টুকরো স্মৃতি-আলেখ্য : নির্ভানা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৩/১০/২০০৯ - ৯:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শেষমেষ যেতেই হলো দেশে । আজ যাব কাল যাব করে কখনযে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে টের পাইনি । কারন যে কিছু নেই তা নয় : মনেহয় প্রতিষ্ঠা, পেশা মাথার ভেতরে খুব ভাল করে জেকে বসেছিল, তাই সময়ের চলে যাওটা ঠাহর করতে পারিনি । যাইহোক অনেক সময়, অর্থ ব্যায় করে অবশেষে দেশে যাওয়া হলো, কমকরে একটা মাস সেখানে কাটানো গেল, এটা অনেক পাওয়া- কোনকিছু দিয়ে তাকে পরিমাপ করা যবেনা । যথাসময়ে কানডায় ও ফিরে আসলাম সপরিবারে । স্বদেশি বন্ধু পরিজন আগ্রহভরে জিঞ্গাসা করলেন, দেশেতো ঘুরে আসলেন, অবস্তা কেমন দেখলেন, কি কি জিনিস খুব ভাল লাগলো, ইত্যাদি, ইত্যাদি । প্রশ্ন শুনে মুল্যায়ন করতে বসলাম, তাইতো এভাবেতো ভেবে দেখা হয়নি, কি কি বিষয় ভাল লেগেছে । ভেবে ভেবে অবিস্মৃত স্মৃতিগুলো থেকে দুই দুটো জ্বলজলে জিনিস তুলে আনলাম, যেগুলোর কথা না বললে আমার ভ্রমন বৃত্তান্ত অসম্পূর্ন তেকে যাবে ।
ফিরে আসতে তখনও সপ্তাহ দুই বাকী, কোন এক স্বজাতি ভাইকে বিদায় জানাবার জন্য মালিবাগ আন্তনগর বাস টর্মিনালে যেতে হলো । ভাই বিদায় হয়েছেন, উদ্দেশ্যহীন পায়চারি করছি ফুটপাতে । মনে হলো সময়টা কাটানোর জন্য কিছু একটা করার দরকার । জুতাটাকে একটু চকচকে করে নেবার জন্য ফুটপাথের পাশে বসে কর্মরত চর্মকারের পাশে এসে দাড়ালাম ।
- এই জুতো জোড়া ভাল করে পালিশ করতে কত নিবেন ?
- দশ ট্যাহা লাগবো
চর্মকারের ঝটপট উত্তর । গাড়ির টায়ারের সোলঅলা ভারি শতছিন্ন একজোড়া স্যান্ডেল এগিয়ে দিল সে,বললো,
-লন, এইডা পইরা জুতাডারে দ্যান ।
অনেক সময় দাড়িয়ে থাকতে হবে ভেবে, লোকটাকে বললাম,
- তোমার পাশর এই কাঠের বাক্সটার উপর একটু বসবো ?
- বহেন ।
বেশী সময় চুপচাপ ঠায় বসে থাকতে ভালো লাগে না । ভাবলাম, রোদে পুড়ে কাল হয়ে যাওয়া, পুষ্টিহীনতায় রুগ্ন, ভাবলেশহীন খেটে খাওয়া এই লোকটার সাতে একটু আলাপ করলে কেমন হয় ।
- কয় ছেলেমেয়ে আপনার ?
-দুই মাইয়া, বরোডা কেলাস ফাইবে, ছোডডায় থিরি । খাই না খাই পোলাপাইনেরে তো লেহাপরা করাইতে অইবো, কি কন ?
-ত ঠিক । মা বাবা নেই ?
- বাবা মারা গ্যাছে চার বছর, মা আছে , বাই, বইন সবই আছে। তয়, অবাবের সংসার, মায়রে একা পালবার পারিনা, আমরা তিন ভাই, সবাই মিল্ল্যা মায়রে দেহি ।
বেশ কিছু সময় উদ্দেশ্যহীন তাকিয়ে থাকি মানুষটার চক্ষু কোটরাগত পুষ্টিহীন মুখটার দিকে । যেন কত কত দিনের পরিচিত আমি তার, কত না স্বজন, সুখ দুঃক্ষের সব কথা বলতে থাকে বিরামহীন । বড় বেশী কাংখীত এই সরলতার স্পর্শে মন পবিত্র হয় ।
একসময় প্রশ্ন করে সে,
- আমনে কই থায়েন, কি করেন ?
অনেকটা সহজাত প্রবৃত্তির বশে, আগু পিছু না ভেবে বলে ফেলি,
- কানাডায় থাকি ।
কিছু সময়ের জন্য নীরব হয়ে যায় লোকটা । আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থকে অপ্রয়জনে । যে মুখে এতসময় ছিল স্বজন বাত্সল্যের ছাপ, এখন সেই মুখ মূহুর্তে ছেয়ে গেল অপরিচয়ের চাদরে । নিজেকে বড় অপরাধি মনে হতে লাগলো । কেন যে বলতে গেলাম অমন অসুন্দর কথাটা । বুঝলাম একই কথার প্রতিকৃয়া সবসময় একইরকম হয়না ।
অনেকটা কোন কারন ছাড়া, উদাস ভাবে লোকটা প্রশ্ন করলো,
-ঐহানে আয় রোজগার কেমন অয় ?
- চলে কোন রকম ।
খেটে খাওয়া মানুষটার মুখের অদ্ভুত অভিব্যক্তি বৈচি গাছের কাটার মত অন্তরে বিধতে লাগলো । কাজ শেষ হয়ে গেছে ততক্ষনে । মজুরি মিটিয়ে দ্রত প্রস্থান করলাম নিজের প্রতি মৃদু একটা অভিমান নিয়ে ।

