ফিরে দেখা সময়

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১৯/১০/২০১১ - ৯:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ব্লগ এর প্রতি কখনই তেমন উৎসাহ বোধ করিনি। এমনকি মর্ম যখন সচলায়তনে বিভিন্ন লেখা পড়ে, তাদের লেখনীর গুনগত মানে মুগ্ধ হয়ে উদ্বেলিত চিত্তে লিঙ্ক গুলো ফরওয়ার্ড করতে লাগল তখনও নয়। বরঞ্চ কিঞ্চিত বিরক্তই হতাম – অফিসে কাজ না করে, এসব কি?

যাই হোক, মধ্যপ্রাচ্যের চলমান বিদ্রোহের মত ভুত থেকে ভুতে ছড়িয়ে পরতে থাকল ব্লগ এর দাবানল। হঠাৎ দেখি আশেপাশে সব কলিগদের মধ্যে তার রেশ ছড়িয়ে পরেছে – দেখতে দেখতে সচলায়তন চলে এলো বুকমার্ক-এ, হয়ে গেল হোমপেজ। কখনও হাসিতে ফেটে পরছে আবার কখনও নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস। নিতান্তই কৌতুহলের বশে পড়তে শুরু করলাম। এখন মনে হচ্ছে এই কৌতুহল সংবরণ করলে ভুল করতাম। অতঃপর আজকের এই লেখা।

পড়ালেখা করেছি ইংলিশ মিডিয়ামে। আশেপাশে সহপাঠীদের মধ্যে ইংরেজির প্রতি অমোঘ আকর্ষণ ছিল লক্ষণীয়। তাদের ইংরেজির দখলও ছিল ঈর্ষা জাগানিয়া। বলা বাহুল্য, বাংলা তাদের কাছে অনেকটাই অবহেলিত, ভাবখানা এমন যেন অছ্যুৎ এর ভাষা । আমরা যারা গুটি কয়েকজন হোঁচট না খেয়েই বাংলা রিডিং পড়তে পারতাম তাদের কাছে ছিলাম কৌতূহলের বস্তু।

আগাথা ক্রিস্টি অথবা স্টিফেন কিং কে নিয়ে তারা যতটা উচ্ছসিত, সমরেশ কিংবা সুচিত্রা কে নিয়ে তারা ততটাই উদাসীন – অনেকে হয়ত নামটাই শোনেনি। অবশ্য কথায় আছে – অফেন্স ইজ দ্যা বেস্ট ডিফেন্স। অপারগতাকে অপছন্দের লেবাস পরিয়ে কেউ কেউ বেশ পার পেয়ে যায়। সে থাক, সচলায়তনের কিছু ব্লগ পড়ে সত্যি মুগ্ধ হয়েছি। উপমার যুতসই ব্যবহার, শব্দের প্রয়োগ সব মিলিয়ে যে ব্লগ গুলো পরেছি সত্যি দারুণ। আর অফিসের হাজারো ঝঞ্জার মাঝেও এইটুকু ভাললাগা এনে দেয়ার জন্য আমাদের মর্মকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

সাহিত্যের চর্চা না করলেও, একটা বয়েসে একটু আধটু লেখালেখি সবাই করে। অতি সাধারণ আমি তার ব্যতিক্রম নই। ভাল লেখা পড়লে তাই ভাল লাগে। আর এই ভাললাগাটুকুর সাথে একটু স্মৃতিকাতরও কি হয়ে যাই না? মনে হয় সারি সারি চিন্তার ঢেউ আছড়ে পরছে কীবোর্ড এর ওপর। মনে পরে, ক্লাসে লেকচার চলছে আর আমি খাতার পেছনের পাতায় এলোমেলো ভাবনা গুলোকে শব্দের রূপ দিচ্ছি। আর অজান্তেই, নিজের লেখার ধরনের এর সাথে পছন্দের কোন কথা সাহিত্যিকের লেখার ধরনের মিল দেখে কখনও আনন্দিত, কখনও চিন্তিত।

আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল আমার লেখায় নাকি সমরেশ-এর টাচ্‌ আছে। কোথায় ডুয়ার্সের জঙ্গল আর আংড়াভাসা নদীর তীরে উদার পরিবেশে অনিমেষ-এর ছেলেবেলা আর কোথায় চলমান যানজট বেষ্টিত এই যান্ত্রিক নগরীর এক জনবহুল বহুতল ভবনের আলোবাতাসহীন বারান্দায় বন্দী আকাশ দেখে আমার বেড়ে ওঠা। এই দুই কখনও এক হবার নয়। তারপরও কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম মিল পেতাম। অবশ্য বয়েসটাও তেমনি ছিল। আশেপাশে যা কিছু অন্যরকম তাই ভাল লাগতো। অন্যরকমের প্রতি এই আকর্ষণটা বোধহয় মানব চরিত্রের ব্যখ্যাতীত বৈশিষ্টগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর তাই পীড়িতের আর্তনাদ শুনে সদ্য যুবা মনের বিদ্রোহী চেতনার বিচ্ছুরণ ঘটতো। ইচ্ছে হতো কোন বিপ্লবীর দঙ্গলে ভিড়ে যেতে – যেমনটা হয়েছিল অনিমেষ এর বেলাতেও। নাটকীয় মহিমায় বিদ্রোহী সত্ত্বার স্বকীয়তার বহিঃপ্রকাশ।

সাহিত্যে বিদ্রোহ যেমন আসে, প্রেমও তার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবার বিদ্রোহী প্রেম-এর গল্পের জাল বুনে অনেক কথা সাহিত্যিক পাঠকের মনে স্থায়ী যায়গা করে নিয়েছেন। প্রেম বলতে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন হ্রদের জলে তৃষ্ণার্ত মনের সাঁতার দেয়ার কথা বলেছেন, আমাদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের গণ্ডিতে “অতি আবেগাপ্লুত” সহপাঠীদের প্রেম ছিল তার ঠিক বিপরীত। যাই হোক, আমার বিদ্রোহী সত্ত্বা নিজের পাশে সংবেদনশীলতার যে অস্পষ্ট অবয়বের অস্তিত্ব টের পেত তা অনেক খানি অনিমেষ এর মাধবিলতার প্রতিবিম্ব। কাম জাগানিয়া উত্তাপ হয়ত ছিলনা কিন্তু সব প্রতিকুলতা উপেক্ষা করার ক্ষমতা ছিল, ছিল উদারতার উষ্ণতা।

এ-লেভেলস্‌ শেষে, ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে বুঝতে পারলাম সমস্যাটা আদতে আমারই, আবহমান সময়ের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছি। প্রেম এখন এমনই - পার্থিব আকর্ষণ, চুম্বকের বিপরীত দুই মেরুর সেঁটে থাকার মতই। দুঃখজনক হলেও উদ্ঘাটন করলাম, আমার চেনা সাহিত্যের বর্ণনার মত প্রেম আর নিঃস্বার্থ, নিষ্পাপ নেই। প্রেম যেন হয়ে উঠেছে বিবাহপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের অলিখিত মেমোর‍্যাণ্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং। অযাচিত আকাঙ্খা গুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে এখানে ভাললাগার চাইতে প্রয়োজনটাই মুখ্য, অনেকটা ক্ষুদা নিবারণের মত। কবি সুকান্ত বলেছেন “ক্ষুদার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়” – ক্ষুদার্ত বেয়াড়া মনের স্বপ্নিল মোহনিয়তার কারনেই বোধহয় আবেগের এমন বেপরোয়া উদগিরণ।

শুধু প্রেম কেন – সব কিছুতেই একটু বাড়াবাড়ি রকমের বেহায়াপনা, লোক দেখানোই যেন সকল কাজের মূল লক্ষ্য। এমনকি নিতান্তই নির্মল বিনোদনের রম্যকৌতুক গুলো থেকেও রসগোল্লার মত রগরগে আদিরস চুইয়ে চুইয়ে পরত। কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে পড়ালেখার কাজে ব্যবহৃত স্টেশনারি সামগ্রী, সবটাতেই নিজেকে একটু আলাদা করে উপস্থাপন করার একটা সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত। এক্সিভিসনিজম, ম্যাটেরিয়ালিজম এর মত কস্‌মোপলিটন কনসেপ্ট এর সাথে সেই আমার পরিচয়।

