আমাদের মা - আমাদের প্রথম ও প্রধান শিক্ষক - ৬ (শেষ)

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি
লিখেছেন জোহরা ফেরদৌসী (তারিখ: রবি, ১৫/১১/২০০৯ - ৪:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের মা - আমাদের প্রথম ও প্রধান শিক্ষক - ৬
জোহরা ফেরদৌসী

পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩
পর্ব ৪
পর্ব ৫

জীবন যখন শুকায়ে যায় করুনাধারায় এসো....

দূঃখ সূখের দোল দোলানো জীবনে মা আনন্দ যেমন পেয়েছেন, শোকও পেয়েছেন। অপরিনত বয়সে প্রথম শোক পেয়েছেন তাঁর প্রথম সন্তানের অকাল মৃত্যুতে। কয়েক মাসের পুত্র সন্তানকে হারিয়ে মা শোকে বিহ্বল ছিলেন অনেকদিন। প্রায় তিন বছর পরে কন্যা সন্তান জন্মালে নাম রেখেছিলেন “রতন”। ভেবেছিলেন রতনের পরশে প্রথম সন্তানটির দূঃখ ভুলবেন। এক এক করে আরো দূ’টি সন্তানের অকাল মৃত্যু সয়েছেন। তারপর, পক্ষাঘাতগ্রস্থ বাবার মৃত্যু দেখেছেন। তাঁর মায়ের চলে যাওয়া দেখেছেন। সবচেয়ে বড় যে আঘাত তাঁকে কাঁদিয়েছে তা’হল ১৯৭৮ এর ১২ই জুলাই মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে রতনের চলে যাওয়া। আমাদের সকলের “বড় আপা”কে মা তাঁর বাকী জীবনের একটি দিনের জন্যও ভূলেন নি। আমাদেরকেও ভূলতে দেননি। আমাদের “ছোট আপা”কে আমরা “ছোট আপা”ই ডেকেছি। একজন যে আমাদের “বড় আপা” ছিল তাঁর স্মৃতিকে মা আমাদের মধ্যে অম্লান করে রেখেছিলেন। রতনের মৃত্যুর পরে মা আরো বেশী করে ধর্ম কর্মের দিকে ঝুঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের “জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুনাধারায় এসো....” এই গানের সঙ্গে বহুদিন মার চোখের জল দেখেছি।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে স্বামীর মৃত্যু তাঁকে একেবারে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছিল। ষাট বছরের সংসার জীবনে সূখ, দূঃখের ভাগীদার চলে যাওয়ায় ভীষন অভিমানী হয়ে পরেছিলেন। জীবিত আট ছেলে মেয়েদের মধ্যে পাঁচ জন প্রবাসে ঘর বাঁধায় সায় ছিল না মার। সব সময় বলতেন, “ইচ্ছে করে পাখীর মত ডানা মেলে সবাইকে আগলে রাখি।” দেশের মাটি ছেড়ে কোথাও যেতে চান নি শেষ পর্যন্ত। শেষতক দেশের মাটি তাঁকে বুক পেতে ঠাই দিয়েছে।

সীমার মাঝে অসীমের সন্ধান

সারাটি জীবন মা পরশপাথরের খোঁজে ফিরেছেন। গল্পের জমিদার বেড়াতে বের হয়েছিল, পথিমধ্যে বাবাকে শিশু কন্যার ডাক শুনতে পেয়েছিল। কচিকন্ঠের “বেলা যে যায়...” ডাকে জমিদারের চেতন হয়েছিল। সত্যিইতো বেলা যে ফূরিয়ে এলো, কিছূইতো করা হল না। সেই ক্ষনে জমিদার গৃহত্যাগ করে অসীমের সন্ধানে যাত্রা করে।

