সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন এবং শিক্ষার মাধ্যমরূপে মাতৃভাষা: আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ঔপনিবেশিক চিন্তাকাঠামো

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১৭/০৮/২০১২ - ১২:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হে বঙ্গ! ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন/তা সবে (অবোধ আমি!) অবহেলা করি/পরধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ/পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি …

একটা বিষয় আপাত দৃষ্টিতে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করবার মতো, বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানি শাসনে এদেশের বাংলা ভাষাভাষি ইংরেজি শিক্ষিত বিদ্বান লোকজনের হাতে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতি হয়ে এর প্রভূত বিকাশ সাধিত হলেও স্বাধীন বাংলাদেশের ইংরেজি শিক্ষায় বিশেষ ভাবে শিক্ষিত লোকজনের হাতে পরবর্তীতে তার আর বিশেষ কোনো ধরনের উন্নয়ন না হয়ে বরং ক্রমান্বয়ে অবনতি ঘটে চলেছে। বিকাশের পথটি এক প্রকার রুদ্ধ হয়েছে এবং এর পরিবর্তে ভাষার ক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছে নানারকম নৈরাজ্য এবং বিকারগ্রস্থতা। বিভিন্ন পথে এর প্রকাশ আমরা চারিদিকে লক্ষ করতে পারি। একদিকে দিনানুদৈনিক ব্যবহারে ভাষাটি স্বাভাবিক পথ হারিয়ে ধাবিত হচ্ছে এমন পথ ধরে যা তাকে হাতছানি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিপরীত গন্তব্যে, ভাষা ক্রমাগত পূর্ণ হয়ে উঠছে অপলাপে- অন্যদিকে সৃষ্টি হচ্ছে অযুত অপসাহিত্য; আবার বিজ্ঞান, দর্শন কিংবা জ্ঞানের অপরাপর শাখায় উন্নত মানের বইপত্র বাংলা ভাষায় রচিত না হয়ে ভাষাটিকে করে তুলেছে একটি অন্ধকার সীমাবদ্ধতায় বসবাসরত অবরুদ্ধ কবন্ধের মতো, যার স্কন্ধ থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গে স্বাভাবিক প্রত্যঙ্গের পরিবর্তে গজিয়ে উঠছে বিকৃত ও কদাকার টিউমারসদৃশ উদ্ভট অপবস্তু। এর একটি উৎকট বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই প্রতি বছর বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বইপত্রগুলোর মান এবং চরিত্রের দিকে ভালোমতো লক্ষ করলে। এই গ্রন্থগুলোর মধ্যে আবার অধিকাংশই প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি মাসের একুশের বইমেলাকে টার্গেট করে। পুরো একটি বছর ধরে অপেক্ষা করার পর বইমেলায় একসাথে অনেকগুলো বই ছাড় করবার বিষয়ে প্রকাশকদের এই চিন্তাভাবনা বইপড়ুয়া হিসেবে বাংলাদেশের বাঙালিদের চরিত্রের একটি দিকের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ আলোকপাত করে।

আমাদের একুশের মাসজুড়ে বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত বইগুলোর গুণগতমান বিচার করলে ভাষার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য এবং চিন্তার ক্ষেত্রে বিকারগ্রস্ততা ও স্থবির অবস্থার প্রমাণ পাওয়া যায়। উন্নত মানের সাহিত্য-গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ-বিজ্ঞান-দর্শন-ইতিহাস-রাজনীতির বইয়ের পরিবর্তে দুর্বল ভাষাজ্ঞান এবং অগভীর দৃষ্টিসম্পন্ন যেসব স্থূল রুচির নিম্নমানের বই প্রতিবারের মেলায় রীতিমতো পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতামূলকভাবে প্রকাশিত হয়ে থাকে তাই দেখে এই মেলাকে এখন যথার্থভাবে বাঙালির মননের প্রতীক অথবা ‘প্রাণের মেলা’ বলে অভিহিত করা কঠিন। স্থুল এবং নিম্নরুচিসম্পন্ন এই সকল বই-পুস্তক সৃষ্টি করছে গভীর এবং স্বচ্ছ চিন্তায় অক্ষম তরল মানসিকতার পাঠক, যদিও এই সকল গ্রন্থের ‘জনপ্রিয়’ রচয়িতারা সমাজে পাঠক সৃষ্টি করছেন বলে প্রায়শ বিভিন্ন মহল থেকে সাধুবাদ লাভ করে থাকেন। কিন্তু প্রতিবছর এই শ্রেণীর যে অজস্র বই-পুস্তক প্রকাশিত হয় তার সবই যে তাদের ভাষায় ‘পাঠক সৃষ্টি’ করে এমন নয়। জনপ্রিয় লেখকদের পুস্তক বিক্রয়ের