প্রত্যাবর্তন – এর চিঠি ১

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৭/০৫/২০১২ - ৮:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

০৯ বেজে ৫৫ মিনিট। ডিনার করতে যাব এমন সময় ফোনের রিং বেজে উঠল। ফোনের ডিসপ্লে-তে মর্ম’র নাম টা দেখে কিছূক্ষনের জন্য মনটা কেমন বিশাদে ভরে গেল। সামনে ওর প্রডাক্ট লঞ্চ। লঞ্চ প্ল্যানটা ইতোমধ্যেই গোটা দশেক বার পরিবর্তন, পরিমার্জন করতে হয়েছে। আবার কোন চেঞ্জ না তো?

ভয়ে ভয়ে ফোনটা ধরলাম। ফোন রিসিভ করতেই তার প্রশ্ন – তোমার এক পাঠক জানতে চায়, তুমি এখন আর লেখনা কেন? মর্ম’র কথায় মনে হল ঠিকই তো, অনেক দিন লেখা হয় না। কিন্তু আমার লেখা পড়ার জন্য পাঠক উন্মুখ এটাও ঠিক মানতে পারছিলাম না। উত্তর দিলাম, “তোর লঞ্চ প্ল্যান লিখে সময় পেলে তবেতো লিখব”।

মাঝে অনেক কিছু ঘটে গেছে। মাস খানেক হল চাকরি বদলেছি। একেবারে যাকে বলে টেবিল এর এপার থেকে ওপার এ। কর্পোরেট-এর একঘেয়ে গোছানো আটপৌরে রুটিন থেকে এজেন্সির চাকচিক্যে ভরা এলোমেলো দিন। গিভিং এন্ড থেকে রিসিভিং এন্ড-এ। এতদিন যেই “পেইন” আমি এজেন্সিদের দিয়েছি, এখন সেগুলো কয়েক গুন হয়ে ফেরত আসছে – হোয়াট গোজ এরাউন্ড কামজ্‌ এরাউন্ড। তারপরও এই নতুন চাকরী, নিত্য নতুন কাজ, প্রতিদিন নতুন নতুন লোকজনের সাথে পরিচয় - বলতে দ্বিধা নেই, সময় আমার ভালই কাটছে।

আগের চাকরিতে রেজিগনেশনের চিঠি দেয়ার পর বিকট সব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। “কেন ছেড়ে দিলা?” “কোথায় জয়েন করবে?” “সেকী তুমি এজেন্সি তে যাচ্ছ? কেন?!” “পাত্তি বেশি, তাই না?” যেন সবাই আমাকে কনফিউজ করতে সংকল্পবদ্ধ। উফফ্‌, মাথার তার ছিড়ে যাবার উপক্রম। এত কিছুর মধ্যে ভাগ্যিস বউ-এর সাপোর্ট ছিল। অবশ্য, জয়েন করার পরপরই এসব প্রশ্ন কেমন এফারমেটিভ স্টেটমেন্ট হয়ে গেল – হুম্‌, তুমি আসলে মেইড ফর এজেন্সি।

বিপত্তি একটাই। মাঝে মাঝে কিছু অর্বাচিন ক্লায়েন্ট এর আজাইরা প্যাচালে মেজাজ খারাপ হলেও হাসি মুখে তাদের উৎকট উদ্ভট আইডিয়া গুলো শুনতে হয়। শুধু তাই নয়, অবনতমস্তক ছন্দে ছন্দে দুলিয়ে বাহবাও দিতে হয়। কখনও কখনও, উচিৎ হবেনা জেনেও ক্লায়েন্ট-এর কথায় নিজেকেও উদ্ভট কাজ করতে হয়। তখন মনে হয়, আমার মাথাটা বদলে গাধার মাথা এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে, কার্টুনে যেমন দেখায় তেমন। মর্ম-দের কাজটা নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা খানিকটা সেরকমই। আরে আমু পর্যন্ত ঝারিবাজি করে, জীবনে এও দেখার ছিল!

মর্ম’র সাথে কথা বলে মনটা কিছুটা খারাপ- সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাক এর মত অনেক টুকরো টুকরো ঘটনা মনে পড়ে।

প্রতিদিন সকাল ১১টা নাগাদ, দল বেঁধে সবাই নিচে নামতাম গুঁড়ের চা খেতে। আর দুপুরে মিটিং রুম ব্লক করে সবাই একসাথে লাঞ্চ। কত গল্প, কুটনামি আর ব্যাঙ্গাত্তক কথার গোলা বর্ষণ। অবশ্য সেই বর্ষণের টার্গেট ছিল দুজন – আমু আর মোটাসান। ওদের বাহবা দিতে হবে, দুজনই বেশ স্পোর্টিং। এমন চতুর্মুখী আক্রমনের পরও কখনও রাগ করেনি। আমি আর নাহিদ চাকরী ছেড়ে আসাতে এই দুজন কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে।

নাহিদ আমার অপকর্মের সাথি। আলম সাহেব মুরুব্বি গোছের লোক, আমাদের দুজনকেই খুব স্নেহ করেন। উনি আমাদের নাম দিলেন নন্টে-ফন্টে। আমাদের দুজনের এসব গোলা বর্ষণে তার নিরব সাঁয় ছিল, মাঝে মধ্যে নিজেও নেমে পরতেন। আমাদের পার্টনারশিপটা মিস্‌ করছি।

