অসামান্য ছেলেখেলার যৎসামান্য ছেলেবেলা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২৯/১২/২০১০ - ৭:২৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছোটবেলা থেকেই আমার অনেক কিছু পারার বড় শখ। পড়াশুনা, খেলাধূলা, গানবাজনা, সাইকেল চালনা ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে জাহির করা মুখ্য উদ্দেশ্য। যেন সবাই অন্তত পিঠ চাপড়ায়। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তির নির্মম পরিহাস! আমি পারতে শিখি শুধু একটা জিনিসই; তা হল কোনো কিছু না পারতে কিংবা পারা একটা সহজ কাজকে পাড়া দিয়ে দলা পাকিয়ে দিতে। ফলস্বরূপ প্রায়শই আমি পিঠ চাপড়ানোর পরিবর্তে হজম করতাম পিঠে থাপড়ানো। আর আমার কঞ্চিসদৃশ না একেবারে চা-চামচ সদৃশ স্লিম ধড়ের কল্যাণে সর্বদাই দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেতাম সবার। খেলাধূলার কথাই বলি আগে। আমার খেলার প্রতি নিজের আকাঙ্ক্ষা আর আসক্তির তিলপরিমাণ কোনো অভাব না থাকলেও শুধুমাত্র সবার চোখে যোগ্যতার অভাব বিলক্ষণ বিদ্যমান ছিল। খুব ছোটবেলায়, গ্রামের বাড়িতে আমাদের মস্ত এক উঠোন ছিল। আমরা চাচাতো-ফুপাতো ভাইবোন মিলে খেলাধূলা করতাম সেখানে। আমি সেখানেও আমড়া কাঠ। আর তাই সব খেলাতেই দ্বাদশ খেলোয়াড়! আমার ঝোঁক ছিল মার্বেল আর লাটিম খেলার উপর। কি সুন্দর করে আমার চাচাতো ভাইয়েরা মার্বেল খেলত যে কী বলবো! এখনো চোখে ভাসে। ডান হাতের মধ্যমায় মার্বেল চেপে বাম হাত দিয়ে কি নিপুণ দক্ষতায় ছুঁড়ে দিত মার্বেলটা। টক্‌ করে গিয়ে লাগত ঠিক নির্ধারিত মার্বেলে কিংবা ঠিকই সেই নির্দিষ্ট গর্তে গিয়ে পড়ত। আমি একদিন ঠিক করলাম মার্বেল খেলবো। গিয়ে যোগ দিলাম বিপুল উৎসাহে। সেখানে আমি সহ মোট চারজন ছিলাম খেলোয়াড়। জায়গাটার সামনেই আমার চাচীর পালিত সদ্যবাচ্চা হওয়া একটা দশাসই সাইজের দেশী মুরগি তার দঙ্গল নিয়ে চরে বেড়াচ্ছিল। মুরগিটা বাচ্চা হওয়ার পর থেকে মারাত্মক হিংস্র স্বভাবের হয়ে গেছে। কাউকে আশপাশে যেতে দেখলেই কঁ কঁ করে তেড়ে আসে। আমি ব্যাপক ভয় পেতাম ওটাকে। বিশেষ করে ওটার শান দেয়া ঠোঁটটাকে। কেমন চকচকে ধারালো। আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে কোনো সুদক্ষ কামারের কাছে নিয়মিত ধার দেয় সেটা। নিজের অজান্তেই ওর শিকার হয়েছিলাম একবার। পার্মানেন্ট সিল বসিয়ে দিয়েছে পায়ে। তারপর থেকে পারতপক্ষে ওটার আশপাশে ঘেঁষতাম না।

তো যাই হোক গিয়ে বসলাম মার্বেল নিক্ষেপে। বাম হাতে মার্বেল ধরে মুখে যথাসম্ভব চৌকস ভাব ফুটিয়ে তুলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনিস খেলোয়াড়ের মত কোঁকানো শব্দে ছুঁড়লাম আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে। থমথমে আমেজে সবাই আশপাশে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল কি হয়। সবার চোখ ছিটিয়ে থাকা মার্বেলগুলোর দিকে। কিন্তু নাহ্‌। ইনপুট এনার্জির সাথে প্রত্যাশিত রিয়্যাকশান সময়ের এবং লক্ষ্যস্থানের হেরফের ঘটল। এবং সংঘর্ষের টোনটাও পালটে গেল। যেখানে টক্‌ করে শব্দ হওয়ার কথা সেখানে আওয়াজ শুনলাম কঁক্‌। এবং তখনই দেখলাম প্রায় বোয়িং স্পিডে ছুটে আসা দু-পেয়ে সাক্ষাত খোক্কসীটাকে। পড়িমরি করে ছুটলাম যে যেদিকে পারি। কোনোমতে জান বাঁচালাম এবং অফিসিয়ালি আমি বহিস্কৃত হলাম মার্বেল খেলা থেকে, কেউ আর আমায় নিয়ে জীবনের রিস্কে পড়তে চায় না। বড়ই হৃদয়বিদারক ঘটনা।

কিছুদিন মন খারাপ রইল। তারপর আবার ঝোঁক উঠল লাটিম খেলার। তখন সারা গ্রাম জুড়ে ছেলেদের মধ্যে এই খেলা নিয়ে ধুন্ধুমার অবস্থা। এমনকি পাড়া-পাড়া, গ্রাম-গ্রাম প্রতিযোগিতাও চলতে লাগল। আমি ঠিক করলাম লাটিম খেলা শিখতেই হবে। না-হলে বন্ধুমহলে আর মানইজ্জত থাকছে না। স্কুল, মাঠ, মুদির দোকান, চা-এর দোকান, নদীর ধার সব জায়গাতেই লাটিম এবং লাটিম বিষয়ক আলোচনার ছড়াছড়ি। কে কবে কার কয়টা লাটিমের চরকিরত ভবলীলা সাঙ্গ করে কত নাম কুড়ালো এই আলোচনা। তো দুই টাকা দিয়ে কিনে আনলাম জাঁদরেল সাইজের লাল রঙ এর একটা লাটিম আর তা ঘোরানোর ফিতা। গ্রামের ভাষায় লাটিমকে আমরা বলতাম “লাট্টু”। আমি এর আগে কখনো লাট্টু ঘুরাইনি। অবশ্য দেখেছি কিভাবে ঘুরায়। সূঁচালো অংশ থেকে শুরু করে ফিতা পেঁচিয়ে তারপর আঙ্গুলের ফাঁকে অপরপ্রান্ত ধরে ছুঁড়ে দিতে হয়। এ আর এমন কঠিন কী? কিন্তু টের পেলাম খেলতে গিয়ে। যারা এই জিনিস খেলেছেন তারা ভালো করেই জানেন এই খেলার নিয়ম। মাটিতে একটা বৃত্ত এঁকে তার মধ্যে লাট্টু ছোঁড়া হয়। এবং প্রতিপক্ষ তার লাট্টু দিয়ে অপরপক্ষের লাট্টুকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। বৃত্তের মধ্যে তখন আমার এক কাজিনের লাট্টু একমনে ঘুরে চলেছে। কখন তার উপর মারণ আঘাত হানবে আমার লাট্টুর পেরেক সেই ভয়ংকর অপেক্ষায়। আমি মুখে একটা ক্রুর হাসি হেসে ধীরে ধীরে আমার লাট্টুর সতর ঢাকলাম। তারপর হাত টেনে পেছনে নিয়ে প্রায় অমানুষিক শক্তিতে ছুঁড়লাম তার দিকে। সবাই সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে নিল বৃত্তকে কেন্দ্র করে। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি! সবাই নিশ্চিত ভাবে ঐ লাট্টুর নৃশংস ব্যবচ্ছেদের অপেক্ষায় তাকিয়ে। হাতের ফিতা এহেন আচমকা হ্যাচকা টানে দুই পাক খেয়ে মূর্ছা গেল। কিন্তু নাহ্‌, বৃত্তের মধ্যে ঐ লাট্টু ছাড়া কিছু নেই। কি হল? এবং মুহূর্ত পরেই কান ফাটানো এক মেটালিক আওয়াজ পেলাম। অকুস্থলের অদূরেই আমাদের টিনশেড দেয়া রান্নাঘর, আম্মু রান্নাঘরে তখন রান্না করছিলেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তার ছাদে গিয়ে ক্র্যাশল্যান্ডিং করেছে আমার মারণাস্ত্র। শুধু তাই না। তার শব্দে ভয় পেয়ে আম্মু দিলেন এক লাফ। সেই লাফের আঘাতেই হোক আর শব্দের প্রচন্ডতায় হোক, পাশে থাকা পানিভর্তি মাটির কলসটা বলা নেই কওয়া নেই, ভট্‌ করে গেল ফেটে। মাটির মেঝের সেই রান্নঘরে তখন ক্লাইমেট চেঞ্জ এর ভয়ংকর এফেক্ট! হঠাৎ করে মৌসুমে না হওয়া এই আকস্মিক বন্যায় কি রকম তান্ডব চালানো উচিত তা ভেবে না পেয়ে ছড়ে পড়া পানিগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আম্মু কোনওমতে বাঁচলেন বটে আছাড় না খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে কিন্তু প্রায় তখনই ঘটল আরও ভয়ংকর একটা ব্যাপার। আব্বু শব্দ শুনে কি হয়েছে তা দেখতে রান্নাঘরে ঢুকলেন টিনের দিকে তাকাতে তাকাতে। বেচারা মাটিতে হতভম্ব হয়ে থাকা পানি হঠাৎ এই অপরিচিত আগন্তুককে দেখে ভড়কে গিয়ে আগপাছ কিছু না ভেবেই মারল এক ল্যাং। আর তাতে আব্বুর নাদুসনুদুস দেহখান তাল হারিয়ে গিয়ে পড়ল ঘরের মাঝখানে প্রচন্ড ভূ-কম্পনে। আম্মু রান্না করার জন্যে বিভিন্ন টাইপের সবজি কেটে আলাদা আলাদা করে সাজিয়ে রেখেছিলেন। সেগুলো হঠাৎ দেখলাম একত্রে লাফিয়ে উঠল, যেন হাইজাম্প হাইজাম্প খেলছে। তারপর গিয়ে পড়ল এলোপাতাড়িভাবে সারা ঘর জুড়ে। আব্বু নিজেকে তখন আবিস্কার করলেন ছড়িয়ে থাকা তরকারির মধ্যে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে। চোখের পলকে ঘটে গেল পুরা ঘটনাটা। আমাদের ঘোর তখনও কাটেনি। ভাবলাম আব্বুর ভাগ্যে এবার মনে হয় খারাপই আছে। এই মুহূর্তে মনে হয় বাসায় কচু নেই আর তাই আম্মু এবার নির্ঘাত আব্বুকে কচুকাটা করে সিদ্ধ করে ফেলবেন। দুপুরে জম্পেশ একটা খাওয়া হবে এবার। কিন্তু নাহ্‌, আমাদের সেই মুখরোচক স্বাদের আশু সম্ভাবনায় পানি ঢেলে আম্মু তেড়ে বের হয়ে আসলেন, তবেরে সব নচ্ছাড়ের দল! আমাদের তখন আর পায় কে?