পরিসংখ্যানের দিকে তাকিয়ে উঠতি শ্রেণীর এক ধরনের তরুণ লেখক কাছাকাছি মাত্রার সাফল্য লাভের তাগিদে হালকা জাতীয় বাক্য বিস্তার এবং চিন্তার সমন্বয়ে একধরনের লঘু সাহিত্য জাতীয় বস্তুর জন্ম দিয়ে থাকেন। এই লেখকদের অধিকাংশের না আছে ভাষার ওপর প্রকৃত দখল অথবা কোনো প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপর প্রয়োজনীয় জ্ঞান। ফিকশন জাতীয় প্রকাশিত বইপত্রের পাইচার্ট তৈরি করা হলে এর মধ্যে উপন্যাস শ্রেণীর লেখ্যগুলোই উল্লেখযোগ্য অংশ অধিকার করে রাখবে। এর লেখকদের মধ্যে অধিকাংশই, বলা যায় পুরো অংশই অর্থনৈতিক এবং চিন্তাগত দিক থেকে মধ্যশ্রেণীভুক্ত। কিন্তু স্বশ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্রগুলোকেও যথার্থ সততা এবং যোগ্যতার সাথে ফুটিয়ে তুলে তার সাথে সমান্তরাল ঘটনাসমূহের সমাবেশে সার্থক আলেখ্য সৃষ্টি বলতে যা বোঝায় এই উপন্যাসগুলোকে তা বলা যাবে না। তার পরিবর্তে বইগুলোর কয়েকটি পাতা ওল্টালেই একজন সচেতন পাঠকের নিকট যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ধরা দ্যায় তাহলো এগুলো রচনা করতে কিংবা ভাষায় প্রকাশ করতে কোনো সক্রিয় মেধা অথবা মানসিক শ্রমের প্রয়োজন তাদের হয় না, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতম পড়াশোনাও তেমন একটা দরকার পড়ে না। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা এগুলো লিখে যাওয়া হয় বাস্তবতার সাথে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধের মাধ্যমে ফ্যান্টাসির জগৎ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায়। এটি মধ্যশ্রেণীভুক্ত এই লেখকদের চেতনার একটি বিশেষ দিককেই প্রকাশ করে- নিজস্ব শ্রেণী উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চপর্যায়ভুক্ত হওয়ার যে অদম্য বাসনা এই গোষ্ঠীভুক্ত অধিকাংশ সদস্যকে প্রতিনিয়ত তাড়িত রাখে, তাদের যথার্থ প্রতিনিধি হিসেবেই তরুণ জনপ্রিয়তাকামী লেখককুল তাদের যোগ্যতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে থাকেন।

একদিকে বাংলা ভাষার প্রকৃত বিকাশের পথ রুদ্ধ করে বই-বাণিজ্যের বিস্তারের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে তার মানের অবনমন আরেক দিকে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ‘সর্বস্তরে মাতৃভাষা চালু হলো না’ বলে তথাকথিত ভাষাপ্রেমিকদের কপটতা মিশ্রিত কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণের বিরাম নেই। এই ভাষাপ্রেমিকগণ এ বিষয়ে সারাবছর চুপচাপ বসে থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য যাবতীয় উদ্যম সঞ্চয় করতে থাকেন। কেবল এই একমাস ধরে তাদের যে তৎপরতা লক্ষ করা যায় এবং কোনোক্রমে ফেব্রুয়ারি পার হলেই তাদের উৎসাহে ভাটা পড়ার প্রবণতা প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয় তা থেকেও এদের এতদসংক্রান্ত বক্তব্যসমূহের অন্তঃসারশূন্যতা এবং ভণ্ড চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে পড়ে। এখানে আরেকটা বিষয় বিবেচনাযোগ্য, টক শোগুলোতে সর্বস্তরে যে মাতৃভাষা প্রচলনের কথা বলে ‘সুশীল’ বুদ্ধিজীবীগণ দীর্ঘশ্বাসে বাতাস কাঁপিয়ে টেলিভিশন ক্যামেরার লেন্স বাষ্পাচ্ছন্ন করে ফ্যালেন সেই মাতৃভাষার রূপ তাদের কাছে কী? তার চরিত্রই বা কেমন? এই ভাষা কাদের দ্বারা কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়? এসব বিষয় গুরুত্বের সাথে আলোচনায় আসতে দেখা যায় না, কদাচিৎ এলেও সেটা জলের দাগের সম্ভাবনা এড়িয়ে তার উপরিভাগ ছোঁয়ার মতোই একটা রূপকল্প দৃষ্টির সম্মুখে উপস্থাপন করে। প্রথমত এ বিষয়ে যা বলা প্রয়োজন সেটি হলো, ভাষা কোনো সরল একরৈখিক বিষয় নয়। এর যেমন নির্দিষ্ট শ্রেণীচরিত্র আছে, তেমনি আছে অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপ। দ্বিতীয়ত, প্রায়োগিক দিক থেকেও এর প্রকাশভঙ্গি এবং উপস্থাপনার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা অবজ্ঞার