মরণরে তুহু মম শ্যাম সমান

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৬/০৮/২০১১ - ১০:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমার একরকম চাপা ক্ষোভ আছে। কোন বিষয় নিয়ে ভাবলেই দেখা যায়, তিনি আগেই সবচে সুন্দর কথাটিই লিখে ফেলেছেন তা নিয়ে। প্রত্যহের যেকোন আবেগে, যেকোন মুহুর্তে তিনি এসে হাজির হন; অন্য যে কারো আগেই। তাঁর জন্যই হয়তো আমার কখনো লেখক হওয়া হবেনা।

আমাদের সবারই রবিঠাকুরের সাথে প্রথম পরিচয় সেই ছোটবেলায়। বাঁকে বাঁকে চলা ছোটনদীর দু’ধারে ফুলে ফুলে সাদা কাশবন দিয়ে হেঁটে গিয়েছি। আবার ‘বীরপুরুষ’ কবিতার “মনে কর যেন বিদেশ ঘুরে, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে...” পংক্তি শৈশবে আওড়িয়ে নিজেই মনে মনে কতবার বীরপুরুষ হয়ে ডাকাত মেরেছি।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সবচে ছোট ছেলেটি এরপর আমাকে প্রতিদিন নতুন করে আশ্চর্য করেন। মনের সব রঙ খুঁজে পাই রবীন্দ্রনাথে। কখনো কবিতা, কখনো গান, কখনো গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ, পত্রসাহিত্য কখনো বা আত্মজীবনী থেকে। তাঁকে অসংখ্যবার পড়েও শেষ করা যায় না। তাঁর প্রতি মুগ্ধতা-আকর্ষণও তাই ফুরোতে চায়না।

মুগ্ধ হই ছোটগল্পে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার। তর্কযোগ্যভাবে হয়ত সবচেয়ে সেরাও। ছোটগল্পগুলো পড়ে আমাদের অন্তরে থেকে যায় অতৃপ্তি, থেকে যায় ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ অনুভূতিটুকু। গল্পের চরিত্রগুলো পড়লে মনে হয়- দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে। ‘ছুটি’ পড়তে পড়তে মনে হয়েছে- আরে, আমিই তো ফটিক। ‘পোষ্টমাষ্টার’ এর রতন বা ‘কাবুলিওয়ালা’র রহমত, মিনি বা ‘ভুল স্বর্গ’র বেকার লোকটিকে মনে হয় আমাদের আশেপাশেরই কেউ। এখনো হৈমন্তী, কাদম্বিনীদের প্রতিদিন মরিয়া প্রমাণ করতে হয়- তারা মরে নাই। তাই রবীন্দ্রনাথ আজো একই রকম প্রাসঙ্গিক।

ভাল লাগে উপন্যাস। মাঝে মাঝে মনে হয়- ‘শেষের কবিতা’র অমিত-লাবণ্যের মত শিলং পাহাড়ের সেই দৈব দুর্ঘটনা জীবনে ঘটলে বুঝিবা মন্দ হয়না। আর ভালবাসাও বুঝি সার্থক হয় বিরহে। ছোটবোনের সাথে তর্ক হত-কে সেরা? রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ নাকি শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’? ভবঘুরে শ্রীকান্তের প্রতিই অবশ্য আমার পক্ষপাত ছিল বেশি।

আর, রবীন্দ্রসংগীত শুনে মনে হয়, আমার মনের অলিগলিতে উঁকি দিয়ে সব দেখেশুনে, আমার একান্ত কথাই বলে দিচ্ছেন তিনি।সেই কবে, হয়ত কোন এক বাদলা দুপুরে জানালায় বৃষ্টি দেখে লিখেছিলেন,অথচ এখনো বৃষ্টি পড়তে দেখে আমি গুনগুনিয়ে উঠি- ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে...’ বা ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে...’। অন্ধকার ঘরে শুয়ে ফুল ভল্যুমে ‘ভালবাসি,ভালবাসি...’ কিংবা ‘ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে...’ শুনলে সবচে কাঠখোট্টা লোকেরও বুঝি ভালবাসতে ইচ্ছে করে কাউকে।
ভোরবেলায় ‘আগুনের পরশমণি’,’আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ বা ‘অন্তর মম বিকশিত কর’ গানগুলো শুনলে ভেতরটা শুদ্ধ হয়ে যায়, সারাদিন আর কোন খারাপ কাজ করতে ইচ্ছে করেনা।কখনো দুঃখ নিতে যাই তাঁর কাছে, সুখ নিতেও। ‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে’ কিংবা ‘ আমার সকল দুঃখের প্রদীপ’ শুনে নিজের ভেতর হারিয়ে গেছি কতদিন। আমাদের বিদায়ী অনুষ্ঠানে ‘ পুরানো সেই দিনের কথা’ শুনে আমরা কেঁদেছিলাম প্রায় একঘন্টা। ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন...’ গানটা আমার সবচে প্রিয়, বিশেষ করে হেমন্তের কন্ঠে। গীতিনাট্যের কথা বলিনি? শিল্পকলায় ‘শ্যামা’ দেখে দুই বন্ধু আমরা নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলাম মুগ্ধতায়।

