আদি বিশ্বাসের আদি মানুষেরা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২৩/০২/২০১০ - ৫:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাঘ মাস। শীতে কাঁপছে গোটা দেশ। অথচ মাস শেষ হতে এখনও আটাশ দিন বাকি।
বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ হবে আজ। দেশের আনাচে কানাচে এই নিয়ে চলছে তুমূল আলোড়ন, চলছে গ্রহণ দেখার নানা আয়োজন। এই আলোড়নের কারণও আছে। আজ থেকে আবার ১০৫ বছর পরে এদেশ থেকে দেখা যাবে এরকম সূর্যগ্রহণ। তাই গ্রহণ দেখাটা রূপ নিয়েছে রীতিমতো উৎসবের।
কিšত্ত দিনাজপুর শহরে নেমেই থমকে গেলাম রীতিমতো। কোথায় গেল সেই উৎসবমুখর মানুষেরা? সূর্যগ্রহণ নিয়ে কি এদের আগহ নেই কোনো? নাকি শীতের ভয়েই ঘরের ভেতর পাঁলিয়ে আছে সবাই?
সেরকম ভাবার কারণ আছে।কারণ কুয়াশার ভারী পর্দার নিচে জড়সড় হয়ে আছে গোটা জেলা।শহরবাসীর শরীরে শীত পোষাকের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। পরিচিতজনদের চিনতেও খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছে। সোয়েটার, মাফলার আর নাক অবধি মাঙ্কি ক্যাপে বদলে যাওয়া মানুষটাকে চিনতে চোখ দুটোই শেষ ভরসা। বাস থেকে নেমে সেভাবেই চোখের ইশারায় চিনে নিলাম শামীমকে। জেলার প্রতিভাবান সংস্কৃতি কর্মী সে।
রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান।ছোট ছোট সব গ্লাস সাজানো।পাম্প চুলায় শোঁ শোঁ করে আগুন জ্বলছে।গলগলিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে কেঁটলির নল দিয়ে। এমন দৃশ্য দেখলেই তো চা খাওয়ার তৃষ্ণাটা আরো বেড়ে যায়।
আমি আর শামীম বসে গেলাম ঝটপট।এক গ্লাস গরম চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিলাম আমরা।
র্স্টাট দিতেই ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে চলল শামীমের মটরসাইকেল।

শহরটাকে পেছনে ফেলে অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা পৌছে গেলাম পুর্ণভবা ব্রীজটিতে।
চর পরার কষ্ট নিয়ে মরে যাওয়া নদী পূর্ণভবার বুকে চলছে বালি ভর্তি বড় বড় লরি। ব্রীজ পেরিয়ে সোজা দক্ষিণমুখো বিরলের পথ। দুদিকে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। ধান কাটার পর নিঃস্ব বুকে পড়ে আছে সেগুলো।
পশ্চিমা বাতাসের ঝাপটায় হিম হয়ে আছে চারপাশের গ্রামগুলো। কিছু লোক খোলা মাঠে প্যান্ডেল তৈরিতে ব্যস্ত। পাশেই টাঙ্গানো ব্যানারে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘ইসলামিক জলসা’। শীতের এ সময়টাতে বাংলার গ্রামে গঞ্জে চলে মেলা, যাত্রাপালা, নাটক আর ইসলামিক জলসার মতো আয়োজন। প্রচন্ড শীতে মাঠের গরু-ছাগলগুলো পড়ে আছে বাহারী কাপড়ের তালি দেয়া বিশেষ পোষাক। স্থানীয়দের ভাষায় এটি ‘ঝুল’।
এসব দৃশ্য দেখতে দেখতেই রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে চলছি।যতই এগোচ্ছে আমাদের মটরসাইকেল, রাস্তায় জনমানব ততই কমে যাচ্ছে। প্রায় এক ঘন্টার পথ পেরিয়ে একসময় শামীমের মটরসাইকেল থেমে গেল রাস্তার পাশে ।আমরা পৌঁছে গেছি আমাদের গন্তব্যে।

