মুক্তিযুদ্ধের হারানো প্রতীক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বাংলাদেশ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৩/০৫/২০১২ - ৬:৩৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কাবেরী গায়েন

এক।

ক. প্রতীক কী? প্রতীকের নির্মাণ কীভাবে ঘটে?
প্রতীক হলো তাই যা কোন আইডিয়া, কোন বস্তুগত অস্তিত্ব বা প্রক্রিয়াকে উপস্থাপন করে অথচ যে চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশ করে, সেই চিহ্নের সাথে ওই বস্তু বা আইডিয়ার সরাসরি কোন মিল নাও থাকতে পারে, হতে পারে কোন বিমূর্ত ধারণার প্রকাশের জন্য কোন ভৌত বস্তুর উপস্থাপন। প্রতীকের উদ্দেশ্য হলো অর্থ তৈরী করা এবং যোগাযোগ স্থাপন করা। চিহ্নের সাথে প্রতীকের পার্থক্য হলো যে, চিহ্নের কেবল একটিই অর্থ হয়, তা সীমিত। যেমন, ‘লরেল মুখে ঘুঘু’ যখন চিহ্ন তখন ঘুঘু একটি পাখি, যার মুখে একটি লরেলের ডাল রয়েছে। অন্যদিকে ‘লরেল মুখে ঘুঘু’ যখন প্রতীক তখন সেটি শান্তিকে নির্দেশ করে। এই অর্থ নির্মাণ কিংবা আরোপ করে মানুষ, বলা ভালো নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটের মানুষ। প্রতীক ভার্সাটাইল, যদিও সার্বজনীন নয়। মানুষ বা সম্প্রদায়ভেদে এই অর্থ ভিন্ন হতে পারে, অথবা একই অর্থের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রতীক ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন, পাশ্চাত্য দুনিয়ায় সেবার প্রতীক যীশুখৃস্টের ক্রস বা রেডক্রস মুসলিম দুনিয়ায় পাল্টে হয়েছে রেডক্রিসেন্ট, লাল চাঁদ-তারা। কাজেই, প্রতীক তাই-ই যা যাপনজাত কোনও অনুভূতিকে বা বস্তু সত্যকে আইডিয়ায় পাল্টে দেয়, পরে যা আবার একটি নির্দিষ্ট ইমেজের চেহারা পায়, অথচ শেষের রুপান্তরটা ইমেজের মধ্যে আইডিয়াকে ধবংস করে ফেলে না। এসব প্রতীক ভাষাতে অর্থাৎ শব্দের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে, নানা ধরণের ইমেজের মাধ্যমে বা চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে। কাজেই প্রতীক হলো অদৃশ্য কোন একটা কিছুর দৃশ্যমান চিহ্নবিশেষ, যা ন্যারেটিভের অন্যান্য অংশের উপর নির্ভরশীল না হয়েও সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

মানুষ দীর্ঘদিন অর্থ আরোপ করে করে কোন বিমূর্ত আইডিয়াকে অর্থবহ করে, প্রতীকায়িত করে। মা-এর সাথে øেহ, কিংবা দেশের প্রতীক। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকার সাথে দেশের সার্বভৌমত্ব বা গর্বের সম্পর্ক নির্মাণ করে। এই নির্মাণ প্রক্রিয়ায় নিত্যনতুন ভাষা তৈরী হয়, অনুভব তৈরী হয়, প্রতীক নির্মিত হয়। তবে এসব প্রতীক নির্মাণের পেছনে শক্ত ইতিহাস থাকে, সেই ইতিহাস নির্মিত হয় মানুষের যুথবদ্ধ চেষ্টা, শ্রম, ঘাম, আবেগ, মেধা আর সংগ্রামে। কখনোবা প্রতীক নির্মাণের জন্য প্রয়োগ করা হয় ক্ষমতার।

খ. যেসব প্রতীক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে
চিহ্ন, ভাষা এবং ইমেজের সমন্বয়ে বেশ কিছু প্রতীক নির্মিত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও। এসব ভাষিক এবং চিহ্নগত প্রতীক আমাদের সামনে যে সত্য তুলে ধরে তা হলো, যে বৈপ্লবিক ঘটনাধারায় অনিবার্যভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের রুপ পরিগ্রহ করেছে, তা সর্বস্তরের নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমেই ঘটেছে এবং যার মূলে কাজ করেছে ভাষাভিত্তিক বাঙালী* জাতীয়তাবাদী জাতিরাষ্ট্রের জন্য আকাংখা। এমনই কয়েকটি প্রতীক নিয়ে আলোচনা করার জন্য কয়েকটি পোস্টার এবং শ্লোগানকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

শ্লোগান
শ্লোগান ১: তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা
শ্লোগান ২ : জয় বাংলা
শ্লোগান ৩: একেকটি বাংলা অক্ষর অআকখ/একেকটি বাঙালির জীবন
শ্লোগান ৪: মা-বোনেরা অস্ত্র ধর/ বাংলাদেশ স্বাধীন কর
শ্লোগান ৫: শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, জনতা এক হও
শ্লোগান ৬: বাইশ বছরে ওদের শোষণে মরেছি,/এসো কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা
দাঁড়াই এক সাথে (১৯৭০)
শ্লোগান ৭: বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক সকলেই আজ মুক্তিযোদ্ধা

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন এসব পোস্টার এবং শ্লোগানের আধেয়কে যদি বিশ্লেষণ করি তবে দেখবো কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতীকায়িত হয়েছে।

পোস্টার এক। ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালী জাতীয়তাবাদের কথা বলে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান, মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় পরিচয়কে ছাড়িয়ে লীন হয়েছেন এই বাঙালি জাতিসত্ত্বার মধ্যে। ধর্মের কারণে কোন বিভেদ নেই।
শ্লোগান এক: ষাটের দশকের শেষদিকেই এই শ্লোগান জোরালো হয়ে উঠেছিলো। যার মূল কথা বাঙালীর আত্মপরিচয়ের ভৌগোলিক সীমারেখা। হাজার মাইল দূরের পিন্ডি নয়, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত এই ভৌগোলিক সীমা এবং তার সংস্কৃতিই তার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা।
শ্লোগান দুই: মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান। যে শ্লোগান দিয়ে বাঙালী যুদ্ধ করেছে। পাকিস্তান জিন্দাবাদকে চ্যালেঞ্জ করে জয় বাংলা শ্লোগানটিও ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের পরিবর্তে বাঙালী জাতীয়তাবাদের জয়গানকেই যুদ্ধের বীজমন্ত্র করে নিয়েছে।
শ্লোগান তিন: ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নির্যাস যা বাঙালী জাতিসত্তার শেকড়কে প্রতীকায়িত করেছে।

তবে এইসব ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালী জাতীয়তাবাদী প্রতীক একদিনে গড়ে ওঠেনি দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া পাকিস্তানে। সেই ১৯৪৮ সালে মুহম্মদ আলী জিন্না যে বিষবৃক্ষ রোপন করেছিলেন “উর্দূ অ্যান্ড উর্দূ শ্যাল বি দ্য ওনলি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান’’ বলে তাকে পাতায়-ফুলে শোভিত করেছিলেন তার বশংবদেরা। এক নেতা বলেছিলেন, পাকিস্তানের দুই অঞ্চল দুই চোখের মত। কিন্তু তার মুখ তো আর দুটো হতে পারে না। সুতরাং উর্দূই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে প্রথম দিককার প্রচারণা ছিলো, বাংলা কাফেরদের ভাষা। সুতরাং পরিত্যাজ্য। একে একে আরবি বা রোমানে বাংলা লেখা থেকে শুরু করে আরবি-ফার্সী শব্দের প্রচলন, বাংলা বানানে পরিবর্তন, রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা, নজরুলের মুসলমানিকরণসহ সব ষড়যন্ত্রকে বাঙালী রুখেছে, প্রথমে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে রক্ত দিয়ে, পরে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কখনো বা আশ্রয় নিয়েছে চিরায়ত বাংলার লোককাহিনীতে। জহির রায়হানের বেহুলা, চাঁদ সওদাগর-বেহুলা, নদী-মাতৃক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে ভেলায় ভেসে চলেছে। বাংলার হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃস্টান সকলেই অতীতের কাহিনীর মধ্যে খুঁজে নিয়েছে নিজের হারানো স্বরুপ। দ্বিগুন উৎসাহে পালন করেছে রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষ আর শামসুর রাহমান, সিকান্দার আবু জাফর, আল মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী-দের পঁয়ষট্টি-উত্তর কবিতা পড়লে দেখা যায়, ফল্গুধারা ক্রমশ ঘূর্ণিমুখর হয়ে বাংলাদেশের ভেতরে গড়ে তুলেছে বাঙালীর নতুন কাব্যভাষা। পাকিস্তান রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতার জিগিরের পেছনে এত অর্থব্যয় এত উদ্যোগের অপচয়, অথচ ফল হলো বিপরীত। ভাষা এবং সংস্কৃতির উপর যত আঘাত এসেছে, বাঙালী ততবেশী সংগঠিত হয়েছে। হেগেলীয় ‘নিগেশন অব নিগেশন’ বা নেতির নেতিকরণ-এর জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র। সাম্প্রদায়িক ভিত্তির উপর জন্ম, কিন্তু উত্তরকালে অতি জোরদার অসাম্প্রদায়িকতার বনিয়াদ সেখানেই প্রতিষ্ঠিত। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক তাই হয়ে উঠেছে বাঙালী জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতা। এই দুটোর একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটি অর্জন সম্ভব নয়, কারণ একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির অস্তিত্ব সম্ভব নয়।

পোস্টার দুই। পরিস্কারভাবে দেখায় বাংলার নারী সমাজ মুক্তিযোদ্ধা। এই যোদ্ধা ইমেজটিও একদিনে গড়ে ওঠেনি। স্বদেশী আন্দোলন হয়ে প্রাক-মুক্তিযুদ্ধকালীন সকল আন্দোলন সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণ এবং অবদান থেকেই এই পোস্টারের জন্ম। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার কর্তৃক প্রচারিত এই পোস্টারের আগেই শ্লোগান উঠেছিলো ৭ মার্চের উত্তাল জনসমূদ্রে , ‘মা-বোনেরা অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ এই সময়কার ছবিতে দেখা যায় জনসভায় যোগ দিতে আসা মেয়েদের হাতে পোস্টার, ‘মা-বোনেরা অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ মুক্ত কর’। বাংলাদেশ সৃষ্টির সাথে নারীর অংশগ্রহণের প্রতীক হলো এসব পোস্টার এবং শ্লোগান। তারা রাইফেল হাতে যুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, স্বামী-সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, ক্যাম্পে শুশ্র“ষা করেছেন, চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, জীবন দিয়েছেন এবং দেশ স্বাধীন হবার পর পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ শেষ হলেও তাদের অনেকের যুদ্ধ শেষ হয়নি আজো নিজের দেশে মাথা উঁচু করে বাঁচবার জন্য।

পোস্টার তিন । বাংলাদেশের সম্পদ বাড়িয়ে পাকিস্তানের পণ্য বর্জনের ডাক দেবার মাধ্যমে স্বনির্ভর অর্থনীতির ডাক দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ বাড়ানোর কথা। বাংলার মানুষের বিক্ষোভ যে-কয়টি মূল কারণে দানা বেঁধেছে, দুই পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য তাদের মধ্যে অন্যতম, হয়তো প্রধানতম। বাংলার পাটচাষী তুলে দিয়েছে তার সোনালী আঁশ অবাঙালী ব্যবসায়ী প্রতিনিধির হাতে। একটা মূল্য সে পেয়েছে, কিন্তু তার প্রয়োজন মেটেনি, ফলে অর্থনীতিবিদ যখন জানালেন তার দেয়া পাট থেকে মুনাফা করছে অবাঙালী ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি, তখন পাটচাষী ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির লগ্নে, দুই অংশের সাধারণ মানুষ আয়ের দিক থেকে ছিলেন প্রায় সমান, সরকারী উদ্যোগে একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা পার হয়ে যাবার পর বাংলাদেশ পিছিয়ে রইলো শতকরা ২৩ ভাগ, দু’টি পরিকল্পনার পরে সে ফারাক দাঁড়ালো শতকরা ৩০ ভাগ, আর তৃতীয় পরিকল্পনার শেষ দিকে আরো বেড়ে হলো শতকরা ৩৪ ভাগ। (Papanek, 1970; Economic Survey of Pakistan 1968-69) । আয়ের বৈষম্য এভাবে বেড়ে উঠছিলো দিন দিন তার কারণ সম্পদের বৈষম্য নয়, বরং এটা গড়ে তোলা হয়েছিলো বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে, বাংলাদেশের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে। এই প্রবঞ্চনার নায়ক একদিকে সরকার, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি। বৈদেশিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে সরকারী নিয়ন্ত্রণ-নীতির ফলে বাংলাদেশের সম্পদ কীভাবে হস্তান্তরিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে তা একটা ছোট উদাহরণ থেকে বোঝা যাবে। বাংলাদেশের চাষী এক মন পাট বিক্রী করলো পশ্চিম পাকিস্তানী রপ্তানি ব্যবসায়ীর কাছে। দিনশেষের হিসাবে দেখা গেলো, একমন পাট বিক্রি করে, পণ্যের হিসাবে, বাংলাদেশ পাচ্ছে মাত্র ০.৫৮ মণ পাটের মূল্য। পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের শতকরা ৫০ ভাগের বেশী এসেছে বাংলাদেশজাত পণ্য রপ্তানি করে। কোন কোন বছর , যেমন ১৯৬১-৬২ অর্থবছরে, শতকরা ৭০ ভাগও বাংলাদেশ থেকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ আমদানির অংশ পেয়েছে মাত্র শতকরা ৩০ ভাগ। (Monthly Statistical Bulletin, Various Issues. Central Statistical Office, Government of Pakistan, উদ্ধৃত, পাল, 1971)| ফলে দেশের সম্পদের উপর নিজস্ব অধিকার স্থাপন এবং পাকিস্তানী পণ্য বর্জনের মাধ্যমে স্বনির্ভর অর্থনীতি নির্মাণের আকাংঙ্খা হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রতীক। এই পোস্টারের আগেই, ১৯৭০ সালে শ্লোগান উঠেছিলো “বাইশ বছরে ওদের শোষণে মরেছি, এসো কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা দাঁড়াই একসাথে।”(শ্লোগান ৬)। কিংবা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শ্লোগান উঠেছে, “বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক সকলেই আজ মুক্তিযোদ্ধা।” (শ্লোগান ৭) ‘৬৯-’৭০ কালপর্বে বারে বারেই শ্লোগান উঠেছে, “শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, জনতা এক হও”। (শ্লোগান ৫)

এই পোস্টার এবং শ্লোগান চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কেবল ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফল নয় বরং এর রয়েছে গভীর রাজনৈতিক অর্থনেতিক সংগ্রামী অভিপ্রায় এবং কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-মেহনতি মানুষের সংগ্রামী অংশগ্রহণ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঘটনাধারাকে যদি বিশ্লেষণ করি তবে দেখা যাবে ১৯৪৭-৪৮ সালেই ন্যায্য বেতনের দাবিতে নিুপদস্থ কর্মচারি ও পুলিশ ধর্মঘট। শাসকচক্রের জবাব জেল, লাঠি, টিয়ার গ্যাস, গুলি। ১৯৪৯-৫১ সময়পর্বে জমির অধিকারের এবং খাজনা কমানোর দাবিতে ব্যাপক দরিদ্র ও নিঃস্ব কৃষকদের বিক্ষোভ। ১৯৫২-৫৩ কালপর্বে বাংলাভাষার আন্দোলন, সরকারী-বেসরকারী কর্মচারিদের যোগদান, শ্রমিকদের মধ্যে নতুন সংগঠনের তৎপরতা। ১৯৫৪-৫৭ কালপর্বে ফের পুলিশ ধর্মঘট। ১৯৬৮-৬৯ সালে সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী গণ-অভ্যূদয়ের তৃতীয় পর্বে পূর্ণ গণতন্ত্র, পূর্ববাংলার স্বাধিকার এবং রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে গণবিপ্লবী অভ্যূত্থান। সেখানে শামিল শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-মেহনতি জনতা, নারী সমাজ। ১৯৭১ সালে ই.পি.আর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং পুলিশ বাহিনী যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পুরোভাগে এসে দাঁড়ালো, সেটা ঘটনাচক্রে আকস্মিকভাবে ঘটেনি। ১৯৪৮ এবং ১৯৫৫ সালের পুলিশ ধর্মঘট এবং ১৯৬৭-৬৮ সালে বাঙ্গালী সামরিক কর্মচারিদের বিরুদ্ধে তথাকথিত আগরতলা মামলার ঘটনা অনুসরণ করলে বুঝতে পারবো, ইপিআর, পুলিশ এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট কেন শেষ পর্যন্ত একটা গণ-বৈপ্লবিক ঝুঁতি নিতে দ্বিধা করেনি। তেভাগা আন্দোলন, টংক, নানকার প্রভৃতি প্রথার বিরুদ্ধে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ, সাঁওতাল, গারো, হাজং, নাচোল বিদ্রোহ যুক্ত হয়েছে এসব আন্দোলন-সংগ্রামে। আর পূর্ববাংলার ছাত্র-সমাজ জনগণের পুরোগামী হিসাবে এদেশের মুক্তিসংগ্রামের ঝান্ডাকে শুরু থেকেই বহন করেছে এবং বারবার বৈপ্লবিক কর্মসূচীভিত্তিক গণশিবির নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছে। ১৯৫৪ সালের ২১ দফা, ১৯৬৬ সালের ৬দফা, ১৯৬৭-৬৯ সালের ১১ দফা প্রনয়ণে ছাত্রসমাজ রেখেছে বৈপ্লবিক ভূমিকা।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ঘটনাধারার বৈপ্লবিক প্রামাণ্যতা এখানেই যে, এই অপরাজেয় জাতিসত্ত্বার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য মেহনতি জনতার নির্মীয়মান বৈপ্লবিক শক্তি। পর্যায়ের পর পর্যায়ে অধিকতর ক্রুর এবং প্রতিহিংসা পরায়ণ পাকিস্তানী শাসকচক্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম জনগণের গভীরতম স্তরগুলো থেকে নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করে এবং নতুনতর চেতনা নিয়ে সংগ্রামে নিয়োজিত হয়েছে বলেই নেতৃত্বের বৈপ্লবিক সম্প্রসারণ অনিবার্য ঐতিহাসিক সত্য হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের সাথে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে সমাজতন্ত্রের দাবি।