বিষয় নয়। যেকোনো ভাষায় তার ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকে, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায়, বিজ্ঞান শিক্ষায়, রাজনৈতিক শ্লোগানে, দাপ্তরিক প্রয়োগে অথবা আইনি ব্যাখ্যায় এর বিভিন্ন রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। শুধু পরিভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেই নয়, নির্দিষ্ট শব্দমালা প্রয়োগে এবং ভাষাভঙ্গির ক্ষেত্রেও একথা সত্য। কিন্তু যারা এভাবে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলনের পক্ষে ওকালতি করেন তারা এ বিষয়টি সামনে আনেন না এবং সর্ববিষয়ে প্রয়োগের উপযোগী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা তথা বাংলার সক্ষমতা অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন না। শুধু সাহিত্যই নয়, অফিস-আদালত, চিকিৎসা-প্রকৌশল, বিজ্ঞান-দর্শনচর্চা থেকে শুরু করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য যেসব পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলতে তাদেরকে খুব কমই দেখা যায়। সুতরাং ভাষার মাসকে কেন্দ্র করে তাদের এইসব কর্মকাণ্ড যে নিতান্ত দায়সারা গোছের প্রচারণাসর্বস্ব বিষয় সেটা না বলে কি উপায় আছে? আপাত দৃষ্টিতে এটি বিস্ময়কর এবং পরস্পরবিরোধী ঘটনা বলে মনে হতে পারে। আবার অনেকেই হয়তো বিষয়টি এভাবে লক্ষ করেন নি কিংবা সেটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন নি। তবে বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা এবং তাকে নিয়ন্ত্রণকারী রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল উপাদানগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা এবং বিশ্লেষণ করলে এই আপাত বিরোধী কার্যের পেছনে বিদ্যমান সক্রিয় কারণ পরিষ্কার হয়ে আসে।

বৃটিশ আমলে আধুনিক শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরেজি। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে সম্মানজনক চাকরির কথা কেউ ভাবতে পারতেন না; যদিও মাদ্রাসা-মক্তব-টোলে আরবি-ফারসি-সংস্কৃত ভাষায় পড়াশোনা করে অনেকেই ধর্মীয় লাইনে চলে যেতেন, তথাপি সাধারণভাবে ইংরেজিতেই পাঠদান চলত এবং এই পাঠদান পদ্ধতিই শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাধান্যে ছিল। কিন্তু এই ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ভারতবর্ষে রাতারাতি হয় নি। কোম্পানির মাধ্যমে ইংরেজরা এই ভূ-খণ্ডের অধিকার দখল করে নেবার সময় রাজ্য পরিচালনার ভাষা হিসেবে প্রচলিত ছিল ফারসি। ঔপনিবেশিক শক্তি ক্ষমতালাভ করে প্রথমে ফারসিকে রাজভাষা হিসেবে মেনেই নিয়েছিল। কিন্তু সর্বস্তরে ইংরেজির প্রচলনে তাদের ছিল সুদূরপ্রসারী চিন্তা। এ জন্য তারা প্রথম তাদের দৃষ্টি দ্যায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। চাকরি-বাকরির পরিসরে ইংরেজিকেই প্রাধান্য দেয়া শুরু করে তারা কালক্রমে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলে। এরই প্রক্রিয়ায় ইংরেজি শিক্ষিত একটি মধ্যশ্রেণী গড়ে সমাজে, যে শ্রেণীটি ঔপনিবেশিক প্রভুদের পক্ষে ইংরেজিতে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় দক্ষ হয়ে ওঠে। এভাবে সমাজের অভ্যন্তরে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার বাস্তবতা সৃষ্টি হয় এবং রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফারসি ভাষার ভূমিকা ক্রমশ প্রান্তিক অবস্থানে গিয়ে ইংরেজি ভাষাকে তার পথ করে দ্যায়।

