বড় আম্মা।

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৩/১২/২০১০ - ১:১৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শামীম।

আমরা ডাকতাম বড় আম্মা। আম্মা আব্বা ডাকতেন “নানীজী”। প্রথম দিকের স্মৃতি যা মনে পড়ে তা হলো সাদা শাড়ি পরা একজন বুড়ো মানুষ। সফেদ চোখ মুখ। বিড়ালের চোখের মতো ঘোলা চোখ। হাতে তসবি। জায়নামাজে বসা। আমার স্বল্প স্মৃতিতে বড় আম্মাকে কখনো জায়নামাজ ছাড়া অন্য কোথাও দেখিনি। তাকালেই মনে একটা শান্তি শান্তি ভাব চলে আসত।
বড় আম্মার ছেলে ছিলেন একজন। আম্মার মামা। আম্মা বলতেন মামুজী। চিটাগাংএর মাঝারি মানের ব্যবসায়ী। সড়ক দূর্ঘটনায় তিনি মারা যাবার পর বড় আম্মা অতি দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে যেতে লাগলেন। সফেদ চামড়া আরো সফেদ হয়ে গেলো। দেখাশোনার জন্য আমার এক মামা চলে আসলেন তাঁর কাছে। মামাকে শেষে বিয়ে করে নানা বাড়িতেই থেকে যেতে হলো নানীজীর সেবা করার জন্য। আমাদের বাড়ী থেকে হেঁটে যেতে সময় লাগতো মিনিট দশেক, তাই আব্বা আম্মার দায়িত্ব ছিলো বড় আম্মার খোঁজ খবর রাখা। আমাদের আকর্ষণ ছিলো অন্য জায়গায়। শুধু মাত্র বড় আম্মাকে দেখতে গেলেই আমরা ছোটরা মগভর্তি লাল চা খেতে পারতাম, কেউ চোখ রাঙ্গাতো না। গরম চায়ের সাথে মুড়ি ভিজিয়ে খাওয়া...আহা!!
আম্মার মামাতো ভাই বোনেরা মায়ের সাথে চট্টগ্রামে স্থায়ী হয়ে গেলেন। বড় আম্মা নিজের মানুষবিহীন হয়ে এক নাতি আর নাত বউকে নিয়ে সময় কাটাতে লাগলেন। বড় আম্মাকে দেখতে যাওয়ার পেছনে আমাদের আরো দুটো কারন ছিলো। প্রথমটা হচ্ছে, ঢোকার মুখে হাতের বাঁ পাশে বহু পুরনো আমলের সোফাসেট। ফোম বিহীন। তার বদলে ছিলো প্লাস্টিকের একধরনের কাভার। বস্লে স্প্রিং এর মতো লাফিয়ে উঠতো। আমাদের অতি অবশ্য কাজের মধ্যে ছিলো বড় আম্মাকে সালাম দিয়ে লাল চার সন্ধান, সেটা হয়ে গেলে সেই সোফায় উঠে লাফালাফি এবং লাফালাফির এক পর্যায়ে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া। বাড়ি ফিরতাম আব্বার কাঁধে করে ঘুমন্ত অবস্থায়। ২য় কারন ছিল বড় আম্মা যে ঘরে থাকতেন সে ঘরের সামনের দিকটায় ছিল বারান্দা। দিনের বেলায় গেলে মূল ঘরের চাল থেকে স্লিপ করে বারান্দার চালে এসে থামার সে এক দূর্দান্ত খেলা আমরা আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম। ঘরের ভিতরের লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচি বা ধমক শুনে সময় নষ্ট করার সময় আমাদের কারোরই ছিলোনা। ফিরতাম হাফপ্যান্টের পিছনে টিনের চালের যাবতিয় ময়লা এবং জং নিয়ে। সেগুলো ধুতে আম্মার বারোটা বেজে যেতো এখন সেটা বুঝতে পারি।