পোস্টার চার একজন সামরিক জান্তার মুখ। এই সামরিক জান্তার নাম ইয়াহিয়া। ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপর যিনি ট্যাঙ্ক চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ মানুষকে যিনি খুন করেছেন। এই সামরিক জান্তার মুখ শিল্পী কামরুল হাসান দানবের মুখ করে এঁকেছিলেন। ইয়াহিয়ার ভয়ংকর রুপ প্রকাশ করতে তার দাঁত ও চোখ তিনি এঁকেছিলেন লাল রঙে। বাকি অংশে ব্যবহার করেছিলেন কালো রঙ। মাত্র দুই রঙে আঁকা এই প্রতিকৃতিটি শুধু ইয়াহিয়ার নয়, পাকিস্তানের সকল সামরিক শাসকের চেহারা হয়ে উঠেছিলো। এই সামরিক জান্তা কেবল ১৯৭১-এ মানুষ খুন করেছেন এমন নয় বরং এই সামরিক জান্তাদের ২৪ বছরের শাসনকালে করাচি-লাহোর-রাওয়ালপিন্ডি ভিত্তিক বাইশ পরিবারের রক্ষক সাম্রাজ্যবাদী-সামন্তবাদী-পূঁজিবাদী শাসকচক্র পূর্ববাংলাকে উপনিবেশ হিসাবে বহাল রাখার জন্য বারে বারেই এদেশের জনগণের উপর নির্যাতন নিপীড়নমূলক প্রশাসনিক এবং সামরিক ব্যবস্থার মাত্রা চড়িয়ে এসেছে। সামরিক বাহিনী যে ঔপনিবেশিক স্বার্থরক্ষার বাহিনী হিসাবেই নিপীড়ন চালিয়েছে, তার দু’টি প্রমাণ উল্লেখ করেন রণেশ দাশগুপ্ত। তাঁর (১৯৭১: ৪২) ভাষায়:

একটি প্রমাণ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সাম্রাজ্যবাদী পূঁজিবাদী শাসকচক্র যে সরকার খাড়া করেছে, তা সামরিক সরকার। দ্বিতীয়ত, সামরিক বাহিনীতে পূর্ববাংলার লোক কার্যত নেয়া হয়নি এবং পূর্ববাংলার সামরিক বাহিনীর সদর দফতর স্থাপন, পূর্ববাংলায় প্রধান নৌ-ঘাঁটি স্থাপন প্রভৃতির দাবিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।

ইয়াহিয়ার যে মুখটি শিল্পী কামরুল হাসান এঁকেছিলেন সেটি চরম স্বৈরাচারী, চরম নির্যাতনকারী, চরম ধিকৃত এক দানবের চেহারা। পর্যায়ের পর পর্যায় পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর শোষণে পিষ্ট বাঙালী জাতির চরম ঘৃণাই মূর্ত হয়েছে এই পোস্টারে। এই ঘৃণা ইয়াহিয়ার প্রতি যেমন, তেমনি নির্যাতন-নিপীড়নের ধারক সামরিক বাহিনীর প্রতি এবং অবশ্যই যুদ্ধাপরাধের প্রতি।

ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন পোস্টার এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়ের কিছু প্রতিনিধিত্বশীল শ্লোগান থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের যে প্রতীকগুলো পাই তা হলো, বাঙালী জাতীয়তাবাদ যার ভিত্তি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা, পাই নারী-পুরুষ-ধর্ম নির্বিশেষে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের অভিপ্রায় কেননা দেশটির সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় নারী এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধ করেছেন, জীবন দিয়েছেন। পাই স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার অভিপ্রায়। পাই এই যুদ্ধে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অংশীদারিত্বের প্রতীক যা অনিবার্যভাবে একটি সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা নির্মাণের দায় তৈরী করে। এবং সবশেষে কামরুল হাসানের পোস্টারটি সুস্পষ্টভাবে সামরিক জান্তা এবং যুদ্ধাপরাধের প্রতি আমাদের জাতিগত ক্ষোভকে মূর্ত করে তোলে। যদি মুক্তিযুদ্ধকে মানি, তবে এই প্রতীকগুলো ধারণ না করে উপায় নেই। উপায় নেই বলেই দেশ স্বাধীন হবার পর, দেশের প্রথম সংবিধানে, ১৯৭২ সালের সংবিধান নামে পরিচিত সংবিধানে, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র - এই চারটি মূলনীতিকে দেশ পরিচালনার নীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়।

গ. প্রতীকগুলো আমরা হারিয়েছি যেভাবে
দেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই কিছু কিছু প্রতীক আমরা হারাতে শুরু করি এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে, পরবর্তী ২১ বছরে প্রায় সবগুলো প্রতীক আমরা হারিয়ে ফেলি। দেখা যাক, কীভাবে আমরা প্রতীকগুলো হারিয়েছি।

বড় প্রতীকগুলো নিয়েই শুরু করতে হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পরে এবং ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করার ভেতর দিয়ে একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়, যার লক্ষ্যই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী একটি পাল্টা রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা। এ’ধারার চূড়ান্ত পরিণতি পায় অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসা প্রথমে সামরিক শাসক এবং পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে। এই এক সংশোধনীতে বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র- এই তিন নীতি খারিজ হয়ে যায়। আসলে খারিজ হয়ে যায় চার মূলনীতিই। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যতীত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কীভাবে বহাল থাকতে পারে? যদি কোন রাাষ্ট্র এক বিশেষ জনগোষ্ঠীর ধর্মকেই প্রাধান্য দেয়, তবে সেই রাষ্ট্রের অন্য নাগরিকের অধিকার ক্ষুন্ন হয়। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার পাবার বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা। বস্তুত এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালীদের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধারণার সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার যে প্রতীকটি নির্মিত হয়েছিলো সেটি উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদ করা হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম শক্তিশালী উপাদান বাঙালী জাতীয়তাবাদ। উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িক। পাকিস্তান আমলে যেমন বাংলাভাষার বিরোধিতা করা হয়েছিলো ‘কাফেরদের ভাষা’ বলে কিংবা এই ভাষায় দেবদেবীদের স্তুতি করা আছে অভিযোগে, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সেই একই বিবেচনায় হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতির সাথে, চর্যাগীতিকা, মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য, আউল-বাউল-দরবেশ-কর্তাভজা সম্প্রদায়, লোককাহিনী থেকে শুরু করে আমাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের গোড়া কেটে এক ফরমানে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করলেন। সুুচতুর যুক্তিটা ছিলো, বাংলাদেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশী হিসাবে পরিচিত হবে। নাগরিকত্ব এবং জাতীয়তাবাদের মধ্যকার পার্থক্য এই সামরিক শাসক এবং তার চাটুকারেরা জানতেন না এমন নয় বরং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চেতনার বিরোধিতা করা, এদেশের মানুষকে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় থেকে উৎখাত করাই ছিলো এই সংশোধনীর মূল উদ্দেশ্য। পঞ্চম সংশোধনীর এই সাম্প্রদায়িক অভিযাত্রা পাকাপোক্ত করেন পরবর্তী সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রধর্র্ম ইসলাম প্রবর্তন করে।

আর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই সামরিক শাসন এবং যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে যে তীব্র ঘৃণা প্রতীকায়িত হয়েছিলো, যা মূর্ত হয়ে উঠেছে কামরুল হাসানের পোস্টারে, এই দুই প্রতীকই তছনছ হয়ে যায় প্রথমে সামরিক শাসক হিসাবে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাগ্রহণের মাধ্যমে এবং এদেশের মন্ত্রীসভায় প্রধানমন্ত্রী করাসহ নানাভাবে যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে। ঘটনা শুধু সংবিধান পরিবর্তনের মধ্যেই থেমে থাকেনি, বরং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধকে আলোচনার বাইরে নিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই করেছিলেন এই সুচতুর সামরিক শাসক। মুক্তিযুদ্ধকে সরিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধকে প্রতিস্থাপন করা হলো, যার ইতিহাস শুরু হলো, ‘‘২৫শে মার্চের কালরাতে ঘুমন্ত বাঙালী জাতির উপর হানাদারেরা অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়লে জিয়াউর রহমানের ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’র মাধ্যমে এদেশের মানুষ সেই হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলার জন্য যু্েদ্ধ অবতীর্ণ হলেন।” এই বিকৃত ইতিহাস পড়ানো হলো সকল স্কুল টেক্সটে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের যে দীর্ঘস্থায়ী ধারাবাহিক সংগ্রাম মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে, সে ইতিহাস গেলো চাপা পড়ে। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান প্রতিস্থাপিত হলো ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগান-এর অনুকরণে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ দিয়ে। এক সামরিক শাসকের ঘোষণায় স্বাধীনতার যুদ্ধে অবয়বহীন তথাকথিত ‘হানাদার বাহিনী’র বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের যুদ্ধ করার বানানো ইতিহাস প্রচারিত হতে থাকলো সকল মাধ্যমে। সমাজতন্ত্রকে সরিয়ে সামাজিক ন্যায় বিচারের কথা বলা হলো। যে অর্থনেতিক মুক্তি অর্জন ছিলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আকাংখা, সেটি ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ নামের উদ্ভট দর্শন দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে গেলো। স্বনির্ভর অর্থনীতি নির্মাণের বিপরীতে নানা দেশ থেকে চেয়ে-চিন্তে আনা টাকা হয়ে উঠলো ‘নো প্রবলেম’-এর উৎস। প্রবর্তন করলেন ‘আই উইল মেক পলিটিকস ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ানস’ নামের ভয়ংকর দর্শন। জিয়াউর রহমান শুধু একথা বলেই ক্ষান্ত হননি, তিনি আক্ষরিক অর্থে সে কাজ করে দেখিয়েছেন। রাজনীতি রাজনীতিকের কাছ থেকে ছিনতাই হয়ে কুক্ষিগত হয়ে পড়লো সামরিক এলিট, ব্যুরোক্রাটিক এলিট এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে। অথচ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় রাজনীতি বলতে সামরিক এলিট, ব্যুরোক্রাটিক এলিট এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিপরীতে সাধারণ মানুষের রাজনীতিই বোঝাত। রাজনৈতিক নেতা বলতে যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, মণি সিং, তাজউদ্দিন-কে বোঝাত, সেখানে রাজনীতিক হিসাবে প্রতিস্থাপিত হলেন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান, যুদ্ধাপরাধী শাহ আজিজুর রহমান, এবং এরই ধারাবাহিকতায় আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ।

আর একটি প্রতীক নিয়ে আলোচনা না করলেই নয়, যে প্রতীকটি কোন স্বৈরাচারী সামরিক সরকারপ্রধান উচ্ছেদ করেননি বরং জাতিগত এবং জেন্ডার অসংবেদনশীলতার কারণেই উচ্ছেদ হয়েছে। দুঃখজনক যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত নানা প্রতীকের মধ্যে প্রথম যে প্রতীকটি আমরা বিসর্জন দেই সেটি হলো, নারীর মুক্তিযোদ্ধা ইমেজ। ‘মা-বোনেরা অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ শ্লোগান পেরিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন পোস্টার ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’য় নারীর যে যোদ্ধা ইমেজ সেটি প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত নাইব উদ্দিন আহমেদ-এর তোলা ধর্ষিত নারীর ছবি দিয়ে। পরবর্তী সময়ে নারীর এই ধর্ষিত ইমেজটিই পাকাপোক্ত হয়ে যায়। যুদ্ধকালীন শারীরিক নির্যাতনের স্বাক্ষর পুরুষকে দেয় মুক্তিযোদ্ধার সম্মান, নারীকে দেয় ‘সম্ভ্রমহানি’র সার্টিফিকেট। এমন কি যেসব নারী মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং নির্যাতিত হয়েছেন, তাদেরও মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি ছাপিয়ে ধর্ষিত ইমেজটিকেই সামনে নিয়ে আসা হয়। কবিতায়, উপন্যাসে, গল্পে, নাটকে, চলচ্চিত্রে নারীর এই ধর্ষিত ইমেজটিই একমাত্র হয়ে ওঠে। আর মূলধারার ইতিহাস লেখে, ‘‘ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।’’ ফলে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের ১৫ খন্ডের কোন খন্ডেই মুক্তিযোদ্ধা নারীর বিবরণ পাওয়া যায় না। যুদ্ধকালে নারীর উপর নেমে আসা শারীরিক নির্যাতন ‘সম্ভ্রমহানি’ত্বর প্রতীক হয়ে ওঠার কারণে সমাজ তাদের এই পরিচয়কে লুকিয়ে রাখতে তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে একদিকে তারা জন পরিসরে অদৃশ্য হয়ে যান, অন্যদিকে তাদের অবদানকে এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গর্বিত অংশীদারিত্বের সাথে এক করে দেখা সম্ভব হয় না। এর ফলাফল কীভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যহত করে বা করতে পারে, সেটি পরবর্তী অংশের আলোচনায় দেখা যাবে।

আমরা যদি একটু মোটা দাগে মিলিয়ে নেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত কিছু প্রতীকের সাথে প্রতিস্থাপিত প্রতীকসমূহ, তা’হলেই হয়তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পর্কিত আমাদের অর্জিত প্রতীকগুলোর হারানোর মর্ম সম্পর্কে ধারণা পাব।

অর্থাৎ দেশের নাম পরিবর্তন এবং পতাকার পরিবর্তন ব্যতিরেকে কার্যত পাকিস্তান মডেলেই ফিরে যাওয়া।

দুই।
প্রসঙ্গ: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা দেশের ভেতরে হত্যাকান্ড, লুট, ধর্ষণ বা বিভিন্ন ধ্বংসের সাথে জড়িত ছিলো, তারা সকলেই যুদ্ধাপরাধী। পাকিস্তানের নীিিতনির্ধারক বা যারা এসব ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন তারা সকলেই যুদ্ধাপরাধী। যুদ্ধাপরাধী তারাও যারা স্থানীয় অধিবাসী, বাঙ্গালী বা অবাঙ্গালী।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার সাথে সাথেই দাবি উঠেছিলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের। আসলে এই দাবিটি উঠেছিলো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই, যেমনটি আমরা দেখতে পাই কামরুল হাসানের ‘‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে” পোস্টারটিতে। দেশ স্বাধীন হবার পর, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকেই বাংলাদেশে গণহত্যা, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবিদের হত্যার জন্য আল-বদরদের দায়ী করে বিচার দাবী করা হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবিদের শ্রদ্ধা জানিয়ে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো ‘চারুকলা ও সাহিত্য সংক্রান্ত ন্যাশনাল কাউন্সিল’ গঠন করা হবে। (মামুন, ২০০৮) এই প্রস্তাবের পরিণতি সম্পর্কে কেউ খোঁজ রাখেননি। ২৫ ডিসেম্বর বেগম সুফিয়া কামাল ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনসহ ৫২জন বিশিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিজীবি হত্যার বিচার দাবী করেন। ১৯৭২ সালে দেখা যায় কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে শহরে ‘বিক্ষোভ সভা ও মিছিল’ হচ্ছে। জহির রায়হান তখন এসব আন্দোলন সংগঠন করছিলেন এবং হত্যার তথ্য সংগ্রহে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর নিখোঁজ হবার পর বুদ্ধিজীবি নিধন তথ্যানুসন্ধান কমিটির উদ্যোগ থামিয়ে দেয়া হয়।

যে কোন মুক্তিসংগ্রামের পরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবার রেওয়াজ আছে সমাজ জীবনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই। আক্রমণকারী বাহিনী যে অপরাধ করেছে, সেটি প্রমাণ হওয়া জরুরী। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জেএন দীক্ষিত জানিয়েছেন, পাকিস্তানী বাহিনীর ৪০০ জনকে যুদ্ধাপরাধের জন্য শণাক্ত করা হয়েছিলো। কিন্তু ১৯৭২-এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সে সংখ্যা হ্রাস করে ১৯৫ এবং তারপর তা ১১৮-তে নিয়ে আসেন। কিন্তু এই ১১৮ জনের বিচারের জন্যও বাংলাদেশ সরকার মামলা তৈরী করতে পারেনি। এই যুদ্ধাপরাধীদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট চাপ ছিলো। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের পাকিস্তানে প্রত্যর্পণে সম্মতি দিয়েছিলেন এবং দীক্ষিত মনে করেন, সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিলো। বঙ্গবন্ধু পিএস হাকসারকে বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা মুশকিল এবং তিনি এ’কারণে সময় ও এনার্জি নষ্ট করতে চান না। (উদ্ধৃত, মামুন, ২০০৮: ৪৮)।