বৈরাগ্য সাধনে নয় সংসারে থেকেই মা আজন্ম সেই চির অচেনা, চির আরাধ্যের সন্ধান করে গিয়েছেন। জীবনের আনন্দ, বেদনার খেলাঘরে মানুষের মাঝেই তিনি সেই অপরূপকে দুটি নয়ন মেলে দেখে নিয়েছেন। মা তাঁর চারিধারের ও বইয়ের জগতের সকল মানুষের মধ্যেই সেই অধরা মাধূরীর সন্ধান করেছেন। “পরশ যাঁরে যায় না করা” সেই সকল প্রার্থনার অধিকারীকে সকলের দূঃখ সূখের সঙ্গে একাত্ম হয়ে খূঁজেছেন।

মা মরমী গান খুব ভালবাসতেন। ছোট বেলায় গ্রামের লন্ঠনের আলোতে যেসব দেহতত্ত্ব, মুর্শীদি গান তিনি শুনেছিলেন তার গভীর ভাবার্থ তাঁকে আলোড়িত করেছিল। লালন শাহ, হাসন রাজার গানের মধ্যে সেই চিরন্তন ঈশ্বর প্রেমের বেদনাকে উপলব্ধি করেছিলেন। লালন শাহের “ও যার আপন খবর আপনার হয় না/ আপনারে চিনতে পারলে যাবে অচেনারে চেনা...”, এই “আপন” যে আর কেউ নয় আপন আত্মা এবং তার সঠিক সন্ধান জানলেই যে ঈশ্বরকে জানা যাবে সেই বোধ তাঁকে কাঁদিয়েছে। হাসন রাজার “মাটির পিঞ্জিরার মধ্যে বন্দী হইয়া...”র মত গানেও তিনি একই কান্না শুনতে পেয়েছেন। এই জীবন যে শেষ অর্থে নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা “হলুদিয়া পাখী”র সন্ধান, একবার সেই পাখী উড়াল দিলে আর ফিরে আসবে না তা তিনি গভীরভাবে জানতেন। রবীন্দ্রনাথের “ভেঙ্গে মোরে ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে...”র চিরায়ত সেই করুন আহ্বানও তিনি শুনেছিলেন।

আত্মশুদ্ধিই যে আত্মোনূসন্ধানের পথ সেই বোধ মার মধ্যে তীব্রভাবে ছিল। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি মার মুখে আমি অজস্রবার শুনেছি।

“একলা আমি বাহির হলেম
তোমার অভিসারে,
সাথে সাথে কে চলে মোর
নীরব অন্ধকারে।
ছাড়াতে চাই অনেক করে,
ঘুরে চলি, যাই যে সরে,
মনে করি আপদ গেছে...
আবার দেখি তারে।

ধরনী সে কাপিয়ে চলে,
বিষম চঞ্চলতা।
সকল কথার মধ্যে সে চায়
কইতে আপন কথা।
সে যে আমার আমি, প্রভূ
লজ্জা তাহার নাই যে কভূ ...
তারে নিয়ে কোন লাজে বা
যাব তোমার দ্বারে।”

ঈশ্বরের আরাধনায়, জীবনের পথ চলায় “আমার আমি”কে বিসর্জন দেয়াই প্রকৃত সাধনা। সেই সাধনায় যে জয়ী হয়, সেই শুদ্ধচিত্তে শেষ যাত্রায় যেতে পারে। তাই জীবনের বন্ধূর পথে পরম করুনাময়কেই জীবনের ধ্রুবতারা করেছিলেন, যেন পথহারা না হন। দূঃখ তাপে ব্যথিত চিত্তেও বলেছেন, “তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবন মাঝে।”