পরেরদিন পিতৃভূমি খুলনা যাবার জন্য দলবল নিয়ে সপরিবারে রওনা হলাম । এবার বাসযাত্রা, আরামদায়ক বলা যায় তবে দীর্ঘ বারো ঘন্টায় সেই কষ্টার্জিত আরাম যে ব্যারামে পরিনত হয়েছিল সে কথা উল্লেখ না করাই আপাততঃ আরাম দায়ক বলে মনে হচ্ছে । কেন এমন মনে হচ্ছে, সেটা একটা উদাহরন দিলে পরিষ্কার হয়ে যাবে : দীর্ঘ পথের বদৌলতে তাপানুকুল যন্ত্রযানের মুহুর্মূহু নাচন কোদনের শেষে যখন গন্তব্যে পৌছলাম তখন শরীরের বাকী শক্তিটুকু প্রানপনে সঞ্চয় করে যেটুকু কাজ করতে পারলাম তা শুধু শয়ন এবং শ্রমনিদ্রায় আত্তসমর্পন । সেদিন কিছু না পারলেও, পরের দিন সকালে কিছুটা সামর্থ দেহে ফিরে পাবার পর, যারপর নাই উত্সাহে আপন, দূর সকল সম্পর্কীয় ভ্রাতা, ভগিনীদের সংগে দেখা সাক্ষাতে কাল অতিবাহিত করতে থাকলাম । অনেক বছর পর বাপের ভিটায় গিয়া যতটা আশা করেছিলাম ততটা দেখলাম না । আশা করেছিলাম এত দিনের ব্যবধানে পরিচিত জনেরা উত্সাহে কৌতুহলে চারদিক থেকে ছুটে আসবে । কিন্তু আমার সব আশার গুড়ে বালি না পড়লেও কিছুটাত পড়েছিল নিশ্চয় । আমার আশার তরীতে বাতাস দিয়েছিলেন একজন, তিনি আমার বাশার কাকা । দূর সম্পর্কের কাকা এবং নিকট প্রতিবেশি, বয়সে কমকরে হলেও ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ বছরের বড় হবে আমার থেকে । সেই কাকা এসেছেন দেখা করতে, জীর্ন শরীর নিয়ে, লাঠিতে ভর করে, খুড়িয়া খড়িয়ে । দেখে কষ্ট লাগলো মনে, লজ্জিত হয়ে প্রশ্ন করলাম,
- কাকা এই শরীর নিয়ে কি দরকার ছিল আসার, আমি না হয় যেতাম ।
- দরকার আছে, ও তুই বুঝবিনা । আজকালকের ছেলেমেয়েরা বুড়ো মানুষদের পুছতে চায় না, বুজলি ।
দেখলাম কাকার অভিযোগ একেবারে মিথ্যে নয় । মানুষের এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে । মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা বোধ বেড়েছে অনেক, একে অন্যের প্রতি আগ্রহ বেশ কমেছে । ধনতান্ত্রিক দেশের সুবিধাভোগী না হয়ে ও ধনবাদী সমাজের রোগলক্ষন গুলো স্পষ্ট ফুটে উঠছে প্রায় সবার মধ্যে । নিরাশাবাদী কথা বাদ দিয়ে কাকার কথায় আসি ।
সেই ছোট বেলা থেকে দেখেছি বাশার কাকা হার্বাল মেডিসিন বা ঔষধি গাছ গাছড়া নিয়ে একেবারে পাগল ছিলেন, এগুলোর উপরে বই পত্র যা পেতেন বিপুল উত্সাহে সংগ্রহ করতেন । এগুলো নিয়ে অনেক সময় কথা বললেন । এদিকে অনেকে আমার সংগে দেখা করার জন্য বসার ঘরে আপেক্ষা করছে, কাকাকে আর বেশী সময় দেয়া যায় না । কথা প্রসংগে জানা গেল উনি আমার সংগে দেখা করতে এসেছেন শুধু কানাডা সম্পর্কে জানতে । বাশার কাকার মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক কৌতুহল, এত অল্প সময়ে কিভাবে তা আমি মেটাবো ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না । কানাডার পোলার বেয়ার কিভাবে ঠান্ডায় বেচে থাকে, ম্যাপেল গাছের গুনাগুন কি, কারিব্যু কি ধরনের প্রানী, কালমেঘী গাছ কানডায় আছে কিনা ইত্যাদি আরও কত কি । একটা অর্ধ শিক্ষিত মানুষের মনে জানার জন্য এমন আগ্রহ, ব্যাকুলতা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না । জানার জন্য জানা, এমন নিঃশর্ত অনুসন্ধিত্সু মানুষ সংসারে গোটা কয়েক থকলে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য । এসব নিরস কথাবার্তা বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি ।
যতটুকু তথ্য ঘটে আছে সব টুকু ঢেলে দিলাম বাশার কাকার ঝুলিতে। তারপরেও উনার জানার পিপাসা যেন মেটে না। প্রায় একমাস পার হতে চললো এমন একটা অদ্ভুত অধ্যাবসায়ী মানুষের সাক্ষাত আমার মেলেনি । পুরা মাসটাই গেল ডলার-পাউন্ড, আয়-রোজগার, গাড়ী-বাড়ী, ক্রেডিট কার্ড আর ফ্যাশন ভুষনের গল্প করে করে ও শুনে। হঠাত্ করে বাশার কাকার মুখে জানা অজানা জ্ঞানের অনেক বিষয় আলাপ করে মনে হলো আমার বাংলাদেশ আসাটা যেন সার্থক হলো ।এতদিনে এমন একটা মানুষ পাইনি সামনে যে নিঃস্বার্থ জ্ঞানের জন্য এতটা ব্যাকুল এবং উত্সাহি হয়েছে । মন প্রান ভরে গেল কাকার সংগে কথা বলে, তার জন্যই এবার দেশে আসা সার্থক হলো ।