তাই রোজ কান পেতে রই রবিবাবুর কাছে।ঘুম ভাঙ্গানিয়া হয়ে, দুঃখ জাগানিয়া হয়ে বুকে চমক দিয়ে ডেকে যান তিনি।

রবীন্দ্রগানের সবচে বড় ধর্ম সর্বজনীনতা। আধুনিকতার যেখানে শেষ, সেখানে শুরু রবীন্দ্রনাথের। সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বিষাদে-হতাশায়-উচ্ছ্বাসে-শূন্যতায়-পূর্ণতায় জীবনের সকল ভাবে,অনুভবে এখনো তিনি সমানভাবে গ্রহণযোগ্য।

আমাকে যদি কোথাও নির্বাসন দেওয়া হয়, আমি ‘গীতবিতান’ সাথে করে নিয়ে যাব।

রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়া দরকার ছিলনা, দরকার ছিল বাংলা সাহিত্যের। তিনি একাই অনেকটুকু এগিয়ে নিয়েছেন বাংলা ভাষাকে। তাঁর উপরেই দাঁড়িয়ে আছে বাংলা সাহিত্য।
রবীন্দ্রনাথ অনেককে নাকি আকর্ষণ করেনা ; যেমন করেনা হোমার,বিটোফেন,শেক্সপীয়ার,চৌরাশিয়া,বিসমিল্লাহ খাঁ। যাদের জীবনবোধের গভীরতা কম,তাদের কাছে রবীন্দ্রগান শুনলে ঘুম আসে। অন্য লেখকেরা যেখানে সাহিত্যের কেবল একক্ষেত্রে হয়ত সীমাবদ্ধ, সেখানে এই সব্যসাচী শুধু কবিতা,উপন্যাস, নাটকে নন,তাঁর অসামান্য সব ছোটগল্পে, সর্বোপরি তিনি তাঁর গানে বাঁচবেন। তাঁর দোষ ছিল, ছিল ত্রুটিও। কারণ তিনিও মানুষ। বিতর্কটা বাদই থাকুক আমার কাছে।

কারণ, রবীন্দ্রনাথ ভেতরে ভেতরে তৈরি করেন আমাকে। এই সৌম্য মানুষটা গান হয়ে,সুর হয়ে ধরা দেন আমার কাছে।একটু একটু করে জায়গা করে নেন আমার ঘরে-বাইরে, গহীনে-প্রকাশ্যে। রবীন্দ্রনাথ আমাকে ভাল থাকার মন্ত্র শিখিয়েছেন- “মনরে আজ কহ যে, ভাল মন্দ যাহাই হোক, সত্যরে নাও সহজে” ; “চারিদিকে দেখ হৃদয় প্রসারি, ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি”। রবিঠাকুর হয়ে উঠেন আমার না বলা কথা, আমি এবং আমার সহজ উপলব্ধি।

একেকজন অসাধারণ মানুষ এভাবে কারো কারো জীবনের বাতিঘরে থেকে যান।

আজ তাই, একশত পঞ্চাশ বছর পরও, বাংলার আকাশের নাম রবীন্দ্রনাথ।

-প্রিয়ম

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03am

মন্তব্য

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

অতি বাস্তব ... আমারও মনে হয় সব বিষয়ে সবচেয়ে সুন্দর কথাগুলো উনি লিখে ফেলেছেন

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

ইস্কান্দর বরকন্দাজ এর ছবি

চলুক

তিথীডোর এর ছবি

রবীন্দ্রনাথ আমার প্রথম প্রেমিক। সকাল থেকে ♥বুড়োটাকে নিয়ে লিখব ভাবছিলাম... কিন্তু সমস্যাটা হলো, অসম্ভব প্রিয় কিছুকে নিয়ে মাউস ঘষটানোর সাহস পাই না আসলে। মন খারাপ

দুটো জায়গায় খুব খু-ব মিলে গেল।
১) যদি নির্বাসনে যেতে হয় কখনো, সবার আগে হাতে নেবো গীতবিতান। এই একটা বই আওড়েই এক জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়.....