সবসময় যে অন্যকে প্যারা দিয়ে পার পেতাম, তা কিন্তু না। একদিন আমাদের দুজনের ফুরফুরে মনের বহিপ্রকাশ করছিলাম, প্রান ম্যাংগো ক্যান্ডি’র জিংগেল গেয়ে। “আই এম মোখলেছ...” । কখন যে পেছনে একজন সিনিয়র ম্যানেজার এসে দাড়িয়েছেন খেয়াল করিনি। উনাকে দেখে চুপসে গেলাম। উনি কিছু বললেন না, কেবল ড্যাব ড্যাব তাকিয়ে থাকলেন।

আমার আর নাহিদ-এর কোম্পানিতে শেষ দিন। শেষ দিন টাকে মোটামুটি উৎসব মুখর করে ফেলেছিলাম। একটা সাদা টিশার্টে ফ্লোর এর সব কলীগদের অটোগ্রাফ/নোট নেয়া শুরু করলাম। সব চেয়ে মজার নোটটা ছিল দীপ্ত’র লেখাঃ ছাকরী পাবার তরে দিয়েছিনু ভাজ/ সেই ভয়ে ছলে গেল চেড়ে দিয়ে খাজ। আরও একটা নোট ছিল, একেবারেই অপ্রত্যাশিত – “ইউ আর দ্যা বেস্ট ম্যান।“ চোখ টিপি

ব্যাপারগুলো মজাই লাগছিল। মনে হচ্ছিল “এবার দেখা যাবে, ক্ষ্যাপ খেলার জন্য কাকে পাও।“ আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলাম, খুব হাসিখুসি বের হয়ে আসব। যেন কিছুই হয়নি। একদম শেষ সময়ে এসে আর পারিনি। তিন বছর দশ মাস যাদের সাথে উঠা বসা তাদের ছেড়ে যাচ্ছি, ভেবে কিছুটা খারাপ লাগছিল বৈকি। তারওপর মোটাসান-এর সেই একই প্রশ্ন বারবার, “দাদা, রবিবার থেকে আপনি সত্যি আর আসবেন না?” নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠেছিল। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা, বদমাশগুলো ফেয়ারওয়েল পার্টি দিয়ে কাঁদিয়ে ছাড়ল।

ফ্লোরের সবাইকে মিস্‌ করি। গত ৪ বছরে এ মানুষ গুলো আমার জীবনে যে ছাপ ফেলেছে, তার খানিকটা যদি আমি তাদের জীবনে ফেলে থাকি, তাহলেই আমার সেসব খুনসুটি সার্থক।

“... উৎকণ্ঠ মোর লাগি কেউ যদি প্রতিক্ষিয়া থাকে, সেই ধন্য করিবে আমায় ...”

অচেনা আগন্তুক
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

আমার আগের লেখা:
১। ফিরে দেখা সময়
২। একটি অলস কর্পোরেট দুপুর, অতঃপর...
৩। একটি অলস কর্পোরেট দুপুর, অতঃপর... (দ্বিতীয় পর্ব)


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

মর্ম মানে কি সচল মর্ম ভাই? হাসি

দুঃখিত, অসংখ্য ভুল বানান আর অপ্রয়োজনীয় ইংরেজির ভারে ভারাক্রান্ত পোস্টখানা পড়ে আরাম পাইনি।
লিখতে থাকুন। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অচেনা আগন্তুক এর ছবি

ভুল বানানের জন্য ক্ষমা প্রার্থী। ধন্যবাদ।

দিবাস্বাপ্নিক এর ছবি

একটা মাস পার হয়ে গেল...এ‘কদিন জীবনের অনেকগুলো চড়াই উৎরাই পার করলাম। অনেক কিছুই আবার কেঁচে গণ্ডূষে আরম্ভ করতে হয়েছে। আপনার জন্য পরিবর্তন যতটা যুতসই হল... আমার জন্য ঠিক ততটা নয়। ফেলে আসা দিনগুলোর হিসেব নিকেশ থেকে ইচ্ছে করেই এতদিন মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলাম। নিজেকে অনেক সহিষ্ণু মনে করতাম। আপনার এই লেখাটা আজ অনেক বছরপর কাঁদাল আমায়। যেই বাঁধ দিয়ে নিজেকে আটকে রেখেছিলাম তাতে চিড় ধরে গেছে। এই লেখাটা না লিখলে হতনা?

অচেনা আগন্তুক এর ছবি

দিবাস্বাপ্নিক, আমাদের পথ আবার কোন এক চৌমাথায় এসে মিলবে, সেই দগ্ধা দিনের প্রতিক্ষায় রইলাম।

আসলে অনুভূতি গুলো আমি নিজেও চেপে রাখতে চেয়েছিলাম, মর্ম ‘র আবদার রক্ষার্থেই লেখা। হাজার হোক ও এখন আমার ক্লায়েন্ট। না করা যায়না। অবশ্য সে ইতোমধ্যেই তার নামে বাজে বাজে কথা লেখায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে, স্রেফ লঞ্চ প্রোগ্রাম সামনে থাকায় এবারের মত পার পেয়েছি। চোখ টিপি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।