এস, কে, নির্ভানা


মন্তব্য

নিবিড় এর ছবি

বাশার কাকার গল্প শুনে ভাল লাগল চলুক


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

অতিথি লেখক এর ছবি

কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ভাইগো, এত বানান ভুল আমি কোন পোস্টে দেখিনি! বুঝতে পারলাম লেখার পরে একবারও পড়েননি মন খারাপ

একটু কষ্ট করে সময় নিয়ে লিখে প্রকাশ করলে ভালো লাগে। হাসি

নীচে কয়েকটা ভুল ধরে দিলাম। আরো আছে। দাঁড়ির আগে কোন স্পেস হয়না। ভুল গুলো বোল্ড করে দিলাম। সবগুলো বোল্ড করলে দেখতে খারাপ লাগবে তাই কতগুলো ইটালিক করে দিলাম। আমার কোন ভুল থাকলে সেটাও জানান। ধন্যবাদ।

শেষমেষ যেতেই হলো দেশে । আজ যাব কাল যাব করে কখনযে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে টের পাইনি । কারন যে কিছু নেই তা নয় : মনেহয় প্রতিষ্ঠা, পেশা মাথার ভেতরে খুব ভাল করে জেকে বসেছিল, তাই সময়ের চলে যাওটা ঠাহর করতে পারিনি । যাইহোক অনেক সময়, অর্থ ব্যায় করে অবশেষে দেশে যাওয়া হলো, কমকরে একটা মাস সেখানে কাটানো গেল, এটা অনেক পাওয়া- কোনকিছু দিয়ে তাকে পরিমাপ করা যবেনা । যথাসময়ে কানডায় ও ফিরে আসলাম সপরিবারে । স্বদেশি বন্ধু পরিজন আগ্রহভরে জিঞ্গাসা করলেন, দেশেতো ঘুরে আসলেন, অবস্তা কেমন দেখলেন, কি কি জিনিস খুব ভাল লাগলো, ইত্যাদি, ইত্যাদি । প্রশ্ন শুনে মুল্যায়ন করতে বসলাম, তাইতো এভাবেতো ভেবে দেখা হয়নি, কি কি বিষয় ভাল লেগেছে । ভেবে ভেবে অবিস্মৃত স্মৃতিগুলো থেকে দুই দুটো জ্বলজলে জিনিস তুলে আনলাম, যেগুলোর কথা না বললে আমার ভ্রমন বৃত্তান্ত অসম্পূর্ন তেকে যাবে ।
ফিরে আসতে তখনও সপ্তাহ দুই বাকী, কোন এক স্বজাতি ভাইকে বিদায় জানাবার জন্য মালিবাগ আন্তনগর বাস টর্মিনালে যেতে হলো । ভাই বিদায় হয়েছেন, উদ্দেশ্যহীন পায়চারি করছি ফুটপাতে । মনে হলো সময়টা কাটানোর জন্য কিছু একটা করার দরকার । জুতাটাকে একটু চকচকে করে নেবার জন্য ফুটপাথের পাশে বসে কর্মরত চর্মকারের পাশে এসে দাড়ালাম ।
- এই জুতো জোড়া ভাল করে পালিশ করতে কত নিবেন ?