জায়গার নাম বহবলদিঘী।যখন পৌঁছালাম, মাথার ওপর তখন মধ্য দুপুরের সূর্য।এক পাশে সীমান্ত অবধি গহীণ শালবন আর অন্য পাশে আদিবাসীদের গ্রাম। সেখানেই পাড়া ভেদে বাস করে নানা ভাষাভাষির আদি মানুষেরা।
চারপাশ থেকেই মাদল, ঢোল আর আদিবাসী ভাষায় চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছিল। আমরা ভাবছি কোন পূজার আনুষ্ঠানিকতা চলছে হয়তো। কিšত্ত হালজার একটি পাড়ায় ঢুকতেই আমরা অবাক হয়ে গেলাম।
দিনাজপুরে আমরা একটু আগেই দেখে এসেছি সূর্যগ্রহণকে ঘিরে কোনো সাড়াশব্দ নেই। কিšত্ত এখানে ঠিক তার উল্টো।গোটা পাড়ার সকলেই ধুপ জ্বালিয়ে, মাদল-ঢোল বাজিয়ে, বাড়ির চালে পানি ছিটিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলছে,‘মামা, গাহানা ছাড়’!
জিজ্ঞেস করে জানলাম, ‘কড়া’ সম্প্রদায়ের লোক এরা। সূর্যগ্রহণ চলায় গোটা পাড়ার সকলেই উপোস। সেই উপোস অবস্থাতেই এই লোকাচার উৎসবে অংশ নেয়াই নিয়ম। গোত্রের প্রধানকে এরা বলে ‘মহত’ । আলাপ হল সেই মহতের সাথে।

কড়া মানে কি? জগেন বলতে থাকে। কড়া মানে ‘মাটি খোড়া’। এক সময় এ সম্প্রদায়ের লোকেরা দিঘী খোড়ার কাজে যুক্ত ছিল। সে থেকেই এরা ‘কড়া’। ইংরেজ আমলে সারা ভারত জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বসেছে রেললাইন। পাহাড় কেটে,মাটি খুঁড়ে সেই রেললাইন বসানোর কাজে ঘাম ঝরিয়েছে এই আদিবাসীরাই। আর সেই রেল লাইনের কাজ করতে করতেই ব্যাপক পরিমাণ আদিবাসীরা চলে আসে এদেশে। বসতি গাড়ে, নিজেদের সংস্কৃতি আচার আচারণকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাই মিলে থাকতে শুরু করে একসাথেই।
জীবিকার তাগিদে দেশ ছাড়া সেই আদিবাসীরাই এদের পূর্বপুরুষ। নানা কারণে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে এ সম্প্রদায়টি। সারা দেশ জুড়ে এ সম্প্রদায়ের মাত্র ১৯টি পরিবার টিকে আছে।
নানা বিশ্বাসের প্রভাবে এদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে নানা আচারের। তারই ধারাবাহিকতায় চলছে এই গ্রহণমুক্তির চেষ্টা। কেন এই সূর্যগ্রহণ হয় সে বিষয়ে অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মতো কড়াদের রয়েছে আদি বিশ্বাস ও কাহিনী। ৯০ বছরের সেড়তি কড়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে শুরু করল সে কাহিনীটি।

‘মানব জাতি একবার খুবই অভাবের মধ্যে পড়ে। মানব জাতিকে বাঁচানোর জন্য চাই ধান। চন্দ্র এবং সূর্য মানুষের জন্য ধান দিতে অনুরোধ করে দোসাদ দেবতাকে। তাদের প্রার্থনায় সšত্তষ্ট হয়ে দোসাদ দেবতা ধান দেয় মানুষকে, তবে আবার ফেরত দিতে হবে এই শর্তে। কিšত্ত সে বছর দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে মানবজাতি সে ধার আর পরিশোধ করতে পারে না। চন্দ্র ও সূর্য মানব জাতির পক্ষে সেই ধান ধার নিয়েছিল বলে দোসাদ দেবতা এখনও সুযোগ পেলেই চন্দ্র ও সূর্যকে আক্রমণ করে। এতে চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণ ঘটে।’