তবে স্বাধীনতার পর পরই এ’দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছিলো। প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে কারাগারে পাঠানো হয়। এদের বিচার কাজ চলতে থাকে এবং ৭৫২ জনকে বিভিন্ন শাস্তি দেয়া হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে ৩৭ হাজার অপরাধীর মধ্য থেকে প্রায় ২৬ হাজার অপরাধীকে ক্ষমা করা হয়। কিন্তু, হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন এবং গ্রামে অগ্নিসংযোগ- এসব অপরাধে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তাদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনা হয়নি। বাকি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছিলো ‘দালাল আইন’-এ। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান সরকার দালাল আইন বাতিল করলে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী মুক্তি পেয়ে যায়। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তী ১৫ বছর এই বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য হয়নি। মাঝখানে জাহানারা ইমাম যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণআদালত গঠন করে সোহরাওয়াদ্দী উদ্যানে প্রতীকী বিচারও হয়, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীরা বহাল তবিয়তেই থেকে যান। যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান গোলাম আযম আইনী সহায়তায় নাগরিকত্ব ফিরে পান। গণআদালতের পর বেগম জিয়ার সরকার এর সাথে যুক্ত ২৪ জনকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে ঘোষণা করে এবং জাহানারা ইমাম ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’র তকমা মাথায় নিয়েই মৃত্যুবরণ করেন। অর্থাৎ যারা দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছেন, সন্তান-পরিজন হারিয়েছেন তারা দেশদ্রোহী, আর যারা বিরোধিতা করেছেন তারা বিভিন্ন মেয়াদে হয়েছেন ক্ষমতাসীন এবং তারাই শাস্তিবিধান করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের, দিয়েছেন দেশদ্রোহীর তকমা।

ফের দীর্ঘ বিরতি, জাতি হিসাবে আমাদের বিস্মৃতিপ্রবণতাকে দায়ী করেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। তার (২০০৮: ৪৬) ভাষায়:

‘‘১৯৭১-৭২ সালের বিবর্ণ ফাইল খুলে দেখলে দেখা যাবে প্রতিটি পাতায় পাতায় হারিয়ে যাওয়া খুন হওয়া মানুষের খবর, খুনিদের তালিকা, বিচারের দাবি আর সরকারি প্রতিশ্র“তি। তৃতীয় বছর থেকে এসব খবর কমতে থাকে এবং এক সময় তা সীমাবদ্ধ হয়ে ওঠে ২৫ মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বর সংখ্যায়। হয়তো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিক নয়, খুনিদের বিচার না হওয়া, সমাজে তাদের প্রতিষ্ঠা করা, তাদের মিত্র করা।”

২০০৮ সালে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম গঠিত হলে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নটি ফের গুরুত্ব পায়। তাৎপর্যপূর্ণ যে, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে এক অভূতপূর্ব সাড়া দেখা যায়। আওয়ামী লীগ ২০০৮-এর নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গটি নিয়ে আসে। এই নির্বাচনে তিন চতুর্থাংশ আসনে জয়ী হওয়াকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেখেছেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবীতে তরুণ প্রজন্মের ম্যান্ডেট হিসাবে। যে গতিতে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে আশা করেছিলো জনগণ, গতি সে তুলনায় ধীর হলেও প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালস অ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুযায়ী বিচার কাজ চালানোর জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইবুনাল, আইনজীবি প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠিত হয়েছে। ইতিমধ্যে অভিযুক্ত করে আটক করা হয়েছে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী (সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে), মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (অভিযোগ গঠিত), আবদুল আলীম (জামিনে মুক্ত), আব্দুল কাদের মোল্লা-কে। অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ পলাতক রয়েছেন।

বিচার প্রক্রিয়ার শ্লথগতি নিয়ে যখন নানা সমালোচনা চলছে, তখন স্বাধীনতা বিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় উগ্রপন্থী ও চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। দেশে-বিদেশে বিপুল অর্থব্যয় করে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা নিয়োগ করে লবিইস্ট নিয়োগ করছে জামায়াত। ইতিমধ্যে আটককৃত অপরাধীদের দ্রুত বিচারের স্বার্থে দ্বিতীয় ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছে ২২ মার্চ ২০১২। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, অন্যদিকে যুদ্ধপরাধীদের রাজনীতির পক্ষের শক্তি আজ মুখোমুখি। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সরাসরি এই বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অথচ যুদ্ধাপরধীদের বিচারপ্রশ্নে তো জাতির দ্বিধাবিভক্তির কারণ ছিলো না। কারণ ছিলো না জামাতে ইসলামির নেতাদের “বাংলাদেশে কোন যুদ্ধপরাধী নেই- ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ নয়, গৃহযুদ্ধ হয়েছে” বা ‘‘মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো ভারতীয় স্বার্থে। আবার কেউ সুন্দরী নারীর লোভে আবার কেউ বা লুটতরাজের জন্য যুদ্ধ করেছিলো”-এ’জাতীয় ধৃষ্টতাপূর্ণ কথা বলার ঔদ্ধত্য দেখাতে পারার। এক সময়ের চরম কমিউনিস্ট সাদেক খান বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলে মুক্তিযোদ্ধাদেরও বিচার করতে হবে। গ্রেফতার হবার কয়েকদিন আগেও গোলাম আজম বলেছেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সমর্থন করে তিনি কোন দোষ করেননি। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের (২০০৮: ২৭) মতে,

যাদের বিচার হওয়া উচিত ছিলো, শাস্তি পাওয়া উচিত ছিলো, কিন্তু ঘটনাক্রমে যারা সেই বিচার থেকে আপাত রেহাই পেয়েছে, তারা এমন একটা অবস্থানে এসেছে যে, তারা এখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে, সর্বোপরি আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম এই প্রিয় মাতৃভূমির বিরুদ্ধে কটাক্ষপূর্ণ কথা বলার দুঃসাহস দেখাচ্ছে।

এই যে ‘তারা এমন একটা অবস্থানে এসেছে’- কোন সে অবস্থান সেটি বিশ্লেষণ করা জরুরী। কেনো তারা আসতে পেরেছেন এমন অবস্থানে যে কারণে এমন কথা তারা বলতে পারছেন বা কোন সে অবস্থানটি তৈরী হয়েছে সেটি বুঝতে না পারলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রশ্নে জাতির দ্বিধাবিভক্তির বিষয়টি বোঝা সম্ভব নয়।

তিন।
ক. হারানো প্রতীকের সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার কোন সম্পর্ক কি আছে?

জর্মান ইডিওলজিতে মার্কস (১৮২৩/১৮৪৫) বলেছিলেন, ‘ ‘The ideas of ruling class are in every epoch the ruling ideas’|
আধিপত্যশীল শ্রেণীর ধারণাই যুগে যুগে আধিপত্যশীল ধারণা হিসাবে বিরাজ করে। আর মিশেল ফুঁকো (১৯৬৯/১৯৭২) বলেছিলেন, ‘‘ভাষা যার দখলে, সত্য তার দখলে।’’ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এদেশের রাজনৈতিক ভাষা নির্মাণ করেছেন সাধারণ জনগণ এবং তাদের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা নেতৃত্ব। তাদের নির্মিত ভাষায় নিণীয়মান কাংঙ্খিত রাষ্ট্র যে প্রতীকগুলো তৈরী করেছে, সে প্রতীকগুলো নির্দেশ করে একটি সমতাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়। সেই সমাজে ঘৃণা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি, লুটেরা কালো টাকার শক্তির প্রতি, সামরিক শাসনের প্রতি, যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি। বহু সংগ্রামে, বহু বেদনায়, বহু যতেœ সে প্রতীকগুলো নির্মিত হয়েছিলো- এই প্রতীকগুলোকেই আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কিছু বিমূর্ত ধারণার মূর্ত প্রকাশ এসব প্রতীক। একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য, জীবনের সুকুমারবৃত্তিগুলোকে ধারণ করবার মতো একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যয় ছিলো এসব প্রতীকের ভেতর।

স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতার নির্মম হত্যাকান্ডের পরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী নেতাদের ছবি মুছে ফেলা সম্ভব হয়, বিশেষত যারা মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের কাছ থেকে। সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় নেতৃত্ব দিয়েছেন যাঁরা পুরোটা পাকিস্তানী আমলে, তাদের নেতৃত্বস্থানীয়দের খুন করা হয়েছে আগেই। এই খুনগুলো পাকিস্তানের পরাজিত শক্তির বড় প্রয়োজন ছিলো। এসব হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে সামরিক উর্দিধারীদের যথেচ্ছ বিচরণের পথে চ্যালেঞ্জকারীদের নিঃশ্চিহ্ন করে ফেলা সম্ভব হয়।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম বছরের পর বছর সামরিক শাসকের তৈরী করা ভাষায় এবং প্রতীকে এদেশের বিকৃত ইতিহাসের সাথে পরিচিত হতে থাকলো। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে যে ক্ষোভ এবং ঘৃণা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেই চেতনায় সংশয় নিয়ে আসা সম্ভব হলো। তারা আসলে পরিচিত হলেন আরেকটি পাকিস্তানের সাথে। মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ প্রক্ষালন করা তবু সম্ভব হয়নি, কারণ মুক্তিযুদ্ধ একটি বিরাট ঘটনা, বাঙালী জাতির জীবনে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। চাইলেই সম্পূর্ণটা ভুলিয়ে দেয়া সম্ভব না। এছাড়াও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি শত দমন-পীড়নেও সম্পূর্ণ পিছু হটেনি। বিশেষত বুদ্ধিজীবি এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের বড় অংশ দায়বোধ বজায় রেখেছেন তাদের শেকড়ের প্রতি। দায়বোধ বজায় রেখেছেন এদেশের সাধারণ মানুষও। কিন্তু যা সম্ভব হয়েছে সেটি হলো সংশয় তৈরী করা। সেই সংশয় যে কেবল নতুন প্রজন্মের একাংশের মধ্যে তৈরী হয়েছে এমন নয়, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যেও তৈরী হয়েছে। তারাও হয় বিস্মৃত হয়েছেন অথবা অপোষ করেছেন ‘পরিবর্তিত’ পরিস্থিতির সাথে। তাই তাদের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাবার প্রতিশ্রুতি থাকলেও তারা পিছু হটেছেন। হাইকোর্টের রায়ে পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করা সত্ত্বেও ফিরে যেতে পারেনি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতায়। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে বাঙালী জাতীয়তাবাদে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রেখে এবং বিসমিল্লাহির রাহমানুর রহিম সংবিধানে রেখে কীভাবে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেটি বোধগম্য নয় যেখানে বাঙালী জাতীয়তাবাদের নির্মাণে বলাই আছে এই ভূ-খন্ডের সকল ধর্মাবলম্বী মিলেই বাঙালী। তবে এখানে একটি বিষয় খোলাসা করে বলে নিতে চাই, যদিও বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল চালিকাশক্তি, প্রাক-মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রস্তুতিপর্বে এবং মুক্তিযুদ্ধে এদেশের অন্যান্য জাতিসত্ত্বার মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন, জীবন দিয়েছেন কাজেই বাঙালী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে শুধু জাতীয়তাবাদ রাখাই হতো অধিকতর যুক্তিসংগত এবং সকল নৃতাত্ত্বিক জাতির সাংবিধানিক স্বীকৃতিই হতে পারে বাংলাদেশ নামের দেশটি যে ধারণাকে প্রতীকায়িত করে, তার সাথে সংগতিপূর্ণ। কিছু উগ্র ধর্মীয় নেতাদের আস্ফালনে, তাদের তুষ্ট করার জন্য বর্তমান সরকার বারবার নারীনীতির বাস্তবায়ন থেকে পিছু হটেছে। ফতোয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারেনি। তবে ধর্ম প্রশ্নে এই দোদুল্যমানতা বর্তমান সরকারের আজকের নয়। বঙ্গবন্ধুর তাড়াহুড়ো করে ওআইসি সম্মেলনে যোগদান, পাকিস্তান সফর, ব্যক্ত-অব্যক্ত নানা শর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ ও সম্পর্কবৃদ্ধি, দেশের ভেতরে মাদ্রাসা শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো, ধর্মব্যবসায়ীদের নানাভাবে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা এবং পাকিস্তানপন্থী শক্তির প্রতি নরম নীতি গ্রহণ এই দলটির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে আপোষেরই ইঙ্গিত। এখনো ‘লা-ইলাহা ইল্লালাহ, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’ বা শিক্ষানীতিতে মাদ্রাসা শিক্ষা এবং ইংরেজী মাধ্যম বজায় রাখা ইঙ্গিত করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দলটি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত প্রতীকসমূহ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। সমাজতন্ত্রকে তাদের আর বাস্তবসম্মত মনে হয় না। অথচ ’৭২-এর সংবিধানে কমিউনিস্ট ইশতেহারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে “‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতা অনুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’ এহ নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কাজের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।” সংবিধানে আরো বলা হয়েছে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব ‘জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন’... ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবন ধারনের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা।’ স্বনির্ভর অর্থনীতির চাইতে চেয়ে-চিন্তে বিদেশ থেকে ভিক্ষে করে আনাই হয়েছে প্রতিস্থাপিত প্রতীক। বাকি থাকে, সামরিক স্বৈরাচার। যে সামরিক স্বৈরাচারকে এদেশের ছাত্র-জনতা দশকব্যাপী আন্দোলনশেষে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে, সেই সামরিক শাসকের সাথেই জোট বেধেছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল, মুক্তিযুদ্ধে প্রধান নেতৃত্বদানকারী দল, ২০০৮-এর নির্বাচনে। ৩ নম্বর পোস্টারে আমরা দেখেছি, দেশের সম্পদ বৃদ্ধি তথা স্বনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার জন্য তাগিদ। অথচ সেই প্রতীক থেকে সরে, নিজস্ব অর্থনীতিকে দাঁড় করানো যায়নি বলে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা আদৌ সম্ভব হবে কী না সেটি নির্ভর করে সৌদি আরবসহ আরব বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর উপর কী প্রভাব ফেলবে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দাতাগোষ্ঠী কতটা সায় দেবে তার উপর। সংবিধান থেকে একমাত্র ‘গণতš’¿কে কেউ সরায়নি বটে, কিন্তু গণতন্ত্রকে যে যার সুবিধামত কেটেছেঁটে নিজের মাপমতো বানিয়ে নিয়েছে। কয়েকবছর পর পর নির্বাচনই হচ্ছে সেই মাপমতো কেটে নেয়া গণতন্ত্রের সংস্করণ। সেই সংস্করণেও, এখন পর্যন্ত নির্বাচিত সরকারের আমলে সংসদ নির্বাচন দিয়ে নিশ্চিত হতে পারে না যখন যে বিরোধীদলে; ‘নির্দলীয়-নিরপেক্ষ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয় আর এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারই প্রতীক হয়ে ওঠে যে, এদেশে স্রেফ নির্বাচন-সর্বস্ব গণতন্ত্রও প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পায়নি। র‌্যাবের গুলিতে লিমনের কাটা পা, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর খন্ডিত অধিকার (মুসলিম পারিবারিক আইন) কিংবা কোন ধরণের অধিকার না থাকা (হিন্দু, বৌদ্ধ এবং বেশ কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর), বিয়ে, বিয়ে-বিচ্ছেদ-সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রশ্নে নারীর অধিকারহীনতা, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপাদানে মানুষের অধিকারহীনতা, নির্বাচনে জেতার জন্য যুদ্ধাপরাধী বা স্বৈরাচারী শাসকদের নিয়ে জোটগঠন খুব ভালোভাবেই প্রতীকায়িত করে শাসক দলগুলো কোন গণতন্ত্র চর্চা করছে। ফলে যেসব শক্তি যুদ্ধাপরাধের বিচার সুষ্ঠু হবে কী না বলে মায়াকান্না করছে কিংবা বর্তমান ব্যবস্থায় যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে মানবতা লঙ্ঘিত হবে বলে ধূয়া তুলছে, তাদের যে গণতান্ত্রিক শক্তির বিক্ষোভের মুখে খড়-কুটোর মতো ভেসে যাবার কথা ছিলো, সেই বিক্ষোভটি তৈরীই হতে পারছে না। এসব নির্ভরশীল চলকের বাইরে, মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত প্রতীক থেকে সরে যাবার কারণে খুব সরাসরি যুদ্ধাপরাধের বিচার যেভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে তার একটি সরল উদাহরণ দিতে চাই। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানকে কেবলই ধর্ষণে সীমাবদ্ধ রাখার কারণে এবং তারচেয়েও বেশি ধর্ষিত নারীকে ‘সম্ভ্রমহীন’ সার্টিফিকেট দেবার কারণে সামাজিক লজ্জার ভয়ে নির্যাতিত নারীরা অদৃশ্য হয়ে গেছেন, তাদেরকে যুদ্ধাপরাধের জীবন্ত সাক্ষী হিসাবে সাক্ষ্য দেওয়ানো আজ খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে। অথচ যুদ্ধে তাদের নানা ধরণের অংশগ্রহণ এবং নির্যাতিত হবার বিষয়টিকে যদি দেশটির সৃজন প্রক্রিয়ায় তাদের অবদান হিসাবে রুপান্তর করা যেতো, মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা দেয়া যেতো, তবে যুদ্ধাপরাধের বিচার অনেক ক্ষেত্রেই সহজ হতো। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক কিংবা বলা ভালো কূট-তর্কে মেতেছেন কেবল মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিই নয়, একদল তথাকথিত বুদ্ধিজীবি, নিরপেক্ষতার নামে, কেউ কেউ এমনকি সমাজতন্ত্রের নাম গায়ে লাগিয়ে। যাদের বাড়ি লুট হয়েছে, আগুনে পেড়ানো হয়েছে জীবনের তাগিদে আবার তারা সাধ্য অনুযায়ী ঘর তুলেছেন কিংবা না পারলে হারিয়ে গেছেন। কিন্তু যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা নিয়ে যেসব নারী এখনো বেঁচে আছেন কেবল তারাই হতে পারতেন সবচেয়ে নির্ভরশীল সাক্ষ্য।

খ. হারানো প্রতীকসব ফিরে পাবো কি?
আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই বলি বা বলি অর্জিত প্রতীক, সেইসব প্রতীক যা ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছি, তার সাথে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সাফল্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত প্রতীকগুলোকে ধরে রাখা যায়নি বলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে জাতি আজ দ্বিধাবিভক্ত। মানুষের মনে সংশয় ঢুকানো হয়েছে, এই বিচার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে বিভক্ত জাতি আরও বিভক্ত হবে কী না, যুদ্ধাপরাধীরা নাশকতামূলক কাজে নিয়োজিত হয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে কী না, সেই উদ্বেগ কাজ করছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে সরকারের নানা সময়ের আপোষ, পরনির্ভরশীল অর্থনীতি, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে তেল-গ্যাস-বিদ্যুত ইজারা দেয়া, নাজুক পররাষ্ট্রনীতি, বিএনপি-জামাত জোটের ক্রম শক্তিবৃদ্ধি সব মিলিয়ে যে জটিল পরিস্থিতি, তার সাথে যোগ হয়েছে অন্য একটি সংশয়, আসলেই মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রত্যাখান করছে কী না। যদি বাংলাদেশ ধারণ করে পাকিস্তানের সকল প্রতীক, তবে সেই রাষ্ট্র রক্ষাকারী রাজাকার-আল বদর-আল শামসকে বিচারের আওতায় টেনে আনার কতটা জোরালো তাগিদ থাকা সম্ভব?

