অতীতের কাসু আপা এবং হালের খুনী শিক্ষিকা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ৩১/০৫/২০০৮ - ২:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যখন ক্লাস টুতে পড়ি- সেই একই রেলওয়ে স্কুল। আমাদের ইংরেজি পড়ান কাসু আপা। দেখতে লম্বা-পাতলা। মুখ ভর্তি বসন্তের ঘন ফোঁটা। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কন্ঠস্বর খসখসে। তিনি খাতায় সাইন করতেন কা.সু। তাই তাঁকে কাসু আপা বলেই জানতাম। পড়ে অবশ্য বেবি একদিন বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে, আপার নাম কাজী সুরাইয়া।

হঠাৎ একদিন কেন জানি তিনি সবাইকে নাম ধরে ধরে ডেকে জিজ্ঞেস করছিলেন- তুমি কোন ক্লাসে পড়?

এক এক করে সবাই বলেবলে যারযার আসনে ফিরে আসছে। আমার ডাক পড়লো। যথারীতি আপার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি প্রশ্ন ছুঁড়লেন- কোন ক্লাসে পড়?

নিষ্কম্প কন্ঠে উত্তর দিলাম- দৃতীয় শ্রেণী।

তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
তারপর আবার প্রশ্ন করলেন কোন শ্রেণীতে? আমিও উত্তর দিলাম- দৃতীয় শ্রেণীতে। কিন্তু উত্তর শুনে তিনি কিছু না বলে, হাতের বেত দিয়ে হঠাৎ আমাকে সপাং সাপাং করে মারতে আরম্ভ করলেন।

বিস্মিত আমি বুঝতে পারছিলাম না যে, এতগুলো ছেলেমেয়ের মাঝে আমি একাই কেন পিটুনি খাচ্ছি! আপার প্রতি প্রচন্ড ক্রোধ আর ঘৃণায় কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিলাম। যে কারণে সেই ঘটনা ঘরে এসে কাউকে বলিনি।

অনেক বছর পর নিজে নিজেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, সেদিন কেন পিটুনি খেয়েছিলাম। কিন্তু এও বুঝতে পারিনি যে, পিটুনি খাওয়ার পর কবে থেকে দৃতীয় কথাটি আমার মুখে দ্বিতীয় হয়ে উঠেছিলো।

তবে আজও মনে হয়, আমার শিক্ষকরা বেশির ভাগই নির্দয় ছিলেন। ক্লাস টু-এর একজন ছাত্রের যে বয়সে প্রতিটি শব্দ বানান করে সঠিক উচ্চারণ শিখতে হয়। শিখতে শিখতে ভুলে যাওয়া। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়া। মুখে মুখে বলে দিলেও তো কত ভুলে যায়। তেমন বয়সের একটি ছাত্রের কী করে বোধগম্য হবে যে কথাটা দ্বিতীয় না দৃতীয়? শিক্ষকেরও ব্যাপারটা ধরিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো। এমন হতো যে, তিনি বানান এবং উচ্চারণ দুটোই আমাকে মুখস্ত করিয়েছেন। তারপর ভুল করলে না হয় রেগেমেগে পিটুনি দেওয়া চলে। কিন্তু তারা শিখানোর চেয়ে বেত্রাঘাতেই পারদর্শী ছিলেন বেশি। যে কারণে আজও আমার কৈশোরের অনেক শিক্ষকের কথা মনে পড়লে তাদের প্রতি শ্রদ্ধার বদলে মনের ভেতরটা বিষাক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম- এ সময়টাতে কোনো শিক্ষকের সু-প্রভাব আমার জীবনে নেই।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, বছর দুয়েক আগে পত্রিকায় একটি সংবাদ পড়েছিলাম যে, আরমানীটোলার একটি স্কুলের শিক্ষিকা বাচ্চা একটি ছাত্রকে এমন পিটুনিই দিয়েছিলো যে, দরিদ্র ঘরের সন্তানটি মানসিক ও শারিরীক ভাবে অসুস্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত মারা যায়। মানুষের বাড়িতে ঠিকা ঝি-এর কাজ করা মায়ের সঙ্গতি ছিলো না সন্তানকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেওয়ার। অথচ আমরা শিক্ষা পেয়ে আসছি যে, শিক্ষক-শিক্ষিকা পিতা-মাতা তুল্য। কিন্তু আমার জিজ্ঞাস্য, যে শিক্ষকরা বিকারগ্রস্থ তাদের কিসের সঙ্গে তুলনা করবো?
-জুলিয়ান সিদ্দিকী