সেদিন কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছিলাম শুধুমাত্র আগের জন্মের পুণ্যের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া এজন্মের সচল এই পা-দুটোর বদৌলতে। শুরুতেই এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতাতেও আমার উৎসাহের কোনো ভাটা পড়ল না। চলতে থাকল আমার লাট্টু খেলা। তবে মাটিতে আঁকা বৃত্তের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকলনা। অন্যদের স্কিল তো কম ছিল। তাই তার গন্ডি ঐ বৃত্তের বাইরে যেতে পারেনি। কিন্তু আমার হাতের চতুর্মাত্রিক দক্ষতায় তা ছড়িয়ে পড়ল সারা বাড়ি জুড়ে। টিনের চালা, ঘরের ছাদ, নারকেল গাছ, পাশের ডোবা, গরুর গোয়াল, মাটির চুলা, বারান্দা, চাপকলের পাড় কোনোকিছুই আয়ত্তের বাইরে গেল না। যেন চারিদিক থেকে উল্কাবর্ষণ হচ্ছে। আমার প্রাণপ্রিয় সে লাট্টুও তার জীবন বাজি রেখে আমাকে সঙ্গ দিয়ে যেতে লাগল। মুহুর্মুহু আঘাতে তার ছাল-বাকলা উঠে একেবারে লন্ডভন্ড অবস্থা। সূঁচালো পেরেকের মাথাও বেঁকে গেছে। সেটা নিয়েও সে কুঁজো হয়ে ঘুরতে পারে। তবে আমার হাতে তার ঘূর্ণনগতির চাইতে প্রাসগতির অভিজ্ঞতাই হয় বেশি। আর সেই তান্ডবের ভয়ে খেলার সময় আমার কাজিনরা সব আমার পেছনে দাঁড়ায়, অতি সাবধানে। তারা আমায় নিয়ে খেলতে আগ্রহী হলেও আমার অতি উৎসাহের বলি হতে কোনোমতেই ইচ্ছুক নয়। আমার সে অতিপ্রিয় লাট্টুকে একদিন এক আঘাতে দুভাগ করে দিল আমার কাজিন তার লাট্টু দিয়ে, সেই বৃত্তের ভেতরে। এবং আমার কষ্টের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি না জানিয়ে যেন সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যে লাট্টু জীবনেও তার মালিকের মাধ্যমে এ বৃত্তে প্রবেশের সুযোগ বা অনুমতি পায়নি শুধু আজ ছাড়া, সেই আজই তার সৎকার ঘটল এই বৃত্তের ভেতরে। চেয়ে দেখলাম নিথর দেহের মাঝখানে বেরিয়ে পড়া মরিচাধরা পেরেকের ঊর্ধ্বাংশ। এহেন নির্মম হত্যাকান্ডের সরব প্রতিবাদ জানাতে তাদেরকে আমি বয়কট করলাম পরেরদিন থেকে লাট্টু খেলায়। তবে হারানোর ব্যথায়-শোকে-কাতরে আমি লাট্টু খেলা সেবারের মত ছেড়ে দিলাম।

আমি তখন ক্লাস ওয়ান কিংবা টু-এ। গ্রামে টেনিস বল এসেছে আগেই। কিন্তু খেলার প্রচলন বেশি হাইস্কুল বা কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের মধ্যে। আমরা সেখানে নির্বাসিত। ছোটদের নাকি সেটা খেলার বয়স হয়নি। আর তাই আমরা শুধু চেয়ে দেখতাম তাদের হাতের মুঠোয় সেটা লাফাতে লাফাতে নিয়ে যেতে কিংবা মাঠে খেলতে। তাছাড়া গ্রামের অধিকাংশ ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পরিবারই গরিব। তারা তাই এমন সব খেলা বেশি খেলে যাতে কোনো যন্ত্রপাতি লাগে না, শুধু জায়গা লাগে। যেমন দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, লুকোচুরি ইত্যাদি। আমার সাথে যারা ছিল তাদের সাথেও এমন খেলা হত বেশি; যদিও নিজের কাজিন ছাড়া অন্যদের সাথে আমার মেশার সুযোগ তেমন ঘটেনি। ছোটদের মাত্র কয়েকজনের কাছে ছিল এমন বল। তাদেরকে দেখতাম সেটা দিয়ে ক্রিকেট না খেলে “পিঠমাইর” নামে এক অভিনব কিন্তু চপেটাঘাত-বহুল এই খেলা খেলতে। তাছাড়া ব্যাট বানানো এক ঝামেলা। কিনতে গেলে অনেক দাম। আবার বড়দের ব্যাট দিয়ে খেলবে তাতেও এক মুসিবত। একে সাইজ তো মোটামুটি মাথা ছুঁইছুঁই তার উপর শুধুমাত্র হ্যান্ডেল আয়ত্তে আনতেই চার হাত-পা কাহিল হয়ে যায়। তো সেই পিঠমাইর খেলা কয়েকদিন দেখে আমারও অনেক শখ জাগল। সে কি উত্তেজনা সে খেলায়। বল ধর আর জোরসে মারো যাকে বাগে পাও তার দিকে। মারার আগে ছুঁয়ে দিতে পারলে আর তাকে মারা যাবে না। অন্যকে মারতে হবে। আবার তেড়ে গিয়েও মারা যাবে না। বল যেখানে পাবে সেখান থেকেই মারতে হবে। আব্বুর কাছে বায়না ধরলাম। প্রথমে না করলেও পরের দিন ঠিকই পেয়ে গেলাম আমার আহলাদের ধন, সবুজ বর্ণের। তাতে কি সুন্দর সাদা ডোরাকাটা। প্রথমদিন সেটা কারো হাতে ধরতেই দিলাম না। এমনকি মাটিতেও ফেললাম না ময়লা হওয়ার ভয়ে। রাতে সেটাকে পাশে নিয়ে ঘুমালাম যাতে তাকে কেউ চুরি করে নিয়ে না যায় কিংবা একলা একলা খাটের নিচে থেকে ভয় না পায় সে। আম্মু টের পেলেন আমার হাস্যকর কীর্তিকলাপ। পরেরদিন ডেকে বললেন যে বলটা খেলার জন্যে; যদি না খেল তবে তো বলটার মূল্যই থাকল না। প্রথমে না না করলেও পরে নিজেই বুঝলাম।