সে সময় ইংরেজি ভাষায় পাঠদান পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত উন্নত মানের। অর্থাৎ যারা এই ভাষার মাধ্যমে বিভিন্ন শাখায় শিক্ষা লাভ করতেন তারা ভাষাটিতে যথেষ্টই বুৎপত্তি অর্জন করতেন। তাদের ইংরেজি শিক্ষার ভিত্তি ছিল বেশ পোক্ত। এই কারণে আমরা দেখতে পাই ঊনিশ শতকে যারা ভাষাটিকে ভালোভাবে রপ্ত করে নিজস্ব মেধা এবং মননের বলে এই ভাষায় জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চা করেছেন তাদের হাত ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে। বৃটিশ সরকারের চাটুকার হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের যতো সমালোচনাই করা হোক না কেন, বাঙালির সংস্কৃতিতে আধুনিকতার সুবাতাস প্রবেশের ক্ষেত্রে তার অবদান অস্বীকার করা চলে না। প্রায় একই কথা বলা যায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিংবা মাইকেল মধুসূদনের ক্ষেত্রে। ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা গদ্যসাহিত্যকে আধুনিক ও সুবিন্যস্ত রূপ দিয়ে তাকে পরিশীলিত করে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা উপন্যাসকে দিয়েছিলেন একটি সুশৃঙ্খল কাঠামো। বস্তুত বাংলা ভাষায় উপন্যাস রচনার যে আধুনিক ফরম্যাট সেটা বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করেছিল। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা বৃটিশ শাসনের প্রতি পক্ষপাতের জন্য তার অনেক সমালোচনা হলেও এবং সে সমস্ত সমালোচনা যথার্থ হলেও তার অবদানকে এক্ষেত্রে কোনোমতেই অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্যদিকে মধুসূদনের হাতে বাংলার নাট্যচর্চা এবং কাব্যকলা তার ভেতরকার গ্রাম্যতাকে ঝেড়ে ফেলে আধুনিক হয়ে উঠেছিল। তা যে শুধু ভাষাকেই আধুনিক করে তুলেছিল তা-ই নয়, সনাতনী এবং প্রচলিত গোঁড়ামিপূর্ণ চিন্তাভাবনার মূলে পদাঘাত করে সাহিত্যক্ষেত্রে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি সুদৃঢ় করেছিল।

এইসব বিষয় নিয়ে এখানে বিস্তারিতভাবে তথ্যপূর্ণ আলোচনার সুযোগ না থাকলেও মোটা দাগে একথা বলা চলে যে, ওপরে যা উল্লেখ করলাম তা সম্ভব হওয়ার মূল কারণ হলো ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা এবং বুৎপত্তি অর্জনের ফলে এর মাধ্যমে ইউরোপীয় সাহিত্য এবং জ্ঞানের বিশাল সমৃদ্ধ ভাণ্ডার তাদের সামনে উন্মুক্ত হয়েছিল। কেননা নিজস্ব প্রভাব বলয় বিস্তারের সাথে সাথে আধুনিক যুগের সূচনায় ইংরেজি হয়ে উঠেছিল ইউরোপীয় দর্শন, বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের পারস্পরিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে প্রধান মাধ্যম। সুতরাং ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ এই ভাণ্ডার থেকে উপস্থাপনার ভঙ, ভাষাভঙ্গি, চিন্তার ধরন সহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে তার সাথে নিজেদের মেধার যথাযথ সমন্বয় ঘটিয়ে বাংলার মাটিতে জন্ম দিয়েছিলেন এ দেশীয় সাহিত্যের নানা উন্নত শাখা-প্রশাখার, সমৃদ্ধি এবং বিকাশ ঘটিয়েছিলেন এর বিভিন্ন ক্ষেত্রের। বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তাভাবনার দিক থেকে ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা মধুসূদনের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকলেও একটি বিষয় ছিল তাদের সবার জন্যই কমন সত্য: তারা সবাই ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে ভাষাটিতে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এবং তাদের শেকড় ছিল বাংলার মাটিতেই প্রোথিত। এ বিষয়ে মধুসূদনের মাতৃভাষাকে অবহেলা করে প্রথম যৌবনে ইংরেজপ্রীতি এবং পরবর্তীতে জীবনের পথপরিক্রমায় বিভিন্ন ধাপে ঘা খেয়ে খেয়ে ভ্রম উপলব্ধি করতে পেরে মানসভূমে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কাহিনী সর্বজনবিদিত হয়ে আছে যেমন, তেমনি কিংবদন্তী হয়ে আছে বিশেষত ‘বঙ্গভাষা’ কবিতায় এ বিষয়ে তার নিজের স্বীকারোক্তি- সে বিষয়ে অধিক কথার বিস্তার না করাই শ্রেয়। তবে শেকড়ে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি এ দেশের সাহিত্য-মৃত্তিকায় যে আশ্চর্য সব ফসলের জন্মদান করেছিলেন তা আজও বহু বাংলা সাহিত্যের গবেষকের বিস্ময়ের বস্তু হয়ে আছে।

