গোলকগ্রাম, গোলকৎসব ও কোলবালিশ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৯/০৬/২০১০ - ৮:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.

গোলকগ্রাম। উহার নির্ভুল অবস্থান জানাইবার বোধকরি কোন প্রয়োজন নাই। গোলকগ্রামের সীমানা ছুইবা মাত্র ভদ্রমোহদয়গন ‘দূচ্ছাই’ বলিয়া মিনিট এবং সেকেন্ডের কাঁটা একযোগে উপড়াইয়া ফেলেন; এই অঞ্চলে উহাদের বিশেষ কোন কারবার নাই। ততোধিক কুলীনেরা ঘড়ি ছুড়িয়া ফেলিয়া ক্যালেন্ডার বগলদাবা করিয়া গ্রামে প্রবেশ করেন।

এই গন্ডগ্রামের বিদ্যানাশিনী উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে অতি দীর্ঘ দুইখানা বাঁশ পোঁতা হইয়াছে। দক্ষিনের বাঁশ খানার শীর্ষে শোভা পাইতেছে আর্জেন্টিনীয় আকাশী-সাদা পতাকা। উত্তরের খানায় ব্রাজীল দেশীয় হলুদ বর্ণের ঝান্ডা। দক্ষিনের পৃষ্ঠপোষক প্রাক্তন হ্যাডমাস্টার পুলিন রায়, উত্তরের বিশিষ্ট আড়তদার বজলু শেখ। পুলিন রায় ‘মারাদোনা’ বলিতে অজ্ঞান। আর বজলু শেখ পাঠ্য বইয়ের সেই কালো মানিকের কথা অদ্যাবধি ভুলিতে পারেন নাই। মে মাস আসিয়াছে কি আসে নাই, উহারা নিজ নিজ গদিতে বিশ্বকাপের সরগরম আসর বসাইয়া ফেলিয়াছেন। আসর গুলিতে নিজ দলের গুনকীর্তণ অপেক্ষা প্রতিপক্ষের নিন্দাই হয় বেশি। তৎসঙ্গে যথারীতি উত্তম জলযোগের ব্যবস্থা থাকে। ফলে বাড়াবাড়ি রকমের জনসমাগম হয়। গদির মালিকদের উহাতে কোন আপত্তি নাই।

“--পেলে এক অতি সাধারন মানের খেলোয়াড়। --সেই কালে অফ-সাইড ছিল না বলিয়া ‘কালা মানিক’ গন্ডা গনিয়া গোল করিতেন। --গোল আর কই করিতেন?! বার-পোস্টে হেলান দিয়া বাতাস খাইতেন আর পদ-সন্নিকটে বল আসিলে গোলে প্রবেশ করাইতেন—তৎসত্ত্বেও ব্যাপক মিস্‌ হইত! –রাক্ষসরাজ রাবণের ন্যায় বদ্‌খত্‌ বদন দেখিয়া গোলকিপার পলায়ন করিত বলিয়া না গোল হইত!”—এই হইল পুলিন রায় তথা আর্জেন্টিনা গোষ্ঠীর আসরের মূল সুর। বজলু শেখের ব্রাজিলীয় আসর গরম হইয়া উঠে ঠিক বিপরীত তালে। “ – মারাদোনা উচ্চ মানের খেলোয়াড় না হইলেও অতি উচ্চ মানের ‘চুর’। হাত দিয়া গোল করিয়া বিস্তর বাহ্‌বা কুড়াইয়াছে! – সাত খানা ইংলন্ডদেশীয় জাম্বুবান কে কাটাইয়া যে গোল করিল? – তাহাতে কি হইয়াছে? এক খানার স্থলে কি তিন খানা গোল হইয়াছে?! বাদবাকী খেলোয়াড়েরা অপদার্থের চূড়ান্ত বলিয়াই তো একাই সাত জনকে কাটাইলো। উহা কি ফুটবল হইল?! বড়জোড় দাঁড়িয়াবান্দা বলা চলে!”
পুলিন ও বজলু তনয়াদ্বয় নিজ নিজ বাটীর অন্দরমহল হইতে এইসকল উচ্চমার্গীয় আলোচনা শ্রবণ করিয়া থাকে। এই শুনিয়া শুনিয়া তাবৎ খেলোয়াড়দিগের নাম উহাদের মুখস্থ হইয়া গিয়াছে। সেই সব নাম মিলাইয়া উহারা পত্রিকা হইতে রঙ্গিন ছবি কাটিয়া লয়। চার-রঙ্গা লিওনেল মেসি আর কাকারা উহাদের কাঁচুলির গোপন সুড়ঙ্গে ঠাঁই পায়। শয্যায় পিঠ এলাইবার পূর্বে সেইসব ল্যাগসামদিগের ছবি লইয়া উহারা বিস্তর মাতিয়া উঠে—ইচ্ছা মত কল্পনার রাস ছাড়িয়া দেয়। ষোড়ষীর দুষ্ট-মিষ্ট কল্পনায় কোলবালিশেরা কাকা আর মেসি হইয়া যায়। অতঃপর কাকা-মেসি কঠিন আলিঙ্গনে নিষ্পেষিত হইতে থাকে।