প্রয়োজন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কেনো প্রয়োজন, সেই বিষয়ে সবাইকে সচেতন করা, যুদ্ধাপরাধের প্রতি প্রকৃত ক্রোধ ও ঘৃণা তৈরী করা, কিন্তু তারচেয়েও বেশি প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকগুলোকে চিনিয়ে দেয়া এ’প্রজন্মকে। কোন সরকারের পক্ষেই এই দায়িত্ব একা পালন সম্ভব নয়। সেজন্য দরকার স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মকান্ডে এসব প্রতীকগুলো ছড়িয়ে দেয়া, প্রকৃত ইতিহাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। বিশ্বায়নের এই যুগে, কর্পোরেট আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা মেধায়-মননে-জীবনে চর্চা করা খুব চ্যালেঞ্জিং। অথচ এই চ্যালেঞ্জিং কাজটি করার স্পর্ধা নিয়েই এদেশটির স্বপ্ন দেখেছে মানুষ। যুদ্ধপরাধের বিচারটি করা গেলে কিছু প্রতীক ফিরিয়ে আনা সহজ হবে আবার কিছু প্রতীককে ফিরিয়ে আনা না গেলে প্রকৃত অর্থে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্ভব কী না, এই আন্তঃসম্পর্কিত প্রশ্ন নিয়ে ভাবা যেমন প্রয়োজন তেমনি যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হবার পাশাপাশি প্রাত্যাহিক জীবন-যাপনে এই প্রতীকগুলো কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় সে বিষয়েও প্রাকসিস শুরু করা দরকার। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বাম গণতান্ত্রিক মোর্চা যেমন প্রয়োজন, প্রয়োজন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক, প্রয়োজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে এসব চেতনা বা প্রতীককে ছড়িয়ে দেবার কাজে ব্যবহার করা। পাশাপাশি একটি শিক্ষাবার্তা, একটি ছায়ানট, গণসংগঠন উদীচী, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদসহ দেশীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে শামিল শক্তি এবং এ’জাতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ছোটবড় অবিরাম প্রতিরোধ ফিরিয়ে আনতে পারে হারানো প্রতীকগুলো। এসব হারানো প্রতীক ফিরে পেলে হয়তো পাকিস্তান রক্ষায় বদ্ধপরিকর খুনী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ফেটে পড়তে পারে দেশের মানুষ। এই প্রতীকগুলো মুক্তিযুদ্ধের সাথে আমাদের যোগসূত্র। বৃটিশ গণমাধ্যম তাত্ত্বিক, গণমাধ্যম বিশ্লেষণের সমাজ-সংস্কৃতি ধারার অন্যতম প্রবক্তা, রেমন্ড উইলিয়ামস সংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সামাজিক ‘অনুভব কাঠামো’ (ঝঃৎঁপঃঁৎব ড়ভ ঋববষরহম)-র কথা বলেছেন যা দীর্ঘদিনের চর্চায় কোন নির্দিষ্ট সংস্কৃতির মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়, যেমন তুমুল বৃষ্টি হলে বাঙালী খিচুরি-ইলিশের তাগিদ বোধ করে। এই সামাজিক অনুভব কাঠামোর ভেতর মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকগুলোকে নিয়ে আসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের এক একটি পোস্টার, একটি ছবি, একেকটি শ্লোগান হয়ে উঠতে পারে সেই সামাজিক অনুভব কাঠামো গঠনের এক একটি হাতিয়ার। হারানো প্রতীকসব ফিরে পাব কি? হায়!

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(* প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রচার বিভাগ থেকে প্রকাশিত পোস্টারে লিখিত বানান অনুযায়ী ‘বাঙালী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। )
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
তথ্য নির্দেশ
খন্দকার, এ. কে. (২০০৮)। “একাত্তরের ঘাতকদের ক্ষমা নাই”, যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি চাই। হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত। ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা।
পাল, মতিলাল (১৯৭১)। ‘‘বাংলাদেশ: অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত”, রক্তাক্ত বাংলা। পৃষ্ঠা ১৮৭-২১৫। আজিজুর রহমান মল্লিক সম্পাদিত। মুক্তধারা, ঢাকা।
মামুন, মুনতাসীর (২০০৮)। “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা জরুরি”, যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি চাই। হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত। ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা।
দাশগুপ্ত, রণেশ (১৯৭১)। “পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের গতিপ্রকৃতি”, রক্তাক্ত বাংলা। পৃষ্ঠা ৩৭-৬৮। আজিজুর রহমান মল্লিক সম্পাদিত। মুক্তধারা, ঢাকা।
Focult, Mitchel (1969/1972). The Archaeology of Knowledge. Routledge.
Marx, Karl (1845). The German Ideology. Marx-Engles Collected Works, Vol.5.
Papanek, Gustav. (1970). “Pakistan’s Development, Social Goals and Private Incentives”, Harvard University Press, Cambridge, Mass, Table 5A.
Economic Survry of Pakistan 1968-69. Ministry of Economic Affairs, Government of Pakistan.

gayenkaberi@gmail.com


মন্তব্য

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

চমৎকার।

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

আলী হায়দার এর ছবি

প্রিয় কমরেড কাবেরী,

আপনার দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা না করে পারছি না। লেখাটি আমার এপর্যন্ত দেখা মহান মুক্তিযুদ্ধের উপর সবচাইতে বিস্লেসনধর্মী লেখা। এ লেখাটিকে আরো বিস্তৃত করে একটি বই আকারে বের করা যেতে পারে। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের জানালা খুলে দিতে হবে। আর আমাদের 'তানিয়াদের'কে সামনে নিয়ে আসতে হবে। আমরা আছি আপনার সাথে।

লাল সালাম, শুভেচ্ছা।

স্বাধীন মণণ এর ছবি

অসাধারণ

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

উত্তম জাঝা!

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

Bivas Ahmed এর ছবি

অসাধারণ বলে আসলে কিছু বোঝানো যায় না।।।বার বার পড়তে হবে।।।বার বার।।।শুক্রিয়া।
বরষায় ইলিশ-খিচুরির তাগিদের মতই মুক্তিযুদ্ধের প্রতিকগুলোকে আত্মার, অনুভবের তাগিদে আনতে হবে।
হুহুহুহুহুহু---লালালালালা----লেখাটাকে একটা ডাক বলে মনে হচ্ছে।

তানিম এহসান এর ছবি

এই পোস্ট ছড়িয়ে দেয়া উচিত। শেয়ার দিলাম।

স্যাম এর ছবি

অসাধারণ

ধুসর জলছবি এর ছবি

অসাধারন বললে কম বলা হবে, পোস্টটা খুব দরকার ছিল। শেয়ার করলাম।

নীল এর ছবি

আমার গা শিরশির করছে। একটা সুরঙ্গের ভেতর দিয়ে আলো দেখতে পাওয়ার মতই কিছু একটা অনুভব করছি। আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারব না, লেখাটা পড়ার পর আমি কী অনুভব করছি। এই লেখাটা এতদিন কোথায় ছিল? শুধুমাত্র এই একটা লেখা দিয়ে একটা জাতি জেগে উঠতে পারে। এত আধুনিক বিশ্লেষণ, এত নিরমেদ আয়োজন, যুদ্ধকালীন সেইসব পোস্টার গুলোর এই রকম ব্যাখ্যা- আই এম সিম্পলি স্পিচলেস! প্লিজ এই লেখাটাকে ছড়িয়ে দিন, যেকোনো মূল্যে। আমাদের পুরো দেশের জন্য এই লেখাটা খুব বেশি দরকার।
আমি প্রকাশক হলে ঠিক এই মুহূর্তে দুই কোটি কপি ছাপিয়ে রাস্তায় নেমে যেতাম।
সচলায়তন সত্যিকার অর্থে আমাদের নির্জীব অচলায়তনকে নাড়াতে পেরেছে। ড কাবেরি গায়েন- কৃতজ্ঞ।

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

এত অসাধারণ হয়েছে যে গুছিয়ে মন্তব্য করতে পারছি না। প্রায় প্রতিটি বাক্যই কোট করার মতো যথাযথ, বিশ্লেষণিক, অতি গুরুত্বপূর্ণ। তবু এই কথাগুলো পুনর্ব্যক্ত করলাম>

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানকে কেবলই ধর্ষণে সীমাবদ্ধ রাখার কারণে এবং তারচেয়েও বেশি ধর্ষিত নারীকে ‘সম্ভ্রমহীন’ সার্টিফিকেট দেবার কারণে সামাজিক লজ্জার ভয়ে নির্যাতিত নারীরা অদৃশ্য হয়ে গেছেন, তাদেরকে যুদ্ধাপরাধের জীবন্ত সাক্ষী হিসাবে সাক্ষ্য দেওয়ানো আজ খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে। অথচ যুদ্ধে তাদের নানা ধরণের অংশগ্রহণ এবং নির্যাতিত হবার বিষয়টিকে যদি দেশটির সৃজন প্রক্রিয়ায় তাদের অবদান হিসাবে রুপান্তর করা যেতো, মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা দেয়া যেতো, তবে যুদ্ধাপরাধের বিচার অনেক ক্ষেত্রেই সহজ হতো।

শুধু চাই সবাই লেখাটি পড়ুক, সচলায়তন কর্তৃপক্ষ তথা সম্মানিত মডারেটরদের এই নিমিত্তে অনুরোধ করবো পোস্টটিকে বেশ কিছুদিন স্টিকি করে রাখা সম্ভব কি না এবং সেরা সন্দেশে আরো দীর্ঘদিন রেখে দেওয়া যায় কি না ভেবে দেখতে।

ম্যাডাম আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর মতো উপযুক্ত অনুভূতি খুঁজে পাচ্ছি না! সচলায়তনে আপনাকে স্বাগতম (আমি নিশ্চিত নই আরো লেখা ছিল কি না)। আপনার গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা অধ্যাপনা আর এজাতীয় জাতীয় বোধ বিনির্মাণের কর্মাকাণ্ডের জন্য অনেক শুভ কামনা রইলো।


_____________________
Give Her Freedom!

শমশের এর ছবি

অসাধারণ বিশ্লেষণ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আমার পড়া শ্রেষ্ঠ লেখা।
গুরু গুরু

তারেক অণু এর ছবি
রায়হান রশিদ এর ছবি

লেখাটির প্রায় সবটুকুই ভাল লেগেছে, শুধু এক জায়গায় লেখকের অতি-সরলীকরণ এবং এক ধরণের প্রেজুডিস লক্ষ্য করে একটু হোঁচট খেয়েছি, যা এমন একটি লেখার কাছ থেকে আশা করিনি।

লেখক মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক "একেকটি বাংলা অক্ষর অ আ ক খ একেকটি বাঙালীর জীবন" এর বিপরীতে প্রতিস্থাপিত প্রতীক হিসেবে "ইতিহাসের সাথে সংশ্রবহীন অপরিকল্পিত ক্যাডেট (কলেজের) প্রসার"-কে উল্লেখ করেছেন। একথা ঠিক মুক্তিযুদ্ধের পরে আরও অনেক নতুন ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে, আমি অবাক হয়েছি লেখকের ঢালাও মন্তব্যে। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় "ইতিহাসের সাথে সংশ্রবহীন" বহু কিশোর (এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও না) ক্যাডেটের ভূমিকা এবং আত্মত্যাগের কথা সম্ভবত এই লেখকের কখনও জানা হয়ে ওঠেনি। এ নিয়ে ব্লগমন্ডলে একটু খোঁজ করলেই বেশ কিছু পোস্ট অনায়াসেই খুঁজে পাবেন লেখক, তাই উল্লেখের প্রয়োজন বোধ করছি না।

আর ক্যাডেট কলেজ শিক্ষাব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধের আগ থেকেই ছিল, এটা ১৯৭১ এর পরের কোনও ঘটনা না। আর লেখক মাদ্রাসা ব্যবস্থা আর ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলগুলোর সাথে ক্যাডেট কলেজ শিক্ষাব্যবস্থাকে যেভাবে এক কাতারে বসিয়ে গুলিয়ে ফেললেন তা দেখে ধরে নিচ্ছি তিনি ক্যাডেট কলেজগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা রাখেন না। লেখকের জ্ঞাতার্থে - ক্যাডেট কলেজগুলোর শিক্ষার প্রধান মাধ্যম বাংলা। আরবী বা উর্দু বা ইংরেজী না! আর, ক্যাডেট কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও প্রচলিত শিক্ষাবোর্ডের সিলেবাস অনুসরণ করেই এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে থাকে!

আর এটা হয়তো তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য না লেখকের জন্য, তবে আমার জানা মতে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলনে এবং বর্তমানের বিচার প্রক্রিয়ায় সাথে "ইতিহাসের সাথে সংশ্রবহীন" বহু প্রাক্তন ক্যাডেটও দিনরাত নিজ নিজ অবস্থান থেকে সক্রিয়! সে সব সক্রিয়তার বিস্তারিত ফিরিস্তি দেয়ারও আগ্রহ বোধ করছি না, লেখক নিজ দায়িত্বে জেনে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

ধন্যবাদ।

কুলদা রায় এর ছবি

এই নোটে লেখক ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই কথা বলেন নি। তিনি বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ক্যাডেট কলেজ এবং সাধারণ স্কুল কলেজের শিক্ষাপদ্ধতি নিশ্চয়ই অভিন্ন নয়। খরচাপাতিও এক-রকম নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তো বিশেষ শ্রেণীর জন্য বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা রাখা হবে--এরকম ছিল না। কি বলেন, রায়হান রশীদ?

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

রায়হান রশিদ এর ছবি

এই নোটে লেখক ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই কথা বলেন নি। তিনি বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

সবিনয়ে বলি, লেখকের যে মন্তব্যটির ব্যাপারে আমি দৃষ্টি আকর্ষন করেছি তা নিঃসন্দেহে বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নয়! উপরে লেখকের দেয়া চমৎকার তুলনামূলক চার্টটি খেয়াল করুন (নিচ থেকে দু'নম্বর)। লেখকের রায়টি বাঙালীর সংস্কৃতি কৃষ্টি ও ইতিহাস নিয়ে, যার আলোকে ক্যাডেট কলেজগুলোকে "সংশ্রবহীন" বলে ঢালাওভাবে দাবী করা হয়েছে। সুতরাং, হ্যাঁ, লেখক ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের (বা ব্যবস্থাটির) ব্যাপারেই মন্তব্যটি করেছেন!

যদি বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েই লেখকের এই মন্তব্যটি হতো, তাহলে সেটা নিশ্চয়ই ভিন্ন ব্যাপার হতো, দৃষ্টি আকর্ষণেরও নিশ্চয়ই প্রয়োজন পড়তো না। কারণ আমি মনে করি না সার্বজনীন-বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়ে অন্তত নীতিগতভাবে আমাদের কারোই কোন দ্বিমত রয়েছে। আপনার যুক্তি অনুযায়ী যদি ক্যাডেট কলেজগুলোর ব্যয়বহুলতার দিকটা লেখকের উদ্দিষ্ট ধরেও নিই, তারপরও কি সেটা মাদ্রাসার সাথে এক কাতারে তুলনীয় হয়? আপনি নিশ্চয়ই দাবী করবেন না মাদ্রাসা শিক্ষাও একইরকম ব্যয়বহুল?

আমার ধারণা একটি লেখার সিংহভাগের সাথে একমত হয়েও কিছু কিছু ঢালাও অংশের সাথে দ্বিমত পোষণ করা যায়। যায় না কুলদা রায়?