মন্তব্য

পুতুল এর ছবি

বর্ষয় বৈঠা টেনে নৌকা নিয়ে স্কুলে যেতাম। ব্রীজের থামে নৌকা তালা দিয়ে বৈঠা চোরের ভয়ে ক্লাসরুমে নিয়ে যেতাম। অনেক শিক্ষক বৈঠাকে বেত হিসেবে আমাদের পিঠে ভাঙ্গতেন! এখন মাঝে মাঝে মনে হয়: তার দরকার ছিল কিছু?
আপনার লেখা পড়ে সেই দুঃখের কথা মনে হল!
শিশু নির্যাতনের কত কৌশল!
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অতিথি লেখক এর ছবি

কী বলবো? খুঁচিয়ে কষ্টের কথা মনে করিয়ে দিলাম বলে দুঃখিত। এদের কথা বলে কী আর হবে? এখন তো সেই দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছে আমাদের সন্তানরা। তারাও ঠিক একই ভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। দেশে থাকতে দেখেছি- আমার ছেলেও পিঠের উপর বেত্রাঘাতের রক্তাভ ছাপ নিয়ে ঘরে ফিরে আসে। এ নিয়ে শিক্ষককে কিছু বললে ছেলে লাই পেয়ে যাবে ভেবে প্রতিবাদ করতেও সাহস করিনি। সমব্যথী হওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

খুব ভাল লিখেছেন। এই বিষময় স্মৃতি আমাদের প্রজন্মান্তরের। উন্নত দেশে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে স্কুলশিক্ষককে মনোবিদের কাছে পরীক্ষায় বসতে হয়। তাও তো মাঝেমধ্যে তাদেরও দু'একজনের বিকৃত আচরণের খবর পাওয়া যায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

তাহলে অনুপাতের হারটা আমাদের দেশে কত বেশি? একবার ভাবেন তো! আমাদের বাচ্চারা এর কারণেই কিছুটা ক্ষ্যাপাটে হয় হয়তো। ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভাইরে... বানরামির অপরাধে ইশ্কুলে তো খালি শাস্তিই পোহাইছি। হাই ইশ্কুলের শেষকালে অবশ্য টিচাররা সাহস পাইতো না... কারন এক স্যাররে নানান কায়দা কইরা ইশ্কুল ছাড়া করছিলাম আর তার পরের মাসে ভূত চালান দিয়া করছিলাম এলাকা ছাড়া। সেই থেকা শাস্তি নিস্তার ঘটছিলো...
কিন্তু কিন্ডারগার্টেন কাল আমার বড়ই শাস্তিময় কাটছে। দিলেন সেইসব মনে করায়ে।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনের দুঃখে দুঃখী! কী আর করি? আমাদের পাড়াগুলোর কিন্ডারগার্টেনের বেশিরভাগ টিচারের বেতন ৫০০ থেকে ১০০০। শিক্ষাও তেমন বেশি না। কাজেই তারা কী করে জানবে একজন শিক্ষকের দায়িত্ব কতটুকু? আমাদের কিন্ডারগার্টেন বলতে গেলে এক একটা দোকান। এই কারণেই আমরা দিন দিন পিছন হটছি! নজরুল, মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক পুরানো একটা বাজে কথা আছে । যার নাই কোন গতি সে করে ওকালতি । আর যে নাকি সেটাও পারেনা সে স্কুলের শিক্ষক হয় । এই কথা আমার নিজের এক শিক্ষক বলেছিলেন । তিনি বলতেন বেশিরভাগ স্কুল এবং কলেজের শিক্ষক নাকি মূলত গবেট । আর কোন কাজ না পেয়ে / কাজের যোগ্যতা না থাকায় 'মাস্টারি' করে । আর এই কারনেই নাকি অধিকাংশ শিক্ষক "ছোটলোক" । শিক্ষকতা করার মত যোগ্যতা যাদের আছে তারা নাকি খুব একটা এই পেশায় আসে না । উনি তবুও স্বপ্ন দেখতেন কোন এক সময় নাকি ভাল যোগ্য লোকেরা শিক্ষকতা করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে ।