২.

পুলিন রায় জনাকয়েক মোসাহেব পরিবেষ্টিত হইয়া হাঁটের পানে যাইতেছিলেন। পথিমধ্যে উহার সহিত বজলু শেখের সাক্ষাৎ হইয়া গেল। প্রতি চারি বছরের ব্যবধানে উহারা তুমুল বিবাদে লিপ্ত হন। তাহা না হইলে দুই বৃদ্ধ একে অপরের অকৃত্তিম বন্ধু বৈ ভিন্ন কিছু নহেন।

পুলিন রায় কোমরে দুই হস্ত রাখিয়া বজলু শেখের পথ রোধ করিলেন।
“কি বিষয় পুলিন? বৃদ্ধ বয়সে ভীমরতি ধরিয়াছে নাকি?! বড় যে ছেলেমানুষের ন্যায় পথ আটকাইয়া রাখিলে!” বজলু শেখ তীর্যক বাণ হানিলেন।
--বাতুলতা রাখ! লোকমুখে শুনিতে পাই আমা-সম্পর্কে অকথা কুকথা রটাইয়া বেড়াইতেছো!!
--কি বলিতে চাও খোলাসা করিয়া বল।
--আমি নাকি জীবনে একটি মাত্র বার ফুটবলে লাথি মারিয়াছি আর তাহাতেই প্রপাতধরণীতল হইয়া দুইখানা দন্ত হারাইয়াছি!! তুমি বল নাই এইসব?!
--বলিয়াছি! অতি অবশ্যই বলিয়াছি। কথা তো মিথ্যা নহে হে।
--রাখো তোমার সত্য-মিথ্যা!! বাল্যবন্ধুর মানসম্মানের দিকটা ভাবিলে না? তুমি যে টোলের পন্ডিতের মার খাইয়া মুতিয়া দিয়াছিলে উহা কি আমি বলিয়া বেড়াই?
--এই তো ভুল করিলে! কোন আকাশী-সাদা আমার বন্ধু নহে।
--এইসব ভড়ং ছাড়িয়া লাইনে আইসো! এখনো কিছুমাত্র বিলম্ব হয় নাই। কেলে ভূতদিগের দল ছাড়িয়া আর্জেন্টেনীয় পতাকাতলে আসিয়া পড়। ইজ্জত বাচিবে!
--আমার আর খাইয়া কাজ নাই। অসভ্য উলঙ্গের দলে যোগ দেই!
--উলঙ্গ?!
--না তো কি? হাফপ্যান্ট পড়িয়াই ফুটবল খেলিতে হয় উহা ঠিক আছে। তথাপি আর্জেন্টেনীয় হতভাগার দল যাহা কোমড়ে জড়াইয়া মাঠে নামিয়া পড়ে-- দেখিয়া তো ল্যাংকোট বলিয়া ভ্রম হয়!!
--অহো! দেখাইবার মতন থাই থাকিলে কেলে মানিকের দলও ল্যাংকোট পড়িত!
--যাহাই হউক, বাতুলতার বিশেষ সময় নাই। চলিলাম।
--যাইতেছো কই? দাঁড়াও!! কটকটে হলুদ বর্ণের উহা কি গায়ে চাপাইয়াছো?! দেখিলেই তো চক্ষু-প্রীড়া হয়! হলুদ কোন রঙ হইলো? হলুদ দেখিলেই সম্প্রতি বিঁছুটির জালা অনুভব করিতেছি।
--ডাল-মাংস তো বিস্তর হলুদ দিয়া খাও! না খাইলেই হয়!!
--হলুদ খাওয়া বন্ধ করিব?! আজি হইতে ত্রিগুন-চারিগুন হলুদ দিয়া ব্যাঞ্জন রাঁধিব! গোষ্ঠীর যত হলুদ গিলিয়াই শেষ করিব!!
--যেমন তোমার ইচ্ছা।
এই বলিয়া বজলু শেখ একখানা আকাশী-সাদা রুমাল বাহির করিলেন। অতঃপর অম্লান বদনে উহা দিয়া স্বীয় বগল মুছিয়া নিলেন।
--বুঝিলে পুলিন। অধমের চারিখানা আর্জেন্টেনীয় ফ্যাশনের লুঙ্গি ছিল। সেইসকল ছিন্ন করিয়া রঁসুইঘরের তেনা আর বগোল মুছিবার বিশেষ রুমাল বানাইয়া লইলাম। যাহাই বল, আকাশী-সাদায় বগোল মুছিয়া বড় আরাম হয়!