শুরু হল আমাদের পিঠমাইর। আমরা কাজিনরা মিলে তিন চার জন আর আশপাশের এলাকার তিন চার জন। একেবারে টিপু সুলতানের কুরুক্ষেত্র বেধে গেল। যে যেমনে পারছে গোলা নিক্ষেপ করছে। মজার ব্যাপার হল এই টেনিস বলও আমাদের গ্রামে টিপু-বল নামে প্রচলিত ছিল, এখনও আছে। যাই হোক খেলার সময় নিজের অবস্থান ভুলে আমি ভয়ে ভয়ে আছি, বলটা না ব্যথা পায়। একেকজনের যে দামড়া শরীর! মাঝখানে আমারই শুধু নিজেকে পুটি মাছ মনে হল। হ্যাঙ্গার মার্কা চেহারা হোক আর বলের মালিকানার বদৌলতেই হোক, কেন জানি সবাই আমাকে এড়িয়ে চলছিল। অর্থাৎ আমার দিকে কেউ বল নিক্ষেপ করে না। আমি বল পেতে লাগলাম কম। শুধু মাঝখানে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যেগুলো আসে সেগুলো আমি পাই। তবে আমি লক্ষ্য করলাম যে আমি বল পেলে আর কেউ তেমন ছুটোছুটির জন্যে হুড়োহুড়ি লাগায় না। এবং এর যথোপযুক্ত কারণ টের পেলাম একটু পরেই। আমার হাতে বল তখন। সবচেয়ে কাছে আছে আমার ফুফাত ভাই মানিক। নিশানার চুলচেরা বিশ্লেষণে এক চোখ বন্ধ করে ঠিকমত হাত পেছনে টানলাম বলসমেত। আমার হাতে তখন মনে হয় দুই-তিনটা টাইফুন জন্ম নিয়ে নিয়েছে ইতোমধ্যে। পালাবি কোথায় এই মর্মে ধুম করে ছুঁড়লাম বল মানিক ভাই এর দিকে। কিন্তু এ কি! মানিক ভাইএর চেহারা সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন। আমার সেই ছোঁড়া আগুনঝরা গোলা যে ধাবিয়ে যাচ্ছে তার দিকে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নাই। বরং মারার সাথে সাথে আমিই শংকিত হয়ে উঠলাম না জানি কি হয়। খেলতে গিয়ে না আবার পিঠ মালিশ করা লাগে! কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, দুই-তিনবার কান চুলকে আরামসে একখান ঢেকুর তুলে বাম হাত দিয়ে বলটাকে কুক্ষিগত করল মানিক ভাই উদাস দৃষ্টিতে! এ কি চোখের ভুল? এটা কিভাবে সম্ভব হল আজও আমি বুঝি নাই। বল ছুঁড়ল “ব্রেট লি” আর বল পৌঁছাল এমনভাবে যেন ছুঁড়েছে “আশরাফুল”। যাই হোক এত কিছু বোঝার সময় নেই তখন। আমি তার সামনে। পালাবার জন্যে জায়গা খুজতে লাগলাম। কিন্তু চোখে শুধু মানিক-মুখী এভিনিউ-টাই ধরা পড়ল। কি আর করা? উলটা দৌড় দিলাম। আশ্চর্যের বিষয়, তখন বাগে থাকা সত্ত্বেও মানিক ভাই আমার দিকে বল মারলেন না। সামনে ছুটতে ছুটতে বেশ কিছুদূর গিয়ে ভাবলাম আর মনে হয় মারবেন না। আর ঠিক তখনই পিঠে ঠাস্‌ করে একটা বজ্রপাত হল। কোনোমতে আকাশের দিকে মুখ তুলে বোঝার চেষ্টা করলাম যে, আসলেই শরতেও আকাশে বিদ্যুৎ চমকায় কিনা। কিন্তু পারলাম না। দুচোখের সামনে মূর্তিমান তখন দুই দুগুণে চার বিঘা সর্ষে ক্ষেত; একেবারে বাম্পার ফলনে সয়লাব। টলতে টলতে গিয়ে আরও কিছুদূর সামনে সেই বাম্পার ফলনযুক্ত সর্ষে ক্ষেত সমেত ভূপাতিত হলাম।

পুনশ্চঃ সেই বল দিয়ে আর পরে শৈশবে থাকাকালীন পর্যন্ত পিঠমাইর খেলার দুঃসাহস হয়নি। বরং কাউকে খেলতে দেখলেই পিঠে বজ্রপাতের আর চোখে সর্ষে ক্ষেতের পূর্বাভিজ্ঞতার ছটা অনুভব করতাম। আর তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে পেরেছি, এবং মনে হলেই শিউরে উঠি যে যদি সেইদিন মানিক ভাই বল পাওয়ার সাথে সাথেই মারতেন; তবে নিশ্চিত আজ আমি সর্ষে ক্ষেতে না থাকলেও পটলক্ষেতে থাকতাম। যে ঋতুই হোক না কেন।

-অতীত


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

অতিথি লেখক লিখেছেন:

ছোটবেলা থেকেই আমার অনেক কিছু পারার বড় শখ। পড়াশুনা, খেলাধূলা, গানবাজনা, সাইকেল চালনা ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে জাহির করা মুখ্য উদ্দেশ্য। যেন সবাই অন্তত পিঠ চাপড়ায়। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তির নির্মম পরিহাস! আমি পারতে শিখি শুধু একটা জিনিসই; তা হল কোনো কিছু না পারতে কিংবা পারা একটা সহজ কাজকে পাড়া দিয়ে দলা পাকিয়ে দিতে। ফলস্বরূপ প্রায়শই আমি পিঠ চাপড়ানোর পরিবর্তে হজম করতাম পিঠে থাপড়ানো। আর আমার কঞ্চিসদৃশ না একেবারে চা-চামচ সদৃশ স্লিম ধড়ের কল্যাণে সর্বদাই দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেতাম সবার। খেলাধূলার কথাই বলি আগে। আমার খেলার প্রতি নিজের আকাঙ্ক্ষা আর আসক্তির তিলপরিমাণ কোনো অভাব না থাকলেও শুধুমাত্র সবার চোখে যোগ্যতার অভাব বিলক্ষণ বিদ্যমান ছিল। খুব ছোটবেলায়, গ্রামের বাড়িতে আমাদের মস্ত এক উঠোন ছিল। আমরা চাচাতো-ফুপাতো ভাইবোন মিলে খেলাধূলা করতাম সেখানে। আমি সেখানেও আমড়া কাঠ। আর তাই সব খেলাতেই দ্বাদশ খেলোয়াড়! আমার ঝোঁক ছিল মার্বেল আর লাটিম খেলার উপর। কি সুন্দর করে আমার চাচাতো ভাইয়েরা মার্বেল খেলত যে কী বলবো! এখনো চোখে ভাসে। ডান হাতের মধ্যমায় মার্বেল চেপে বাম হাত দিয়ে কি নিপুণ দক্ষতায় ছুঁড়ে দিত মার্বেলটা। টক্‌ করে গিয়ে লাগত ঠিক নির্ধারিত মার্বেলে কিংবা ঠিকই সেই নির্দিষ্ট গর্তে গিয়ে পড়ত। আমি একদিন ঠিক করলাম মার্বেল খেলবো। গিয়ে যোগ দিলাম বিপুল উৎসাহে। সেখানে আমি সহ মোট চারজন ছিলাম খেলোয়াড়। জায়গাটার সামনেই আমার চাচীর পালিত সদ্যবাচ্চা হওয়া একটা দশাসই সাইজের দেশী মুরগি তার দঙ্গল নিয়ে চরে বেড়াচ্ছিল। মুরগিটা বাচ্চা হওয়ার পর থেকে মারাত্মক হিংস্র স্বভাবের হয়ে গেছে। কাউকে আশপাশে যেতে দেখলেই কঁ কঁ করে তেড়ে আসে। আমি ব্যাপক ভয় পেতাম ওটাকে। বিশেষ করে ওটার শান দেয়া ঠোঁটটাকে। কেমন চকচকে ধারালো। আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে কোনো সুদক্ষ কামারের কাছে নিয়মিত ধার দেয় সেটা। নিজের অজান্তেই ওর শিকার হয়েছিলাম একবার। পার্মানেন্ট সিল বসিয়ে দিয়েছে পায়ে। তারপর থেকে পারতপক্ষে ওটার আশপাশে ঘেঁষতাম না।