হাসান এর ছবি

কুলদা রায় এর সাথে দ্বিমত । রায়হান ভাই এর সাথে একমত ।

ক্যাডেট কলেজ এবং সাধারণ স্কুল কলেজের শিক্ষাপদ্ধতি নিশ্চয়ই অভিন্ন নয়। খরচাপাতিও এক-রকম নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তো বিশেষ শ্রেণীর জন্য বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা রাখা হবে--এরকম ছিল না।

সত্যি কথা বলতে কি, বর্তমান সময়ে ক্যাডেট কলেজ এবং সাধারণ স্কুল কলেজের শিক্ষাপদ্ধতি'র মধ্যে কোন পার্থক্য নেই , পার্থক্য শুধু আবাসিক আর অনাবাসিক এটাই । ক্যাডেটদের ইউনিফরম খাকী আর সাধারণ স্কুল কলেজের সাদা বা সবুজ । আর যেহেতু আবাসিক সেজন্নে খরচাপাতি বেশি । কিন্তু ছাত্রদের বেতন নির্ভর করে অভিভাবক দের আয়ের উপর । আমাদের সাথে কেউ কোন টাকা দিত না আবার কেউ বছরে সত্তর হাজার টাকা দিত ।
আর ক্যাডেট কলেজে যে কেউ ভর্তি হতে পারে , এটা কোন বিশেষ শ্রেণীর জন্নে না - আমাদের ক্লাসে আদিবাসী , হিন্দু , বৌদ্ধ বা গ্রাম থেকে আসা অনেক ছাত্র ছিল ।
সার্বিকভাবে ঢাকা র একটা কলেজের সাথে গ্রামের একটা কলেজের যে বৈষম্য , ক্যাডেট কলেজের সাথে অন্য ইস্কুল কলেজের পার্থক্য তার বেশী না ।

লেখক এর ছবি

আপনার প্রশ্নের উত্তরটি কিন্তু দেয়া হয়ে গেছে। অতিথি লেখক কুলদা রায় দিয়েছেন। ব্যক্তি ক্যাডেটরা নিশ্চয়-ই অনেক দেশপ্রেমিক, যেমন দেশপ্রেমিক অনেক মাদ্রাসা পড়ুয়া, কিংবা ইংরেজী মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থী। কারো দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করার কোন প্রশ্নই আসে না, অন্তত আমার, কারণ, ব্যক্তি আমি পড়ানো ছাড়া কিছু করতে পারিনি দেশের জন্য। নিরীহ শিক্ষক হিসেবে বড়জোর গবেষণা ক্লাশে হয়তো জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেয়া'য় বাঙ্গালী জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের প্রতীকগুলো কীভাবে অবয়ব পেয়েছে সে বিষয়ে সেমিওলজিক্যাল অ্যানালাইসিস-টা কীভাবে করতে হয়, শিখিয়ে দিতে পারি। আমি এখানে ব্যক্তি নয়, সিস্টেম হিসেবে এই ধারাগুলোকে অভিযুক্ত করি এই কারণে যে '৬২-র শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এমন কি '৯০-এ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-সমাজের দশ-দফা দাবিতেও বিজ্ঞানমনস্ক, সেক্যুলার, একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার দাবি জানানো হয়েছে সবার জন্য, সব স্তরে। এই দাবি কিন্তু খুব বড় ধরণের আন্দোলন থেকে উঠে এসেছে। আপনি দাবি করেছেন, এই শিক্ষা ব্যবস্থা তো পাকিস্তানী আমলেও ছিলো। একদম ঠিক বলেছেন। আরেকজন অতিথি হাসান আরো ঠিক বলেছেন যে, ঢাকার একটি নামকরা কলেজের সাথে গ্রামের একটি কলেজের যে পার্থক্য, ক্যাডেট কলেজের সাথে অন্য স্কুল কলেজের পার্থক্য তার বেশি নয়। আমি এই বৈষম্যের কথাই বলতে চাই। ক্যাডেট কলেজের শিক্ষায়তনিক আবহ আমার জানামতে [আমার জানাটা অবশ্যই শেষ কথা নয়, ভুল হলে যে-কোন মূহুর্তে শুধরে নেয়াই আমার কাজ] খানিকটা কৃত্রিম, চাপিয়ে দেয়া, এবং অবশ্যই সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে বিচ্ছেদ-প্রবণ। তাদের জন্য সরকারী মাথাপিছু বরাদ্দ আর সাধারণ সরকারী বিদ্যায়তনের মাথা-পিছু বরাদ্দের হিসেব দেখলেই সেটি বোঝা যায়। সিলেবাস এক হলেই এক শিক্ষা হয় না। একটি এলিট শ্রেণী তৈরী-ই যদি এই সিস্টেমের উদ্দ্দেশ্য না হবে, তবে কেনো এতো বিনিয়োগ? আমার ভুল হলে আগাম দুঃখ প্রকাশ করে রাখছি, কাটা-চামচে খাওয়া বা টেবল ম্যানার্স জানা, লেফাফা-দুরস্ত হতে শেখানো, ইংরেজীতে বিশেষ জোরারোপ, লেফট-রাইট করানো এগুলো একসময় ইউরোপের 'নবেল' পরিবারের সন্তানদের যে সামরিক একাডেমিতে রেখে শেখানো হত সাধারণ মানুষের সাধারণ শিক্ষার বিপরীতে, হয়তো তার-ই ধারাক্রম। এ'ছাড়াও শুধু ঢাকা শহরে নয়, সারা দেশে যে শত শত প্রি-ক্যাডেট গজিয়ে উঠেছে, যদি সেইসব প্রি-ক্যাডেট-এর বিজ্ঞাপন দেখেন তা'হলে দেখবেন, 'সম্পূর্ণ ইংরেজী মিডিয়াম'-এ 'আবাসিক' শিক্ষাদান পদ্ধতির কথা। আপনার আপত্তি, 'একেকটি বাংলা অক্ষর অ আ ক খ একেকটি বাঙ্গালীর জীবন'-এর বিপরীতে কেনো 'ইতিহাসে সাথে সংস্রবহীন' হিসেবে ক্যাডেট-কেও দেখানো হল। আমার মতো যারা কম জানেন, তাদের মস্তিস্কে কিন্তু ক্যাডেটের ছেলেমেয়েদের সাথে ইংরেজীতে চোস্ত, কেতায় দুরস্ত, তুখোড় বিতার্কিক, এক্টুখানি সমাজের পাঁচটা সাধারণ ছেলেমেয়ের চাইতে 'স্মার্ট' ছেলেমেয়ের কথাই ভেসে ওঠে। এসব গুণের কোনটাই খারাপ নয়, কিন্তু তাদের উপর ছাপ দেয়া আছে যে তারা 'আলাদা'। এই 'আলাদাত্ব' অর্জনের প্রক্রিয়া তাদের সাধারণত্বের প্রাত্যাহিক ইতিহাস থেকে আলাদা করে দেয় বলে আমার মনে হয়। এই আলাদাত্ব যেমন রয়েছে ইংরেজী মিডিয়ামের শিক্ষায়, তেমনি মাদ্রাসা শিক্ষায়। আর হ্যা, মাদ্রাসা শিক্ষা কেবল গরীবদের জন্য, সেই দিন পালটে যাচ্ছে। এখন ঝাঁ-চকচকে ইংরেজী এবং আরবী-তে দক্ষ করবার মাদ্রাসা গজাচ্ছে সৌদী কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের টাকায়। মাদ্রাসায় বরাদ্দ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলে সরকারগুলোর মধ্যে। বেসরকারী, প্রাইভেট স্কুল্গুলোও দারুণ। শুধু ক্ষয়ে যাচ্ছে, বরাদ্দ কমে যাচ্ছে, ভদ্রস্থ চেহারাটা চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের সাধারণ সরকারী শিক্ষার। অবজ্ঞা তৈরী হচ্ছে বাংলা মাধ্যমে দেয়া শিক্ষার। ক্যাডেট কিংবা ইংরেজী মিডিয়ামের শিক্ষা বাংলা মাধ্যমের সাধারণ শিক্ষাকে কোণে ঠেলে দিতে চায়, পারে, ক্যাডেটে বাংলা মিডিয়ামে পড়ানো হলেও। কারণ বহুজাতিক কর্পোরেশনে কাজ করতে পারার অন্যতম যোগ্যতা এই ইংরেজী ভাষায় কাজ চালানোর মতো দক্ষ হওয়া। আমাকে ভুল বোঝার অবকাশ কমানোর জন্য বলি, একটি বিদেশী ভাষায় দক্ষতা অর্জনে আমার কোন আপত্তি নেই, বরং অভিনন্দিত করার আছে, কিন্তু আমার আপত্তি হল সেই ভাষায় আরোপ করা মূল্যে। আমার দেশের পরিকল্পনায় প্রতিবছর কতজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, শিক্ষক তৈরী করা হবে, কাজে নিয়োগ করা হবে সেই হিসেব নেই, কিন্তু আকাঙ্ক্ষা আছে কতজন বহুজাতিক কর্পোরেশনে কাজ করতে পারবে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে পড়ার চেয়ে হোটেল ম্যানেজমেন্টে পড়ার চাহিদা মেটাতে তৈরি হচ্ছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আর তার অর্থকরী কোর্স, ইংরেজী মাধ্যমে। ২০০৯ সালে প্রণীত শিক্ষানীতির উপর আমার একটি দীর্ঘ লেখা ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোতে তিন সংখ্যায়। আপনি চাইলে সেটি আপনাকে পাঠানো যাবে। কীভাবে এইসব বিশেষায়িত শিক্ষাকে জোরদার করতে গিয়ে মার খাচ্ছে আমাদের সাধারণ শিক্ষা, সেকথা বলতে গিয়েই আসলে এই প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে। সবশেষে বলি, আমাদের দেশে এখন প্রাইমারি স্তরে সরকারী হিসেব অনুযায়ী দশ ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। আমি একবার 'একুশের রাত'-এ হোস্ট হিসেবে এক থানা শিক্ষা কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি তার সন্তানকে সরকারী প্রাথমিক স্কুলে পড়ান কী না। তিনি পড়ান না তার সন্তানকে সরকারী প্রাথমিক স্কুলে। পড়ান স্থানীয় কিন্ডার গার্টেন-এ। এ'জন্যই বলি 'একেকটি বাংলা অক্ষর অ আ ক খ একেকটি বাঙ্গালীর জীবন'-এর বিপরীতে প্রতিস্থাপিত প্রতীক হয়ে উঠেছে অন্য সব বিশেষায়িত শিক্ষা। হ্যাঁ, মাদ্রাসা শিক্ষাও। কারণ শুধু স্কুল-কলেজেই নয়, শিক্ষিত মাওলানাদের পদ এখন তৈরী হচ্ছে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যন্ত। বর্তমান শিক্ষানীতিতে মাদ্রাসা শিক্ষাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তনের কথাও বলা হয়েছে। সবশেষে, আবারো বলি, কাউকে দুঃখ দেয়ার জন্য নয়, সিস্টেম হিসেবে এক সমাজে এতো ধরণের শিক্ষা এবং তাদের উপর আরোপিত নানা ধরণের সংযোজিত মূল্যেই আমার সংশয়। এবং তারপরো দ্বিমত থাকলে, সেখানে আমার শ্রদ্ধাপূর্ণ আলোচনা চালাতে অসুবিধা নেই।

আরিফ হাসান  এর ছবি

লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি,
ক্যাডেট কলেজ কোন এলিট শ্রেণি তৈরি করেনা। ক্যাডেট কলেজ তৈরি করে দেশের জন্য দক্ষ জনবল এবং সেনাবাহিনীর জন্য দক্ষ অফিসার। সেনাবাহিনীকে যদি আপনি এলিট শ্রেণি বলে দোষারোপ করে দেশের জন্য বোঝা বলতে চান একমাত্র সেইক্ষেত্রেই আমি বলবো যে ক্যাডেট কলেজ এলিট শ্রেণি তৈরি করে শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি করছে। আর আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি ক্যাডেট কলেজের কোন শিক্ষাই কৃত্তিম বা চাপিয়ে দেয়া নয় । বরঞ্চ আমাদের জেলা স্কুলগুলোতে যখন একজন শিক্ষার্থীকে ৫/৭ জন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ানো হয় সেটাই জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়। এই অসুস্থ অনুশীলনটা ক্যাডেট কলেজে করানো হয়না । দিনে সাড়ে ৩ ঘন্টা পড়াশুনার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ট্রেনিং দেয়া হয়। এই প্রয়োজনীয়তা আপনি তখনই বুঝতে সক্ষম হবেন যখন আপনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারবেন। আর যদি বলেন যে সেনাবাহিনীতে তুখোড় অফিসারদের দরকার নেই সেক্ষেত্রে আপনাএ বলার জন্য আপার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ধন্যবাদ।

সদানন্দ ঘরামী এর ছবি

২০১২ সালে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে তুখোড় অফিসারদের দ্বারা বাংলাদেশের সাধারন মানুষ কী কী উপকার পাচ্ছে সেটা একটু বিশদে বুঝিয়ে দিলে আমার মত যারা একটু কম বোঝে তাদের উপকার হতো। যদি আপনার একটু সময় হয়, আমি আসলেই জানতে আগ্রহী।

Ali Hyder এর ছবি

কিসের মধ্যে কি পান্তা ভাতে ঘি। কোথায় বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকের অবমুললায়নের কথা আর কোথায় সেনাবাহিনীর শ্রেণী চরিত্রের বিস্লেসন। আমার জানামতে গ্রাম এবং মফস্সল শহরের ছেলেমেয়েরা সেনাবাহিনীতে ভালো ফলাফল করে। কারণ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষকরা চায় একটা কাদামাটি যাকে তারা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের উপুযুক্ত করে গড়ে তুলবে। সেখানে ক্যাডেট কলেজের একটি ছেলে বা মেয়েকে mould up করা একটু কঠিন বইকি।

Ali Hyder এর ছবি

আমার জানামতে কাডেট কলেজ গুলো সৃষ্টি করা হযেছিল আয়ুব আমলে, উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি প্রসাসনের জন্য একদল অনুগত আমলা তৈরী করা। বাংলাদেশ আমলে এগুলো বন্ধ না করে বরং আরো এরকম কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলো. ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা সম্পর্কে আলাদাভাবে একটি আলোচনা হতে পারে.

তাশফীন এর ছবি

খুব ভালো লেখা, খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখা। আরো অনেক কমেন্ট পড়েনি কেন বুঝতে পারছি না।
# তাশফীন

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

প্রতীকের গুরুত্ব বর্ণনার জন্য ধন্যবাদ। আসলে ৭২ এর সংবিধানটাই একটা অ-বাস্তবায়িত প্রতীকে পরিণত এখন।

--

জহির রায়হান তখন এসব আন্দোলন সংগঠন করছিলেন এবং হত্যার তথ্য সংগ্রহে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর নিখোঁজ হবার পর বুদ্ধিজীবি নিধন তথ্যানুসন্ধান কমিটির উদ্যোগ থামিয়ে দেয়া হয়।

কোনো সূত্র পাওয়া যাবে কী?

--

জামাতের সাথে ঐক্য করে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের মূলস্বরকে নাকোচ করে না। রাজাকার মানসিকতার পার্টি রাজাকারের গলায় মালা পরাবে এতে আশ্চর্যের কী। বিএনপি জামাতকে স্বাধীনতার পরে পলাতক অবৈধ একটা দল থেকে বাংলাদেশকে হঠাৎ জিম্মি করে তোলার ক্ষমতাসম্পন্ন একটা দানবে পরিণত করছে। বিএনপির আদর্শ আর জামাতের আদর্শে পার্থক্য দাঁড়িকমাসেমিকোলনগত। আওয়ামী লীগ পক্ষান্তরে এরশাদের পার্টিকে পালন করে আদর্শের সাথে সমঝোতা করছে । যদিও, জাতীয় পার্টিকে জামাতের মতো দানব হয়ে দেয়ার সুযোগ দেয় নাই (হ্যাঁ, এই কথাটা বলা জরুরি কারণ জামাতকে লঘুকরণের জন্য জাতীয়পার্টিকে টাইনা আনা একটা ছদ্মজামাতি সুশীল লক্ষণ)। ঘরের ভিতরে হায়েনা পালন আর শুয়োর পালনের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমটা ভীতিকর, দ্বিতীয়টা অরুচিকর (যদিও সাংস্কৃতিক/ধর্মীয় কনটেক্সে)।

---

‘অনুভব কাঠামো’ (ঝঃৎঁপঃঁৎব ড়ভ ঋববষরহম)

স্ট্রাকচার অফ ফিলিং হওয়া কথা, ভেঙ্গে গেছে ইংলিশটা। সংবেদন কাঠামোও হইতে পারে বাংলা।

---

সচলায়তনে স্বাগতম। আরো লিখবেন আশা করি।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ স্বাগত জানানোর জন্য। আপনার জিজ্ঞাসার উত্তরগুলোঃ
১। সূত্রঃ মুনতাসীর মামুন (২০০৮)। ''যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা জরুরি'', যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি চাই। হায়া\ মামুদ সম্পাদিত। ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা। পৃষ্ঠা ৪৬-৫২। মামুন (২০০৮ঃ৪৭)-এর ভাষায়,

"...জহির রায়হান তখন এসব আন্দোলন সঙ্গগঠন করছিলেন এবং হত্যার তথ্য সংগ্রহে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পরবর্তী ঘটনা বিবৃত হয়েছে 'একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়' গ্রন্থে। আমি সেখান থেকে উদ্ধৃত করছি - '৩০ জানুয়ারী জহির রায়হান রহস্যজঙ্কভাবে নিখোঁজ হয়ে যান। এরপর বুদ্ধিজীবী নিধন তথ্যানুসন্ধান কমিটির উদ্যোগ থামিয়ে দেয়া হয়।..."