এ কারণেই কড়ারা মনে করে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় মানবজাতির দায়িত্ব তাঁদের বাঁচাতে ভগবানের সাহায্য প্রার্থনা করা।

বেলা বাড়ছিল ক্রমশই। কথাও জমে উঠছিল বেলার সাথে সাথে। তাদের কাছ থেকেই জানলাম,কড়াসহ নৃগোষ্ঠীর কোনো সম্প্রদায়েরই লিখিত বর্ণ নেই। পুরোটাই মৌখিক। মায়ের ঘুম পাড়ানির গান আর বাবার আদরের ভাষা শুনে শুনেই শিশুরা তাদের জাতির ভাষা শিখে ফেলে।
আমাদের আগ্রহ দেখে পাশ থেকে সুনিয়া কড়া গাইতে শুরু করল তাদের ভাষায় ঘুমপাড়ানির গানটি -

‘ ইয়ারে ডিম চড়ওয়া ডিমা পার দে/নুনুক খনামে আগ লাগাল নুনু নিন্দারে দে’

গানের কথার অর্থ হচ্ছে এরকম : কোকিল পাখিকে ডাকা হচ্ছে, সে যেন তার ডিম পাড়া শেষ করে চলে আসে এই শিশুটির বিছানায়। আর তারপর তা দিয়ে গরম করে দেয়া বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দেয় শিশুটিকে।
তাদের উৎসবের অংশ হিসেবেই এবার তাদের মধ্যে চলতে থাকে ধাঁধার খেলা। এক পাশ থেকে সেড়তি বলল, ‘দাশটা মারাত রাগদেলকে, দুটা মারত পাকারকে মারকে’।
এর উত্তর বলতে পারল না কেউ। সবাই চুপ।
কেউ না পারায় সেড়তির মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল। হাসতে হাসতেই উত্তর দিল সে,
‘ঢিলা বাছা’।
মানে উকুন আনা- দুই হাতের দশ আঙ্গুল থাকলেও উকুন মারা হয় দুই আঙ্গুল দিয়ে।
এবার সুনিয়া বলল আরেকটি ধাঁধা, ‘ভুরুত পাংখি, একজন ডুবেলকে দুজন সাক্ষি’।
দলের মহত বলল,এটি হচ্ছে সেচ দেয়ার জন্য টিন জাতীয় বালতি বিশেষের দুই দিকে দড়ি বেঁধে দুইজন টেনে ধরা।
এরকমভাবে চলতেই থাকল উৎসবের একের পর এক লোকাচার।
এরই মধ্যে আমরা কড়া পাড়া থেকে বের হলাম। হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়লাম গিরিডোবার ওরাও পাড়ায়। ভাঙ্গাচোরা রাস্তার দুদিকে সারি সারি তুতগাছ। পথেই দেখা মিলল নিপেন টি¹ার। নিপেন টি¹া এই ওরাও পাড়ারই একজন। সে আমাদের জানাল, প্রায় ৩০টি পরিবারের বাস এখানে। পরিবারের দারিদ্রতা থেকে মুক্তি পেতে, চিকিৎসা সহায়তা পেতে আর বিনামূল্যে বাচ্চার শিক্ষা প্রাপ্তির প্রলোভনে কয়েকটি পরিবার খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও অধিকাংশই পালন করছে তাদের পূর্ব পুরুষদের আদি ধর্ম।
চন্দ্র ও সূর্য ওরাওদের দেবতা। ওরাও ভাষায় বিড়ি নাদ ও চান্দু নাদ। চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি নিয়ে এদের বিশ্বাসে আছে প্রাচীন এক কাহিনী। আধো কুরুক ও আধো বাংলায় নিপেন বলতে শুরু করল কাহিনীটি-

