টোকাই কথন---প্রারম্ভিকা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৭/০৬/২০১১ - ১:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের লিখন শৈলী দেখে আমি বরাবরই মুগ্ধ হই। সহজ কথাকে তারা এমন জবরদস্ত ভাষায় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে লেখেন, যে আমার মত নির্বোধের পক্ষে তার মর্মার্থ উদ্ধার করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এদিকে আমার জ্ঞানত্‌ষ্ণা প্রবল। কী লিখলো, তার অর্থ উদ্ধার করতে না পারলে আমি অস্বস্তিবোধ করি। বন্ধুমহলে যারা একটু জ্ঞানীগুণী আছেন, তাদেরকে তখন আমি জ্বালাতন করা শুরু করি। এই টার্মটা বুঝায়ে দে, ঐ কন্ডিশনটা বুঝায়ে দে---এমনি সব বন্ধুবাড়ির আবদার করতে থাকি। আমার বন্ধুভাগ্য খুবই ভালো। বন্ধুরা তাই কিছুমাত্র বিরক্ত না হয়ে আমার মত অন্ধজনে সানন্দে আলো দান করে।

সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে আমাদের বন্ধুমহলে একচোট হয়ে গেলো। শিক্ষানীতিতে ধর্ম শিক্ষা বা নৈতিক শিক্ষার জায়গা আছে কি নেই, থাকলে কতটুকু---এ নিয়ে খোমাখাতায় অনর্থকই বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হল। কেনো এই বিভ্রান্তি, তার উত্তরে আমি বলবো, শিক্ষানীতির ধোঁয়াশা রূপই এজন্য দায়ী। আমাদের কর্মকর্তারা সুনিশ্চিতভাবেই কবিগুরুর ঐ কবিতাটি পড়েননি। 'সহজ কথা যায় না বলা সহজে'। কিংবা পড়লেও তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে ইচ্ছুক নন। কেননা, সহজ কথা সহজ করে বললে বেকুব জনতা তাদের অসৎ উদ্দেশ্যগুলো খুব সহজেই ধরে ফেলবে। তখন যদি জনতা ক্ষেপে গিয়ে 'দড়ি ধরে মারে টান'?

সরকারি নথির অস্পষ্টতার সাম্প্রতিক নিদর্শন পিএসসি-২০০৮। সচেতন সকলেই অবগত আছেন যে, এই নথিটির উপর ভিত্তি করি বাংলাদেশ সরকারের সাথে কনকাফিলিপসের তেল-গ্যাস উত্তোলন বিষয়ক চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, আর দশটা সরকারি নথির মত এটিও হাজারো অস্পষ্টতা ও ফাঁকফোকরে ঠাসা। গত দু'দিন ধরে নথির ১৫ নম্বর আর্টিকেলটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। হাল ছেড়েই দিয়েছি, এমন সময় হাতের সামনে বন্ধু সৌরভের নোটটা পেলাম। নোট থেকে মূল লেখায় গেলাম। এম এম আকাশের লেখা বিশ্লেষণ। আগ্রহী যে কেউ লেখাটা পড়ে দেখতে পারেন। আশা করি, আইনের ফাঁকফোকরগুলি অনেকখানি ক্লিয়ার হবে।

অনলাইনে যারা নিয়মিত ঘোরাঘুরি করেন, তাদের কাছে এতোদিনে হয়তো এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, এই চুক্তিতে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ক্ষতি বৈ কোন লাভ হবে না। লাভ যদি কারো হয়ে থাকে, তো কনোকাফিলিপ্সের ধামাধরা এদেশীয় কিছু মন্ত্রী-এমপি আর ইঞ্জিনিয়ারের। তারা কলাটা-মুলোটা খাবেন আর আমরা আমজনতা (সপ্রতি এক মন্ত্রীবর আমাদের 'টোকাই' আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর সম্মানে নিজেদের এখন থেকে টোকাই জনতা সম্বোধন করবো) উহুঁ, টোকাই জনতা ঘরে বসে বসে মুড়িটা-চিড়াটা খাবো আর দেশের বাপ-বাপান্ত করবো। আমাদের ছেলেরা দেশে বিদ্যুত নেই বলে হাঁহুতাশ করবে, মোমবাতি জ্বালিয়ে GRE'র বই খতম করবে আর অচিরেই আমেরিকার অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে দিনরাত খেটে মরবে। চমৎকার পরিকল্পনা। অসামান্য উদ্যোগ।

কতিপয় দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীর দাবি, আমরা টোকাইরা ভুল পথে চালিত হচ্ছে। আনু মুহম্মদ নামের এক ভদ্রলোক আমাদের বিপথে চালিত করছেন। বেহুদাই আমরা লাফাচ্ছি। সরকার বাহাদুর যা করছেন, ঠিকই করছেন। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, আপনাদের কথাই ঠিক। তবে আপনারা গ্যাস চুক্তিটি জনসমক্ষে প্রকাশ করছেন না কেনো? নাকি, আপনাদের ধারণা, চুক্তিটি প্রকাশ পেলে সে জনরোষ ধিকি ধিকি করে জ্বলছে, তা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েবে শহর, বন্দরে, নগরে। আর নগর পুড়িলে তো দেবালয় এড়ায় না। সে আগুনে ভস্মীভূত হবেন আপনারাই।