২। হ্যাঁ, শব্দটা 'স্ট্রাকচার অব ফিলিং', ইংরেজীটা ভেঙ্গে গেছে। রেমন্ড উইলিয়ামসের উপর এক দীর্ঘ লেখায় (১৯৯৮) আমি 'স্ট্রাকচার অব ফিলিং'-এর বাংলা করেছিলাম 'অনুভব কাঠামো'। তার দ্য লং রেভল্যুশন বই-এ এই প্রত্যয়টি পাই। আর কেউ কোনদিন এর অন্য কোন বাংলা করেছিলেন বলে জানা নেই। আপনারটাও হতে পারে। আমি 'অনুভব কাঠামো'-তে সন্তুষ্ট।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

১। অনেক ধন্যবাদ, বিষয়টা ইন্টারেস্টিং।

২। আমি কিন্তু বলি নাই অনুভব কাঠামো ভুল বা ঠিক। অনুভবের বদলে সংবেদন শব্দটা বসাইলে কেমন লাগে ভাবলাম আরকি। অনুভব শব্দটায় রোমান্টিকতা আছে একটা, আমারই সমস্যা আসলে। রেমন্ড উইলিয়ামস বিষয়ে আমার বিশেষ পড়াশুনা নাই। কেবল টেলিভিশন বিষয়ক তার একটা ছোট বই আছে। বহুবছর আগের লেখা হইলেও, সেইটার প্রাসঙ্গিকতা পাওয়া যায়। 'ফ্লো' থিওরি মাঝে মাঝে অনেক কিছু বুঝতে সাহায্য করে। আপনার তার উপরে লেখাটা পড়ার আগ্রহ হইল।

আরো লিখবেন আশা করি।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

লেখক এর ছবি

না না, সমস্যা কেনো হবে? একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদ হতেই তো পারে।
দ্য লং রেভল্যুশন
কালচার অ্যান্ড সোসাইটি

বই দু'টোকে মিডিয়া গবেষণার 'সমাজ-সংস্কৃতি' ধারার সেমিনাল বই হিসেবে ধরা হয়। টেলিভিশন বইটা আমাদের ডিপার্টমেন্টেও পড়ানো হয় বোধ হয়। আপনার ই-মেইল ঠিকানাটা মনে করে দিয়েন কোন সময়, আমি পাঠিয়ে দেবো লেখাটা।

সাফি এর ছবি

সময় নিয়ে পড়লাম, লেখাটা ভাল লেগেছে। তবে আশা করেছিলাম আরো অনেক মন্তব্য দেখব। একটা কারণ হতে পারে লেখাটা অনেক বড়। পর্ব পর্ব করে দেওয়ার চিন্তা করতে পারেন পরের লেখাগুলো। সচলায়তনে স্বাগতম।

পথিক পরাণ এর ছবি

অসাধারণ বিশ্লেষণধর্মী লেখা। ম্যাডামকে অনেক ধন্যবাদ।

বুভুক্ষু কঙ্কালসার বাসার কাজের লোকটি পর্যন্ত সামান্য গ্লাস ভেঙ্গে আমাদের ক্ষমায় সিক্ত হয়না, বরং নিজের প্রায় হিমোগ্লোবিন শূন্য রক্তে নিষিক্ত হয়। আর সেই আমরা আমাদের মহান স্বাধীনতার শত্রুদের অবলীলায় ক্ষমার ধুঁয়া তুলি!! আমাদের এতো ঔদার্য কোথায় থাকে!

হা সেলুকাস!

কাজি মামুন এর ছবি

দারুন বলেছেন‍! চলুক

সৌরভ কবীর  এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রিয়তে নিয়ে রাখলাম কাবেরী গায়েনের এই লিখা হাসি

চরম উদাস এর ছবি

অসাধারণ গুরু গুরু

লেখক এর ছবি

সচলায়তনে যারা আমাকে স্বাগত জানিয়েছেন, তাদের সবাইকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। যারা লেখাটি পড়েছেন, মন্তব্য করেছেন, তাদেরকেও আমার কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ। আমি দারুণ অনুপ্রাণিত। ব্লগে এই প্রথম। কাজেই ব্লগ সংস্কৃতির প্রায় পুরোটাই অজানা। শুধু জানি সচলায়তনে সব লেখকদের বসবাস। ভয়ে আছি। আমি লেখক নই। ভুল যা হবে, হবেই জানি, শুধরে দিলে কৃতজ্ঞ হবো।

লেখক এর ছবি

দুঃখিত, ক্যাডেট কলেজ নিয়ে যে বিতর্কটি উঠেছে, তার উত্তর আসলে দিতে চেয়েছি রায়হান রশীদ এবং হাসান-দু'জন-কেই। আনাড়িপনার জন্য উত্তরটি লেখা হয়েছে হাসান-এর মন্তব্যের নীচে।

সৌরভ কবীর  এর ছবি

ভীষণ ভালো লেগেছে। পড়বার পরেই মনে হল মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, চেতনা আর সত্য ইতিহাসের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় এক অভিযাত্রার মধ্যে ছিলাম।
গুরু গুরু

সাইফ শহীদ এর ছবি

কাবেরী গায়েনকে স্বাগতম এবং এই দীর্ঘ লেখাটার জন্যে ধন্যবাদ।

১৯৭৫-এর আগে থেকেই কিন্তু আমরা কিছু কিছু জিনিস হারাতে শুরু করি। সৎ ইতিহাসের সার্থে সেগুলির উল্লেখ হলে ভাল হত। ১৯৫ জন পাকি যুদ্ধবন্ধীকে ছেড়ে দেওয়া, রক্ষী বাহিনী সৃষ্টি করা, ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষে অসহায় মানুষকে বাঁচাতে না পারা, ক্ষমতা কেন্দ্রীভুত করা - এগুলির পিছনে যতই যুক্তিযুক্ত কারন থাকুক - উল্লেখ করলে হয়তো লেখাটা পরিপূর্ণ মনে হত।

ভবিশ্যতে আরও লেখা আশা করবো আপনার কাছ থেকে।

সাইফ শহীদ

লেখক এর ছবি

একমত। ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দেওয়া, সাধারণ ক্ষমা বিষয়গুলো লিখেছি। আরো আসা উচিত ছিলো 'রক্ষী বাহিনী সৃষ্টি করা, ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষে অসহায় মানুষকে বাঁচাতে না পারা, ক্ষমতা কেন্দ্রীভুত করা', প্রেস নিয়ন্ত্রণ, সাত-খুন, ডাকসু'র ব্যালট ছিনতাই, সাম্রাজ্যবাদবিরোধি সংহতি মিছিলে মতিউল কাদের খুন, সারাদেশে ছাত্র ইউনিয়নের উপর ভয়াবহ নিযাতন যা ছাত্ররাজনীতির চেহারা পালটে দেয় চিরতরে। সবটাই অকপটে বলতে হবে, বলবো। এক লেখায় বলা মুশকিল যদিও। ধন্যবাদ।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

৭৫ এর আগে থেকে হারানো প্রতীক পুনরুদ্ধারের ব্রত নিয়া একদল বিপ্লবী শেখ মুজিবকে হত্যা করে। তারপর বিপ্লবীগণ জিয়াকে ক্ষমতায় বসায়া হৃত-প্রতীক পুনস্থাপন করে। (জোকিং)

মুশকিল হইল একীভূত ক্ষমতার পক্ষ নেয়া যেমন তাত্ত্বিক অবস্থান। একীভূত ক্ষমতার বিপক্ষে যাওয়াটও তাত্ত্বিক অবস্থান। যেকোনো তাত্ত্বিক অবস্থান যেমন সাবজেক্টিভ জাজমেন্ট দ্বারা সীমিত হয়, এই দুইও তাই।

সুতরাং পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বলতে গেলে কেউ কেবল পাকি যুদ্ধবন্দীকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলতে চায়, বলতে চায় না কেন ছেড়ে দেয়া।

সরলবিশ্বাসী অথবা অশিক্ষিত অথবা জ্ঞানপাপী ব্যক্তিরা এইগুলা বলতে চায় না। আমি অল্পশিক্ষিত। এই সচলায়তনেরই, সচল সাঈদের পুরাতন পোস্ট থেকে উদ্ধৃতি দেই।

"যুদ্ধের সময় যে ৪ লক্ষ বাঙালী পাকিস্তানে আটকা পড়ে, পাকিস্তান সরকার তাদেরকে জিম্মি করে বাংলাদেশের বিচার বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করে। প্রায় ১৬ হাজার বাঙালী সরকারী কর্মকর্তা যারা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটকা পড়ে এবং পরবর্তীতে চাকুরিচ্যুত হয়, তাদের পাকিস্তান ত্যাগের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। অনেক কর্মকর্তাকে ক্যাম্পে আটক করে রাখার কারনে বাংলাদেশ তখন আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদও জানায়।... এসময় পাকিস্তান সরকার পলায়নপর বাঙালীদের ধরিয়ে দেবার জন্য মাথাপিছু এক হাজার রুপি পুরষ্কার ঘোষনা করে ..." সূত্র: http://www.sachalayatan.com/syeed_ahamed/32147

৭৪ এর দুর্ভিক্ষ কেন হইছিল এইটা নিয়াও ঐসব অশিক্ষিত অথবা জ্ঞানপাপীকে কিছু বলতে দেখা যায় না। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্লোগানে গলা ফাটানো চিনপন্থী সৈনিকেরা আমেরিকার সৃষ্ট এই মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে আশ্চর্য চুপ থাকে। যেমন চুপ থাকে ৭৫ এর ১৫ অগাস্টের পরে বাংলাদেশকে চীনের স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়ে। শুধু চিনপন্থী না বিএনপি-জামাত-রাজাকার-স্বঘোষিত_অ্যানার্কিস্ট-ভাবান্দোলনপন্থী কাউরেই খুব একটা জবান খুলতে দেখলাম না।

৭৫ এর শেখ মুজিবকে মেরে সৌদি রাজতন্ত্র এবং চৈনিক সমাজতন্ত্র দুইয়ের আর্শীবাদ আদায়ে ব্যপক সাফল্য লাভ করে ৭৫ এর বিপ্লবীসকল। এই সাফল্য আজও আমরা ভোগ করতেছি। (নট জোকিং) জয় বাংলা। জয় বাংলার সরলবিশ্বাসী/ অশিক্ষিত/ জ্ঞানপাপীদের।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

লেখক এর ছবি

অনিন্দ্য, সব যুদ্ধের পরেই কিন্তু শত্রুদেশে আটকে যাওয়া সৈনিক বা নাগরিকদের জিম্মি করার চেষ্টা করা হয় কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ফেরত দেবার নজির বা বিচার দাবি থেকে সরে যাবার নজির কিন্তু খুব একটা নেই। মুশকিল হলো বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিলো, তার কোন স্পষ্ট দলিল কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। আপানার দেয়া সূত্রে যে ৪ লক্ষ বাঙ্গালী, ১৬ হাজার কর্মকর্তা আটকে পড়েছিলেন, তাদের কী হয়েছিলো এই প্রত্যর্পণের পরে? তারা কি সবাই ফিরে আসতে পেরেছিলেন ঠিক-ঠাক মত? তারা কি থেকে গিয়েছিলেন নিরাপদে?জিজ্ঞেস করছি, খুব গুরুত্ত্বপূণ পয়েন্ট বলে, জানতে ইচ্ছে করছে। যাকে উদ্ধৃত করেছেন তিনি নিশ্চয়-ই এই তথ্যের পক্ষে কোন সূত্র ব্যবহার করেছেন, একটু জানাবেন প্লিজ? দীক্ষিতের (উদ্ধৃত মামুন, ২০০৮ঃ৪৮) মতে অবশ্য এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলোঃ
"The substantive motivation for Mujib's decision might have been his long term strategy of not doing anything which would prevent recognition of Bangladesh by normalcy in the sub-continent Mujibur Rahman's approach was valid."
কিন্তু মুনতাসীর মামুনসহ আরো অনেকের মত আমারো প্রশ্ন, যুদ্ধাপরাধের বিচার না করায় ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশে কি সেই প্রার্থিত স্বাভাবিকতা এসেছে?

২। আবু সাইয়িদ তার ‘সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিত ও গোলাম আযম’ বই-এ অনেক কারণ উল্লেখ করেছেন যার ফলে রাজাকার ও দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হয় নি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সামাজিক চাপ, একই পরিবারে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার দু-ই ছিল এবং রক্ত সম্পর্কের অনেকে রাজাকারদের বাঁচাতে চেয়েছিল।

এই কারণগুলোকে ২৬ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনার ব্যাপারে যথেষ্ট বলে মনে হয় না।

৩। আপনার পরের বক্তব্যের সাথে একমত। কেউ না লিখলে বসে থাকা তো যাবে না। আপনাকেই লিখতে হবে।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ম্যাডাম,

মন্তব্যটা একটু সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে করা। ঠিক এই লেখাটার বিষয়ে না। তবে উপরের কোনো একটা মন্তব্যের প্রেক্ষিতে কিছুটা। আমি একটা সুশীল প্রবণতা দেখি, সবকিছু ব্যালেন্স করার। বাংলাদেশের কোথও কোনো সাম্য নাই, কেবল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আসলে ভারসাম্য আছে! একটা অতি চালু নমুনা হইল বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের মাফ কইরা দিয়া গেছে। প্রথমত এইটা সে করে নাই। দ্বিতীয়ত (একেবারেই হাইপোথিটিকাল সিচুয়েশন) মাফ করলেও তাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নায্যতা হারায় না। আমি অল্পবিস্তর লক্ষ্য করছি, এইধরণের কথাবার্তা যারা বলে তারা কিছু বিশেষ প্রসঙ্গ উঠলে এইটা অতিঅবশ্যই বলে। ধরেন আপনি বললেন জিয়া যুদ্ধপরাধী রাজাকারদের লাল গালিচা বিছায়া দিয়া মাথায় মুকুট পরাইছে। তারা বলবে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা করছে। আপনি বললেন খালেদা জিয়া জাহানারা ইমামকে নিগৃহিত করছে। তারা বলবে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা করছে। আপনি বললেন বিএনপি জামাতকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন করছে। উপরন্তু দেশটাকে জঙ্গী আখড়া বানাইছে। তারা বলবে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা করছে। আপনি বলবেন আপনার মোবাইলের চার্জার কাজ করতেছে না। তারা বলবে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা করছে। পাল্টা-যুক্তির মোড়কে সাজানো অসম-অসৎ প্রতিতুলনা এখন পাড়াতো খিস্তি থেকে অ্যাকাডেমিক রচনা সর্বত্র বিরাজমান। সকলে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে চায়। ফাইন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভারসাম্যবাদী না। কিন্তু আপনার প্রশ্নটা আমারও। পাকিস্তানে আটকা থেকে আসা কিছু আর্মি অফিসাররাই "নাকি" আর্মিতে ঢুইকা ধীরে ধীরে বাংলাদেশ আর্মিকে পাকিপনায় ভরায়া তুলছিল। অতিঅবশ্যই আমি স্পেকুলিটিভ আলোচনা করতেছি। আমার কোনো ইমপিরিকাল ডিফেন্স নাই।

অনেকের মতে তিরিশ লক্ষ শহীদ সংখ্যাটাও স্পেকুলেশন‍! কিন্তু সংখ্যায় কী আসে যায় বলেন তো। এথনিং ক্লিনজিং আর রেইসিস্ট গণহত্যা সংখ্যা দিয়া মাপার মতন গাড়ল আমরা? তারপরও লোকজন মাপে। আপনি বলবেন পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালাইছে। তারা বলবে বাঙালিরা বিহারী মারছে। সুতরাং কাটাকুটি, তোমার জামা ফিরোজা কালারের আমার জামাও ফিরোজা কালারের। জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম, তার সাথে জড়িত আক্রোশ, অ্যাট্রসিটি, রিফ্লেক্সিভ ভায়োলেন্স (সহিংসতা প্রসঙ্গে অন্য টপিকে লিখছিলাম) এক বস্তু, আর মিলিটারি নামায়া লাখে লাখে "নিরস্ত্র" মানুষ মারা আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেইলে রেইপ করা আরেক বস্তু। এইখানে ভারসাম্যের খেলা চলে না। আবার চলতেও পারে, কারণ ফোর্ড ফাউন্ডেশন ভারসাম্য-ভারসাম্য খেলানোর জন্য বস্তা বস্তা টাকা নিয়া বইসা আছে।

ইতিহাসে স্রেফ অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়ার বেদনা থেকে ইতিহাসবিকৃতির যে ধারা বাংলাদেশের চিনাবাম-সংখ্যাগরীষ্ঠ বুদ্ধিজীবীকুল চালায়া যাচ্ছে, তাতে তাদের প্রতি সহানুভূতি জন্মায়। কিন্তু তারা জ্ঞানী, সুতরাং সম্ভ্রমও জন্মায়। এই অ্যাম্বিভ্যালেন্স নিয়া তাদের সাথে পাল্লা দেয়া কঠিন। আমিও রোজ দুইপাতা দুইপাতা ফানো, গ্রামসি আর চারু মজুমদার পইড়া শামুকের মত আগাই। কিন্তু আমার উগ্র জাতীয়তাবাদী সামন্ত-অনুকূল রাজনৈতিক চেতনা বেশিদূর আগাইতে দেয় না। কিন্তু কেউ লিখতে বললে সাহস পাই।

পুনশ্চ: "১৯৭৪ সালে পাকিস্তান-ফেরত ২৮ হাজার সদস্যকে সশস্ত্র বাহিনীতে আত্তীকরণ করা হয়। এতে একই বাহিনীতে সমান্তরাল দুই মনমানসিকতা লক্ষ করা যায়। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী সেনার কাউকে চাকরিতে রাখেনি। আমরা মহানুভবতা দেখাতে গিয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছি।" বইলা আলুপেপারে আমীন আহম্মদ চৌধুরী বীর বিক্রম এক লেখায় মন্তব্য করছেন (তার বক্তব্যের দায় তার)। আলুর লিঙ্ক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, কর্ণেল তাহের এই সকল হত্যাকাণ্ডেই পাকিস্তান ফেরত কেউ না কেউ মূল ভূমিকায় ছিল। আবার এই কথাও সত্য বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাইতে জীবন দেয়া কর্ণেল জামিল পাকিস্তান ফেরত ছিলেন। এই "পাল্টা-তথ্য" যদিও পাকিস্তান-ফেরত-আর্মি-প্রবণতা বিষয়ক অন্তর্হিত প্রস্তাবনায় ভারসাম্য আনয়ন করে না।