“ধরমেশ যখন পৃথিবী সৃষ্টি করল তখন আকাশ ও মাটি ছিল খুবই কাছাকাছি। মানুষ চলাফেরা করার সময়ই আকাশ মাথায় ঠেকতো। একবার মানুষের কোনো এক অপরাধে আকাশ উপরে উঠে গেল। এতে চলাফেরায় মানুষের সুবিধা হলেও সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।
বনের মধ্যে ছিল এক মহুয়া গাছ। সে গাছে ফুল যতক্ষণ ফুটে থাকত ততক্ষণ পৃথিবী আলোকিত থাকত। আর যখন ফুল শুকিয়ে যেত তখন আবার অন্ধকার নেমে আসতো।
সবাই ভাবল, গাছটিই অন্ধকারের মূল কারণ। সিদ্ধান্ত নেয়া হল, গাছটিকে কেটে ফেলে আলো উদ্ধারের।
গাছটিকে কাটা হলো। কিšত্ত তারপরও সেটি মাটিতে পড়ছে না। দৈববাণীর মাধ্যমে জানা গেল গাছটিতে রয়েছে চিলের বাসা। চিলটিকে না মারলে গাছটি মাটিতে পরবে না। তাই হল। চিলটিকে মারার পর পরই গাছটি মাটিতে পড়ে গেল। পড়ার শব্দে কেপে উঠল গোটা পৃথিবী ।
সে দেশের রাজা ভাবল,শত্র“রা তার রাজ্য আক্রমন করেছে। তিনি সৈন্য নিয়ে এসে দেখলেন মহুয়া গাছটি কাটা। রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে শাস্তির হুকুম দিলেন। উভয় পক্ষের সাথে চলল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। রাজার সৈন্য পরাজিত হল।
অতপর গাছটিকে দুই ভাগ করে কাটা হল। দেখা গেল নিচের দিকের বড় অংশটিতে সূর্য আর উপরের দিকের ছোট অংশটিতে চন্দ্র।
কিšত্ত তাদের জীবন দান হবে কীভাবে?
আবারও দৈববাণী এলো। এক চাষীর আদরের পুত্রকে চুরি করে এনে হত্যা করে তার রক্ত ঢেলে দেয়া হলো গাছের কাটা অংশে। সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্র ও সূর্য জীবিত হয়ে আকাশে উঠে গেল।”

সে সময় থেকেই ওরাওরা মনে করে সূর্য পুরুষ এবং সে বেশি রক্ত পান করেছিল বলে তেজী ও লাল। একইভাবে চন্দ্র মহিলা এবং সে কম রক্ত পান করেছিল বলে স্নিগ্ধ ও সাদা।

ওরাও গ্রামের পাশেই নিপেন দেখিয়ে দিল সাঁওতাল পাড়াটি। এ পাড়াটিতেই ঐতিহাসিক পাড়– রাজার বিদ্রোহ হয়েছিল।
পাড়ার ভেতর ঢুকতে ঢুকতে মনে পড়ল সাঁওতালদের বিষয়গুলি। এরা নিজেদের ‘সানতাল’ বলতেই অধিক পছন্দ করে। নিজেদের মধ্যে এরা একে অপরকে ডাকে ‘হর’ বলে। ‘হর’ অর্থ ‘মানুষ’। এদের আদি দেবতা সূর্য। সাঁওতালী ভাষায় ‘সিং বোঙ্গা’। সূর্য পূর্বদিকে উঠে বলেই পূর্বদিক সাঁওতালদের কাছে পবিত্র। তাই পূজাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এরা পূর্বদিকে মুখ করে বসে।

এখনও শিকারসহ যে কোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামে নৃগোষ্ঠীদের একমাত্র অস্ত্র তীর-ধনুক। এছাড়া নানাপূজা পার্বণেও এরা তীর ধনুককে ব্যবহার করছে পূর্বপুরুষদের আমল থেকে। শিকারসহ তীরধনুকের ব্যবহার নিয়ে প্রচলিত আছে একটি কাহিনী বা উপকথা। গোত্রের ষার্টোধ্ব রাগদা হেমব্রন গল্পের ছলে বলতে থাকল কাহিনীটি-