আমার কথা সামান্যই। আনু মুহম্মদ ও তার অনুরাগী টোকাই জনগোষ্ঠী যদি বেহুদাই হরতাল ইত্যাদি শান্তিনাশক কর্মসূচি দিয়ে থাকে, সরকার বাহাদুরের দায়িত্ব সঠিক তথ্য প্রকাশ করে জনমনে বিভ্রান্তি দূর করা। তা না হলে আমরা মনে করবো, এই দুর্মূখ টোকাইরাই সত্য কথা বলছে এবং দলে দলে টোকাইদের পতাকাতলে শামিল হতে দ্বিধা করবো না। বিজ্ঞজনে জানেন, এই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এবং বরাবরের মতই, কবি এখানে নীরব। কবি মানে আমাদের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া। তাদের কেউ দায়িত্বের সাথে বিষয়টা তুলে ধরছে না দেখে আমরা অবশ্য বিস্মিত হচ্ছি না। বছর দুয়েক ধরেই আমরা দেখে আসছি, যে কোন সঙ্কটে-সংশয়ে অনলাইন মিডিয়াই আমাদের মত প্রকাশের একমাত্র আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সচেতন জনতা অন্ধজনে আলো দানের জন্য ফেসবুক ও ব্লগগুলোতে নোট লিখছেন। যারা লেখেন না, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ও ডাইনিংয়ে পোস্টারিং করে সচেতনতা তৈরি করছে, যারা এসব কিছুই করছেন না তারা হয়তো ফেসবুকে যদু-মধুর নামে স্ট্যাটাস না দিয়ে তেল-গ্যাস রক্ষার্থে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, প্রোফাইল পিকচারে কিছুদিনের জন্য নিজেদের চাঁদমুখ বিসর্জন দিয়ে তেল-গ্যাস চুক্তির অর্থ-অনর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাদের সবার প্রতিই আমার শ্রদ্ধা। সর্বশেষ যারা চুক্তিটিpকে দেশবিরোধী মনে করছেন, তাদেরকে আগামী ৩ জুলাইয়ের অর্ধদিবস হরতাল সফল করার আহবান জানাই এবং যারা চুক্তিটিতে দেশবিরোধী কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, তাদের প্রতি অনুরোধ, চুক্তিটি প্রকাশ করুন। সত্য সামনে আসুক। আজ কিংবা কাল। বেশি দেরী যেন না হয়ে যায়। আমার সন্তান যেন আগামীকাল দেশের সম্পদস্বল্পতার জন্য আমাকে অপরাধী মনে না করে---এইটুকুই প্রার্থনা।

---আশফাক আহমেদ

১।[http://barta24.net/?view=details&data=Leather&news_type_id=1&menu_id=74&news_id=1069]সহজ পাঠের’ জটিলতা ![/url]
২।সমুদ্র বক্ষে গ্যাস চুক্তির সবচেয়ে সহজতম পাঠ (গরুচন্ডালী দোষে দুষ্ট)


মন্তব্য

ধৈবত(অতিথি) এর ছবি

চলুক দারূণ, ভালো লিখেছিসরে টোকাই আশফাক!!! প্রতিবাদে সোচ্চার আছি, দেখি শেষমেষ জল কোথায় গিয়ে গড়ায়।

সার্থক এর ছবি

আমরা সবাই টোকাই - গ্যাস চোরদের ঠেকাই গুল্লি গুল্লি গুল্লি

নির্লীপ্ত বহুদুর এর ছবি

টোকাইদের সাথে বুয়েটিয়ান দের একাত্মতা ঘোষণা

আমরা সবাই টোকাই - গ্যাসের দালালী ঠেকাই
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা - তেল গ্যাস দিব না

অতিথি লেখক (তাত্ত্বিক) এর ছবি

টোকাই প্রার্থণা পূরণ হোক।
দেশপ্রেম জাগ্রত হোক।

মহাস্থবির জাতক এর ছবি

বেশ ভালো লাগলো। তরুণেরা এভাবেই জেগে উঠুক। আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে।

_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

অদ্রোহ এর ছবি

ভেবেছিস সারা জীবন রয়ে গেলাম বোকাই
প্রতিবাদ করে তাই হয়ে গেলাম টোকাই!!