তো যাই হোক গিয়ে বসলাম মার্বেল নিক্ষেপে। বাম হাতে মার্বেল ধরে মুখে যথাসম্ভব চৌকস ভাব ফুটিয়ে তুলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনিস খেলোয়াড়ের মত কোঁকানো শব্দে ছুঁড়লাম আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে। থমথমে আমেজে সবাই আশপাশে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল কি হয়। সবার চোখ ছিটিয়ে থাকা মার্বেলগুলোর দিকে। কিন্তু নাহ্‌। ইনপুট এনার্জির সাথে প্রত্যাশিত রিয়্যাকশান সময়ের এবং লক্ষ্যস্থানের হেরফের ঘটল। এবং সংঘর্ষের টোনটাও পালটে গেল। যেখানে টক্‌ করে শব্দ হওয়ার কথা সেখানে আওয়াজ শুনলাম কঁক্‌। এবং তখনই দেখলাম প্রায় বোয়িং স্পিডে ছুটে আসা দু-পেয়ে সাক্ষাত খোক্কসীটাকে। পড়িমরি করে ছুটলাম যে যেদিকে পারি। কোনোমতে জান বাঁচালাম এবং অফিসিয়ালি আমি বহিস্কৃত হলাম মার্বেল খেলা থেকে, কেউ আর আমায় নিয়ে জীবনের রিস্কে পড়তে চায় না। বড়ই হৃদয়বিদারক ঘটনা।

কিছুদিন মন খারাপ রইল। তারপর আবার ঝোঁক উঠল লাটিম খেলার। তখন সারা গ্রাম জুড়ে ছেলেদের মধ্যে এই খেলা নিয়ে ধুন্ধুমার অবস্থা। এমনকি পাড়া-পাড়া, গ্রাম-গ্রাম প্রতিযোগিতাও চলতে লাগল। আমি ঠিক করলাম লাটিম খেলা শিখতেই হবে। না-হলে বন্ধুমহলে আর মানইজ্জত থাকছে না। স্কুল, মাঠ, মুদির দোকান, চা-এর দোকান, নদীর ধার সব জায়গাতেই লাটিম এবং লাটিম বিষয়ক আলোচনার ছড়াছড়ি। কে কবে কার কয়টা লাটিমের চরকিরত ভবলীলা সাঙ্গ করে কত নাম কুড়ালো এই আলোচনা। তো দুই টাকা দিয়ে কিনে আনলাম জাঁদরেল সাইজের লাল রঙ এর একটা লাটিম আর তা ঘোরানোর ফিতা। গ্রামের ভাষায় লাটিমকে আমরা বলতাম “লাট্টু”। আমি এর আগে কখনো লাট্টু ঘুরাইনি। অবশ্য দেখেছি কিভাবে ঘুরায়। সূঁচালো অংশ থেকে শুরু করে ফিতা পেঁচিয়ে তারপর আঙ্গুলের ফাঁকে অপরপ্রান্ত ধরে ছুঁড়ে দিতে হয়। এ আর এমন কঠিন কী? কিন্তু টের পেলাম খেলতে গিয়ে। যারা এই জিনিস খেলেছেন তারা ভালো করেই জানেন এই খেলার নিয়ম। মাটিতে একটা বৃত্ত এঁকে তার মধ্যে লাট্টু ছোঁড়া হয়। এবং প্রতিপক্ষ তার লাট্টু দিয়ে অপরপক্ষের লাট্টুকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। বৃত্তের মধ্যে তখন আমার এক কাজিনের লাট্টু একমনে ঘুরে চলেছে। কখন তার উপর মারণ আঘাত হানবে আমার লাট্টুর পেরেক সেই ভয়ংকর অপেক্ষায়। আমি মুখে একটা ক্রুর হাসি হেসে ধীরে ধীরে আমার লাট্টুর সতর ঢাকলাম। তারপর হাত টেনে পেছনে নিয়ে প্রায় অমানুষিক শক্তিতে ছুঁড়লাম তার দিকে। সবাই সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে নিল বৃত্তকে কেন্দ্র করে। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি! সবাই নিশ্চিত ভাবে ঐ লাট্টুর নৃশংস ব্যবচ্ছেদের অপেক্ষায় তাকিয়ে। হাতের ফিতা এহেন আচমকা হ্যাচকা টানে দুই পাক খেয়ে মূর্ছা গেল। কিন্তু নাহ্‌, বৃত্তের মধ্যে ঐ লাট্টু ছাড়া কিছু নেই। কি হল? এবং মুহূর্ত পরেই কান ফাটানো এক মেটালিক আওয়াজ পেলাম। অকুস্থলের অদূরেই আমাদের টিনশেড দেয়া রান্নাঘর, আম্মু রান্নাঘরে তখন রান্না করছিলেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তার ছাদে গিয়ে ক্র্যাশল্যান্ডিং করেছে আমার মারণাস্ত্র। শুধু তাই না। তার শব্দে ভয় পেয়ে আম্মু দিলেন এক লাফ। সেই লাফের আঘাতেই হোক আর শব্দের প্রচন্ডতায় হোক, পাশে থাকা পানিভর্তি মাটির কলসটা বলা নেই কওয়া নেই, ভট্‌ করে গেল ফেটে। মাটির মেঝের সেই রান্নঘরে তখন ক্লাইমেট চেঞ্জ এর ভয়ংকর এফেক্ট! হঠাৎ করে মৌসুমে না হওয়া এই আকস্মিক বন্যায় কি রকম তান্ডব চালানো উচিত তা ভেবে না পেয়ে ছড়ে পড়া পানিগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আম্মু কোনওমতে বাঁচলেন বটে আছাড় না খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে কিন্তু প্রায় তখনই ঘটল আরও ভয়ংকর একটা ব্যাপার। আব্বু শব্দ শুনে কি হয়েছে তা দেখতে রান্নাঘরে ঢুকলেন টিনের দিকে তাকাতে তাকাতে। বেচারা মাটিতে হতভম্ব হয়ে থাকা পানি হঠাৎ এই অপরিচিত আগন্তুককে দেখে ভড়কে গিয়ে আগপাছ কিছু না ভেবেই মারল এক ল্যাং। আর তাতে আব্বুর নাদুসনুদুস দেহখান তাল হারিয়ে গিয়ে পড়ল ঘরের মাঝখানে প্রচন্ড ভূ-কম্পনে। আম্মু রান্না করার জন্যে বিভিন্ন টাইপের সবজি কেটে আলাদা আলাদা করে সাজিয়ে রেখেছিলেন। সেগুলো হঠাৎ দেখলাম একত্রে লাফিয়ে উঠল, যেন হাইজাম্প হাইজাম্প খেলছে। তারপর গিয়ে পড়ল এলোপাতাড়িভাবে সারা ঘর জুড়ে। আব্বু নিজেকে তখন আবিস্কার করলেন ছড়িয়ে থাকা তরকারির মধ্যে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে। চোখের পলকে ঘটে গেল পুরা ঘটনাটা। আমাদের ঘোর তখনও কাটেনি। ভাবলাম আব্বুর ভাগ্যে এবার মনে হয় খারাপই আছে। এই মুহূর্তে মনে হয় বাসায় কচু নেই আর তাই আম্মু এবার নির্ঘাত আব্বুকে কচুকাটা করে সিদ্ধ করে ফেলবেন। দুপুরে জম্পেশ একটা খাওয়া হবে এবার। কিন্তু নাহ্‌, আমাদের সেই মুখরোচক স্বাদের আশু সম্ভাবনায় পানি ঢেলে আম্মু তেড়ে বের হয়ে আসলেন, তবেরে সব নচ্ছাড়ের দল! আমাদের তখন আর পায় কে?