২) বুড়োর অসংখ্য প্রিয় কবিতার মধ্যে 'মনেরে আজ কহো যে,
ভাল মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে....' এই তিনটে লাইন মাথায় নিয়ে রোজকার পথ হাঁটি।

আবুল হাসানকে নিয়ে লেখা পোস্টটার পর দ্বিতীয় এই লেখা দিয়ে মুগ্দ্ধতা বাড়িয়ে দিলেন। চলুক চলুক চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

শুকরিয়া! হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক করি বিরচন ,
গীতরসধারা করি সিঞ্চন
সংসার-ধূলিজালে

আপাতত এই গানটা শুনি... পৃথিবীর অন্যতম সেরা গান

একটা ছোট্ট সংশোধনী আছে:
চারি দিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি,
ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি
প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

সচলে অতিথি লেখক তো, এডিট করার অপশন নেই। :/

সুমন_তুরহান এর ছবি

বাংলার আকাশের নাম রবীন্দ্রনাথ

চলুক

তানিম এহসান এর ছবি

রবীন্দ্রনাথ! - না চাহিলেও যারে পাওয়া যায়!!

মৌনকুহর এর ছবি

চলুক

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

guest_writer এর ছবি

আমার দুঃখ এখানেই, আমাকে একজনই বুঝত... আমার সব মনের শুধু তারই জানা!

প্রিয়ম এর ছবি

আমাদের অনেকের দুঃখই এখানে, একজনই শুধু বুঝে আমাদের। মন খারাপ

প্রিয়ম এর ছবি

নজরুল ভাই, টাইপো হয়েছে,'চাহি' শব্দটা টাইপ করিনি ভুলে, খেয়াল করেছিলাম আগেই,কিন্তু, 'অতিথি লেখক'রা মনে হয়, এডিট করতে পারে না।তাই আর ঠিক করা হয়ে উঠেনি।

আয়নামতি1 এর ছবি

উত্তম জাঝা!

guesr_writer rajkonya এর ছবি

আমিও তো তাই বলি। যা ভাবি, তা অনেক আগেই রবিদা বলে গেছেন। খুব অবাক হলাম গতকাল
http://www.prothom-alo.com​/detail/date/2011-08-06/ne​ws/175815
এই লেখাটা পড়তে গিয়ে।

সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজের অপমান’—গানটি আমাদের অনেকেরই চেনা। এ গানটির সঙ্গে কী ধরনের নাচ হতে পারে? ভাবনার ডানা মেলে ধরুন, করুন যতটা ইচ্ছে তার বিস্তার। উহু, ধরতে পারবেন না। রবীন্দ্রনাথ এই গানের সঙ্গে যে নাচের কম্পোজিশন করেন, তা জুডোর ভঙ্গি। সে সময় শান্তিনিকেতনের মেয়েদের আত্মরক্ষার জন্য জুডোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। সেই ব্যায়ামগুলোর মাধ্যমেই এই গানটির সঙ্গে নাচের কম্পোজিশন হলো।

কত আধুনিক ছিলেন রবিদা। তাঁর জন্মের দেড়শত বছর পরে একজন তাঁর গানটিকে শিরোনাম করে সাম্প্রতিক সময়ের একটি সমস্যা নিয়ে লিখছে। অথচ তিনি এ ব্যাপারে অনেক আগেই ভেবে রেখেছিলেন!!!
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------
http://www.facebook.com/notes/tanya-kamrun-nahar/%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A6%87-%E0%A6%85%E0%A6%AA%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8/10150242085357101

ধৈবত(অতিথি) এর ছবি

আশফাক আহমেদ এর ছবি

চলুক

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

সাত্যকি. এর ছবি

পুরাই কুফাকুফি পোস্ট।
(রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখলে, মন্তব্য প্রতিমন্তব্যগুলোও রাবীন্দ্রিক ঢং-এর হবে, এই স্বাভাবিক। আমি মাঝখানে একটু ডোপিং এড করলাম আরকি।)
কিন্তু 'রবীন্দ্রনাথ সবকিছু লিখে ফেলেছে', 'রবীন্দ্রনাথ একশ বছর পরেও আধুনিক'- এইগুলো কি ভক্তিবাদের অন্ধবাক্য নয়?
আরো কুফান প্রিয়মবদা-দা। কুফাইতেই থাকেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।