“সাঁওতাল রাজা তখভনের রাণীর এক গোপন প্রেমিক ছিল। প্রেমিকটি বনের মধ্যে থাকতো সর্পরাজের বেশ ধরে। রাজা যখন শিকারে যেতেন রাণী তখন তাকে জঙ্গলের বিশেষ একটি দিকে যেতে নিষেধ করতেন।
একবার শিকার করতে গিয়ে কৌতুহল বশত রাজা ঐ বিশেষ দিকে যান এবং সর্পরাজকে দেখতে পান। নিজের প্রাণ রক্ষার্থে তীর দিয়ে রাজা হিংস্র সর্পরাজকে মেরে ফেলেন।
শিকার থেকে ফিরে রাজা ঘটনাটি রাণীকে খুলে বলে। সর্পরাজের মৃত্যুর কথা শুনে রাণী ভেতরে ভেতরে বেশ ব্যথিত ও প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠেন। তিনি রাতের আধারে জঙ্গলে গিয়ে সেখান থেকে সর্পরাজের হাড় গোড় কুড়িয়ে এনে বাগানে পুতে রাখেন। কিছুদিন পর ঐ জায়গা থেকে একটি গাছ হয় এবং ঐ গাছে একটি আধ ফোটা ফুল সারা বাগানকে আলোকিত করে তোলে।
প্রতিহিংসা পরায়ণ রাণী একবার কৌশলে রাজার সাথে মেতে ওঠেন সর্বনাশা বাজীর খেলায়। রাজা যদি বাগানের সব ফুলের নাম বলতে না পারেন তবে, রাণীর হুকুমে প্রজারা রাজার প্রাণদণ্ড দেবে। নিজের বাগানের ফুলের নাম বলাটা খুবই সহজ ভেবে আত্মবিশ্বাসী রাজা রাজি হলেন।
অতপর গ্রামে গ্রামে ঢোল পিটিয়ে এ খবর সর্বত্র জানিয়ে দেয়া হলো। নির্দিষ্ট দিনে রাজ্যের প্রজারা ‘বাজী খেলা’ দেখার জন্য রাজপ্রসাদের বাগানে উপস্থিত হলো। রাজা একে একে সব ফুলের নাম বলতে পারলেন কিšত্ত অদ্ভুত আধফোটা ফুলটির কাছে এসে রাজা আটকে গেলেন। সে সময় রাজার পক্ষে প্রজারা রাণীর কাছ থেকে আরো ৭ দিন সময় চেয়ে নেয়। খবর পেয়ে রাজাকে বাঁচাতে অন্য রাজ্য থেকে পায়ে হেটে রওনা হয় রাজার এক বোন। হাঁটতে হাঁটতে ৬ষ্ট রাতে সে বিশ্রাম নিচ্ছিল একটি শিমূল গাছের তলায়। হঠাৎ গভীর রাতে বোনটি শুনতে পায় গাছের মগডালে এক শকুনি তার ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন এই বলে যে, পরদিনই সে বাচ্চাদের জন্য রাজার দেহের মাংস তাদের খাওয়াবে। উৎসুক বাচ্চারা কিভাবে তা সম্ভব মার কাছে জানতে চাইলে গল্পচ্ছলে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে পাড়াতে সমস্ত ঘটনা এবং ফুলের নাম ও জন্ম বৃত্তান্ত খুলে বললো। শিমূল গাছের নীচে বসে রাজার বোনটি সব কথা শুনে ফেললো।
ভোরের মধ্যেই বোনটি রাজার কাছে পৌছে ফুলের নামসহ সমস্ত ঘটনাটি বলল। ৭ দিনের দিন রাজা, প্রজা ও রাণীর সম্মুখে বললেন, ফুলের নাম হলো,‘ কারি নাগিন হাড় বাহা’ আর তখনই ফুলটি পূর্ণ প্রস্ফুটিত হলো। রাজা প্রাণ দণ্ড হতে মুক্তি পেল।
কিšত্ত ক্ষুব্ধ প্রজারা প্রতিহিংসা পরায়ণ রাণীকে তীর মেরে ঝাঝরা করে দিল এবং তাতেও তাদের ক্ষোভ প্রশমিত না হওয়ায় লাঠির আঘাতে রাণীর মাথা গুড়িয়ে দিল।”