(পুরাপুরি প্রাসঙ্গিক না, কিন্তু আমার একটা পুরান পোস্টের লিঙ্ক দিলাম)


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নৈষাদ এর ছবি

অনিন্দ্যকে ধন্যবাদ।
আরও কন্টেক্সট ছিল। সামগ্রিকভাবে না দেখে ‘অউট অভ কনটেক্সট’ অনেক কিছুই বলা যায়। বুঝতে হবে নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত যুদ্ধবিদ্ধস্ত এই দেশটা এখনের মত ছিল না।

খুব সাধারন একটা উদাহরণ দেই। স্বাধীনতার পর পরই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ডিপ্লমেসি এবং নেগোসিয়্যাশন চলছিল। ক্ষমা ইত্যাদির সাথে সাথে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির নেগোসিয়্যাশনের সম্পর্কও ছিল। এই দিকগুলি নিয়ে লেখালেখি হয়না। ওআইসি, চীন, আমেরিকা – কত ভেস্টেড ইন্টারেস্টের গ্রুপ।

একীভূত ক্ষমতার পক্ষ/বিপক্ষ আসলে তাত্ত্বিক অবস্থান – এখানেও অউট অভ কনটেক্সটে, খুব সীমিত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। (যেমন জাতীয়করণকে কিংবা প্ল্যানিং কমিশনের পরিবর্তনকে দেখা হয় আইসোলেটেডভাবে, সেগুলো যে একটা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের সার্বিক দর্শণের সাথে জড়িত, কিংবা কনসার্টেড স্টেপ, সার্বিকভাবে এটা কেউ দেখে না)

(লেখাটা যে চমৎকার লেগেছে, আলাদা মন্তব্যে জানিয়ে গেলাম)

লেখক এর ছবি

'আমিও রোজ দুইপাতা দুইপাতা ফানো, গ্রামসি আর চারু মজুমদার পইড়া শামুকের মত আগাই।' হা হা হা।।।
তারাপদ রায়ের এক ‘দারিদ্র রেখা’ কবিতা-কে এক পাল্লায় রাখেন আর সব শোষণ-দারিদ্র বিষয়ক একশ থিসিস রাখেন, আমার তো মনে হয় ‘দারিদ্র রেখা’ কবিতার ভার বেশি হবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে হলে এর ঘ্রাণ পাওয়াটা জরুরী, ফানো, গ্রামসি, চারু মজুমদার বরং পইড়েন শখের জন্য, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার জন্য তার দরকার নাই বলে মনে হয়। কারণ যারা পড়েছে বলে দাবি করেন, তারা আবার যুদ্ধাপরাধের বিচার চান না, বলেন এতোদিন পরে এই বিচার জাতিকে কী উপহার দেবে? সাধু সাবধান!

রূপ সনাতন এর ছবি

আপনার বক্তব্য অনেক জোরালো সন্দেহ নেই। তবে আমি এটাকে গবেষণার পর্যায়ে ফেলতে পারছিনা এর ভেতরে প্রবহমান প্রচন্ড আবেগের তোড়ে। আসলে দোষটা আপনার না, আপনার লেখার না এবং মজার ব্যপার এখন যারা এই নাটকের কুশীলব তাদেরও না। যদি অভয় দেন যে আপনি পুরোটা পড়বেন তবে বলি। আমার ধারণা, আপনার যুক্তি-তর্কের যে Premise তাতেই ভয়ানক রকমের গলদ রয়ে গেচে। হয়তো একটু Abrupt হয়ে যাবে বলাটা, তবু বলি আমাদের দেশটা মুক্তিযুদ্ধের ফসল হিসেবে আমরা পাইনি। পেলে আপনার এই নিবন্ধের অনেক কিছুই আলোচনায় আসার প্রয়োজন থাকত না। সবার প্রথমেই বলতে হয়, স্বাধিনতার বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আপনি কোত্থেকে শুরু করবেন? দুঃখজনক হলেও সত্যি “একদা মধ্যরাতে একদল উন্মত্ত সৈনিক ভয়ানক ধ্বংসলীলা শুরু করিল আর আর অমনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইয়া গেল” –গোছের কিছু একটা ছাড়া আমাদের স্বাধিনতার সূচনার সপক্ষে এর চেয়ে গৌরবজনক কিছুই বলার নেই। এর চেয়ে বেশি দাবি করার মত কোনো সাহিত্য বা প্রকাশনা কি আপনি উল্লেখ করতে পারবেন? আমি কিন্তু কোনো নেতৃত্ব ছাড়াই যারা ঐ অতর্কিত আক্রমণের মুখে বুক চিতিয়ে দিয়েছিলঃ হয় অমিত তেজে কিংবা জান বাঁচাতে বীর কিংবা বোকার মত...তাদের বদান একেবারেই অস্বীকার করছিনা।
এক অখ্যাত মেজরের ঘোষণার কৃতিত্বকে যেমন অস্বীকার করছিনা তেমনি আমরা সবাই জানি এম ভি সোয়াতে অস্ত্র নামাতে গিয়ে তাকে হত্যা করার পরিকল্পনাটি ফাঁস না হলে তিনি বিদ্রোহও করতেন না ‘স্বাধিনতার ঘোষণা’ও দিতে যেতেন না। কিন্তু পিতৃপ্রতিম (প্রতিম কেন পিতাই তো) নেতাটি কি করলেন? সফেদ পাঞ্জাবি পরে বসে রইলেন জামাইয়ের মত শ্বশুরবাড়ির টাঙ্গার অপেক্ষায়। কোনো নেতা কর্মীর মুখে তো শুনিনি পিতা শেষ নির্দেশ দিয়ে গেছেন করণীয়ের ব্যপারে? ১০ মাস বাদে প্রবাস ফেরৎ পিতার নবজাতকের পিতৃত্বের দাবি হাস্যকর শোনায় বৈ কি! বেদনাদায়ক হলেও এটাই আমাদের ইতিহাস। আর এটাই আমাদের দরিদ্র জাতির লজ্জাও বটে। পিতা আমাদের শত ছিন্ন জীর্ণ পুরান লুঙ্গির মত পরলেও লজ্জ্বা মানে না আর ফেলে দিলে তো কিছুই থাকে না।
পিতা যেদিন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, আপনি তো গণমাধ্যমের শিক্ষিকা, বলতে পারেন তাদের জন্য কেউ কি আবেদন জানিয়ে ছিল ক্ষমার? পড়ে দেখুন সে সময়কার পত্রিকাগুলো। জাতির চোখের জল তখনও শুকায়নি, চারদিকে তখন শুধুই পোড়ামাটি আর পোড়াবাড়ি। পিতা উদার! কিন্তু উদার পিতা কিন্তু সদ্যস্বাধিন দেশে ক্ষমতাটি কুক্ষিগত করতে ভোলেন নি। জাতীয় সরকারের প্রস্তাবটাও অনুমোদন করেন নি। এক জামা’য়াত/মুসলিম লীগ ছাড়া আর কোন দল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল? তবে কেন???? মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের মত টাকা ছিলনা কোষাগারে কিন্তু দালাল শাহ্‌ আজিজকে (এবং আরো অনেককে) মুক্ত করে তার জন্য পরিত্যক্ত বাড়ি এবং গাড়ির ব্যবস্থা কিন্তু করা হয়েছিল ঠিকই। আর জনপ্রিয়তা যখন সজোরে নিম্নগামী তখন পিয়া কিন্তু ঠিকই সব দল বাতিল করে একদল বাতিল করে সম্রাটের কায়দায় রাষ্ট্রপতিরাসনে বসেছিলেন। আজকে মুশতাকের নামে সবাই জানে সে মুক্তিযূদ্ধের বিরোধিতা করত খোদ কলকাতায় বসেই। তারপরও তো পিতা তাকেই রাখলেন পাশে আর আস্তাকুঁড়ে ফেললেন তাজউদ্দিনকে মন্ত্রিসভার প্রথম রদবদলেই। পিতাও কি মুশতাকপন্থী ছিলেন?
আরেকটা কথা বলে শেষ করব? লাগাবেন কাঁঠালের বিচি আর আশা নিএ বসে থাকবেন খাবেন ফজলি আম...তাই কি হয়? পিতা কিন্তু মুসলিম লীগের product. তার চেতনা আর মুক্তিযোদ্ধার চেতনাবলতে যা বোঝাচ্ছেন একসাথে চলেনা। OIC সম্মেলনে তিনি যোগদিয়েছিলেন মহান মিত্র ভারতকে একটু রুষ্ট করেই।
এরকম আরো অনেক কিছুই বলা যায়...বলছি না। শুধু বলি, এখনো অনেকেই ১৯৭১-কে গন্ডগোলের সময় বলেই উল্লেখ করে। ৭৫ পরবর্তী কোনো পাঠ্য বইয়ে সে ধারণা কিন্তু দেয়া হয়নি। আমি কিন্তু শিশু –কিশোরদের কথা বলছিনা, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, যারা হানাদার বাহিনীর নির্মমতা প্রত্যক্ষ করেছেন , হয়তো মুক্তিবাহিনীকে টুকটাক সাহায্যও করেছেন তারাও এভাবেই ১৯৭১-এর সময়কালটার উল্লেখ করেন। কারণ, তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এলোপাতাড়ি গোলাগুলির ভেতর পড়ে জান নিয়ে দৌড়েছেন......কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বা স্বকীয় জাতীয়তার জন্য তৈরি ছিলেন না। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা করতে পারেন নি। তারা নিজেরাও কি জানতেন তাদের গাড়িতে কি চাঁদ-তারা না রক্তটিপ কোনোটা শোভা পাবে?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

দুঃখজনক হলেও সত্যি “একদা মধ্যরাতে একদল উন্মত্ত সৈনিক ভয়ানক ধ্বংসলীলা শুরু করিল আর আর অমনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইয়া গেল” –গোছের কিছু একটা ছাড়া আমাদের স্বাধিনতার সূচনার সপক্ষে এর চেয়ে গৌরবজনক কিছুই বলার নেই। এর চেয়ে বেশি দাবি করার মত কোনো সাহিত্য বা প্রকাশনা কি আপনি উল্লেখ করতে পারবেন?

যেহেতু আপনি বাংলায় লিখতে ও পড়তে পারেন, আমি বিশ্বাস করি না আপনি একুশের বইমেলা কিংবা নীলক্ষেত শাহবাগ নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানে সাজিয়ে রাখা শত শত বইয়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কোন বই খুঁজে পাননি। আপনি খুঁজতে চাননি, পেলেও পড়তে চাননি বলেই আপনার মনে হয়েছে ওই দুলাইনের বেশী ইতিহাস কোথাও নেই। যারা চোখে মেজরের চশমা লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খোঁজেন তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ওই দুই লাইনই।

সফেদ পাঞ্জাবী পরা উদার পিতাটি ২৫শে মার্চ রাতে পালিয়ে না গিয়ে কেন বসে রইলেন সেটা বুঝতে অন্ততঃ বিশ খানা বই পড়ে আসতে হবে, আপনার দুই লাইন ইতিহাসের মধ্যে আটবে না, তাই ওটা বোঝার চেষ্টা বাদ দেন।

তবে সেই সফেদ পাঞ্জাবি পরা উদার পিতাটি স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তার সকল ভুল, সরলতা, বোকামীর খেসারত দিয়েছিলেন নপুংশক সামরিক অফিসাদের হাতে সপরিবারে নিজের প্রাণটা দিয়েই। সুতরাং তাঁর সেইসব ভুল নিয়ে এই পোষ্টে আলোচনা অর্থহীন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, পিতা ভুল করেছেন বলে কেউ খালু বা চাচাকে গিয়ে পিতা ডাকে না।

আপনার জন্য সংক্ষেপে একটা বইয়ের নাম বলে যাই। মেজর রফিকুল ইসলামের 'লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে'। এই বইটিতে আপনি কিছুটা হলেও আঁচ পাবেন যুদ্ধটা কেন কিভাবে শুরু হয়েছিল। যে কোন বইয়ের দোকানে এটি পাবেন।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

রূপ সনাতন এর ছবি

'৭১ পূর্ববর্তী আমাদের যত আন্দোলন তা ছিল স্বায়ত্ত্বশাসনের এবং তা পাকিস্তানের কাঠামো মেনে নিয়েই। স্বায়ত্ত্বশাসন আর স্বাধিনতাকে এক করে দেখলে বলার কিছু নেই। ইতিহাস বড় নির্মম এখানে ভুল বলে কোনো কথা নেই।।।সব অপরাধ। রাজনীতিতে শেখ মুজিবের উত্থান পড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন চর দখল করা লাঠিয়ালের কোনো রাজনৈতিক দর্শন থাকে না (আমাদের রাজনীতিতে খুন গুম আরে অত্যাচারে স্টিম রোলার চালানোর ঐতিহ্য সবই পিতার কাছ থেকেই নেয়া। এদেশের শাসকদের তিনি পিতা বটে)। আর উনি কোন জাতির জনক? উনার আবির্ভাবের পূর্বে কি বাঙালি নামে কোনো জাতীয়তার অস্তিত্ব ছিল না?

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

৭১ পূর্ববর্তী আমাদের যত আন্দোলন তা ছিল স্বায়ত্ত্বশাসনের

তারপরও ৭১ এ আমরা স্বাধীন হইয়া গেলাম, হোলি শিট। এখন ৭১ এর পূর্ববর্তী আন্দোলনের স্পিরিট রক্ষা কইরা সায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলন শুরু করেন।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

চলুক

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

শান্ত এর ছবি

ছাগুরাম সুলভ রূপ সনাতন: কস্কি মমিন!

__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত

সাম্য এর ছবি

কস্কি মমিন!

রাব্বী আহমেদ এর ছবি

ক্যাডেট কলেজ নিয়ে যে বিতর্কটি তৈরি হয়েছে আমি মনে করি তা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক। ক্যাডেট কলেজ গুলোর উদ্ভব হয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য উপযুক্ত কিছু অফিসার তৈরির পূর্ব প্রশিক্ষন কেন্দ্র হিসেবে। আর এ জন্যেই দেশের প্রখম ক্যাডেট কলেজ ফৌজদার হাটে নির্মিত হবার পরে ধীরে ধীরে এর চাহিদা বাড়তে থাকে। যার ধারাবাহিকতায় আজ দেশে বারোটি ক্যাডেট কলেজ। ক্যাডেট কলেজ গুলো অন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা এ জন্য যে এখানে একজন ক্যাডেটকে পড়ালেখার পাশাপাশি দেশ গঠনে অংশ নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গুনাবলী শেখানো হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রায় সত্তর সতাংশ ক্যাডেট কলেজ ব্যাকগ্রাউন্ডের। প্রতিবছর ক্যাডেট কলেজ গুলোর ফলাফল ও কিন্তু ঈর্ষান্বিত। সেনাবাহিনী ছাড়াও দেশের সব গুরুত্বপূর্ন অবস্থানে ক্যাডেটরা অধিষ্ঠিত। আর ক্যাডেট কলেজের নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন ই বাইরের একটা ছেলে অথবা মেয়ের থেকে একজন ক্যাডেট কে আলাদা করে দেয়। তবে দাম্ভিকতা একান্ত ই নিজের মনের ব্যাপার। আর ক্যাডেট কলেজের যাত্রা কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার আগেই। তাই এ নিয়ে বিতর্ক না করাই ভালো।
ধন্যবাদ

রাব্বী আহমেদ(উদাসী কবি)

তানভীর এর ছবি

ক্যাডেট কলেজ গুলোর উদ্ভব হয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য উপযুক্ত কিছু অফিসার তৈরির পূর্ব প্রশিক্ষন কেন্দ্র হিসেবে। আর এ জন্যেই দেশের প্রখম ক্যাডেট কলেজ ফৌজদার হাটে নির্মিত হবার পরে ধীরে ধীরে এর চাহিদা বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নয়, বলুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৫৮ সালে। তখন নিশ্চয়ই বাংলাদেশের জন্ম হয় নি! আর বাংলাদেশে হাঁটু পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং হাঁটুর ছত্রছায়ায় মৌলবাদেরও ধীরে ধীরে প্রসার ঘটেছে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো একই কায়দায় অর্থাৎ 'পাকি মডেলে' কব্জা করার অভিপ্রায়ে। 'পাকি মডেল' কী জিনিস জানতে চাইলে এ লেখাটা একটু পড়ে আসতে হবে।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

চলুক


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

লেখক এর ছবি

আপনার লেখাটা কাজের খুব। কাছে রাখতে হবে।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

প্রতীকগুলো যাদের বুকের ভেতর প্রোথিত আছে সেখান থেকে কেউ মুছতে পারবে না। কোন পরিবর্তনের হাওয়া মুছতে পারেনি। আর নতুন প্রজন্ম যাদের স্মৃতিতে কোন প্রতীকই এখনো বরাদ্দ হয়নি, তাদের জন্য এই লেখাটি দরকার ছিল। ইতিহাস বিকৃত করেও সব সত্য লুকোনো যায়নি যাবে না।

যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা নিয়ে যেসব নারী এখনো বেঁচে আছেন কেবল তারাই হতে পারতেন সবচেয়ে নির্ভরশীল সাক্ষ্য।

মুশকিল হলো সেসব নারীর অভিজ্ঞতা নিয়ে যে খুচরো কিছু বই বের হয় সেগুলো আড়ালেই থেকে যায় প্রচারের অভাবে। আমি সেদিন মুশতারী শফির সম্পাদনায় একটা বই(মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী) পেয়ে খুব অবাক হয়ে যাই যেখানে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন নারীর মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার কথা আছে তাদের সাক্ষাতকার সমেত। এই বইটি খুব বেশী প্রচার পায়নি, অথচ গুরুত্বপূর্ন কিছু সাক্ষ্য আছে বইটিতে। প্রচারের দাপটে পরিচিতির দাপটে বিখ্যাত মানুষদের অখাদ্য বইও বাজারের দোকানে শোভা পায়, কিন্তু এসব বইয়ের কোন প্রচার নেই।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

লেখক এর ছবি

'প্রচারের দাপটে পরিচিতির দাপটে বিখ্যাত মানুষদের অখাদ্য বইও বাজারের দোকানে শোভা পায়, কিন্তু এসব বইয়ের কোন প্রচার নেই।'-সহমত
সময়্টাই-ই যে বাজারের!