সেদিন কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছিলাম শুধুমাত্র আগের জন্মের পুণ্যের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া এজন্মের সচল এই পা-দুটোর বদৌলতে। শুরুতেই এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতাতেও আমার উৎসাহের কোনো ভাটা পড়ল না। চলতে থাকল আমার লাট্টু খেলা। তবে মাটিতে আঁকা বৃত্তের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকলনা। অন্যদের স্কিল তো কম ছিল। তাই তার গন্ডি ঐ বৃত্তের বাইরে যেতে পারেনি। কিন্তু আমার হাতের চতুর্মাত্রিক দক্ষতায় তা ছড়িয়ে পড়ল সারা বাড়ি জুড়ে। টিনের চালা, ঘরের ছাদ, নারকেল গাছ, পাশের ডোবা, গরুর গোয়াল, মাটির চুলা, বারান্দা, চাপকলের পাড় কোনোকিছুই আয়ত্তের বাইরে গেল না। যেন চারিদিক থেকে উল্কাবর্ষণ হচ্ছে। আমার প্রাণপ্রিয় সে লাট্টুও তার জীবন বাজি রেখে আমাকে সঙ্গ দিয়ে যেতে লাগল। মুহুর্মুহু আঘাতে তার ছাল-বাকলা উঠে একেবারে লন্ডভন্ড অবস্থা। সূঁচালো পেরেকের মাথাও বেঁকে গেছে। সেটা নিয়েও সে কুঁজো হয়ে ঘুরতে পারে। তবে আমার হাতে তার ঘূর্ণনগতির চাইতে প্রাসগতির অভিজ্ঞতাই হয় বেশি। আর সেই তান্ডবের ভয়ে খেলার সময় আমার কাজিনরা সব আমার পেছনে দাঁড়ায়, অতি সাবধানে। তারা আমায় নিয়ে খেলতে আগ্রহী হলেও আমার অতি উৎসাহের বলি হতে কোনোমতেই ইচ্ছুক নয়। আমার সে অতিপ্রিয় লাট্টুকে একদিন এক আঘাতে দুভাগ করে দিল আমার কাজিন তার লাট্টু দিয়ে, সেই বৃত্তের ভেতরে। এবং আমার কষ্টের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি না জানিয়ে যেন সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যে লাট্টু জীবনেও তার মালিকের মাধ্যমে এ বৃত্তে প্রবেশের সুযোগ বা অনুমতি পায়নি শুধু আজ ছাড়া, সেই আজই তার সৎকার ঘটল এই বৃত্তের ভেতরে। চেয়ে দেখলাম নিথর দেহের মাঝখানে বেরিয়ে পড়া মরিচাধরা পেরেকের ঊর্ধ্বাংশ। এহেন নির্মম হত্যাকান্ডের সরব প্রতিবাদ জানাতে তাদেরকে আমি বয়কট করলাম পরেরদিন থেকে লাট্টু খেলায়। তবে হারানোর ব্যথায়-শোকে-কাতরে আমি লাট্টু খেলা সেবারের মত ছেড়ে দিলাম।

আমি তখন ক্লাস ওয়ান কিংবা টু-এ। গ্রামে টেনিস বল এসেছে আগেই। কিন্তু খেলার প্রচলন বেশি হাইস্কুল বা কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের মধ্যে। আমরা সেখানে নির্বাসিত। ছোটদের নাকি সেটা খেলার বয়স হয়নি। আর তাই আমরা শুধু চেয়ে দেখতাম তাদের হাতের মুঠোয় সেটা লাফাতে লাফাতে নিয়ে যেতে কিংবা মাঠে খেলতে। তাছাড়া গ্রামের অধিকাংশ ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পরিবারই গরিব। তারা তাই এমন সব খেলা বেশি খেলে যাতে কোনো যন্ত্রপাতি লাগে না, শুধু জায়গা লাগে। যেমন দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, লুকোচুরি ইত্যাদি। আমার সাথে যারা ছিল তাদের সাথেও এমন খেলা হত বেশি; যদিও নিজের কাজিন ছাড়া অন্যদের সাথে আমার মেশার সুযোগ তেমন ঘটেনি। ছোটদের মাত্র কয়েকজনের কাছে ছিল এমন বল। তাদেরকে দেখতাম সেটা দিয়ে ক্রিকেট না খেলে “পিঠমাইর” নামে এক অভিনব কিন্তু চপেটাঘাত-বহুল এই খেলা খেলতে। তাছাড়া ব্যাট বানানো এক ঝামেলা। কিনতে গেলে অনেক দাম। আবার বড়দের ব্যাট দিয়ে খেলবে তাতেও এক মুসিবত। একে সাইজ তো মোটামুটি মাথা ছুঁইছুঁই তার উপর শুধুমাত্র হ্যান্ডেল আয়ত্তে আনতেই চার হাত-পা কাহিল হয়ে যায়। তো সেই পিঠমাইর খেলা কয়েকদিন দেখে আমারও অনেক শখ জাগল। সে কি উত্তেজনা সে খেলায়। বল ধর আর জোরসে মারো যাকে বাগে পাও তার দিকে। মারার আগে ছুঁয়ে দিতে পারলে আর তাকে মারা যাবে না। অন্যকে মারতে হবে। আবার তেড়ে গিয়েও মারা যাবে না। বল যেখানে পাবে সেখান থেকেই মারতে হবে। আব্বুর কাছে বায়না ধরলাম। প্রথমে না করলেও পরের দিন ঠিকই পেয়ে গেলাম আমার আহলাদের ধন, সবুজ বর্ণের। তাতে কি সুন্দর সাদা ডোরাকাটা। প্রথমদিন সেটা কারো হাতে ধরতেই দিলাম না। এমনকি মাটিতেও ফেললাম না ময়লা হওয়ার ভয়ে। রাতে সেটাকে পাশে নিয়ে ঘুমালাম যাতে তাকে কেউ চুরি করে নিয়ে না যায় কিংবা একলা একলা খাটের নিচে থেকে ভয় না পায় সে। আম্মু টের পেলেন আমার হাস্যকর কীর্তিকলাপ। পরেরদিন ডেকে বললেন যে বলটা খেলার জন্যে; যদি না খেল তবে তো বলটার মূল্যই থাকল না। প্রথমে না না করলেও পরে নিজেই বুঝলাম।