সেই থেকে সাঁওতালদের শাকরাৎ-এর সময় কলাগাছে তীর মারা ও লাঠির ঘায়ে হাড়ি ভাঙ্গাকে এরা অশুভ শক্তির প্রতীকী বিনাশ বলে মনে করে। এমনিভাবে সাঁওতালরা বিশ্বাস করে, পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বে সমগ্র দুনিয়া জলে ঢাকা ছিল। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী তৈরীর সিদ্ধান্ত নিলে তাকে সাহায্য করে কেচো ও কচ্ছপ।
কেচো জলের তলদেশ থেকে মাটি এনে কচ্ছপের পিঠের ওপর রাখতে থাকে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠল বিশাল পৃথিবী। অতঃপর সৃষ্টিকর্তা তৈরী করলেন আদি পিতা ও মাতাকে। পিতা-মাতার জোড়ায় জোড়ায় সন্তান জম্মের মাধ্যমে গড়ে উঠল সমগ্র মানবজাতি।

সাঁওতাল পাড়া থেকে যখন বের হলাম তখন সন্ধ্যা ছুই ছুই। চারদিকের গ্রামগুলোতে থেমে থেমে বাজছিল মাদল আর ঢোলগুলো। ফেরার পথে লোহা ডাংগাং ঢুকে দেখি উঠানের বোঙ্গায় সন্ধ্যা প্রদীপ দিচ্ছে একটি সম্প্রদায়ের লোকেরা। এরা তুরি সম্প্রদায়। এ গোত্রের মহত লবানু সিং। পুরুষদের নামের শেষে এরা ‘সিং’ ব্যবহার করলেও নারীদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে ব্যবহার করা হয় ‘বালা’।
একজন লোকের আর্তচিৎকারে আমরা প্রায় দৌড়ে চলে গেলাম মহতের পাশের বাড়িটিতে। সেখানে সাপে কাটা এক রোগীর শরীর থেকে বিষ নামাচ্ছিল মহতেরই ভাই সবানু সিং। বিশেষ ভঙ্গিতে পরছেন তাদের ভাষায় মন্ত্র -

‘এখানি পুসকেননি চারি খানি ঘাট
তাতে দিনু পদ্মার পাত
পদং কুমারী মা-বাপার নাম - জয় বিশহরি
নাব বিষ নাব
বত্রিশে গড়ে গড়ে নাব
নিচ থাকি উপারে যদি ধাউবো
দোহার লাগে - শিব, দুর্গা, কার্তিক, গনেশের মাথা খাবো।’

মুন্ডা, ভুনজার, ওরাও আর কড়াদের মতো তুরি সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় পূজার নাম কারমা। ভাদ্র মাসে হয় এই পূজাটি। পূজার পূর্বে মেয়েদেরকে তার স্বামীর বাড়ি থেকে দাওয়াত করে নিয়ে আসে তার ভাই ও বাবা।তাই ভাদ্র মাসে চারদিকে যখন কাশ ফুল ফুটতে থাকে তখন মেয়েদের মনে বাবার বাড়ি যাওয়ার আনন্দের ঢেউ। মনের এই আকুতি নিয়ে করমা পূজার সময় দলবেধে তারা গায় নানা গান।
আমাদের শোনাতে বাসন্তি বালা সুর করে গাইতে থাকেÑ

‘কাশি ফুলা ফুটেই গেলে
আসা মরা লাগি গেলে
ভাইয়া বাপা লেগেল আতে বেটিক
কারমা পূজাকে রাতে।’

পাশ থেকে খিরো বালা ধরেন আরেকটি গান-

‘করম ডাল,করম ডাল
চল শশুড়ায়ে
ভাদ্র মাসে বিয়া হতে গো
আনে ঘুরায়ে।’