যে মাটিতে জন্মগ্রহণ তার সাথে সংলগ্ন থাকার বোধই মূল কারণ যে জন্য বিদেশি ভাষায় সৃষ্ট বিপুল জ্ঞানসম্ভারের সম্মুখীন হয়ে তারা সেই জ্ঞানকে আত্মস্থ করে তার দ্বারা স্বদেশি ভাষা এবং সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার কথা ভেবেছিলেন এবং সে কাজে আত্মনিয়োগও করেছিলেন। যাদের কথা ওপরে লিখলাম তাদের আগে এবং পরে আরো অগণিত মনীষী লেখক-চিন্তক-সাহিত্যিক বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন; রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত থেকে শুরু করে পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী, দীনবন্ধু মিত্র, মীর মশাররফ, কাজী নজরুল এবং আরো অসংখ্য কবি-ঔপন্যাসিক-গল্পকার-প্রাবন্ধিক সম্মিলিতভাবে বাংলা সাহিত্যের ধারাকে বেগবান করেছিলেন এবং এর অজস্র উপধারা সৃষ্টি করে প্রবহমান নদীর মতো তাকে প্রাণসমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন। আলাদা করে তাদের সবার নাম উল্লেখের সুযোগ এখানে নেই।

বৃটিশ-উত্তর যুগে পাকিস্তানি আমলে পূর্ব বাংলায় নব্যশিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্তদের মধ্যে এই বিষয়ে দেখা দ্যায় দ্বিধাবিভক্তি। তাদের মধ্যে একাংশ বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণী-সৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতা এবং আত্মকেন্দ্রিক সুবিধাবাদী উপমহাদেশীয়, বিশেষত কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দের গণবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিঘাতে অখণ্ড ভারতবর্ষের যুগে কোণঠাসা হয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে নিজেদের আশ্রয় খুঁজে নিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ অনুভব করে এবং পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে বাংলা ভাষাকে ঢেলে সাজাবার প্রয়াসী হয় ও কলকাতা-কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার পাল্টা হিসেবে এদেশীয় সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে ভাষাকে ধর্মীয় রূপ প্রদান করার চেষ্টা করে। এর ফলশ্রুতিতে প্রথমে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থা হতে বিচ্ছিন্ন করে এই ভূ-খণ্ডের জনগোষ্ঠীকে অবদমিত রাখার চক্রান্ত এবং তাতে সফলতা লাভ না করে পরবর্তী পর্যায়ে তাকে বিকৃত করার তৎপরতা বিকশিত হতে থাকে। বেতারে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের ওপর বিধি-নিষেধ এবং নজরুলচর্চার খণ্ডিতকরণ ছাড়াও বাংলার মূল ধারার সাহিত্যের চর্চার ওপর রাষ্ট্রীয় চোখরাঙানি তো ছিলই, সেই সাথে ছিল উর্দূ, ফারসি, এমনকি রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রচেষ্টাও সমান্তরালে বিদ্যমান ছিল। বাঙালিকে পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর অধীন এবং বশংবদ রাখাই শুধু নয়, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ-কেন্দ্রিক বাংলা ভাষাচর্চার প্রভাব বলয় থেকে বিচ্ছিন্নকরণ ছিল উদ্দেশ্য। এই তৎপরতার পক্ষে রাষ্ট্রযন্ত্রের সুবিধাভোগী একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী জুটে গেলেন। ১৯৪২ সালে গঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ এই কর্মকাণ্ডকে চিন্তার ক্ষেত্রে ভিত্তি প্রদান করেছিল। আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখের কথাবার্তা, চিন্তাভাবনা এবং রচনাসমূহ এপক্ষীয় প্রচারণার পালে বাতাসের যোগান দিয়েছিল। কিন্তু এর বিপরীতে যে প্রগতিবাদীদের জোরদার অংশটি ছিলেন, তারা ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অল্প দিনের মধ্যেই নিজেদের মোহভঙ্গের মধ্যে দিয়ে শেকড়ের সন্ধানে প্রয়াসী হন এবং এই আত্মানুসন্ধানের পথ পরিক্রমায় বাংলা ভাষার আধুনিকীকরণ, বিকাশ এবং অসাম্প্রদায়িকীকরণের দিকে ঝুঁকে পড়েন, নিজস্ব তৎপরতার বিস্তার ঘটান। এ কাজে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তো ছিলেনই সেই সাথে আবদুল হক, মোতাহের হোসেন চৌধুরী প্রমুখ মনীষী এবং