শুরু হল আমাদের পিঠমাইর। আমরা কাজিনরা মিলে তিন চার জন আর আশপাশের এলাকার তিন চার জন। একেবারে টিপু সুলতানের কুরুক্ষেত্র বেধে গেল। যে যেমনে পারছে গোলা নিক্ষেপ করছে। মজার ব্যাপার হল এই টেনিস বলও আমাদের গ্রামে টিপু-বল নামে প্রচলিত ছিল, এখনও আছে। যাই হোক খেলার সময় নিজের অবস্থান ভুলে আমি ভয়ে ভয়ে আছি, বলটা না ব্যথা পায়। একেকজনের যে দামড়া শরীর! মাঝখানে আমারই শুধু নিজেকে পুটি মাছ মনে হল। হ্যাঙ্গার মার্কা চেহারা হোক আর বলের মালিকানার বদৌলতেই হোক, কেন জানি সবাই আমাকে এড়িয়ে চলছিল। অর্থাৎ আমার দিকে কেউ বল নিক্ষেপ করে না। আমি বল পেতে লাগলাম কম। শুধু মাঝখানে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যেগুলো আসে সেগুলো আমি পাই। তবে আমি লক্ষ্য করলাম যে আমি বল পেলে আর কেউ তেমন ছুটোছুটির জন্যে হুড়োহুড়ি লাগায় না। এবং এর যথোপযুক্ত কারণ টের পেলাম একটু পরেই। আমার হাতে বল তখন। সবচেয়ে কাছে আছে আমার ফুফাত ভাই মানিক। নিশানার চুলচেরা বিশ্লেষণে এক চোখ বন্ধ করে ঠিকমত হাত পেছনে টানলাম বলসমেত। আমার হাতে তখন মনে হয় দুই-তিনটা টাইফুন জন্ম নিয়ে নিয়েছে ইতোমধ্যে। পালাবি কোথায় এই মর্মে ধুম করে ছুঁড়লাম বল মানিক ভাই এর দিকে। কিন্তু এ কি! মানিক ভাইএর চেহারা সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন। আমার সেই ছোঁড়া আগুনঝরা গোলা যে ধাবিয়ে যাচ্ছে তার দিকে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নাই। বরং মারার সাথে সাথে আমিই শংকিত হয়ে উঠলাম না জানি কি হয়। খেলতে গিয়ে না আবার পিঠ মালিশ করা লাগে! কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, দুই-তিনবার কান চুলকে আরামসে একখান ঢেকুর তুলে বাম হাত দিয়ে বলটাকে কুক্ষিগত করল মানিক ভাই উদাস দৃষ্টিতে! এ কি চোখের ভুল? এটা কিভাবে সম্ভব হল আজও আমি বুঝি নাই। বল ছুঁড়ল “ব্রেট লি” আর বল পৌঁছাল এমনভাবে যেন ছুঁড়েছে “আশরাফুল”। যাই হোক এত কিছু বোঝার সময় নেই তখন। আমি তার সামনে। পালাবার জন্যে জায়গা খুজতে লাগলাম। কিন্তু চোখে শুধু মানিক-মুখী এভিনিউ-টাই ধরা পড়ল। কি আর করা? উলটা দৌড় দিলাম। আশ্চর্যের বিষয়, তখন বাগে থাকা সত্ত্বেও মানিক ভাই আমার দিকে বল মারলেন না। সামনে ছুটতে ছুটতে বেশ কিছুদূর গিয়ে ভাবলাম আর মনে হয় মারবেন না। আর ঠিক তখনই পিঠে ঠাস্‌ করে একটা বজ্রপাত হল। কোনোমতে আকাশের দিকে মুখ তুলে বোঝার চেষ্টা করলাম যে, আসলেই শরতেও আকাশে বিদ্যুৎ চমকায় কিনা। কিন্তু পারলাম না। দুচোখের সামনে মূর্তিমান তখন দুই দুগুণে চার বিঘা সর্ষে ক্ষেত; একেবারে বাম্পার ফলনে সয়লাব। টলতে টলতে গিয়ে আরও কিছুদূর সামনে সেই বাম্পার ফলনযুক্ত সর্ষে ক্ষেত সমেত ভূপাতিত হলাম।

পুনশ্চঃ সেই বল দিয়ে আর পরে শৈশবে থাকাকালীন পর্যন্ত পিঠমাইর খেলার দুঃসাহস হয়নি। বরং কাউকে খেলতে দেখলেই পিঠে বজ্রপাতের আর চোখে সর্ষে ক্ষেতের পূর্বাভিজ্ঞতার ছটা অনুভব করতাম। আর তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে পেরেছি, এবং মনে হলেই শিউরে উঠি যে যদি সেইদিন মানিক ভাই বল পাওয়ার সাথে সাথেই মারতেন; তবে নিশ্চিত আজ আমি সর্ষে ক্ষেতে না থাকলেও পটলক্ষেতে থাকতাম। যে ঋতুই হোক না কেন।

-অতীত

<script type="text/javascript" language="javascript">eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%61%6d%6b%68%66%6f%69%73%61%6c%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%22%3e%61%6d%6b%68%66%6f%69%73%61%6c%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))</script>


গড় রেটিং
( ভোট)

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিক বুঝলাম না মন্তব্যটা; আপনার নাম আর ব্যাখা দিলে প্রীত হতাম

-অতীত

অতিথি লেখক এর ছবি

উনি সম্ভবত হায়ক করতে চাইছিলেন। সেজন্য জাভাস্ক্রিপ্ট কোড দিয়েছেন। এই স্ক্রীপ্টকিডি আরো অনেক সাইট হ্যাক করেছে। মডারেটরদের সাবধান থাকার জন্য অনুরোধ করছি

অতিথি লেখক এর ছবি

শিরোনাম দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম এটা আপনার লেখা, তাই দেরী না করে লুংগিতে গোঁচ দিয়ে পড়তে বসে গেলাম।বর্ননা বরাবরের মতই সাবলীল আর সুন্দর।

'মার্বেল আর লাটিম খেলে রাস্তার ছেলেরা'- পরিবারের মুরুব্বিদের মধ্যে এরকম একটা মনোভাব কাজ করত বলে ওই দুটা বিশেষ খেলা উনাদের প্রতিনিয়ত চোখরাংগানির সামনে খেলে দেখার ফাঁক খুব একটা বের করতে পারিনি। তাই পাড়ার বন্ধুরা যখন খেলত আমার কাজ ছিল ওদের খেলা মনিটরিং করা।এমনকি আমি অবরে সবরে পাড়ার 'মার্বেল টিমের' টেকনিকাল কোচের আলগা দায়িত্বও পালন করতাম(হেহে), আর আশেপাশের পাড়ার সাথে দুই টাকা- তিনটাকা, আচার-লজেন্সের বেটগুলোতেও ভাগ মারতাম এ সুযোগে!!

'পিঠমাইর' খেলাটাকে আমার গ্রামের বাড়ির দিকে বলা হয় 'বোমফাইট' অথবা 'বোম্বাস্টিং'। ক্রিকেট, ফুটবলের চেয়ে ঢের বেশি উত্তেজনাপূর্ন খেলা মনে হত আমার। ছোটকালে একটু কল্পনাবিলাসী ছিলাম বলে বড় হয়ে একটা "আন্তর্জাতিক 'বোমফাইট' কাউন্সিল" জাতীয় কিছু খুলে বসে 'বিশ্বকাপ বোমফাইট' এর আয়োজন করার কথাও ভেবেছি।এমন একটা খেলা কেন আন্তর্জাতিকতার সম্মান পেলনা তা আসলেই পরিতাপের বিষয়

যাই হোক ছোটবেলার এসব টুকরো ব্যাপারগুলো সুন্দর বর্ননায় আবারো তুলে আনলেন বললে বেশ ভাল লাগল।এভাবে আরো চালিয়ে যান, বস!!

ধৈবত

অতিথি লেখক এর ছবি

হুম; বোমবাস্টিং নামটা পরে জেনেছি। তোমার সেই স্থগিত উদ্যোগটা পুনরায় চালু করা উচিত; আমরা বিশ্ব-বোমবাস্টিং ট্যুর্নামেন্ট দেখতে চাই; তবে তার আগে আম্রিকাকে শানেনুযূল বুঝিয়ে আসতে হবে; নয়ত বিপদের সমূহ সম্ভাবনা আছে। তাদের মাথার মডেলটা বাই ডিফল্ট মোটা

পুনশ্চঃ লেখা পড়ার আগে লুঙ্গি কি অবস্থায় ছিল???

