চুনার - এক নিম্নমধ্যবিত্ত দূর্গশহর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/০৪/২০০৯ - ১১:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চুনার সম্বন্ধে যা লিখেছি শিরোনামে অনেক ভেবেও তার থেকে উপযুক্ত আর কিছু পাওয়া গেলো না । নেহাতই সাদামাটা জায়গা । তবু আমি তো ওখানে থাকি না তাই ওটাকে বেড়াতে যাওয়ার জায়গা তো বলতেই হবে । তা গিয়েছিলাম ওখানে বছরখানেক আগে । বেনারস থেকে গাড়িতে দেড়-দুই ঘন্টা লাগে । দিব্যি রাস্তা । আমরা যেমন কলকাতা থেকে ডায়মন্ডহারবার বা সোনারপুর যাই পিকনিক করতে বেনারস থেকেও তেমনি লোক আসে ওখানে । সে যাই হোক , কথাটা হচ্ছে আপনি কখন যাবেন ? কবিতা লেখেন ? একখানা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন বর্ষাকালের দুপুরে ! গদ্যে ঝোঁক বেশী ? বেশ । বেছে নিন শীতের সকাল বা গরমের বিকেল । নেহাত সাধারণ লোক ? এই তো চাই । আপনার জন্য চুনার ৩৬৫ দিন খোলা । গেলেই হল ।
আমি গেছিলাম ডিসেম্বর মাসে ( খেয়াল করে দেখুন, গদ্যয় লিখছি ) । উত্তরপ্রদেশে তখন বেশ শীত । সকাল ৯ টার আগে বেরোন খুব অসুবিধে । যাই হোক “উঠোন পেরোলেই অর্ধেক মুশকিল আসান” । হইচই করে তো বেরোলাম সবাই মিলে । ফাঁকা রাস্তা । গাড়ি তো ছুট লাগিয়েছে পাঁইপাঁই করে । জানলার ধারে বসে আছি । মনে ফুর্তি খুব ! চুনারে যাওয়ার এটা একটা উপরি পাওনা । চওড়া রাস্তা । দুধারে লম্বা লম্বা গাছ । একটু দূরে রেললাইন । প্রথমে মা গঙ্গাও দেখা দেবেন কিছুক্ষণের জন্য । তারপর আবার চুনারেই দেখা হবে । কাব্যরসিকেরা ভেবে দেখুন ঝিরঝির বর্ষায় কেমন লাগবে ! আহা ! এসব শোভা দেখতে দেখতে আর ভাবতে ভাবতে তো পৌঁছোন গেল চুনার । হাইওয়ে ছেড়ে একটা মোটামুটি গ্রাম্য অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে মিনিট দশেক যেতে হয় । এখানে আপনাকে মসৃণ রাস্তার কবিতা ছাড়তে হবে । তারপর গাড়ি উঠবে পাক দেওয়া রাস্তা দিয়ে । ব্যাস ! আর কি ? চুনার দুর্গ ।
হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে । দুর্গে ঢোকার আগে যে রাস্তায় গাড়ি পার্ক করা হয় তার বাঁদিকে অনেক নীচে চওড়া ন্দী । গঙ্গা । শীতে মাঝখানে চড়া পড়েছে । মোচার খোলার মত একটা নৌকা পেরোচ্ছে ন্দী । জলে চকচক করে উঠছে সকালের সূর্য । পেছনে উঁচু পাথরের দেওয়াল । সামনে ন্দী । দূর্গ এরে কয় । এখন এখানে মিলিটারীদের আস্তানা । ব্রিটিশ আমলে এখানে ছিল জুভেনাইল কয়েদখানা । পুরো জায়গাটা চৌকো । মাঝখানে একটা মন্দিরের মত জায়গা । প্রথম যেটা হবে সেটা হল, একটা অলস বিষণ্ণতা আস্তে আস্তে গ্রাস করবে আপনাকে । দেখবেন গভীর একটা পাথরের কুয়ো । তার একদম নীচে অসংখ্য বাদুড় বাসা করে আছে । তাদের আওয়াজ একটা যন্ত্রের মতো আওয়াজ করছে । পাশের একটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে পারেন নীচে । কুয়োর একতলায় । দারুণ ব্যাপার । এখানে বাদশার আমলে সৈন্যরা জল খেতে আসত । জল খাওয়াও কত রোমাঞ্চকর ! সেখান থেকে কয়েক পা হাঁটলেই জেলখানা । এখানে অল্পবয়স্ক অপরাধীদের রাখা হত কয়েদ করে । দেওয়ালের গায়ে কত লেখা । জায়গাটা লম্বা ধরণের । মাঝখানে ছাতে একটা অংশ ফেটে গিয়ে সার্চলাইটের মত একটা রশ্মি এসে পড়েছে মেঝেতে । পাশের সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে যান । দেখবেন এক আশ্চর্য দৃশ্য । পুরো চুনার কে বেড় দিয়ে গেছে ন্দী । প্রায় দিগন্ত অবধি ছড়ানো । দূরে একটা সেতু । কুয়াশায় ঝাপসা । এখান থেকে পালানো কঠিন । তাহলে প্রায় ১৫০ ফুট নীচে ন্দীতে লাফ দিয়ে পড়তে হয় । ভারী সুন্দর ছবি । এখন তো জায়গাটা পরিত্যক্ত, জেলের গরাদ ভেঙে পড়েছে , তার মাঝে বটের চারা । মন খারাপ হবেই । কোন কারণ ছাড়াই । সবথেকে ভালো হয় যদি একা থাকেন এখানে । এখানে এমন এক নির্জনতা আছে যা অনুভব করার জিনিস । তাকে ভাঙা কঠিন । ফাটা দেওয়াল , খসা পলেস্তারা , জং ধরা লোহার গরাদ এসবের মধ্যে বিচিত্র ইতিহাসের গন্ধ । কিছুক্ষণ বসুন না এখানে । কিসের এত তাড়া ? কত পুরোনো কথা ভিড় করে আসবে মনের মধ্যে । কত স্মৃতি , কত ছবি । চুনার গরীব দূর্গ , বলছিলাম না ? আপনাকে স্থাপত্য দেখিয়ে চমকে দিতে পারবে না । ইতিহাসের বিখ্যাতদের পদচিহ্ন দেখাতে পারবে না । সাজান বাগান দেখিয়ে কয়েকটা ছবিও তোলাতে পারবে না। কিন্তু খেয়াল করবেন কোন কারণ ছাড়াই আপনি চুনারকে মনে রাখবেন । বিষাদমাখা শূন্যাতা দিয়ে এক ভালোলাগা বিষণ্ণ স্মৃতি হয়ে থাকবে চুনার । আমি আবার সেখানে যাব , কোন কারণ ছাড়াই । সেদিন সেই বিষাদ মেখে চলে গেছিলাম বিন্ধ্যাচলের দিকে । সে কথা সুযোগ হলে আরেকদিন হবে ।