বিদায় আশীর্বাদ

মাগো,

এই জীবনে যা শিখেছি, যা দেখেছি সবই তোমার কাছে শেখা, তোমার চোখে দেখা। আজ তোমার কথা কইতে গিয়ে দেখি কি জ্যোতির্ময়ী হয়ে দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমাদের সবার চেতনার গভীরে। আমি জানি তোমার জীবনে তোমার বাবার করা প্রথম আশীর্বাদটি সত্য হয়েছিল, সত্যিই তুমি জগতের আলো হয়েছিলে মা। আমি তোমার সাথে আমার জীবনের যত স্মৃতির কথা বলে কাঁদতে পারি। কিন্তু আমি আজ কাঁদব না। আমি আজ তোমার মত মা পাওয়ার আনন্দে তোমার জীবনকে উদযাপন করবো। বেদনার অশ্রুজল যতই আমার দূ’চোখের দৃষ্টিকে আচ্ছন্য করে আসুক না কেন, আমি তোমার জ্বালানো আলোক শিখায় পথ চলব। দূঃখ যতই আমার কণ্ঠ রোধ করে আসুক, আমি তোমার কন্ঠে শোনা গানই আজ গাইবো। তোমার শেখানো কবিতাই আজ আবৃত্তি করবো। মৃত্যূ নিয়ে তোমার প্রিয় কবিতাটি ...

মরন যেদিন দিনের শেষে
আসবে তোমার দুয়ারে
সেদিন তুমি কী ধন দেবে উহারে
ভরা আমার পরানখানি
সম্মুখে তার দিব আনি,
শুন্য বিদায় করব না তো উহারে..
মরন যেদিন আসবে আমার দুয়ারে।

কত শরৎ-বসন্ত - রাত
কত সন্ধ্যা, কত প্রভাত
জীবনপাত্রে কত যে রস বরষে ..
কতই ফলে কতই ফুলে
হৃদয় আমার ভরি তুলে
দূঃখ সুখের আলোছায়ার পরশে
যা কিছু মোরে সঞ্চিত ধন
এতদিনের সব আয়োজন
চরমদিনে সাজিয়ে দেব উহারে
মরন যেদিন আসবে আমার দুয়ারে।

আমি জানি তুমি মরনকে শুন্য হাতে বিদায় দাওনি। জীবনের যা কিছু সঞ্চয় পরম করুনাময় তোমাকে দিয়েছেন, তার সবই তুমি উদার হাতে তাকে দিয়েছো।

মাগো, জীবনে যতবার তোমার কাছে বিদায় নিয়েছি, বলেছো “আল্লাহর হাতে সোপর্দ করছি”। আজ তোমাকেও আমরা আল্লাহর হাতেই সোপর্দ করছি। শুধু বিদায় আশীর্বাদ দিয়ে যাও সত্য, সূন্দর আর মঙ্গলের যে আলো তুমি জ্বেলেছিলে, তিমির রাতের অন্ধকার যাত্রায়ও যেন কখনো সেই আলোহারা না হই।

প্রার্থনা
পরম করুনাময়,

যাচি হে তোমার চরম শান্তি
পরানে তোমার পরম কান্তি

এমন মায়ের সন্তান করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছ সে জন্যে শোকর গোজার করি। তোমার একত্ব, মহত্ত্ব, শক্তি, করুনার কথা মাই আমাদের প্রথম বলেছেন। দয়া করে তুমি তাঁর সকল ভূল ক্ষমা করে দাও। যা কিছূ সে তোমার উদ্দেশ্যে করেছেন দয়া করে তা গ্রহন কর। তোমার করুনার ধারা তাঁকে আজ সিক্ত করুক। তোমার শান্তি আজ তাঁর সাথী হোক। তোমার আলোক আজ তাঁর দিশারী হোক। আমেন।
নুর জাহান বেগমের সন্তানেরা

মৃতা নূরে জান্নাত রতন (মৃত্যুকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের ছাত্রী), মোহাম্মদ আলাউদ্দীন (রসায়নবিদ, গবেষক, শিক্ষক), মোহাম্মদ সালাহ উদ্দীন (চিকিৎসক), মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম (প্রকৌশলী), সুফিয়া নূরানী (স্নাতকোত্তর) মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম (প্রকৌশলী), মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম (প্রকৌশলী), মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন (প্রকৌশলী), মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দীন (স্নাতক), জোহরা ফেরদৌসী (স্নাতকোত্তর)।

ঋণ স্বীকারঃ অনেকের সদয় সহযোগিতা ছাড়া এই লেখাটি লেখা সম্ভব হতো না। আমাদের বড় মামা মোহাম্মদ এছহাক (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ফিজিওলজি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) এর কাছ থেকে মার প্রথম জীবনের অনেক অজানা কথা জেনেছি। সজল শর্মা, পার্থ সরকার, শিপ্রা বড়ুয়া, হেদার ম্যাকফে, ফেরদৌসী আরা সহ সকলকে আমার সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা।

(শেষ)


মন্তব্য

রিফাত সানজিদা এর ছবি

সবগুলো পর্ব পড়লাম,এই অনন্য মায়ের প্রতি বিনম্র অসীম শ্রদ্ধা রইলো...