নৈষাদ এর ছবি

লেখাটা প্রথমেই পড়া পড়া হয়েছিল, মন্তব্য করা হয়নি। চমৎকার হয়েছে সেটা জানিয়ে গেলাম।

মুকতাদা এর ছবি

[] ক্যাডেট কলেজগুলো ইংলিশ পাবলিক স্কুলের অনুকরনে করা। পাবলিক স্কুল মানে প্রাইভেট বোর্ডিং স্কুল যেখানে ছেলেমেয়েরা ১২ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত আবাসিকভাবে পড়ালেখা করে, পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কতিক সার্বিকভাবে সব শিখে বড় হয়। ইংল্যান্ডে প্রায় ৭০০ এর মত পাবলিক স্কুল আছে। সবচেয়ে পুরাতনটা ১২০০ সাল থেকে চালু। স্কুল পড়ালেখা চালু হওয়ার পর থেকে প্রথমে আবাসিক ভাবেই শুধু স্কুল ছিল, তারপরে ডে স্কুল (মানে বাসায় থেকে দিনে স্কুলে যাওয়া যেমনটা দেশে আমরা সবাই পরিচিত) ও এখন হোম স্কুলিং (মানে বাসায় থেকেই পড়ালেখা যেমনটা রবিঠাকুর করেছিলেন) পদ্ধতি চালু হয়েছে। এই তিন পদ্ধতির সবগুলোতেই কিছু পজিটিভ/নেগেটিভ থাকতে পারে।

[] যারা এ বোর্ডিং স্কুলগুলোতে পড়ালেখা করেছেন সে রকম কিছু মানুষের নাম আমি দিচ্ছি - ডারউইন, শেলী, চার্চিল, এলান টুরিং, জন মেইনার্ড কেইনস, আলডাস হাক্সলি, জর্জ অরওয়েল - এ রকম আরো অগনিত বুদ্ধিমান ও ভালো মানুষ।

[] বাংলাদেশে ক্যাডেট কলেজগুলোর শুরুতে কয়েকজন ইংলিশ পাবলিক স্কুলের মানুষ এগুলোর প্রিন্সিপাল ছিলেন। যেমন - উইলিয়াম পিট, মরিস ব্রাউন - কলেজেগুলোর অধিকাংশ নিয়মকানুন, হাউসিং সিসটেম, ড্রেসকোড, এগুলো হুবহু ইংলিশ পাবলিক স্কুলের অনুকরনে। যেমন - 'হল'কে 'হাউস' বলা, হাউস মা্সটার, টিউটর, প্রিফেক্ট সিস্টেম, ডিনার ড্রেস, প্রেপ ক্লাস - এরকম অগনিত টার্ম ও সিস্টেম।

[] আমরা বোর্ডিং স্কুল পদ্ধতির সাথে পরিচিত না বলে ও ক্যাডেট কলেজগুলো মিলিটারি ফান্ডেড বলে এগুলোকে সাধারনভাবে দেখলে বেমানান মনে হতে পারে। কিন্তু যারা এখানে পড়েছে ও ভালভাবে জানে, তারাও এ দেশেরই নাগরিক - তারা কি একে আমাদের এডুকেশন সিস্টেমে নেগেটিভ বলে ভাবে?

[] এদেশে এডুকেশন সিসটেম কিন্তু ব্রটিশদেরই চালু করা - ১৮০০ এর শুরুর দিকে - ডে স্কুল (যেমন জিলা স্কুল, প্রাইমারি স্কুল), কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বোর্ডিং স্কুল সবই তারা তখন চালু করে। এর আগে শুধু মাদ্রাসা, মক্তব, পাঠশালা এ ধরনের ব্যবস্থা ছিল। আমরা তাদের চালু করা ডে স্কুল সিস্টেমকেই এখন নিজেদের বলে চালিয়ে দিচ্ছি ও আগের সিস্টেমকে সনাতন বলছি। আসলে সময়ের সাথে মডার্ন কিনা সেটাই আমাদের বিবেচ্য। কিন্তু আবার তাদেরই বোর্ডিং স্কুল সিস্টেমকে অপরিচিত হওয়ার কারনে, বা না জানার কারন বা শ্রেনী বৈষম্যের নাম করে ভিনদেশি বলে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছি।

[] অনেকে ক্যাডেট কলেজ গুলোকে পাকিস্তান কানেক্টেড মনে করে - যেটা ঠিক নয় - উপরে আমি যেটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। রাজশাহী, জাহাংগিরনগড়, চিটাগাং, ময়মনসিংহ এসব ইউনিভার্সিটি গুলোও পাকিস্তান আমলে করা হয়েছিল - সেগুলো পাকিস্তান কানেক্টেড নয় - ইউনিভার্সিটিই।

[] দেশে আবাসিক ব্যবস্থার দরকার আছে। আমার মত যারা ঢাকার বাইরে থাকে ও পরিবারে ভালো গাইডেন্স নেই বা নিম্ন মধ্যবিত্ত হওয়ার কারনে অসুবিধাগ্রস্থ, বা বাবা দেশের বাইরে থাকে, এরকম অনেকেই ক্যাডেট কলেজের সুফল পেতে পারে। যারা এ রকম আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে আসেনি তারা এটা বুঝতে পারবে না। আমাদের বাবাদের জেনারেশনে শুনেছি ছোটবয়সে শহরে জায়গির থেকে পড়তে হত।

[] লেখক এখানে একমুখি এডুকেশন সিস্টেমের কথা বলেছেন। বাংলাদেশ এডুকেশনের মডেল দেশ নয়। ইউরোপ, আমেরিকা, এমনকি ভারত এ সব দেশ গুলো দেখুন - নিজেদের থেকে কোনো কিছু উদ্ভব না করে। কোথাও একমুখি বলে কোনো এডুকেশন সিস্টেম নেই, আছে পাবলিক, প্রাইভেট, বোর্ডিং, হোম স্কুল সব ধরনের - আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে সব শেখাতে হবে সেটাই মুখ্য। সবাইকে কেন এক সিস্টেমের মধ্যে থাকতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে কি তাই হচ্ছে?

[] আরো অনেক কথা বলা যায়, তবে "ইতিহাসের সাথে সংস্রবহীন" নামে ক্যাডেট কলেজকে যুক্ত করাটা এ লেখার একমাত্র দুর্বল পয়েন্ট। পাঠশালা ও মাদ্রাসাই আমাদের দেশের অরিজিনাল ছিল। সে কারনে এক সময় মুসলমানরা উনিশ শতকে স্কুল কলেজে যেতে চায়নি। এখন আমরা ইংরেজদের সিস্টেমকে আমাদের "মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত প্রতিক" বানিয়েছি এ কারনে নয় যে এটা আমরা মুক্তিযুদ্ধে অর্জন করেছি - এর কারন আমরা সময়ের ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শেখাই স্কুল কলেজ এডুকেশনের একটা প্রধান গোল।

[] 'স্বাধীনতার চেতনা' ও 'সাম্যবাদে'র নাম দিয়ে এডুকেশনের বিষয়কে তালগোল পাকিয়ে লেখাটি অন্য সব কিছুতে ভাল লাগলেও, এডুকেশন বিষয়ে লেখকের অগভীর চিন্তার প্রকাশ পেয়েছে বলেই আমি মনে করি। আরো অনেক কথা বলার থাকলেও কমেন্ট আর বড় করছি না। তবে লেখককে আমি এডুকেশন বিষয়ে আরো গভীরভাবে ভাবার পরামর্শ দিচ্ছি।

কুলদা রায় এর ছবি

ভাই মুকতাদা,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে সকল মানুষের শিক্ষা একটা অধিকার। সুতরাং সবার জন্য একই ধরনের শিক্ষানীতি হতে হবে। কারো জন্য লেফট রাইট--আর কারো তালের পাতা-খাগের ভোতা কলম, নেভার, চলতে পারে না।

বোর্ডিং স্কুল নিয়ে সমস্যা পেলেন কোথায়? সব স্কুলের জন্য বোর্ডিং স্কুল করে দেন, তাহলেই তো লেঠা চুকে যায়। কিন্তু একজন বোর্ডিং স্কুল পড়বে--তিনি বোর্ডে স্ট্যাণ্ড করে বসবেন, আরেকজন আধপেটা খেয়ে ভাঙা চোরা স্কুলে পড়তে পড়তে ঝরে যাবে--এটা তো সংবিধান বলে নাই।

মুসলমানরা উনিশ শতকে স্কুল কলেজে না যাওয়ার অনেক কারণ আছে। শুধু ধর্মীয় কারণ বললে খুব বেশী সরলী করণ হবে।

মাদ্রাসায় পড়ে আসা আবুল ফজল, শহীদুল্লাহ কায়সার/ মাওলানা হোসেন আলী অথবা টোলে পড়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কি খারাপ মানুষ? যদি এইভাবে বিবেচনা করেন তাহলে তো মাদ্রসা শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলার কোনো মানে হয় না।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

মুকতাদা এর ছবি

"সকল মানুষের শিক্ষা একটা অধিকার। সুতরাং সবার জন্য একই ধরনের শিক্ষানীতি হতে হবে।" আপনি অতি সরলিকরন করে ফেললেন। "সবার জন্য একই ধরনের শিক্ষানীতি হতে হবে" - শিক্ষা অধিকার সবার আছে বলেই সবার এক পদ্ধতির শিক্ষা কেন নিতে হবে? আপনি অন্য উন্নত দেশগুলোও দেখেন। আমরা শিক্ষায় সবচেয়ে পিছু একটা দেশ। সেখানে আমরা নিজেদের মত করে সব নিয়মকানুন করলেই তো হয়ে গেল না। শিক্ষা সবার অধিকার বলেই সবাই কি এক সিস্টেমের স্কুলে পাঠানো হয় বা যেতে পারে উন্নত দেশগুলোতে। আপনি সাম্যতার বুলি দিবেন অথচ ঢাকার ও দেশের অন্য সব জেলায় বা গ্রামে সব কিছুতে যে অসমতা বিরাজমান, সেটা কি ভেবেছেন। সবার কি জেলা স্কুলে পড়ার অধিকার আছে? কিন্তু কেন পড়তে পাচ্ছে না? যে চ্যান্স পাচ্ছে সেই তো পড়ছে। বাকিরা হয়তো সে রকম ভাল স্কুলে পড়তে পারছে না। অথবা বুয়েট, ভার্সিটি। যারা চান্স পায় তারাই পড়তে পারে, কিন্তু অধিকার সবারই আছে। ধনী গরিব সবাই কি একই বেতন পায়, সবাই কি তাদের বাচ্চাদের একই সুযোগ দিতে পারে? আমার মনে হয় সাম্যতার বানী ঠিকভাবে না বুঝে তোতা পাখির মত আপনি আ্উরে যাচ্ছেন।

"সবার সমান অধিকার" ও "একই ধরনের শিক্ষানীতি" এক বিষয় নয়। ডাইভার্সিটিকে বাদ দিয়ে আপনি সবাইকে কেন "ই্উনিট্রাক" সিস্টেমে নিতে চান - সবার প্রয়োজন কি একই রকম। ই্উরোপ, আমেরিকা, জাপান, ভারত - সব দেশ দেখুন। তারপর এ বিষয়ে মন্তব্য করুন। ষাট, সত্তর দশকের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা নিয়ে যারা বড় হয়েছেন, তারা এডুকেশন বিষয়ে মাঝে মাঝে খুবই সরলিকরন করে ফেলেন - এডুকেশন এডুকেশনই। যে সিস্টেম ঠিকভাবে কাজ করছে তাকে টেনে নামানো নয়, সবাইকে উপরে উঠানোতেই কল্যান ও কাম্য। সব কথা হয়তো গুছিয়ে বলতে পারিনি। আরো অনেক কিছুই বলা যায়।

কুলদা রায় এর ছবি

ভাই মুকতাদা,
আপনি শিক্ষা বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন এরপরে আর কথা নাই। আপনার সমৃদ্ধি কামনা করছি।
আসেন, গান শুনতে যাই।
প্রথম গানটি তালাত মাহমুদ গেয়েছেন। ছবির নাম : সুজাতা। সুরকার : এসডি বর্মন।

দ্বিতীয় গানটি গেয়েছেন মিতালী মুখার্জী।

গান দুটো গভীরভাবে শুনে দেখুন। একটা মিল খুজে পাবেন। ভালো লাগতে পারে।
ধন্যবাদ।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

কাবেরী গায়েন এর ছবি

১। কত অজানারে! আমার জানাশোনা সীমিত, ক্রমাগত ক্যাডেটিয়ানদের কাছ থেকে জানার জন্য উপদেশ পেয়ে যাচ্ছি। খুব ভালো। অবশ্যই গভীরভাবে ভাবার চেষ্টা করব।

আপনার মতে,
“আমরা বোর্ডিং স্কুল পদ্ধতির সাথে পরিচিত না বলে ও ক্যাডেট কলেজগুলো মিলিটারি ফান্ডেড বলে এগুলোকে সাধারনভাবে দেখলে বেমানান মনে হতে পারে।‘’
আমার শুধু একটি বিনীত জিজ্ঞাসা ছিলঃ নিয়োজিত পুঁজির মালিকানা নিয়োজিত পুঁজির ফলয়াফলকে প্রভাবিত করে কি?

২। ‘ডারউইন, শেলী, চার্চিল, এলান টুরিং, জন মেইনার্ড কেইনস, আলডাস হাক্সলি, জর্জ অরওয়েল - এ রকম আরো অগনিত বুদ্ধিমান ও ভালো মানুষ বোর্ডিং স্কুলে পড়েছেন’, কিন্তু তারা মিলিটারি ফান্ডেড স্কুলে পড়েছেন কী না জানালে উদাহরণ্টা যুতসই হতো বলে মনে হয় কিংবা বাংলাদেশের মিলিটারি ফান্ডেড ক্যাডেট স্কুল-কলেজগুলো থেকে বের হওয়া মহামানবদের একটা লিস্ট দিলে যুতসইতর হতো। তারপরেও বলি, আমি কিন্তু ব্যক্তি ক্যাডেটদের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলিনি।

৩। ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন থেকে ’৯০-র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ছাত্র সমাজের দশ দফা তক একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কথাই বলা হয়েছে। এই গণ-দাবিটি যারা করে এসেছেন তাদের বুদ্ধি-বৃত্তি নিয়ে ঘোরতর অবজ্ঞা আমার কেনো জানি হয় না এতো চট করে।

৪। ‘এর আগে শুধু মাদ্রাসা, মক্তব, পাঠশালা এ ধরনের ব্যবস্থা ছিল।‘
‘পাঠশালা ও মাদ্রাসাই আমাদের দেশের অরিজিনাল ছিল।‘
জ্বী, আরো আগে ছিলো গুরুর টোল। সেসব আমরা পেরিয়ে এসেছি নানা ঐতিহাসিক বাস্তবতায়। ‘৪৭-’৭১ কালপর্বে বিজ্ঞানমুখী, সমতা-ভিত্তিক শিক্ষার দাবি ’৫৪-‘৬২-’৬৯-এর প্রত্যেকটি দফায় যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে, এটাই বাস্তবতা। আমি উপদেশ দেয়াটা পছন্দ করি না, অনুরোধ করব শুধু ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন এবং উনসত্তরের ১১ দফা একটু নেড়েচেড়ে দেখতে।

৫। ঠিক আছে, চলুক তবে প্রাইমারিতেই চালু থাকা ১০ ধরণের শিক্ষা-ব্যবস্থা।

ক্যাডেট সম্পর্কে আমার আর কিছু বলার নেই। এবং আবারো সকল ক্যাডেটদের, যারা এই লেখাটি পড়েছেন, মন্তব্য করেছেন এবং উপদেশ দিয়েছেন গভীরতর জ্ঞান আহরণের জন্য, তাঁদের সবাইকে কৃতজ্ঞতা।

নীল এর ছবি

কিয়ের মইদ্দে কী, পান্তা ভাতে ডালডা ! কোথায় মুক্তিযুদ্ধের হারানো প্রতীক আর কই ডারউইনের বোর্ডিং ইশকুল ! বাপ রে বাপ ! ডরাইসি ! এত গ্যান কনে রাকপোঁ ?

Jui Mony Das এর ছবি

এ আলোচনা ক্যাডেট কলেজ কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে .......মূল বিষয় থেকে দূরে সরে যাচ্ছি বোধ হয়.....

kaushik sur এর ছবি

আপা, অনেক বিষয়ে লিখছেন কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দালাল শিক্ষকদের নামে আপনার নিজের বিভাগে একটি সেমিনার লাইব্রেরি রয়েছে। মনোবিজ্ঞান বিভাগেও একটি ল্যাব রয়েছে আরেকজনের নামে।

এই বিষয়গুলা নিয়ে কিছু লিখেন না কেন?
এ বিষয়ে কি কিছু লিখবেন?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।