একটি রেইনবোর গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ৩০/০১/২০০৮ - ১১:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বহু বছর আগে রেডিওতে (তৎকালিন রেডিও বাংলাদেশ) ওয়ার্ল্ড মিউজিক নামে একটি অনুষ্ঠান হত। খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতাম; ম্যাকগাইভারের জন্য অপেক্ষা বেশি কষ্টকর ছিল, না ওয়ার্ল্ড মিউজিক এর জন্য, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।

যাই হোক, ওয়ার্ল্ড মিউজিক এর থিম জিংগলটি ছিল রোলিং স্টোনস এর "জাম্পিং জ্যাক ফ্ল্যাশ" গানটির একটি সাইকাডেলিক কভার। সেই কভারটি ছিল প্রখ্যাত সেতার বাদক আনন্দ শংকর এর কম্পোজ করা। মজার ব্যাপার হল, থিমটি বহুদিনের চেনা হলেও আমি আর্টিস্ট এর নাম জেনছি মাত্র বছর খানিক আগে।

সেসময় রেডিওতে গান শুনে রেইনবোতে যেতাম রেকর্ড করানোর জন্য। তখন কেবল টিভির অস্তিত্ব ছিল না; ছিল না ইন্টার্নেট এবং কোন সংগীত সংক্রান্ত পত্রিকাও যাওয়া যেত না সহজে।

আমরা তিন বন্ধু তখন কলেজ ছাত্র। সংগীত নিয়ে প্রবল উৎসাহ। কিন্তু কারোরই বাসার পরিস্থিতি এরকম নয় যে পড়ালেখা বাদ দিয়ে সংগীত সাধনা করবো। শেষ ভরসা অডিও ক্যাসেট এবং পুরনো হয়ে যাওয়া ডেক সেট।

এবং অবশ্যই বি গিস লুক এলাই, এক এবং অদ্বিতীয় কবির ভাই---

আশা করি কবির ভাই কিছু মনে করবেন না উনার নাম নিয়েছি দেখে। পত্রিকায় উনার নাম প্রকাশিত হলে উনি খুবই বিব্রত বোধ করতেন।

যাই হোক, ইহা তো আর পত্রিকা নয়। জো স্যার্টিয়ানি কোন পরিস্থিতিতে ডিপ পার্পলে বাজিয়ে ছিল, কনসার্ট ফর বাংলাদেশে এরিক ক্ল্যাপটন কেন আসলো, জিম মরিসন আসলে কবি না গায়ক না দু'টোই, নফলার কেন ডায়ার স্ট্রেইটস ভেঙে দিল, রিচি ব্ল্যাকমোর কেন এত রগচটা, বাংলাদেশে বিটলস কেন এত কম জনপ্রিয়, টাকিলা সানরাইজ জিনিসটা আসলে কি বস্তু, ডিও ওজি কি আসলেই শয়তানের উপাসক ছিল নাকি, ব্ল্যাক সাবাথ এর সেরা ভোকাল কে--এরকম শত শত মজার টপিক নিয়ে গল্প হোত, ঘন্টার পর ঘন্টা।

কবির ভই এবং রেইনবোর সেই মায়াবী আকর্ষণে ছুটে যেতাম প্রতিদিন আরামবাগের ব্যস্ত রাস্তা ধরে এলিফ্যান্ট রোডে--১৫ টাকা রিকশা ভাড়া নিত (না, তার আরো বহু আগেই মোঘল বাদশারা পটল তুলছেন)। সেসময় মনে হত "ইসসস, কেন যে শুক্রবার রেইনবো খোলা খাকে না--তাইল ৭ দিনই যাওয়া যেত!"

আমি রেকর্ড করালাম বিটলস, রুশো করালো ডিপ পার্পল এবঙ স্বস্তি ব্ল্যাক সাবাথ এর সব এ্যালবাম। আহা, কত মধুর সময় কাটিয়েছি সেসব শুনে। পরে ড্রিম থিয়েটার, ডোরস, রেইনবো, এলভিস (সোহেল ভাই এর ভাষায় ইবলিশ), মেটালিকা আরও কত কি শুনলাম।

রেকর্ডিস্ট সোহেল ভাই, মুকুল ভাই এর সাথে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্ব; এইতো সেদিনও দেখা করে আসলাম মুকুল ভাই এর সাথে।