-অতীত

অতিথি লেখক এর ছবি

অসামান্য লেখা, বদ্দা।
যৎসামান্য ছেলেবেলার আরো অনেক অনেক গল্প শুনতে চাই।

---আশফাক আহমেদ

অতিথি লেখক এর ছবি

হাহাহা!!! তোমাকেও অসামান্য ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়ার জন্যে।

আমার স্মৃতিশক্তি ভয়াবহ রকমের দূর্বল। ইদানিং নিজের নাম মনে করতেও মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। মনে হয় ফরম্যাট দেয়া লাগবে। তার আগে কিছু এই প্রসেসরের পক্ষে করা সম্ভব কিনা এখনই বলতে পারছি না।

-অতীত

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার হয়েছে দাদা।
আপনার শেয়ানা বয়সেরও এরকম কোন গল্প শুনতে চাই।

দৃপ্র

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ দৃপ্র

অপেক্ষা কর; কেবল তো বাল্যকাল শুরু করলাম। বালেগ হইতে এখনো বহুত বাকি। তবে ততদিনে এসব আবজাব আইডিয়া মাথায় থাকবে কিনা সন্দেহ আছে।

আর বয়স এখনও মনে হয় আমার খুব একটা বাড়েনি; শুধু বুইড়া হয়া গেছি... হাসি

-অতীত

মর্ম এর ছবি

অতীতের অতীতে
মসৃন গতিতে,

সরস লেখার সাথে
নানা পরিনতিতে,

ঘুরে ভাল লেগেছে,

স্মৃতির কোঠরীগুলো
ফের বুঝি জেগেছে,

আরো লেখা আসবে

পাঠকেরা তাই পড়ে
আরো আরো হাসবে,

এই শুধু ইচ্ছে,

সচলে আসুক আরো
ছেলেবেলা-কিচ্ছে!!
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ!!!!!!! আমি রীতিমত মুগধ আপনার স্তুতিতে...
এখন তো মনে হচ্ছে এইটাকে পোস্ট বানিয়ে আমারটা মন্তব্য আকারে জুড়ে দেই......... হাসি

অদ্রোহ এর ছবি

আরো কিছু প্যারা করে দিলে ভাল হত, পরতে আরেকটু আরাম পেতাম।

বোম্বাস্টিং খেলায় আমি বরাবরই বাড়তি সুবিধে পেতাম। এমনিতেই তালপাতার সেপাই আমি, তারপরে ছুটতে পারতাম খুব, তাই আমাকে খুব কাছ থেকে আঘাত করাও মুশকিল ছিল ,কিভাবে কিভাবে যেন পিছলে যেতাম।

--------------------------------------------

আজি দুঃখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও ধরণী
তোমার অভয় বাজে হৃদয় মাঝে হৃদয় হরণী।

--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

অদ্রোহ, ইশ সেই সময় আপনি কোথায় ছিলেন??? তাহলে আপনার কাছে থেকে ট্রেনিং নিতাম; আর আমাকে সর্ষে ক্ষেত দেখতে হত না... মন খারাপ

আসলে লেখার হাত নিতান্তই কাঁচা নয়; এক্কেরে কচকচে বলে কোনো কিছু ঠিক থাকে না, তবে উত্তরণের চেষ্টা থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আশা করি এই ভুল-ভাল রয়ে সয়ে দেখবেন

-অতীত

অপছন্দনীয় এর ছবি


যেখানে টক্‌ করে শব্দ হওয়ার কথা সেখানে আওয়াজ শুনলাম কঁক্‌।

গড়াগড়ি দিয়া হাসি আপনার কি বর্তমানেও লক্ষ্যের অবস্থা এইরকম নাকি? অনেক আগে খুলনা থেকে ঢাকা আসার পথে যশোর ক্যান্টনমেন্টের একটা আর্টিলারি কনভয়ের সামনে পড়েছিলাম - গাড়িগুলোর সামনে লাল ব্যানার টানানো ছিলো - "সাবধান, পিছনে কামান"। লক্ষ্যভ্রষ্টতার পরিমাণ একই রকম থাকলে জনস্বার্থে এই টেকনিক ব্যবহার করে দেখতে পারেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

কি আর বলব বলেন, সে বড়ই বেদনাবিধুর কাহিনী...... মন খারাপ

ছোটকালে স্কুলে রসিয়ে রসিয়ে রচনা লিখতাম Aim in Life অথবা আমার জীবনের লক্ষ্য। আর বুঝতেই পারছেন তা ছিল শিক্ষকতা নতুবা ডাক্তার হবার মধ্যে ঘূর্ণায়মান। রচনায় যে পরিমাণ জনসেবা থাকত তার যদি সিকিভাগও পালন করা সম্ভব হত এদেশের কর্তাব্যক্তিদের দ্বারা; তাইলে এত্তদিনে আমরা মনে হয় নিশ্চিত জান্নাতে থাকতাম; পরকালে যাওয়ার কষ্ট আর করতে হত না। কিন্তু বিধিবাম!!! কোনোটাই বরাতে জুটল না।

আর এটা একেবারে সত্যি যে বেশিরভাগ বাবা-মায়ের ধারণা ভালো ছাত্র মানেই সাইন্স পড়তে হবে। অথবা সাইন্স পড়লেই সে ভালো ছাত্র। এই মারপ্যাঁচ ঐ কাঁচা বয়সে (!) অনুধাবনের আগেই দেখি চোখের সামনে bufo melanostictus , মহাকর্ষ নামক এক নতুন মনোবিকর্ষণ আর NaCl এর ব্যবচ্ছেদ! যাই হোক, আম্মুর প্রচন্ড ইচ্ছা ডাক্তার হই, আব্বুর তেমন কিছু নাই, শুধু বলেন যে যেটা ভালো লাগে সেটা কর। আমার তো ইচ্ছা তখন ম্যাকগাইভার কিংবা রবিন হুড হওয়ার। কিন্তু ক্যম্নে কই? প্রচন্ড ইচ্ছা থাকলেও মুখে বলি ইঞ্জিনিয়ার। এবং ওই মুখে বলার অভিশাপে হয়েও গেলাম তাই (যদিও নিজেরই সন্দেহ আছে এখনও) কেননা রক্ত দেখলেই আমার রক্ত জমাট বেঁধে যায়। (ভার্সিটিতে থাকতে একবার ব্লাড দিতে গিয়ে নিজের রক্তকে ঐ ভয়ংকর পলিপ্যাকে রিমান্ডে থাকতে দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। বুঝুন অবস্থা!!!!!)

ইঞ্জিনিয়ারিং এডমিশন দেয়ার আগে ভাবলাম কম্পু তে পড়ব। কিন্তু আমার অতি মেধাবী বন্ধুরা সবাই একজোট হয়ে সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্র করে আমাকে না জানিয়েই ভালো পরীক্ষা দিয়ে ফেলল। তার ধাক্কায় গিয়ে পড়লাম ইট-রড-বালি-সিমেন্টের মধ্যে। ভাবলাম এবার একটা বুর্জ আল বাংলাদেশ বানায়াই ফেলব। সাম্প্রতিক আপডেট হচ্ছে আমি পানি নিয়ে নাড়াচাড়া করছি!

এরপরও লক্ষ্য?????? লক্ষ্যচ্যুত শব্দটারো তো একটা মান-সম্মান আছে, কি বলেন???

-অতীত

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

লেখাটা দুই কিস্তিতে পড়লাম।

বোমাবস্টিং খেলায় খুব একটা পাকা ছিলাম না। এলাকার দুষ্ট পোলাপান চুটিয়ে হাতের সুখ করে নিতো আমায় দিয়ে। আর আমি যতই জোরে ছুঁড়ি না কেনো-

দুই-তিনবার কান চুলকে আরামসে একখান ঢেকুর তুলে বাম হাত দিয়ে বলটাকে কুক্ষিগত করল মানিক ভাই উদাস দৃষ্টিতে

চলুক
_________________________________________

সেরিওজা

অতিথি লেখক এর ছবি

এলাকার দুষ্ট পোলাপান চুটিয়ে হাতের সুখ করে নিতো আমায় দিয়ে
অ্যাঁঅ্যাঁ

সু.রি বদ্দা, এই ভদ্রলোককে (অতীত) আমি কিন্তু এমন ভয় পেতাম ইয়ে, মানে... যে একটাও দুষ্ট কথা বলার সাহস পেতাম না যে....আর আপনি এটা কি বললেন যে।

দেঁতো হাসি দেঁতো হাসি দেঁতো হাসি

ধৈবত

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

বাবা ধৈবত- পরীক্কের সুমায় রাত জেগে জেগে ইয়াহুদীনাসারাদের বাইস্কোপ দেখিয়াই তোমার এই প্রগলভতা। যাও বাবা জীবন্ময়, মাতা ধুয়ে পর্তে বসো এইবেলা...