--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

শুধু এই চুক্তিটি কেন ১৯৮৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সকল সরকার খনিজ সম্পদ উত্তোলন সংক্রান্ত ব্যাপারে বিদেশী যাদের সাথেই চুক্তি করেছে তার কোনটিই প্রকাশ করেনি। এই ব্যাপারে সব সরকারের এক রা। পুরনো সরকার যারা এখন বে-সরকার, তারাও এই সব ব্যাপারে বিশেষ কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। এই ব্যাপারে যারা আন্দোলন করছেন তারা "জাতীয় তথ্য অধিকার আইন"-এর আওতায় সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন না কেনো? কেনো তারা আদালতে গিয়ে দাবী করেন না যে, "আমি টোকাই হই আর যা-ই হই আমি এই রাষ্ট্রের নাগরিক। আমার অধিকার আছে এই সব চুক্তির (স্বাক্ষরিত চুক্তি, ফরম্যাট নয়) কপি দেখার। কারণ, এখানে দেশ ও জনগণের স্বার্থ সরাসরি জড়িত"।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

গুল্লি গুল্লি গুল্লি

সাথে আছি।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আরিফ জেবতিকের ফেসবুকে লিখে অনেক কথা শুনেছি, কিন্তু এখনো বলি-
"দাবীর প্রতি পূর্ণ সমর্থন, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই হরতাল সমর্থন করি না"

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নির্লীপ্ত বহুদুর এর ছবি

ভাইয়া তাহলে দাবী আদায়ের বিকল্প কি বলতে পারেন ?
এইটা তো ভাঙ্গচুরের হরতাল না , জনগনের সতস্ফুর্ত হরতাল,
কোন কর্মসূচী টা করা বাকি আছে বলেন?
পদযাত্রা,সমাবেশ,পাঠচক্র,সেমিনার ,মিটিং ,মিছিল , উন্মুক্ত বিতর্কের আহ্বান, এমন একটা কর্মসূচীর কথা বলেন যেইটা দেওয়া বাকি এবং যেইটা দিলে সরকারের টনক নড়বে ? প্লিজ বলেন প্লিজ

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

জনগন সম্ভবত বিষয়টা এখনো জানেই না... যাহোক জনগনের স্বতস্ফূর্ত হরতাল সফল হোক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

আশফাক এর ছবি

@নজরুল ভাইয়াঃ ভাইয়া, হুরতাল মাত্র ৬ ঘণ্টার। এতে দেশের আহামরি কোন ক্ষতি সাধিত হবে বলে মনে হয় না। আমি যদ্দূর বুঝলাম, এই হরতাল কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য দেয়া হয়নি। দেয়া হয়েছে জনগণকে নিজের অধিকারটুকু সম্পর্কে সচেতন করার জন্য। হরতাল দিলে লোকে জিজ্ঞেস করবে, ভাইডি, আইজকা হরতাল ক্যানো দিলো? তখন আমরা সবাইকে এই ব্যাপারটা খোলাসা করে বলতে পারবো।

আরো দুটি লিঙ্কঃ
১।গ্যাস উৎপাদন চুক্তির সহজ পাঠ - আমার চোখে যেমন
২।"বিভিন্ন দেশের চুক্তি বাতিলের অভিজ্ঞতা - আমরা কেন পারবো না?"-গণসংহতি পত্রিকা, জুন, ২০১১

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ঠিকাছে

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

guest_writer এর ছবি

প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি টোকাই আশফাক ভাইয়া কে লেখাটির জন্য।

আসলেই আমরা সবাই টোকাই। এরশাদ কাকু টোকাইদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য কাফকো চুক্তি করেছিলেন ৯০র দশকে। চুক্তি অনুযায়ী আমরা এখন কাফকোকে $1 মুল্যে গ্যাস সরবরাহ করছি এবং সেখানে নিরবিচ্ছিন গ্যাস সংযোগ চালু রাখার জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠানে গ্যাস বন্ধ করে দিচ্ছি। বিনিময়ে কাফকো টোকাইদের একটু করুণা করছে। আন্তর্জাতিক দামে টোকাইদের কাছে তাদের উৎপাদিত সার বিক্রী করছে। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টার কল্যাণে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য কনোকো-ফিলিপ্সের সাথে চুক্তি করেছে। কিছু বছর পর এই কোম্পানি গ্যাস রপ্তানী করবে বিদেশের বাজারে আমরা আমাদের দেশের সম্পদ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করব আন্তর্জাতিক মুল্যে।

কি আর করা?
আমরা যে টোকাই...........................।

দীপাবলি।

MIU পাঠক এর ছবি

হরতালের প্রতিবাদে সব কিছু বন্ধ না করে, যাদের বিরুদ্ধে হরতাল তাদের কে কাজ করার চাপ দিতে বাধ্য করার জন্য উচিত তাদের কর্মস্থল এর আসে পাশে অবস্থান নেয়া, যেন তারা কাজ না শেষ করে কর্মস্থল থেকে বের হতে পারে!
হরতাল শুনলেই কেমন যেন একটা জ্বালাও-পোড়াও ভাব চলে আসে! তাই, হরতালের বিকল্প কিছু চিন্তা করতে হলে প্রথমেই একটা বিকল্প নাম বের করা উচিত! "হরতাল" শব্দটির বিকল্প কি হতে পারে?

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ভাই, যাই বলেন, 'তেল' দিয়ে লাভ হয় না একথা মানতে পারলাম না চোখ টিপি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

স্বপ্নডানা এর ছবি

ভেবেছিস সারা জীবন রয়ে গেলাম বোকাই
প্রতিবাদ করে তাই হয়ে গেলাম টোকাই!!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।