অন্যান্য সবখানের মতই এখানেও সমমনা লোকজনের ছোট ছোট গ্রুপ তৈরী হল। আমিও যুতসই একটা গ্রুপ দেখে তাদের মাঝেই নিজেকে খাপখাইয়ে নিলাম। প্রতিদিনকার রুটিন থেকে লেখালেখির সময়টা একটু একটু করে কমে একসময় শুন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকল। বিজনেস স্কুলের উইন উইন সিচুয়েশনের কনসেপ্ট এর পেছনে আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে লাগল আমার বিদ্রোহী সত্ত্বা। লিভ অ্যান্ড লেট লিভ এর কম্প্রমাইজিং এটিচুড আমার মধ্যে একটু একটু করে জেঁকে বসতে থাকে। গ্লোবালাইজেশনের দিনে বসে রদ্যিকালের ফিলসফি নিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন?

একটু একটু করে নিজের বদলে যাওয়াটা দেখলাম। এক যুগ পর, পেছনে তাকিয়ে নিজের যে চেহারা দেখি সেটা একেবারেই অচেনা। সেদিনের ছন্নছাড়া আমি আজকে রীতিমত কর্পোরেট। আছে সংসার ছাড়াও হাজারটা দায়বদ্ধতা। সময়ের আবর্তে, বিছানার পাশে ফেলে রাখা বই-এর মলাটে জমা ধুলার আস্তরের নিচে সেই অনুভূতি গুলোও চাপা পরে গেছে। আজ অনেকটা পথ হেঁটে এসে বুঝতে পারি, আমি সেই আগের মত নেই। কর্তব্যের দায়ের কাছে বাকি সবকিছু ম্লান, ফিকে হয়ে আসা স্বপ্নের মত। এখানে ভালোলাগাটুকু প্রকাশ করা যায় না, হয় স্মৃতি চারণ। আর সেই স্মৃতিগুলো বেদনা ঘন অনুভুতির মতই।

অচেনা আগুন্তুক


মন্তব্য

উচ্ছলা এর ছবি

জনাবে আলীর লেখা এত্ত বেশি পেসিমিস্টিক মন খারাপ মনটাই খারাপ হয়ে গেল মন খারাপ

তবে সচল আপনার 'কর্পোরেট', 'ইংলিশ মিডিয়াম' মনে দাগ কেটেছে জেনে আনন্দিত হলাম হাসি

আপনার স্মৃতিচারণমূলক লেখা পড়বার প্রত্যাশায় রইলাম হাসি

চরম উদাস এর ছবি

ভালো লাগলো। লিখতে থাকুন চলুক

অচেনা আগুন্তুক এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

তানিম এহসান এর ছবি

আরে, শেষ প্যারাগ্রাফে মনে হলো যেন কোন একভাবে নিজের কথা শুনতে পেলাম। অচেনা একজন আগন্তককে দন্ডায়মান শুভেচ্ছা হাসি

guest_writer এর ছবি

সুন্দর, গোছানো একটি পোস্ট। ভাল লেগেছে। চলুক

প্রৌঢ়ভাবনা

 তাপস শর্মা  এর ছবি

খুবই ভালো লেগেছে। বিশেষ করে ব্লগ কে 'দাবানল' বলে আপনি বিদ্রোহের একটা আগুন ছড়িয়ে দিলেন। এইতো চাই। কলম কথা বলুক। পরিবর্তনের কথা। চলুক

guesr_writer rajkonya এর ছবি

ভাল লাগলো।

তিথীডোর এর ছবি

ব্লগিং জিনিসটা আসলে বেশি ভালু না। চাল্লু
আর সচলাসক্তি সারানোর ওষুধ গত দু-বছর ধরে খুঁজছি...