পার্থসারথি মুখার্জী


মন্তব্য

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি

আহ্ চুনারের স্মৃতি আমার চুনরীতে বাঁধা ছিল দীর্ঘদিন; সেই পেঁয়াজখসি চুনরী আমার পুরোনো হয়েছে, মনে হয় এখন আমি বন্দী নিজের গড়া চুনারে, যখন জীবন্ত ছিল চুনার ঠিক তখনকারই মতো।

পলাশ দত্ত [অতিথি] এর ছবি

কয়টা ছবি যদি দিতেন। ইমেইলে দিলেও চ'লে যায়।

নিবিড় এর ছবি

ভাল লাগল চলুক


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

জিজ্ঞাসু এর ছবি

লেখাটা খুব ভাল লাগল।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হয়তো একদিন গিয়ে আমিও ছুঁয়ে আসবো সেই বিষণ্নতা...

০২

দুর্দান্ত বর্ণনা

অতিথি লেখক এর ছবি

অবশ্যই যাবেন । আপনার লেখার অপেক্ষা করব । অনেক ধন্যবাদ ।
পার্থসারথি মুখার্জী

অমিত এর ছবি

ছবি চাই আরও

তারেক এর ছবি

যেতে লোভ হচ্ছে খুব...
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ সবাইকে । আরো ছবি দেওয়ার ইচ্ছে রইল । দেখা যাক ।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

চলুক

সুপর্ণা  এর ছবি

এই লেখা টা আমার বেশী ভাল লেগেছে।বা যায়গা টাই বেশী ভাল।জেটাই হোক খুব ভাল লেখা হয়েছে।যায়গাটাকে কত ভাল ভাবে লক্ষ্য এবং অনুভব করেছেন লেখা পড়েই বোঝা জাচ্ছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।