- এনকিদু

অতিথি লেখক এর ছবি

কথাটা সত্যি হলেও বাস্তবে এর প্রতিফলণ খুবই কম। অনুপ্রাণিত হওয়ার মত শিক্ষক পেয়েছিলাম ক্লাস সিক্সে। সেগুনবাঁগিচা হাইস্কুল। ননি স্যার।
তারপর গুমতা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান।
জগন্নাথ কলেজে বলতে গেলে বাংলা বিভাগের সবাই।
আমিও স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সেই দিনটা কি ক্রমান্বয়ে পিছু হটছে? তবুও
স্বপ্ন দেখাবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ প্রাপ্য আমার ঐ শিক্ষকের, আমার না । ওনার কথায় অনুপ্রানিত হয়ে একসময় আমি নিজেও শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখতাম । এখনো দেখি । ভাবতাম আমি একজন ভাল শিক্ষক হব । ছাত্রদের কে যা শেখাব আসল জিনিসটাই শেখাব । ভুজুং ভাজুং দিব না । আমার নিজের দেখা ব্যতীক্রমী শিক্ষক কে আমি যেরকম শ্রদ্ধা করতাম, নিজের ছাত্রদের কাছ থেকে সেরকম শ্রদ্ধা আদায় করে নিব, এরকম অনেক কিছু ভাবতাম । ভাল শিক্ষক হওয়ার জন্য একটা জিনিস আগে নিজেই ভালভাবে শিখতে হয়, তাই খুব নিষ্ঠা নিয়ে শিখতাম । কিন্তু পরে বাস্তবতার ঠেলায় শিক্ষক হওয়া আর হল না । অবশ্য আমার শিক্ষক হবার স্বপ্ন এখনো মরে নি । টাকা পয়সা গাড়ি বাড়ি করে বুড়া বয়সে গ্রামের বাড়িতে চলে যাব । গ্রামে স্কুল দিব । বর্তমানে এটাই আমার শিক্ষকতা সঙ্ক্রান্ত স্বপ্ন ।

- এনকিদু

অতিথি লেখক এর ছবি

এনকিদু-
আপনার সৎ ভাবনা যেন সঠিক পথেই স্থির থাকে। আমাদের সৎ ভাবনাগুলো বেশির ভাগই দলছুট হয়ে পড়ে। পরে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

কোন ক্লাসে পড়ো'র জবাবে ২য় শ্রেণী বলেও মাইর খাওয়ার নজির আছে। কারণ, সঠিক উত্তর ক্লাস টু।
টু দ্য পয়েন্ট উত্তর দিতে হবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমরা কেবল মাইর খাওয়ার জন্যেই স্কুলে যেতাম মনে হয়। যে কারণে যেন তেন প্রকারের বাহানা বানিয়ে নিতেন আমাদের তথাকথিত শিক্ষকেরা। ধন্যবাদ আপনাকে।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍অধিকাংশ মারকুটে শিক্ষকই তাঁদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আর শিক্ষাপ্রদানে অপারদর্শিতা আড়াল করে থাকেন বেত্রাঘাতের মাধ্যমে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

অতিথি লেখক এর ছবি

১০০ তে ১০০
ধন্যবাদ।
জুলিয়ান সিদ্দিকী

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ক্লাশ এইটে থাকতে একবার চারজন তাগড়া টিচার চারপাশ থেকে আমাকে পিটিয়েছিল
বেতের সাথে কিল লাথিও বাদ যায়নি

এনকিদু এর ছবি

কারনটা কি শুধুই academic ছিল ? চিন্তিত


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

মাহবুব লীলেন এর ছবি

টিচার্স কমনরুমে সাপ ছেড়ে দিয়েছিলাম

অতিথি লেখক এর ছবি

ওরা টিচার ছিলো কি?
আমার তো মনে হয় কারো ভাড়া করা লাঠিয়াল। জেনে মর্মাহত না হয়ে পারছি না।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমাদের সময় বগুড়া জেলা স্কুলে ছিলেন রকিম স্যার। শিক্ষক হিসেবে চমৎকার, এমনিতেও নরম স্বভাবের। কিন্তু কোনো কোনোদিন (বছরে এক বা দুইবার) কীভাবে কে জানে, তিনি হঠাৎ কোনো ছাত্রের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন এবং ছাত্রের পিঠে একাধিক বেত ভেঙে ফেলতেন। গোটা ক্লাস স্তব্ধ হয়ে দেখতো এই প্রহার। সবশেষে রকিম স্যার নিজের চেয়ারে ফিরে যেতেন, দুই কনুই টেবিলে রেখে দুই হাতে মুখ ঢাকতেন। তারপর হু হু করে কেঁদে ফেলতেন।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অতিথি লেখক এর ছবি

এমন হলে তো কথাই ছিলো না। কত হাজারে এমন একজন থাকে ভাবতে পারেন?
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।