সচলে স্বাগতম অচেনা আন্তুক।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অচেনা আগুন্তুক এর ছবি

সচলাসক্তি - সুন্দর বলেছেন। সাবধান বাণীর জন্য ধন্যবাদ। আপাতত এই ডুবে যাওয়াটা উপভোগ করছি। আর নেপথ্যে থেকে চারপাশে আগুন ছড়িয়ে দিতেই হয়েছি "অচেনা আগুন্তুক"।

guest_writer এর ছবি

আমিতো নিরাময়কেন্দ্র খুজে ফিরছি। ভাবছি নিজেই একটা খুলে বসবো কিনা!

প্রৌঢ়ভাবনা

আশালতা এর ছবি

আশা করছি আর কদিন বাদেই আপনিও আমাদের সাথে সুর মিলিয়ে হাসিমুখে মাথা ঝাঁকিয়ে বলবেন সচল ভারী পচা জিনিষ, কিন্তু কিছুতে আর সেটা ছেড়ে যেতে পারবেন না।
স্বাগতম হাসি

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

মর্ম এর ছবি

হু হু, আপিসে বসে সচলায়তন পড়া ভালু নয়কো! চোখ টিপি

'অচেনা আগুন্তুক-এর আড়ালে যিনি আছেন তাঁকে সচলায়তনের 'নেশার জগতে' স্বাগতম! 'আগুন্তুক' আগুনের ঝলক দেখিয়ে 'আগন্তুক' হয়ে যাবেন না- বরং সে হারিয়ে বসা নিজেকে ফিরে পাবেন, 'কর্পোরেট'-এর খোলস ঘুচিয়ে 'অনিমেষ'-এর ছায়াকে কায়ায় রূপ দেবেন আবার- কামনা তা-ই।

ভাল থাকুন আগুন্তুক, সুগম হোক আপনার সচলপথ! চলুক

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

স্বাগতম ... লেখা ভাল হয়েছে

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

স্বাগতম...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

কল্যাণF এর ছবি

বুজছি, আপনারে দিয়া চলব চলুক , একটু ঘষা মাজা করতেছেন এইতো? আরো লেখা দেন মিয়া তাড়াতাড়ি কইলাম। ইতি সচল পুলিশ (চরম উদাস প্রদত্ত উপাধি, আমার কোন দোষ নাই দেঁতো হাসি )

দিবাস্বাপ্নিক এর ছবি

চরম একটা লেখা। পরে নিজের সাথে অনেক কিছুর মিল খুজে পেলাম। ভাল লাগলো 
দিবাস্বাপ্নিক

শাব্দিক এর ছবি

ইংলিশ মিডিয়াম থেকে আপনার মত আগন্তুক তৈরী হওয়া সত্যই দুর্লভ। আপনার শব্দ চয়ন, ভাষা সে হিসাবে অতুলনীয়। চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

কর্ণজয় এর ছবি

ভাল লাগলো... সরল বয়ান....

অঅসাধারন এর ছবি

লেখা খুব ভালো হয়েছে অচেনা আগন্তুক। লিখতে থাকুন, আপনাকে দিয়ে হবে।

একটা ধন্যবাদ জানাতে চাই, আমার ধারনা ছিলো যারা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে তারা বাংলা ভালোমতো পড়তেই জানে না, লিখা তো অনেক দূর। আপনাকে দেখে একটু বদলে নিলাম চিন্তাভাবনা। আশা করি আপনি হাজার দায়িত্বের মাঝেও বাংলাভাষাপ্রিয়তাকে ছড়িয়ে দেয়া অব্যাহত রাখবেন।

হাততালি

বন্দনা এর ছবি

লিখা ভালো লেগেছে। হাসি

KamrulHasan এর ছবি

ইসলামীয়া কলেজের বাংলার অধ্যাপক সাহেব ও আপনার মতো বাংলা লিখতে পারবেনা। গ্যারান্টিড... গুরু গুরু

স্বপ্নদূত এর ছবি

অসাধারন!!!!!! ভালো লেগেছে.... চালিয়ে যান...... আরো লেখা প্রত্যাশিত..... গুরু গুরু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।