- দশ ট্যাহা লাগবো
চর্মকারের ঝটপট উত্তর । গাড়ির টায়ারের সোলঅলা ভারি শতছিন্ন একজোড়া স্যান্ডেল এগিয়ে দিল সে,বললো,
-লন, এইডা পইরা জুতাডারে দ্যান ।
অনেক সময় দাড়িয়ে থাকতে হবে ভেবে, লোকটাকে বললাম,
- তোমার পাশর এই কাঠের বাক্সটার উপর একটু বসবো ?
- বহেন ।
বেশী সময় চুপচাপ ঠায় বসে থাকতে ভালো লাগে না । ভাবলাম, রোদে পুড়ে কাল হয়ে যাওয়া, পুষ্টিহীনতায় রুগ্ন, ভাবলেশহীন খেটে খাওয়া এই লোকটার সাতে একটু আলাপ করলে কেমন হয় ।
- কয় ছেলেমেয়ে আপনার ?
-দুই মাইয়া, বরোডা কেলাস ফাইবে, ছোডডায় থিরি । খাই না খাই পোলাপাইনেরে তো লেহাপরা করাইতে অইবো, কি কন ?
-ত ঠিক । মা বাবা নেই ?
- বাবা মারা গ্যাছে চার বছর, মা আছে , বাই, বইন সবই আছে। তয়, অবাবের সংসার, মায়রে একা পালবার পারিনা, আমরা তিন ভাই, সবাই মিল্ল্যা মায়রে দেহি ।
বেশ কিছু সময় উদ্দেশ্যহীন তাকিয়ে থাকি মানুষটার চক্ষু কোটরাগত পুষ্টিহীন মুখটার দিকে । যেন কত কত দিনের পরিচিত আমি তার, কত না স্বজন, সুখ দুঃক্ষের সব কথা বলতে থাকে বিরামহীন । বড় বেশী কাংখীত এই সরলতার স্পর্শে মন পবিত্র হয় ।
একসময় প্রশ্ন করে সে,
- আমনে কই থায়েন, কি করেন ?
অনেকটা সহজাত প্রবৃত্তির বশে, আগু পিছু না ভেবে বলে ফেলি,
- কানাডায় থাকি ।
কিছু সময়ের জন্য নীরব হয়ে যায় লোকটা । আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থকে অপ্রয়জনে । যে মুখে এতসময় ছিল স্বজন বাত্সল্যের ছাপ, এখন সেই মুখ মূহুর্তে ছেয়ে গেল অপরিচয়ের চাদরে । নিজেকে বড় অপরাধি মনে হতে লাগলো । কেন যে বলতে গেলাম অমন অসুন্দর কথাটা । বুঝলাম একই কথার প্রতিকৃয়া সবসময় একইরকম হয়না ।
অনেকটা কোন কারন ছাড়া, উদাস ভাবে লোকটা প্রশ্ন করলো,
-ঐহানে আয় রোজগার কেমন অয় ?
- চলে কোন রকম ।
খেটে খাওয়া মানুষটার মুখের অদ্ভুত অভিব্যক্তি বৈচি গাছের কাটার মত অন্তরে বিধতে লাগলো । কাজ শেষ হয়ে গেছে ততক্ষনে । মজুরি মিটিয়ে দ্রত প্রস্থান করলাম নিজের প্রতি মৃদু একটা অভিমান নিয়ে ।