ঘৃণা মিশ্রিত কুপিত দৃষ্টি হানিয়া পুলিন রায় দ্রুত হাঁট অভিমুখে যাত্রা করিলেন। বজলু শেখ মৃদু হাস্যে বিপরীত পথ ধরিলেন।

৩.

মাসাধিক কাল অতিবাহিত হইল। পুলিন রায় বিস্তর হলুদ গিলিলেন। বজলু শেখের কৃপায় সহস্র আকাশী-সাদা লুঙ্গি বগল মুছিবার রুমাল আর হেঁসেলের তেনা হইল। দুই পালের গোঁদা আর তাহাদের চ্যালা-চামুন্ডারা ‘দেখাইয়া দিব!’ বলিয়া বিস্তর আস্ফালণ করিলেন। উহারা কি দেখাইলেন ঠিক স্পষ্ট নহে। তবে আর্জেন্টিনা দেখাইয়া দিল। দেখাইয়া দিল উহারা কেবল উত্তম বল-প্ল্যায়ারই নহে, সবিশেষ ক্রন্দন-পটিয়সীও বটে। ব্যাপক কাঁদিয়া আকাশী-সাদার দল কোয়ার্টার ফাইনাল হইতে বিদায় লইল। তারকাকুল শিরোমনি লিওনেল মেসি অধিক কাঁদিলেন। ততোধিক কাঁদিলেন পুলিন রায়। দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল খেলিল জর্মণ দেশের বিরুদ্ধে। পুলিন রায় ও তার বান্ধবেরা মসজিদ-মন্দিরে ব্রাজিল-বধে ব্যাপক প্রার্থনার আয়োজন করিলেন। শকুনের দোয়ার গরু মরে না বলিয়া প্রবাদ রহিয়াছে। উহা ভুল প্রমান করিয়া গরু মরিয়া গেল। জর্মণ বীরেরা সেলেকাওদের অবলীলায় বাড়ির পথ দেখাইয়া দিল। রবি বাবু (রবিনহো) আর কাকা বাবু গলা জড়াজড়ি করিয়া বঙ্গদেশীয় পাললিক রমণীদের ন্যায় উথাল-পাতাল ক্রন্দন করিলেন। এই দৃশ্য দেখিয়া বজলু শেখ ‘পুঙ্গির পুত!’ ধাঁচের অশ্লীল গালিগালাজ সহযোগে দূরদর্শন যন্ত্র খানা ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন।

দুই বাঘা দলের বিদায় তথা বিউটিফুল গেমের মৃত্যুতে পিতারা ভাঙ্গিয়া পড়িলেও কন্যাদ্বয় কিছুমাত্র বিচলিত হইল না। উহারা প্রবল উৎসাহে সুপুরুষ, দীর্ঘকায় জর্মণ খেলোয়াড়দিগ লইয়া মাতিয়া উঠিল। মেসি-কাকারা ষোড়ষীদিগের গোপন প্রকোষ্ঠের কাঁঠালচাঁপা গন্ধে হারাইবার সুযোগ হারাইলেন। সুযোগসন্ধানী জর্মন স্ট্রাইকারেরা প্রান ভরিয়া সেই গন্ধ লইতে লাগিলেন। রাত্রি গভীর হইল। চপলার চপল কল্পনায় আর বয়সোচিত রাগে কোলবালিশেরা একবার বালাক আরেকবার ম্যাসুট ওজিল হইতে লাগিল।

