প্রোগ্রামারের ডায়েরীঃ অরণ্যের চিঠি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৫/০৬/২০১২ - ৫:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার খুব কাছের বন্ধুদের মিস করছি কয়েকদিন ধরে। কারো সাথেই আমার এখনকার পার্থিব দূরুত্ব হাজার কিলোমিটারের কম না। লেখাটা তাদের জন্য। আজকাল চিঠি লেখার চল উঠেই গেছে। তবু আমার মাঝে মাঝে চিঠি লিখতে ইচ্ছা হয়। সেই ইচ্ছাটাও একটা অনুঘটক।

কল্যাণীয়াসু,

আজ অনেকক্ষণ একটা বনের পথে একা একা হেঁটেছি। গিয়েছিলাম বরের অফিসের একটা পিকনিকে।কাউকেই তেমন চিনতাম না।সবাই এতো ভালো যে নিমিষে পরিচয় হয়ে গেল। কিন্তু সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা? পাথর বিছানো সরু পথটা খুঁজে আপনি পা চলা শুরু হল। পিকনিক পার্টি পার হলাম। শখের আলোকচিত্রশিল্পী জেলে আর স্ব্যস্থসন্ধানীদেরকেও। সরু হতে হতে পথের চিহ্নমাত্র রইল শুধু । দুপাশের গাছগুলো নুয়ে পড়ে চাঁদোয়ার মত রোদ আটকাচ্ছিল। আকাশ ছোঁয়া গাছেদের জংগলে বিরাম কিছু কাটা গুঁড়ি আর পোড়া কাঠ। গভীর শ্বাস নিলে রোদের সুবাস পাওয়া যায়। এদেশের গাছেদের চটজলদি পাতা গজিয়ে, ফুল ফুটিয়ে পরাগায়ন সারতে হয়। তাই গাছে গাছে ঝকঝকে তরুন পাতার পাশে শিশু ফুলের দল। ঘাসের মাথায়, গুল্মের ভাঁজ়ে, ছোবল তোলা শিকড়ের পিছনে হলুদ, নীল, বেগুনী আর সাদা ফুল। হাঁটতে হাঁটতে আমি গাছেদের কাছ থেকে সকল অসুখ সারিয়ে নিচ্ছিলাম। নিজেকে কথা দিচ্ছিলাম আসছে পাতাঝরার দিনে আসব আবার। আসব শীতে তুষার আর পত্রহীন শাখার নির্বাক যুগের ছবি দেখতে। এরপর হঠাৎ ফেরার পথ ধরেছি। কারন ভিতরে ভিতরে আমি টের পাচ্ছিলাম আমি আর নিজেকে থামাতে পারবো না। পায়ের অদৃশ্য শিকড়গুলো আমাকে সেখানে আটকে চিরতরে সূর্যমুখী করে দেবে।

হতে পারে পথের ধারে এই এলোমেলো গাছের সারি বনের সম্মান পায় না। কিন্তু একজন ঢাকাবাসীর জন্য যে পঁচিশ বছর বয়ষ পর্যন্ত জীবনে ত্রিশ দিনের বেশি ঢাকা ছেড়ে থাকে নি তাকে মুগ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। আমার মনে আছে স্নানঘরে চুরি করে খাওয়া তেঁতুলবিচিতে অঙ্কুর দেখে কি অদ্ভুত লাগতো আমার। অথবা, সেই গাছটার কথা যার দিয়ে তাকিয়ে অসংখ্য স্কুলের দুপুর কাটিয়েছি আমরা ঘুমঘুম চোখে। কমলাপুর রেললাইনের পিছনে বিস্ময়ের মত অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গুলে জায়গাটার কথা মনে আছে তোমার? রেল হাসাপাতালের পিছনে গাছগুলো? কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি দিয়ে বিনিসুতায় মালা গাঁথা অথবা ঘাসের সুতোয় টগরের নূপুর… জ়াফলং থেকে ফেরার পথে সিএনজির পেছনের জানালার ফ্রেমে মেঘালয়ের পাহাড় গুলো আমি চিরতরে স্মৃতিবন্দী করে রেখে দিয়েছি।

বইপড়ার ব্যপারে আমার কোনকালে বাছবিচার ছিল না। খুচরো ডালের মোড়ক থেকে স্টিফেন হকিং, সবই এক নিঃশ্বাসে পড়তাম। ব্যতিক্রম শুধু শিকার আর ভ্রমন কাহিনী। আর ব্যতিক্রমের ব্যতিক্রম হল পালামৌ আর অরণ্য। আমি চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট টের পাই একটা একশিলা পাহাড়, রাধার মান ভাঙ্গানো আশ্চর্য পাখি, মন্দ্র কাষ্ঠঘন্টা ধবনি, সরস্বতী কুন্ডু, শুকনো মৌরিফুলের গন্ধ। অষ্টআশির বন্যার আগে আমাদের একতলার বাসার জানালার ওইপাশে একটা গোলাপ গাছ ছিল। আমার মাথা তখনো জানালা ছোঁয়নি বলে গোলাপগাছটা আমার দেখা হয়নি কখনো। এখনো মাঝে মাঝে সেই নাদেখা গোলাপগাছ কে স্বপ্ন দেখি।