পরেরদিন পিতৃভূমি খুলনা যাবার জন্য দলবল নিয়ে সপরিবারে রওনা হলাম । এবার বাসযাত্রা, আরামদায়ক বলা যায় তবে দীর্ঘ বারো ঘন্টায় সেই কষ্টার্জিত আরাম যে ব্যারামে পরিনত হয়েছিল সে কথা উল্লেখ না করাই আপাততঃ আরাম দায়ক বলে মনে হচ্ছে । কেন এমন মনে হচ্ছে, সেটা একটা উদাহরন দিলে পরিষ্কার হয়ে যাবে : দীর্ঘ পথের বদৌলতে তাপানুকুল যন্ত্রযানের মুহুর্মূহু নাচন কোদনের শেষে যখন গন্তব্যে পৌছলাম তখন শরীরের বাকী শক্তিটুকু প্রানপনে সঞ্চয় করে যেটুকু কাজ করতে পারলাম তা শুধু শয়ন এবং শ্রমনিদ্রায় আত্তসমর্পন । সেদিন কিছু না পারলেও, পরের দিন সকালে কিছুটা সামর্থ দেহে ফিরে পাবার পর, যারপর নাই উত্সাহে আপন, দূর সকল সম্পর্কীয় ভ্রাতা, ভগিনীদের সংগে দেখা সাক্ষাতে কাল অতিবাহিত করতে থাকলাম । অনেক বছর পর বাপের ভিটায় গিয়া যতটা আশা করেছিলাম ততটা দেখলাম না । আশা করেছিলাম এত দিনের ব্যবধানে পরিচিত জনেরা উত্সাহে কৌতুহলে চারদিক থেকে ছুটে আসবে । কিন্তু আমার সব আশার গুড়ে বালি না পড়লেও কিছুটাত পড়েছিল নিশ্চয় । আমার আশার তরীতে বাতাস দিয়েছিলেন একজন, তিনি আমার বাশার কাকা । দূর সম্পর্কের কাকা এবং নিকট প্রতিবেশি, বয়সে কমকরে হলেও ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ বছরের বড় হবে আমার থেকে । সেই কাকা এসেছেন দেখা করতে, জীর্ন শরীর নিয়ে, লাঠিতে ভর করে, খুড়িয়া খড়িয়ে । দেখে কষ্ট লাগলো মনে, লজ্জিত হয়ে প্রশ্ন করলাম,
- কাকা এই শরীর নিয়ে কি দরকার ছিল আসার, আমি না হয় যেতাম ।
- দরকার আছে, ও তুই বুঝবিনা । আজকালকের ছেলেমেয়েরা বুড়ো মানুষদের পুছতে চায় না, বুজলি ।
দেখলাম কাকার অভিযোগ একেবারে মিথ্যে নয় । মানুষের এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে । মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা বোধ বেড়েছে অনেক, একে অন্যের প্রতি আগ্রহ বেশ কমেছে । ধনতান্ত্রিক দেশের সুবিধাভোগী না হয়ে ও ধনবাদী সমাজের রোগলক্ষন গুলো স্পষ্ট ফুটে উঠছে প্রায় সবার মধ্যে । নিরাশাবাদী কথা বাদ দিয়ে কাকার কথায় আসি ।
সেই ছোট বেলা থেকে দেখেছি বাশার কাকা হার্বাল মেডিসিন বা ঔষধি গাছ গাছড়া নিয়ে একেবারে পাগল ছিলেন, এগুলোর উপরে বই পত্র যা পেতেন বিপুল উত্সাহে সংগ্রহ করতেন । এগুলো নিয়ে অনেক সময় কথা বললেন । এদিকে অনেকে আমার সংগে দেখা করার জন্য বসার ঘরে আপেক্ষা করছে, কাকাকে আর বেশী সময় দেয়া যায় না । কথা প্রসংগে জানা গেল উনি আমার সংগে দেখা করতে এসেছেন শুধু কানাডা সম্পর্কে জানতে । বাশার কাকার মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক কৌতুহল, এত অল্প সময়ে কিভাবে তা আমি মেটাবো ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না । কানাডার পোলার বেয়ার কিভাবে ঠান্ডায় বেচে থাকে, ম্যাপেল গাছের গুনাগুন কি, কারিব্যু কি ধরনের প্রানী, কালমেঘী গাছ কানডায় আছে কিনা ইত্যাদি আরও কত কি । একটা অর্ধ শিক্ষিত মানুষের মনে জানার জন্য এমন আগ্রহ, ব্যাকুলতা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না । জানার জন্য জানা, এমন নিঃশর্ত অনুসন্ধিত্সু মানুষ সংসারে গোটা কয়েক থকলে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য । এসব নিরস কথাবার্তা বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি ।
যতটুকু তথ্য ঘটে আছে সব টুকু ঢেলে দিলাম বাশার কাকার ঝুলিতে। তারপরেও উনার জানার পিপাসা যেন মেটে না। প্রায় একমাস পার হতে চললো এমন একটা অদ্ভুত অধ্যাবসায়ী মানুষের সাক্ষাত আমার মেলেনি । পুরা মাসটাই গেল ডলার-পাউন্ড, আয়-রোজগার, গাড়ী-বাড়ী, ক্রেডিট কার্ড আর ফ্যাশন ভুষনের গল্প করে করে ও শুনে। হঠাত্ করে বাশার কাকার মুখে জানা অজানা জ্ঞানের অনেক বিষয় আলাপ করে মনে হলো আমার বাংলাদেশ আসাটা যেন সার্থক হলো ।এতদিনে এমন একটা মানুষ পাইনি সামনে যে নিঃস্বার্থ জ্ঞানের জন্য এতটা ব্যাকুল এবং উত্সাহি হয়েছে । মন প্রান ভরে গেল কাকার সংগে কথা বলে, তার জন্যই এবার দেশে আসা সার্থক হলো ।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