মেসি-কাকা নিজ নিজ গৃহে ফিরিয়া সুস্বাদু তরিতরকারী ভক্ষণে ব্যস্ত হইলেন। এবং অবশ্যই, অতি অবশ্যই, ক্ষনে ক্ষনে বালাক, ম্যাসুট ও কোলবালিশদিগে চরম ঈর্ষা করিলেন। ওরে কোলবালিশ, ভাগ্য লইয়া জন্মাইয়াছিলি বটে!

---------------
আসাদ-বাবু
ইমেইলঃ


মন্তব্য

প্রখর-রোদ্দুর এর ছবি

হা হা হা হা - খাশা জনাম খাশা ।

হাসিতে হাসিতে পেটের খিলান হইতে কব্জার খিড়কি খানা উঠিয়া আসিবার যোগাড় হইয়াছে ।

ভালো লাগলো

আসাদ-বাবু [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ প্রখর-রোদ্দুর

আসাদ-বাবু [অতিথি] এর ছবি

'মহোদয়' বানান ভুল করলাম!! তেব্র ধিক্কার নিজেরে মন খারাপ

আসাদ-বাবু [অতিথি] এর ছবি

@প্রখর-রোদ্দুর: ধন্যবাদ।

ঘুমের তোড়জোড় করতে গিয়া তাড়াহুড়ায় ব্যাপক বানান ভুল করছি মন খারাপ ... না জাইনাও হয়তো কিছু ভুল করছি...ক্ষেমা...ক্ষেমা...

জি.এম.তানিম এর ছবি

বেশ ভালো লাগলো আসাদ ভাই। মজা পেলাম অনেক!
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

আসাদ-বাবু [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ তানিম হাসি

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

হাসিবো কী কাঁদিবো বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিনা, তবে জব্বর লিখিয়াছেন বটে!

-----------------------------------------------------------------------------------
...সময়ের ধাওয়া করা ফেরারীর হাত থিকা যেহেতু রক্ষা পামুনা, তাইলে চলো ধাওয়া কইরা উল্টা তারেই দৌড়ের উপরে রাখি...

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

আসাদ-বাবু  [অতিথি] এর ছবি

হাস্যের ন্যায় ক্রন্দনও একখানা বিশুদ্ধ আবেগ। কাঁদিলে মন্দ হয় না। ( অজ্ঞাতে একখানা কালজয়ী ট্র্যাজেডি রচনা করিয়া ফেলিলাম কিনা সর্বশক্তিমান জানেন! )

ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

আসাদ ভাই, ফাটাইয়া ফেলছেন... আপনার কোলবালিশ তথা নিদ্রাময় ফুটবল যুদ্ধে আমরা হাসিতে হাসিতে পেটে খিল ধরাইয়া বসিয়া রহিয়াছি... ;-D
--শফকত মোর্শেদ

আসাদ-বাবু [অতিথি] এর ছবি

ভ্রাতঃ, আপনি তো অধমকে পূনঃরায় কনফিউজ্‌ড করিয়া দিলেন।

এক বালিকা কাঁদিবার আয়োজন করিতেছে, অন্যদিকে আপনি হাসির দমকে কাঁপিয়া উঠিতেছেন! কি লিখিলাম?! ট্র্যাজিডি না রম্য? ( এইডা মুনে হয় কিছুয় অয় নাই দেঁতো হাসি )

ধন্যবাদ, শফকত মোর্শেদ।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

একটা প্রশ্ন,
রম্য মানেই কি সাধু ভাষায় লিখতে হবে?

আসাদ-বাবু [অতিথি] এর ছবি

মোটেই না। আবার লিখতেও তো মানা নেই, তাই না?

ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

আজি হইতে পূনর্বার কোলবালিশদিগের নিষ্পেশন শুরু হইয়া গেল...!

আসাদ-বাবু [অতিথি] এর ছবি

হাসি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

জোসস গুরু গুরু

________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

আসাদ-বাবু [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ। ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।