বিদ্বজ্জনের লেখালিখি, বক্তব্য এবং চিন্তা ছিল তাদের মূল তাত্ত্বিক ভিত্তি। তাদের এ প্রচেষ্টার ফলে ঊনবিংশ শতাব্দের বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চাকারী দিকপালদের সাথে পূর্ব বঙ্গের মৃত্তিকা-সন্তানদের নাড়ির যোগাযোগটি যেমন অক্ষুণ্ন থাকে, তেমনি বিকশিত হতে থাকে এখানকার বাংলা ভাষা। অর্থাৎ পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণ এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি অবলম্বন হিসেবে যেখানে নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যে শেকড়ের অনুসন্ধান শুরু হয়- তা থেকেই ভাষা হিসেবে বাংলা বিকাশ লাভ করে। মূলত ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে পরিণতি লাভের মধ্যে দিয়ে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী-কেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয়-সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মুখে কষাঘাত পড়ে, নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার বাস্তব সম্ভাবনা সবদিক থেকে শক্তিশালী হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুরু হয় এর উল্টো যাত্রা। স্বাধীন রাষ্ট্রে, যেখানে বিদেশি শক্তির প্রকাশ্য হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিল না- সেই খানে এসে বাংলা ভাষার প্রবহমানতা মুখ থুবড়ে পড়ে অনেকাংশে, এর বিকাশ বিঘ্নিত হয়। এর কারণ বিবিধ। প্রতিরোধের চেতনা ছিল অনুপস্থিত, ফলে সমুদ্র তীরের দিকে ধেয়ে আসা উদ্দাম জলস্রোত যেমন বাধা পেলে অধিক ফুসে ওঠে, তার অনুপস্থিতিতে এই প্রয়াসে কিছুটা ভাটা পড়ে। কিন্তু মূল কারণ ছিল, এই বিকাশের ক্ষেত্রে যে শাসক গোষ্ঠী প্রভাবকের ভূমিকায় থাকার কথা ছিল তাদের ভাষা-বিষয়ক দূরদৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব। স্বাধীনতার পর এখানে শিক্ষার মাধ্যমরূপে মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার কথা বলে বিদেশি ভাষা, বিশেষত ইংরেজি শিক্ষার পথ সরকারিভাবে একরকম বন্ধ করে দেয়া হয়। শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা- এটি নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল এবং বৈজ্ঞানিকভাবে যথাযথ একটি ধারণা। কিন্তু মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের কথা বলে বিদেশি ভাষা শিক্ষার পথ রুদ্ধ করে দেয়া ছিল পুরোমাত্রায় প্রতিক্রিয়াশীল এবং অবৈজ্ঞানিক একটি পদক্ষেপ। কেননা দেশ স্বাধীনের পর যদি দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার কার্যকারিতা সৃষ্টি করতে হয় তাহলে বিভিন্ন ভাষায় লিখিত জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-দর্শন-ইতিহাসের বই সর্বাগ্রে বাংলায় অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন শাখায় ব্যবহৃত বিশেষ বিশেষ বিদেশি শব্দের ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ এবং শ্রুতিমধুর পারিভাষিক শব্দ উদ্ভাবনের। এর জন্য প্রয়োজন শুধু ইংরেজি ভাষায় নয়, বিশ্বের সমৃদ্ধ এবং ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছয়-সাতটি ভাষা, যেমন: জার্মান, ইতালীয়, ফরাসি, জাপানি, চীনা, আরবি, ফারসি প্রভৃতি ভাষায় দক্ষতা অর্জনকারী একদল মানবসম্পদ- যারা বিশ্বের এই সকল সমৃদ্ধ ভাষার সাথে পরিচিতি লাভ করে তাদের সাথে বাংলার সেতুবন্ধন রচনা করবে এবং এই ভাষাগুলোতে রচিত জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মূল্যবান গ্রন্থসমূহ বাংলায় অনুবাদ করে ভাষাটির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটাবে; সেই সাথে বাংলায় লেখা উচ্চ মানের রচনাসমূহের সাথেও বৈশ্বিক পাঠকসমাজের পরিচয় করিয়ে দেবে। মূলত জীবিত কোনো ভাষাই অন্য ভাষার সাথে মিথষ্ক্রিয়া ব্যতিত তার প্রবহমানতাকে অক্ষুণ্ন রাখতে পারে না।

কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষার মাধ্যমকে বাংলা করার নামে যেভাবে অন্য ভাষা শিক্ষার পথ কণ্টকাকীর্ণ করা হয় সেটা তখনকার নব্য শাসক গোষ্ঠীর অদূরদর্শিতা এবং অপরিপক্বতার ফলাফল একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা বাংলায় শিক্ষাগ্রহণ করলেও উন্নত মানের গ্রন্থের অভাবে শিক্ষার মান ক্রমাগত নিম্নমুখী হতে থাকে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতা হলো, একটি নির্দিষ্ট দেশের সংস্কৃতি, ভাষা, শিল্প, বাণিজ্য এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেক বেশি বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্কিত, সংযুক্ত। বাংলাদেশও কোনো ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের অফিস-আদালত এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সহ অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সেতুবন্ধন রচনাকারী বিদেশি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকলে সরকার তড়িঘড়ি করে ইংরেজিকে আবার প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার একটি বিষয় হিসেবে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু এভাবে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হলেও এই দায়সারা মুখস্থবিদ্যা-কেন্দ্রিক ইংরেজি শিক্ষায় এ দেশীয় মূলধারার শিক্ষার্থীরা যে বিদ্যা লাভ করছে তাতে ইংরেজিতে তাদের জ্ঞান হচ্ছে ভাসা ভাসা এবং এখানে দক্ষতা বলতেও কিছুই অর্জিত হচ্ছে না। ফলত, একদিকে যেমন বর্তমান সময়ের বেশির ভাগ সাধারণ শিক্ষার্থীর ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা দরিদ্র পর্যায়ে, তেমনি সুষ্ঠুভাবে মাতৃভাষা চর্চায়ও তাদের অবস্থা ভয়ানকভাবে নিম্নে অবস্থান করছে। অর্থাৎ শিক্ষানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাস্তবতার নিরিখে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ‘শ্যাম-রাখি-না-কুল-রাখি’ এই অবস্থার সৃষ্টি হয়ে শ্যাম এবং কুল উভয়েই এখন হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম।

অন্যদিকে সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ধনিক শ্রেণীর সন্তানদের জন্য এ দেশে গড়ে উঠেছে ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়সমূহ। অর্থাৎ বাণিজ্যিকভাবে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা যখন অনুভূত হতে শুরু করে তখন শিক্ষাব্যবসায়ীরা আর হাত গুটিয়ে বসে থাকে নি। সরকার-প্রবর্তিত পাঠ্যক্রমকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ঢাকা সহ দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে এখন গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদান কেন্দ্র। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠ্যক্রম বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানের প্রবর্তিত। এখানে অনেক প্রতিষ্ঠানেরই ইংরেজি শিক্ষার মান মোটামুটি ভালো, লেখাপড়ার খরচ অত্যধিক, ফলত ধনিক-বণিক শ্রেণীর পরিবারের সন্তানদের জন্য এগুলোর দ্বার উন্মুক্ত। এছাড়া উচ্চমধ্যবিত্ত থেকে উচ্চশ্রেণীতে উত্তরণ প্রয়াসী বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকগুলোতে কর্মরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সন্তানরাও উচ্চহারে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয়ে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে সকল শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, সংস্কৃতিগতভাবে তাদের মানসে দৃঢ়মূল থাকে শিক্ষালাভের শেষে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা, ব্যক্তিগত লাভালাভের হিসেব-নিকেশ। এদের অধিকাংশই পড়াশোনা সমাপ্ত করে অথবা আরো অধিক পড়াশোনার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাবার স্বপ্ন দ্যাখে এবং সেখানেই স্থায়ী আবাস গড়ে তোলার চিন্তায় নিমগ্ন থাকে। এই চিন্তার বাইরে যারা থাকে তাদেরও শেকড় মানসজাগতিকভাবে দেশের মাটিতে প্রোথিত না