কোমলমতি!!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৯/০৭/২০০৯ - ৩:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শিশুদের কথা যেখানেই পড়ি বা দেখি- তাদের সম্বোধন করা হয় কোমলমতি, নিষ্পাপ ইত্যাদি নানা বিশেষণ সহযোগে! ব্যাপারটা আমার কাছে বড়ই অবাক লাগে। শিশুদের ত্বক-কেশ ইত্যাদি বড়ই কোমল তা মানি; দেখতে হয়ত নিষ্পাপ মনে হয়- তাও মানি, কিন্তু তাদের মন/মতি আদৌ কোমল কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ সামান্য জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই! আর তাদের মন/মতি যে মোটেও কোমল নয় বরং ভীষণ কঠিন (হীরক-কঠিন না হলেও টাইটেনিয়াম-কঠিন তো বটেই!) সেটা বুঝতে পেরেছি আমার ছোট ভাইটি জন্মানোর দুই বছরের মধ্যেই! আর জীবনের নানা বাঁকে নাদান সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা আমার সেই বুঝতে পারাকে অন্ধবিশ্বাসে পরিণত করেছে (যেকোন ধার্মিকের ধর্মবিশ্বাসের চেয়ে কম নয় বলেই ধারণা!)। তেমনি কিছু অভিজ্ঞতা-আত্মোপলব্ধি আজ আপনাদের বলতে চাই।

।।এক

নিজে শিশুকালে কেমন ছিলাম তা এতদিন পরে মনে থাকার কথা না-কারণও নেই। মায়ের স্নেহমিশ্রিত স্মৃতিচারণ থেকে যতদূর বুঝি- খুব ভাল কিছু ছিলাম, এমনটা আমার পরম বন্ধুও সাক্ষী দিতে তিনবার চিন্তা করবে (ফৌজদারি মামলায় পড়ার সম্ভাবিলিটি উড়িয়ে দেয়া যায়না!)। একটা ঘটনা প্রায়ই আমার গুরুজনেরা আমার ছোটবেলার উচ্চস্তরের বুদ্ধিবৃত্তির প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপন করেনঃ
আমাদের গ্রামের বাড়িতে আমার পিসিরা(ফুপু) তাদের স্বামী-পুত্রকন্যা সহ প্রায়ই আসতেন..আর বাড়িতে কাজের লোকও ছিল জনাতিনেক। একদিন অতিথিরা সবাই চলে গেলে আমার ক্লান্ত মা আর তার তিন সহযোগী দিবানিদ্রার প্রয়োজন বোধ করেন। আমি তখন সবে ট্রাইসাইকেল চালানো শিখেছি-দুপুরে ঘুমানো আমার কাছে অবাস্তব-অসম্ভব প্রস্তাব বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক, বিশেষত যখন বাবা বাড়িতে নেই! আমাকে দেখে রাখাটাও আবার জরুরি। যেহেতু আমি কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকলে বাড়ির সীমানার বাইরে যাওয়ার কথা মনে পড়বেনা, তাই আমার মা বুদ্ধি করলেন আমাকে বাড়ি পাহারা দিতে বলবেন আর নতুন অনেকগুলো হাঁস-মুরগির বাচ্চা দেখে রাখতে বলবেন। গ্রামে কিছুদিন থাকার কারনে "চোর" নামটা পরিচিত ছিল, আর হাঁস-মুরগির বাচ্চাতো যেকোন শিশুর প্রিয় জীবন্ত খেলনা। আমি সানন্দে তাই রাজি হয়ে গেলাম যে বাড়ির বাইরে যাব না।

মাঝে কি হয়েছিল জানিনা...কেউ যেহেতু চাক্ষুস করেনি; আমি নাকি ঘন্টাখানেক পর মা-কে চিৎকার সহ জাগিয়ে তুলি এবং অতি দুঃখিত ভঙ্গিতে কিন্তু প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলি "সর্বনাশ হইছে, সবগুলা হাঁস-মুরগির বাচ্চা এক্সিডেন করছে আমার গাড়ির তলে"!