তুরিদের গানের আসর থেকে যখন ফিরছি তখন চারদিকে নিস্তব্ধ অন্ধকার । আকাশে অজস্র তারা।হঠ্যাৎ থমকে গেলাম। চোখের সামনেই আকাশের একটি তারা খসে পড়ে। আবার তা নিমিষেই হারিয়ে যায়।দূরে কোন একটি গ্রাম থেকে ভেসে আসে আদি মানুষের সূর - ‘হে ভগবান, পতিসে পাবনে সিতারাম, জেয় ভগবান’।

- সালেক খোকন


মন্তব্য

হরফ এর ছবি

আপনার লেখার style সুন্দর কিন্তু আমার আজকাল কোন বিশেষ জনজাতির (ethnic group/tribe) জীবনাত্রার কথা পড়লে বা দেখলেই ভয়ানক depression হয়. মনে হয় আর তো ক'দিন...এরপরেই কোন nationalist integration agenda বা majority population এর organized religious practice-এর চাপে, integration, unity অথবা syncreticism-এর দাবিতে এইসব গল্পকথা এবং rituals নিশ্চই হারিয়ে যাবে, যেতে বাধ্য.

তুলিরেখা এর ছবি

আহা এত এত উপকথা লোককথা! খুব ভালো লাগলো।
প্রার্থনা করি সুন্দর ও বিচিত্র লোকাচারগুলি ও লোককথাগুলি বেঁচে থাকবে, কোনো না কোনো রূপে।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তিথীডোর এর ছবি

বাহ্!
অন্যধাঁচের লেখা...

--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

তাহসিন আহমেদ গালিব এর ছবি

পড়লাম!

নাশতারান এর ছবি

বিষয়বস্তু আর লেখা দুইই ভালো লাগলো। নিয়মিত লিখুন।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

তাসনীম এর ছবি

ভালো লেগেছে, লেখনি চালু থাকুক।

+++++++++++++++++++++++++++++++++++++
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

চোখে পড়ে নাই আগে। পছন্দের পোস্ট রাখলাম। নিয়মিত লিখবেন আশা রাখি।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দারুণ লেখা, পছন্দের পোস্টে রাখলাম। নিয়মিত লিখুন
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

খোকন, লেখাটা দুর্দান্ত। শহরে বসে কতকিছুই আমরা জানি না। অথচ এদের কৃষ্টি নিয়ে দেশের বাইরের লোক এসে মাথা ঘামায়।
উদ্ধৃতি : সাঁওতালরা বিশ্বাস করে, পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বে সমগ্র দুনিয়া জলে ঢাকা ছিল। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী তৈরীর সিদ্ধান্ত নিলে তাকে সাহায্য করে কেচো ও কচ্ছপ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থেও কূর্মাবতারের কথা উল্লেখ আছে। কূর্মাবতার মানে কূর্ম অবতার। পৃথিবীকে রক্ষা করতে একসময় কেঁচো অবতার হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিল।
আদিবাসী মানুষদের নিয়ে সেই অর্থে ভালো লেখা কম। ওদের উঠানে বসে, ওদের সাথে কথা বলতে বলতে ওদরে মনের কথা জেনে নিয়ে লিখবে, এমন মানুষ তো নেইই বোধহয়।
তুই এই কাজটা নিয়মিতভাবে করে যাবি এরকমটাই বিশ্বাস রাখি। তাহলে সেটা খুব বড় কাজ হবে।
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

মাহবুব লীলেন এর ছবি

অনেক চমৎকার একটি লেখা
কিন্তু অনেকগুলো বিষয় বোধহয় একসাথে চলে আসলো

সূর্যগ্রহণ আর বিভিন্নগোত্রের সৃষ্টি উপকথাগুলো একসাথে মিশে গেছে

০২

গোত্রগুলোর পরিচিতিসহ সৃষ্টিকথাগুলোর আলাদা একটা সিরিজ করতে পারেন

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

দারুণ লেখা। মনে হচ্ছে দিনের সেরা লেখা পড়লাম। অবকাঠামো অসাধারণ।
==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।