বানান ভুল আছে বেশ কিছু- যেগুলো পিপিদা ধরে দিয়েছেন । ... তবুও আপনার অভিজ্ঞতা পড়তে কিন্তু মন্দ লাগেনি...

আরো নিয়মিত লিখলে নিশ্চয়ই মান ভালো হবে। হাত খুলে লিখুন...

---------------------------------------------------------------------------

মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক

রেশনুভা এর ছবি

আপনার বাসা খুলনা...আমারও। ঠিক স্থানীয় নই কিন্তু ২২ বছর ধরে বাবা-মা আছেন।
ঐ খেটে খাওয়া মানুষগুলোর চেহারা ভেসে উঠছে। আমরা কত স্বার্থপর!
ভালো থাকবেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিক বলেছেন। সাধারন মানষের সরলতা এখনও অকৃত্রিমভাবে মনকে নাড়া দেয়। হ্যা, খুলনায় অমার জন্ম, তবে যাওয়া হয়না বিভিন্ন যৌক্তিক ও অনিবার্য কারনে। ভাল থাকুন।

পলাশ দত্ত এর ছবি

ভালো। মনেহয় >> মনে হয়
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

অতিথি লেখক এর ছবি

স হজ বাংলা বানান রীতি কিনে নিয়েছি ইতিমধ্যে। সময়মত দেখে নেব। সংশোধনের জন্য ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।