসগুলোকে হারিয়ে ফেলা।"

খুব ভালো লিখেছেন।
নিয়মিত লিখুন

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

স্নিগ্ধা এর ছবি

সুন্দর লেখা !

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

নির্বাসন শব্দটির অন্যতর একটি মানে আজ থেকে জানলাম।
ধন্যবাদ।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

অনিকেত এর ছবি

অসাধারন!

আপনার লেখাটি পড়ে ঝিম মেরে বসে ছিলাম অনেকখন। আপনার লেখার হাত খুবই ভালো। খুবই খুবই ভালো।

গৌতম এর ছবি

নির্বাসন মানে অচেনা কোথাও চলে যাওয়া না, এর অর্থ পরিচিত, প্রিয়, ভালবাসার জিনিসগুলোকে হারিয়ে ফেলা। এখন বুঝি প্রকৃতই আমরা এক এক জন নির্বাসিত মানুষ।

আপনার সাথে অসম্ভব রকমে একমত।

..................................................
ছিদ্র খুঁজে বেড়াই, বন্ধ করার আশায়

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

হাসান মোরশেদ এর ছবি

'মানুষ মুলতঃ একা,
সে তার চিবুকের কাছে ও ভীষন অচেনা ও একা...'
তো, কি আর করা?
----------------------------------------
শমন,শেকল,ডানা

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

দুর্দান্ত লেখা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

s-s এর ছবি

আমি জানিনা আমার করা আগের মন্তব্যটা কেন দেখালো না
আপনাকে আবারও তাই লিখছি, এবারে লগ ইন করে:

"ক্ষণিকের আলো ছায়া,তারে যায়না যে পাওয়া
বুকের গভীর ভেতর থেকে তীব্র হাহাকার
সেইতো সব আছে,সেইসব স্কুলবাড়ি মাঠঘাট দোয়াত কলম পাদানি
একসময়ের দিনরাত আড্ডা মারা চায়ের টেবিল
শরীরের অংশের মত যাদের চিনতাম----
সেইসব ছুঁয়ে আজ কেন হঠাৎই মনে হয়
আমি কই,কখনও কি ছিলাম?"

আমার ছোট্টবেলার সেগুনবাগান বাড়ীর তীব্র হাসনুহেনার গন্ধ মনে করিয়ে দিলো আপনার লেখা।

ফারুক হাসান এর ছবি

মন খারাপ করে দেয়া লেখা।
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাইরে আপনার লেখা পড়ে আমার নিজের নির্বাসন মনে পড়ে গেলো

(খেকশিয়াল)

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আপনারা কয়েকজন মনে হচ্ছে সচলকে অচল বানাবেন! এই লেখা পড়লে হাত পা অসাড় হয়ে আসে। ইশতিয়াক রউফ, নির্বাসন এসব কি হচ্ছে?
একটু শান্তিতে থাকতে দেন।

মাশীদ এর ছবি

পড়ে মনে হল, আহা! আমরা কত্তখানে কত্তজন একইভাবে নির্বাসিত, না? আপনার মতই আমারো হঠাৎ হঠাৎ জাহাজঘাটের ঘন্টার কথা মনে পড়ে। মনে হয়, আর যদি দেখা না হয়? আর যদি কথা না হয় কোনদিন? কার ঘন্টা কখন জানি বাজে!

ভাল লাগল খুব। তাড়াতাড়ি সচল হয়ে উঠুন। এইখানে আমরা কেউ নির্বাসিত নই। দূরে না গিয়ে এই দেখুন না আমরা অচেনা সবাই কেমন বেশ মনের কাছাকাছিই থাকি এইখানে।


ভাল আছি, ভাল থেকো।


ভাল আছি, ভাল থেকো।

সবজান্তা এর ছবি

এই মধ্যরাতে ডর না দেখাইলেই কি হইতেসিলো না ?
----------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

কনফুসিয়াস এর ছবি

নির্বাসনের মানেটা বড় ভালো লাগলো।
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাদের মন্তব্যের এবং উত্সাহের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। তাতে শংকা একটাই। পাগল কিন্তু সাঁকো নাড়ানোর বুদ্ধি পাচ্ছে। একবার কলম পেষা শুরু করে দিলে আর কি সে আর থামতে চাইবে?

-নির্বাসিত
-----------------------------------------------------------
"যতদুর গেলে পলায়ন হয় ততদুর কেউ আর পারেনা যেতে"।

স্নিগ্ধা এর ছবি

যেন না থামে সেজন্যই তো এতো কথা ?!

অমিত আহমেদ এর ছবি

খুব ভাল্লাগলো লেখাটা।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

পরিবর্তনশীল এর ছবি

বুক কাঁপিয়ে দিল।
আমার পড়া সেরা লেখাগুলোর একটা।
প্রিয় পোস্টে এড করতে বাধ্য হলাম।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

জাহিদ হোসেন এর ছবি

যেদিন ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছিলাম, সেদিন একই ভাবে আমিও ঝিম মেরে ছিলাম অনেকক্ষণ। বড় মায়া লাগছিল আমাদের সবার জন্য। আহারে-এইভাবেই কি তাহলে চলে আমাদের জীবন?

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

জাহিদ ভাই আপনার লেখা কেমন সেটা আমার মত ক্যাবলা ভোদাইয়ের কাছে না শুনলেও চলবে। আমি নিতান্তই এক ভুখা নাঙ্গা পাঠক। লেখাটা পড়ে একদম অসাড় হয়ে গেলাম, আপনার লেখাগুলো একদম হুট করে সব কেটে ঢুকে যায়, তারপর আর বের হতে চায় না, ভেতরে ঢুকে আটকে থাকে। গুরু গুরু
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদ্বপি গরীয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

তিথীডোর এর ছবি

অদ্ভুত সুন্দর!!!

--------------------------------------------------
"সুন্দরের হাত থেকে ভিক্ষা নিতে বসেছে হৃদয়/
নদীতীরে, বৃক্ষমূলে, হেমন্তের পাতাঝরা ঘাসে..."

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অনিকেত এর ছবি

আমি যে কত কত বার এইলেখাটার কাছে ফিরে আসি তার কোন ইয়ত্তা নেই। আমার যেকোন একাকীত্বের দিনে নিঃসঙ্গতা কাটাতে লেখাটা আমার পাশে বসে। আমার যেকোন আনন্দের দিনে লেখাটা আমার বাড়ি বেড়াতে আসে ফুল নিয়ে হাতে। বৃষ্টির দিনে জানালার শিকে আমার মত নাক ঠেকিয়ে বসে থাকে এই লেখাটাই----
জানিনা জাহিদ ভাই আপনি আমাদের সবার কথা দেখতে পাচ্ছেন কিনা---আপনাকে বড় মিস করি আমাদের মাঝে---ফিরে আসুন নির্বাসন ছেড়ে---

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।