দেখা না দেখা স্বপ্ন গুলোকে খুব মিস করি বন্ধু আজকাল। স্বপ্নসংগীদেরও। শৈশবের অবিমিশ্রিত খেলার সকাল, বয়ো:সন্ধির নির্জন দুপুর, তারুন্যের সোনালী বিকেল…যখন বাবারা ছিলেন আকাশের চেয়ে উঁচু, মায়েরা ছিলেন পৃথিবীর চেয়ে গুরুভার। স্বপ্নগুলো কে পুটুলিবন্দী করা আছে যত্নে। তাই মাঝেমাঝে কৃপণের মত নেড়েচেড়ে দেখি। বিকেলের রোদ আরো গাঢ় হচ্ছে। কাল থেকে আবার সপ্তাহ শুরু। অসংখ্য আটপৌরে কাজ পরে আছে। কোন একদিন স্বপ্নের পথে পায়চারীর ইচ্ছা দুর্নিবার হলে জ্বালাবো আবার।

রিক্তা
-----------


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

মডারেশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ১ম ("কল্যাণীয়াসু" সম্বোধনের পর) আর ২য় প্যারার আগের একটা অতিরিক্ত লাইন গ্যাপ দিয়ে ফেলেছিলাম। সেটা মুছে ফেলা যাবে কি?

রিক্তা
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনুভুতিগুলো একদম তরতাজা হাসি

ড্রাইভ করতে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গায় ক্ষনিকের জন্য চোখ যায়। ইচ্ছে করে পরের সপ্তাহান্তে ঘুরতে আসবো। অসংখ্য আটপৌরে সপ্তাহের ছুটির দিনগুলো শেষ। কয়েকদিনের ব্যবধানেই ফলগুলো ফলে রুপান্তর হয়। ফুল-ফল কিছুই ঠিকমতো আর দেখা হয় না।

ফ্রুলিক্স

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ ফ্রুলিক্স। আর সপ্তাহান্ত! সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব সপ্তাহান্ত বুকড মন খারাপ

রিক্তা
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

সত্যপীর এর ছবি

চমৎকার চলুক

..................................................................
#Banshibir.

অতিথি লেখক এর ছবি

গুনীজনের প্রশংসা পাইতে ভালোই লাগে :D। ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে একটু খাটো করার দরকার ছিল। শুধু আপুর খাতিরে মুক্তি দিলাম।

রিক্তা
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনার লেখা, ভাষা ব্যবহার, বাক্যভঙ্গি... মুগ্ধ করলো...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বন্দনা এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ নজরুল ভাই।

স্মৃতিগুলোই মুগ্ধতাজাগানিয়া। বারবার ভাবলেও পুরান হয়না।

রিক্তা
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

অমি_বন্যা এর ছবি

পড়ে অনেক ভালো লাগলো।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ অমি_বন্যা।

রিক্তা
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

বন্দনা এর ছবি

সত্যি আপনার লিখার মাঝে কেমন একটা মুগ্ধতার জাল বিছানো আছে, খুব ভালো লাগ্লো।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ বন্দনা। আপনার লেখাগুলোও আমার খুব ভালো লাগে। আলসেমি আর সময়ের অভাবে মন্তব্য করা হয়ে ওঠে না।

রিক্তা
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

বেশ ভালো লাগলো।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ অতন্দ্র প্রহরী।

রিক্তা
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আমি ভেবেছিলাম প্রোগ্রামারের ডায়েরী বুঝি এমন হবে... খাইছে

void main (std::string name=কল্যাণীয়াসু)

for(অনেকক্ষণ)
একটা বনের পথে একা একা হেঁটেছি।

if(বরের অফিসের একটা পিকনিকে)
{
কাউকেই চিনতাম=0;
সবাই = এতো ভালো = নিমিষে পরিচয় হয়ে গেল।
...
}

ইত্যাদি...

জোকস অ্যাপার্ট, ভালো লেগেছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

তা যা বলেছেন। আমার নিয়মিত লুপ চালায়ে বাসন মাজতে আর ঘর ঝাড়ু দিতে মন চায়।

রিক্তা
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

কালো কাক এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

ভাল লেগেছে।
আরও লিখুন। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ প্রদীপ্তময় সাহা। উৎসাহটা খুব ভালো লাগলো।

রিক্তা
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

রংধনুর কথা এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ রঙধনুর কথা।

রিক্তা
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

কালো কাক এর ছবি

অনেক ভালো লাগলো।
"প্রোগ্রামারের ডায়েরী" কেন ?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।
"প্রোগ্রামারের ডায়েরী" কারনঃ

১ করি কামলার কাজ, পেশায় সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। দিনের ৫০% সময় প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে কাজ করি।
২ এটা কিওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করছি। খুঁজতে সুবিধা।

রিক্তা
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

মরুদ্যান এর ছবি

হাসি

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

রিক্তা
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।