।।দুই

আমার জীবনের প্রথম ছয় বছর গ্রামে কেটেছে...দাদু-ঠাকুমার সান্নিধ্যে। তাই "বংশের প্রদীপ" হিসেবে কিঞ্চিত বখে যাওয়া আমার জন্য হয়ত জায়েজ ছিল। আমার শাসনকারী একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন আমার মা (বাবা সপ্তাহে বৃহস্পতিবারে ঢাকা থেকে বাড়ি যেতেন, শনিবার ভোরে চলে আসতেন); আর আমার যেকোন অপরাধের পর আমার আশ্রয় ছিল দাদু-ঠাকুমা। মা তাই খুব একটা শাসন করার সুযোগ পেতেন না, তার উপর আমার নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল আমার বাবা কোথাও থেকে এই মহিলাকে আমার সৎমা হিসেবে নিয়ে এসেছেন! রাত দুটার সময় উঠে ডিম-টোস্ট খেতে চাওয়া, দুধ-ভাত ছাড়া আর কিছু খেতে না চাওয়া, রাত দশটার পর টিভি দেখে বাড়ি ফেরা (আমাদের গ্রামে তখন দুইটা টিভি ছিল), আখক্ষেত থেকে আখ চুরি করা এগুলো ৫/৬ বছরের ছেলের জন্য একটু বেশিই মনে হতে পারে (ছেলেটি আবার সাড়ে তিন বছর বয়স পর্যন্ত ফিডারে দুধ খেত!)। সেই ছেলেটিই শুক্রবারে খুব ভদ্র-শান্ত!

শুকনো পাটকাঠির বান্ডেল থেকে পাটের আঁশ আলাদা করতে ভাল লাগত খুব (মনে নাই কেন করতাম!)। হঠাৎ একদিন বুদ্ধি এলো মাথায়, এত কষ্ট করে ছাড়ানোর কি দরকার...আগুন ধরিয়ে দিলে আঁশগুলো পুড়ে যাবে, সহজেই আলাদা হয়ে যাবে। থিওরি ইমপ্লিমেন্ট করলাম...পাটকাঠির খানবিশেক বান্ডিলে...যেগুলো রাখা ছিল ঘরের পিছনে আরেক ঘরে ("কোঠাঘর")। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বাড়ির এক কাজের লোক দেখে ফেলে...আগুন ধরানোর সাথে সাথে...।

আমি বড় হয়ে কি হব তা সবাই তখনই বুঝতে পেরেছিলেন! প্রচুর খেলনা পেতাম সবার কাছ থেকে...মুশকিল ছিল একটাই, কোন খেলনাতে স্ক্রু-টাইপ কিছু থাকলে সেটা ১/২ ঘন্টার মধ্যে পরলোকে যাত্রা করত। "যেকোন জিনিস খোলার পর লাগাতে গেলে সবসময় কিছু স্ক্রু বেশি থাকে যা কোন কাজে আসে না" -এই থিওরি অত অল্পবয়সেই আবিষ্কার করেছিলাম!

।। তিন

ঢাকায় আসতাম প্রায়ই মাসির (খালা) বাসায়। আমার চেয়ে দিন পনের বড় ছিল আমার মাসতুতো (খালাত) বোন। তার বড় ভাই ছিল আমাদের দুই বছরের বড়। মেয়ে ছেলের পার্থক্য বুঝতে পারি আমার সেই বোনের সাথে নিজেকে তুলনা করতে গিয়ে। বড়দের প্রশ্ন করে জানতে পেরেছিলাম...আমার বোনটি একদিন রাতে বিছানায় 'সু সু' করে দিয়েছিল, তখন ইঁদুর এসে তারটা নিয়ে গেছে! জীবনে আর কোনদিন বিছানায় _করার আনন্দ অনুভব করার সাহস হয়নি...

মেসো (খালু) ছিলেন খুব কড়া! তার নিয়মে শিশুদের প্রতিদিন দুপু্রে ঘুমানো বাধ্যতামূলক ছিল...প্রতিদিন ৩ ঘন্টা করে যে অভিনয়টা করতে হয়েছিল অনেকদিন ধরে, তা আজ করলে মরা মানুষের দৃশ্যে অভিনয় করেই অস্কার নিশ্চিত!