_________________________________________

সেরিওজা

অতিথি লেখক এর ছবি

বোমবাস্টিং খেলায় তাহলে আমি আপনি একই গোত্রের; কী দারুণ!!! আসেন তাহলে আমরা একটা টিম গঠন করি; তারপর প্রশিক্ষণ নিতে যাই ব্রেট লি এর কাছে...

-অতীত

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আপনি তো সুবিশাল কাহিনী ফেঁদেছেন দেখছি। অর্ধেক পড়লাম। বাকীটা বাকী রাখলাম।

আমাদের সময় লাট্টু খেলার আগে বাজার থেকে লাট্টু কিনে এনে কামারে কাছ থেকে ১ টাকা দিয়ে 'আল' বসিয়ে আনা হতো। মানে বাজারের লাট্টুর চোখা অংশটি যথেষ্ট ধরালো থাকতো না বলে এই ব্যবস্থা। লাট্টু ঘোরানোর সুতাটাকে বলতাম লত্তি। সেই ধারালো ফলা বসানো লাট্টু দিয়ে অনেক খেলেছি। তবে নিতান্তই গোবেচারা টাইপের ছিলাম বলে পাড়ার ষন্ডামার্কা লাট্টুবাজদের সাথে কখনোই খেলতে যেতাম না। তাদের কেউ কেউ এমন দক্ষ ছিল যে এক ঘায়েই লাট্টু দুই ফাঁক করে দিতো হাসি

মার্বেল খেলে একদিন অনেক জিতেছিলাম। সেই ছেলে পরবর্তীতে বাসায় এসে ক্যারাম খেলে আমাকে নিল গেম দিয়ে শোধ তুলেছিল। দেঁতো হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলে মনে হয় ট্যাগে অণুগল্প না দিয়ে গল্প বা ইতিহাস দেয়া উচিত ছিল; কিন্তু ভেবে দেখলাম ছেলেবেলার কাছে এটা নিতান্তই একটা অণু বৈকি!!!!!

ক্যারম খেলায় অবশ্য আমি মোটামুটি ভালো ছিলাম বলা চলে, তবে সেটা শিখেছি আরও পরে ক্লাস থ্রি-ফোরের দিকে। তবে ঐ সময় প্রধানত "তালগাছ" নামক একটা সিস্টেম এর খেলা হত। সব গুটি একটার উপর একটা বসিয়ে লম্বা একটা খাম্বা বানানো হত যার নাম ছিল তালগাছ; সাদা গুটি ১০ পয়েন্ট, কালো গুটি ৫ পয়েন্ট আর রেড মানে রাণী হল ২৫ পয়েন্ট। সাদা কালো চুলোয় যাক, সবার নজর রাণীর দিকে। এমনকি যদি কোনো ক্রমে রাণীকে তালগাছের উপরের দিকে রাখা হয় ভুল করে তবে আঙ্গুল যথাসম্ভব বেঁকিয়ে স্ট্রাইক এমনভাবে নেয়ার চেষ্টা করতাম যেন নিজ দায়িত্বে তা উড়ে গিয়ে রাণীকে গর্তে লিফট দিয়ে ফেরত আসে। মারার আগেই নজর নিবদ্ধ সেই গর্তের দিকে। তবে প্রাইমারীতে গতিবিদ্যার সূত্র না থাকার ভয়াবহ কুফল হিসেবে সেটা তা না করে রীতিমত কামান বর্ষণ করত আমার বিপরীতে যে দাঁড়িয়ে আছে তার উপর। ফলাফল বোর্ডের প্রায় সব গুটি ইচ্ছেমত লুটিয়ে পড়ত আশপাশে। আবার নতুন করে শুরু তখন।

-অতীত

মাহফুজ খান [অতিথি] এর ছবি

বস অ...সা...ধা......র...ন। লেখাটা পড়ে, যে কথাটা সবার আগে মনে হয়েছে তা হল আমার ছেলেবেলা আপনি জানলেন কি করে? বস আমারা ছেলেবেলায় দ্বাদশ খেলোয়াড়দের বলতাম উপদল/ দুধ ভাত; তো আমার সবসময় দুধভাত হতে হত। আর বোম্বাস্টিং খেলার আরেকটা নতুন ভার্শন বের করছিলাম আমরা, সেটা হল নদীতে গিয়ে পানির মধ্যে বল ছুড়া ছুড়ি। সত্যি কথা বলতে কি আমাকে ওরা খেলতে নিত কিন্তু কেও আমার দিকে বল ছুড়তও না, বিষয়টা এমন হত যে আমি খেলার মধ্যে থেকেও নেই, কি যে খারাপ লাগতো। একবার আমার বড় চাচা একটা ছোট সাইজের ফুটবল কিনে দিলেন, তো সেটা নিয়ে শুরু হল খেলা, যথারীতি আমি উপদল, এবং বিশেষ ক্ষমতা বলে, বল পেলে যেকোনো দিকে মারতে পারতাম। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের ব্যপার হচ্ছে কখনো আমি বলকে আমার পায়ের নাগালেই পেতাম না, দু-একবার পেয়ে থাকলেও কি করব ভাবতে না ভাবতেই কেও একজন এসে বল নিয়ে হাওয়া! কিন্তু আমার চেষ্টার কমতি ছিলনা সারা মাঠ দৌড়তাম। তবে সবচেয়ে দামড়া মার্কার একজন ছিল “আরিফ” তাকে ছিল সবচেয়ে ভয়। ও ডিফেন্স এ খেলত, ওর পায়ে বল থাকলে আর আমি আশে-পাশে থাকলে ও বলটা নিয়ে আমাকে ভয় দেখাত যে আমার গায়ে মারবে, আর আমি উল্টা দিকে দৌড়, যদিও শেষ পর্যন্ত কখনো আমার গায়ে সে বল মারেনই তারপরেও বস রাত্রে স্বপ্নে দেখে কেঁদে উঠতাম। তো এভাবে কয়েকদিন খেলার পর শেষদিকে মাঠে গিয়ে আমি দর্শকদের সারিতে বসে থাকতাম আর ওরা আমার ফুটবল দিয়ে খেলত। এভাবে নির্দয়ের মত লাথি খেতে খেতে একদিন আমার ফুটবলটি ফুটুস।
আরেকটা কথা বস, হ্যঙ্গার শব্দটা ছেলেবেলা কখনো শুনিনি, শুনেছি বড় বেলা যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার এক ছাত্রীর বড়বোন আমাকে আড়ালে আবডালে হ্যঙ্গার বলেন বলে তাদের পরিবারের একজনের কাছে জানতে পারি।

অতিথি লেখক এর ছবি

হাহাহাহাহা!!! জোশ!!!

আমাদের এলাকায় "দুধ-ভাত" এর সাথে আর একটা নামও প্রচলিত আছে- "বাগুন-লচপচি" ব্যাপক অপমানজনক, দুঃখের বিষয় আমাকেও অনেক লচপচ করতে হয়েছে এই নাম নিয়ে... মন খারাপ

ফুটবলের কথা আর কি বলব??? সাথে নিয়ে দৌড়ানোর সময় প্রতিপক্ষের কেউ সামনে পড়লে বলকে রক্ষা কিংবা কাটানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে আগে দেখতাম তার পায়ের গঠন। বিপদ আসন্ন বুঝলে আগেভাগেই নিজ দায়িত্বে বল ছেড়ে দিতাম তার কাছে। পা-ই যদি না থাকল তবে গোল দিব কীভাবে???

-অতীত

অতিথি লেখক এর ছবি

এতো চমৎকার আপনার লিখা দাদা ! দারুণ দারুণং দারুণস্য।

শুধু উপরে অদ্রোহ যেমনটা বলেছে তেমন প্যারা করে দিলে পা দুলিয়ে আরামসে পড়তে পারতাম হাসি

আর আপনার মত ছেলেবেলায় আমাকেও বড়ভাইরা খেলায় দুধভাত বানিয়ে রাখত। রেগেমেগে আমি তখন মুখ ঝামটা মেরে মেয়েদের সাথে বুড়ি-চি খেলতে যেতাম।

সাত্যকি

অমি এর ছবি

আল ইজ ওয়েল...

তিথীডোর এর ছবি

চমৎকার!

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

ইশান এর ছবি

সুখ পাঠ্য।সাবলীল বর্ননা ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।