বড় আম্মার পরহেজগারীর গল্প শুনতাম। বড় আব্বা (আম্মার নানা) মারা যাবার পর থেকে তিনি কোন বেগানা পুরুষের সাথে দেখা করেননি। আব্বা ছিলেন উনার ডাক্তার এবং ছেলের মতো। নাত্নির জামাই। সে হিসাবে হয়তো ছাড় ছিলো কিছুটা আব্বার জন্য। রাতদিন ২৪ঘন্টাই ইবাদত নিয়ে থাকতেন। খেতেন খুব সামান্য। বাচ্চা কাচ্চাদের পরম আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। বাপ মার পিটুনি থেকে বাঁচতে চাইলে শুধুমাত্র বড় আম্মার আশপাশে আসলেই মুশকিল আসান। তাঁর বিশ পঁচিশ গজের মধ্যে কোন রকম চিৎকার চেঁচামেচি বন্ধ।আমি কখনই তাঁকে কোথাও যেতে দেখিনি। অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার পর নাতিরা ঢাকা নিতে চাইলেন, চিটাগং নিতে চাইলেন ডাক্তার দেখানোর জন্য, বড় আম্মা নড়েন নি। একবার বড় মামা অনেক কৌশল করে একটা ছবি তুলেছিলেন। বড়ো আম্মা খুব মন খারাপ করেছিলেন। সবাইকে ওয়াদা করতে হয়েছিলো এই ছবি বাইরের কাউকে দেখানো হবেনা। সেই সাদাকালো ছবি বড় ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখা হলো, ছবির সামনে ছিলো জানালার পর্দার মতো পর্দা লাগানো। বড় আম্মাকে দেখতে মন চাইলে পর্দা ফাঁক করে দেখে আবার ঠিক করে রাখতে হতো। আব্বা, আম্মা, মামাদের দেখেছি সেই ছবি দেখে চোখের পানি মুছতে।
বড় আম্মা হঠাত করে খুব বেশী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আব্বার ডিউটি বেড়ে গেলো। গভীর রাতে দেখতে যেতে হতো। তারপর একদিন রাতে খবর আসলো বড় আম্মা মারা গেছেন। শোক বোঝার বয়স মনে হয় তখন হয়নি। কান্নাকাটি করেছিলাম কিনা মনে পড়ছেনা। এখন যখন কোন বৃদ্ধাকে দেখি সাদা শাড়ি পরে আছেন, বড় আম্মার সফেদ মুখ চোখের সামনে চলে আসে। কিছু মানুষ কিভাবেই না অবুঝ চোখ পেরিয়ে মন মগজের গভীরতায় কোথায় হারিয়ে যান! আবার কোথা থেকে মনের মাঝে হাজির হয়ে যান বুঝতে পারিনা।
বড় আম্মারা এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছেন। আমরা বুঝতেও পারিনা কি হারিয়ে ফেলছি! যখন বুঝতে পারি তখন জবরজং জগত এতো বেশী সত্য হয়ে যায়, বড় আম্মাদের মনে হয় সুদূর প্রবাসের মানুষ, যাদের মনের চোখেই ভালো দেখতে পারা যায়।


মন্তব্য

নুসদিন এর ছবি

ঈদের দুই দিন পরই আমার দাদী মারা যায়। যে মানুষ এতদিন আমাদের সাথে ছিল, এত বড় করলো তাকে চোখের সামনে মারা যেতে দেখা যে কী কষ্টের, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এখনও বিশ্বাস হয় না কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে কি হয়ে গেল, কিছুইতো বুঝলাম না। আসলেই, হারানোর পর বুঝি, কী হারালাম মন খারাপ

কৌস্তুভ এর ছবি

মন খারাপ

তিথীডোর এর ছবি

মন খারাপ করা লেখা...

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

কাঠপুতুল এর ছবি

আপনার লেখা পড়ে চোখে জল এসে পড়ল। লিখতে বাধ্য করল এটা।

এমনি মানুষ সবার জীবনে এসেও আসে না। তাঁদের জন্য অন্তহীন শ্রদ্ধা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।