সোনালী সময়ের শেষ দিকে এল ইন্টার্নেট এবং এমপিথ্রি। সেসময় দেখতাম মনমরা হয়ে বসে আছেন কবির ভাই। এক কাস্টমার এসে স্পাইস গার্লস এর এ্যালবাম রেকর্ড করতে দিল। কবির ভাই কে জিজ্ঞেস করলো "ওদের নতুন এ্যালবামটা কেমন হয়েছে, কবির ভাই?" কষ্টে উত্তর দিলেন "ভালো"। "সাথে ফিলার হিসাবে সেপালচুরা দিলে কেমন হয়?" আরো কষ্টের সাথে উত্তর দিলেন "ভালোই তো হয়, দিয়ে দাও।"

বেশিদিন থাকেননি এরপর আর। একদিন তো এক ছোকড়া এসে গেমস এর সিডি চেয়ে বসলো। কফিন শেষ পেরেক।

কবির ভাই এখন অস্ট্রেলিয়া নিবাসী।

বহু স্মৃতি বিজড়িত রেইনবো এখন আর আগের মত নেই। নেই সেই আগের কোলাহল এবং জনস্রোত, নেই কবির ভাই। দোকানটিও অনেক ছোট করে ফেলা হয়েছে। মাঝে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল, কিন্তু এখন খোলা।

কিন্তু আছেন অমায়িক মুকুল ভাই এবং কবির ভাই এর প্রতিষ্ঠিত কালেকশন। পুরনো কোন আর্টিস্ট এর গান, যা কি না টরেন্ট সার্চেও পাওয়া যায় না--রেইনবোতে সহজলভ্য। রেকর্ড করালাম ফ্র্যাংক জ্যাপ্পার দুইটি এ্যালবাম সহ ১০টি সিডি।

সুতরাং এখনো অনেকক্ষেত্রেই রেইনবো ভরসা।

Long Live Rainbow!


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ঢাকা 'গ' চ্যানেলের ওয়ার্ল্ড মিউজিক আমারও প্রিয় ছিলো খুব।

তবে ঢাকার মোহাম্মদপুরের তন্ময়ের চেয়ে বড় কোনো ফ্যান আছে কিনা জানি না। ২০০৫এর আগে ৪/৫ বছর একটানা তার সং রিকোয়েস্ট থাকতো। এখনো আছে হয়তো - - - হাসি

অতিথি লেখক, আপনার নামটা জানা হলো না।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি ইশতিয়াক; পড়ার জন্য ধন্যবাদ!

-ইশতিয়াক

রেজওয়ান এর ছবি

সেই সব দিনগুলির কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। আমার আরেকটি বাতিক ছিল ওয়ার্লড মিউজিকের দেশ-বিদেশের গানগুলো শুনে নামগুলো লিপিবদ্ধ করা। দুপুর বেলাটায় (৩টার সময়) তাই রিলিজিওয়াসলি রেডিওর সামনে থাকতাম। সেগুলো থেকে বেছে আবার পরবর্তীতে ক্যাসেট করাতাম এবং রেইনবো অবশ্যই ছিল পছন্দের শীর্ষে। কবির ভাইয়ের কথাও মনে পরে। গান বেছে দেয়ার ক্ষেত্রে ওনার চয়েসকে আমরা খুবই গুরুত্ব দিতাম।

আর অবশ্যই তার ট্রেডমার্ক ছিল বিশেষ ইংরেজী হাতের লেখায় গানের নামগুলো একটি সবুজ কাগজে। ওটি দেখলেই সবাই বুঝত কোথা থেকে রেকর্ডিং করা।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

তাসনীম এর ছবি

মনের মুকুরের সুবাদে চার বছর আগের লেখাটা পেলাম। খুব ভালো লাগলো।

কবির ভাইয়ের সাথে নানাবিধ ফাজলামি করার অভিজ্ঞতা আছে, যদিও ওনার মুড মারাত্মক ছিল। রেইনবোতে মুরাদ ভাই নামে আরেকজন ছিলেন। শুনেছি রেইনবো দোকানটা আগের জায়গাতে নেই।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

রেইনবো নিয়ে মনে হয় একটা সংকলন হওয়া দরকার যেখানে আশি আর নব্বইয়ের দশকের রেইনবোগোয়াররা লিখবেন তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে, কবীর ভাইকে নিয়ে, জানা ও অজানা সব তথ্য নিয়ে। দুনিয়াতে রেইনবো'র চেয়ে ঢেড় ছোট জিনিস নিয়ে অনেক বড় কাজ হয়েছে; সেখানে রেইনবো অনেক বড় একটা ব্যাপার। রেইনবো আর কবীর ভাইয়ের অবদান আমরা লিখে না গেলে ঋণ অস্বীকার করা হবে। কেউ কি একটু উদ্যোগ নেবেন?

পুনশ্চঃ একই কথা বাংলাদেশ বেতারের 'ওয়ার্ল্ড মিউজিক'-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অনুষ্ঠানটা এখনো হয় কিনা জানি না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।