জোহরা ফেরদৌসী   এর ছবি

সচলায়তনকে আমার অসংখ্য ধন্যবাদ । আমার মাকে নিয়ে লেখাটি প্রকাশ করার জন্য । আমার মা এক অতি সাধারন মা ছিলেন, আপনাদের সকলের মায়ের মতই “শুধুই একজন মা” । যাঁর সারাজীবনের অকৃত্রিম প্রচেষ্টা ছিল তাঁর সন্তানদেরকে মানুষের মত মানুষ করা । সকল মাই তাই করেন । নিজের জীবনের সকল অপূর্ন সাধ পুর্ন করেন সন্তানের মধ্য দিয়ে ।

আমার মাকে নিয়ে লেখার আসল উদ্দেশ্য ছিল দূ’টো । প্রথমতঃ আমার মা আসলেই অনেক দূর পাল্লার অভিযাত্রী ছিলেন । শুধুমাত্র সুযোগের অভাবে তিনি তা যেতে পারেন নি । এখনো অনেক মায়েরা পারেন না । আমরা যেন সকলে আমাদের সাধ্য মত এইসব “নুরজাহান”দের এগিয়ে যাওয়ার পথটুকু করে দেই । তাহলে শুধু তাঁরাই এগোবে, তাই নয় অনেক পরিবারেই আলো জ্বলে উঠবে ।
দ্বিতীয়তঃ আমাদের সকলের বেড়ে উঠার পেছনের সবচেয়ে পরিশ্রমী কর্মীটিকে আরেকটূ বেশী মর্যাদায় দেখা । পরিবারে, সমাজে, রাস্ট্রের সব জায়গায় তাঁদের যথাযথ সম্মান প্রতিষ্ঠা করা, এই স্বপ্নটির প্রতি আমার ভালবাসার কথা উচ্চারন করা ।
আপনারা যাঁরা সময় করে আমার মত এক অতি সাধারন মানুষের লেখা পড়েছেন তাঁদের সকলকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ । আপনাদের সকলের মায়ের প্রতি আমার ভালবাসা ।

জোহরা ফেরদৌসী   এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ । আপনার প্রতিও রইলো আমার শ্রদ্ধাবোধ ।

অতিথি লেখক এর ছবি

"-তোমাকেও আমরা আল্লাহর হাতেই সোপর্দ করছি। শুধু বিদায় আশীর্বাদ দিয়ে যাও----------------" -চমৎকার!
মাকে নিয়ে এমন মরমী লেখায় মন্তব্য করার সাহস আমার নেই। শুধু এই রত্নগর্ভার রূহের মাগফেরাত কামনা করছি!
এস হোসাইন

---------------------------------
"মোর মনো মাঝে মায়ের মুখ।"

জোহরা ফেরদৌসী  এর ছবি

আপনার প্রার্থনা কবুল হোক, এই প্রার্থনা করি । দোয়া করবেন যেন তাঁর যোগ্য সন্তান হতে পারি ।

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

সবগুলো পর্ব একসাথে পড়লাম। এই লেখাটি পড়ে নিজের মায়ের প্রতি অনেক সময় অনেক খারাপ আচরনের জন্য মন খারাপ লাগছে। একজন মা সবসময়ই মা হয়ে থাকেন। আমার মা যে কষ্ট করেছেন আমাদের ভাইবোনদের জন্য আবার নতুন করে ভাবছি সেই ত্যাগের কথা।
আপনার মায়ের আত্মা শান্তি লাভ করুক।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।