নিজের শিশুকালের কোমলমতিত্বের (!) আরেকটা গল্প বলে শেষ করব আজ। আমার খালার বাসায় তিনজন ভাই-বোন (কাজিন) মিলে একটা খেলা আবিষ্কার করি...ডাক্তার-রোগী খেলা। রীতিমত প্রফেশনাল ভঙ্গিতে...আমরা দুই ভাই সার্জন, রোগী সেই বেচারি বোন...এবং তার পেটে একটা বাচ্চা (তার কয়দিন আগে আমার খালার সবচেয়ে ছোট ছেলে জন্ম নিয়েছিল)। একদিন বাসায় কাজের লোক ছাড়া কেউ ছিলনা; খেলায় আমরা কাঁটাচামচ-চামচ -এর বদলে আসল ছুরি-কাঁচি ব্যবহার করে বাচ্চা অপারেশন করার চিন্তা করলাম! সাথে আরো ছিল একটা প্লাগপয়েন্টে লাগানো বাল্ব জ্বালানোর ব্যবস্থা!...যেটাকে খেলার এক পর্যায়ে আমি বাতি দিয়ে ছেঁকা দেয়া, ইলেকট্রিক শক দেয়া এবং অটোমেটিক ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব দেই। যে মুহূর্তে আমি কানেকশন দিয়ে আমাদের রোগীর গায়ে লাগিয়ে অপারেশন শুরু করতে যাব সেই মুহূর্তে আমার মামার আগমন-চিৎকার...এবং বুঝতেই পারছেন এরপর আজ কেন আমি ডাক্তার নই!


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ভালোই তো আপনার অভিজ্ঞতাগুলো হাসি

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

হাসতে হাসতে পড়ে গেলাম! মারাত্মক দুর্দান্ত ছিলেন তো আপনি! এখন বড় হয়ে কী হলেন, ডাক্তার হলে ভালো করতেন। যে যত রোগী মারে, তার সুনাম তত বেশি!
লেখা চলুক... আর আপনার নামটা একটা কমেন্টে দিয়ে দিন। লেখায় তো পেলাম না!
--------------------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়...

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

স্বপ্নহারা [অতিথি] এর ছবি

দুঃখিত...সচলায়তনে এটাই আমার প্রথম লেখা! ভেবেছিলাম নামটা হয়ত কোন বিশেষ জায়গায় দিতে হবে। পরে দেখলাম লেখার শেষে দেয়ার নিয়ম!

স্বপ্নহারা,

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

সাংঘাতিক !
আপনি তো আসলেই খুব কোমলমতি ছিলেন দেখি। চোখ টিপি

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

তানভীর এর ছবি

মজারু

ফারুক হাসান এর ছবি

একেবারে ফাটায়ে ফেলছো দোস্ত! হাহাপগে চলুক

ওহে স্বপ্নহারা স্বাপ্নিক, লেখক হিসেবে সচলে স্বাগতম!!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনে তো দেখি ছোটবেলা থেকাই পুরা ফাউল... কোমলমতি পোলাপান আমি দুই চোক্ষে দেখতে পারি না...

পছন্দ হইলো আপনের লেখা... নিয়মিত লেখেন...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নিবিড় এর ছবি

আপনে দেখি পুরাই সিরাম ছিলেন দেঁতো হাসি


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

হাহাহা, আপনে তো পুরা সিরাম ছিলেন। এখনো কী 'কোমলমতিত্বের' কিছু অবশিষ্ট আছে নাকী?

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

মূলত পাঠক এর ছবি

মজার!

স্বপ্নহারা [অতিথি] এর ছবি

মৃদুল ভাই, না ডাক্তার হই নাই...ইন্টার পর্যন্ত ইচ্ছা ছিল; কিন্তু ডিএমসির ক্যাম্পাস পছন্দ হয় নাই! তবে তড়িৎ প্রকৌশলী হওয়ার পর এখন হাফ ডাক্তার...কমপিউটার এইডেড ডায়াগনোসিস (ব্রেস্ট আর এবডোমিনাল ক্যান্সার) নিয়ে কাজ করছি! বুঝতেই পারছেন কি ডায়াগনোসিস হবে...ঃ)

সবাইকে উৎসাহের জন্য অনেক ধন্যবাদ। না এখন আর কোমল নাই...ছোট ভাই জন্ম নেয়ার পরপরই আমি কঠিন হয়ে গেছি
..আমার ভাইয়ের উপর লেখাটা আসতে দেন...আমারে সে পুরাই অফ করে দিছিল্‌,...হেহে

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

ভাই, আপনি তো ভীষণ রকম বস পাব্লিক...!!!
আপনার লেখাও তো খুবই কোমল...
আরো ছাড়েন জলদি, নাইলে কলাম এক্সিডেন হইবো...
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

মাহবুবুল হক এর ছবি

হুমম্ । ওই দুই এরিয়াতে ( ব্রেস্ট এবং এ্যাবডোমিন) আপনার আগ্রহ ও প্রতিভা ছোটবেলাতেই দেখা গিয়েছিলো। আপনার অকপট প্রকাশভঙ্গী খুব ভালো লেগেছে।
.................................................................................................................

--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।

তানবীরা এর ছবি

মারাত্বক ভাই আপ্নে
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।