থাকার কারণে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষালাভ করে তারা উন্নত ও আধুনিক বিষয়গুলোয় উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ ও জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে বাণিজ্যিকভাবে মুনাফা অর্জন এবং ভোগবাদিতার খায়েস মেটানোর জন্য মিডিয়ায় বিজ্ঞাপিত বস্তুসমূহে দখল প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় আকৃষ্ট হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফার জন্য এই সকল বস্তু যে উত্তেজনা সৃষ্টি এবং সাময়িক চাহিদা মেটানোর তাগিদে উৎপাদিত হয় সেটা বলাই বাহুল্য। পণ্যায়নকৃত উৎপাদন ব্যবস্থায় অন্যান্য বস্তুর মতো তাই বইপুস্তকও মুনাফা অর্জনের বাহন। সেদিকে লক্ষ রেখেই এগুলো রচিত, প্রকাশিত এবং বিজ্ঞাপিত হয়। ফলে অগ্রসর রাষ্ট্র এবং জাতিসমূহের উন্নত সভ্যতা এবং সংস্কৃতির সাথে পরিচয় ঘটার বদলে এদের ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে ওইসব ভূ-খণ্ডে উৎপাদিত সাংস্কৃতিক আবর্জনার (Garbage) সাথে। এইসব আবর্জনা বাংলায় অনুদিত এবং প্রচারিত হয়ে তা সৃষ্টি করে এমন এক বিকারগ্রস্ততা যা পক্ষান্তরে অবনমন ঘটায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের। বর্তমানে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনারত ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে, ইঙ্গিতে (Gesture) এবং আচরণে বাংলার যে রূপ দেখা যায় তা এই বিকারগ্রস্ততার শিকার এবং এইসব ইংরেজি শিক্ষিত কিশোর-তরুণ বয়সী ছেলেমেয়েদের হাতে বাংলা ভাষার দুরবস্থার প্রধান কারণ এটাই।

অথচ অফিস-আদালত, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিচারালয় সহ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চর্চার যে বিষয়ে বুদ্ধিজীবীগণ ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বুলি কপচানোর মতো করে বলে থাকেন, তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার প্রচলন। এর জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো জ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় উন্নত মানের গ্রন্থ প্রণয়ন এবং অনুবাদ করা। প্রতি বছর একুশের বইমেলায় যে সমস্ত তরুণ লেখক যেনতেন প্রকারে এক/দুইটা বই প্রকাশ করে নিজেদের পরিচিতির বলয় গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত থাকেন, এবং যেই সকল শিক্ষার্থী ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থায় আকৃত হয়ে যথেচ্ছ বাংলা চর্চায় ব্রতী হয়, তাদের এবং সমচরিত্রসম্পন্ন অন্যান্যদের দ্বারা যে এই কাজ সম্ভব নয় সেকথা বলার দরকার পড়ে না। আর এরজন্য যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় এবং সঠিক পরিকল্পনায় যথোপযুক্তরূপে শিক্ষিত এবং মে‍ধাবী ‌‌জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা আবশ্যক সেটাও আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেই সাথে প্রয়োজন জনমানসে আধিপত্যশীল ঔপনিবেশিক চিন্তার কাঠামোকে ভেঙে ফেলা। বিজ্ঞান সহ বিদ্যাচর্চার অপরাপর অঞ্চলে দক্ষতা অর্জনের জন্য বাংলা উপযুক্ত ভাষা নয়- এ জাতীয় প্রচারণা বেশ কার্যকররূপে বিদ্যমান। অনেকেই পরিভাষার অভাবকে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা, বিশেষত চিকিৎসা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু এই বক্তব্য এবং তার সমান্তরাল চিন্তাভাবনাগুলো বিশেষ স্বার্থান্বেষী অথবা অবরুদ্ধ ঔপনিবেশিক মানসকাঠামো দ্বারা উদ্ভূত। কেননা ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ এবং শ্রুতিমধুর পরিভাষা উদ্ভাবন কঠিন কাজ হলেও অসম্ভব কিছু নয়। জ্ঞানকাণ্ডের অপরাপর শাখা-প্রশাখায় বাঙালিরাই এ কাজটিকে এ যাবত সম্ভব করে দেখিয়েছেন। তাছাড়া সব পরিভাষাগত শব্দের বাংলা রূপান্তর যে ঘটাতে হবে তার কোনো অর্থ নেই। উদাহরণস্বরূপ অম্লজান, উদজানের মতো পারিভাষিক শব্দাবলী বাংলায় থাকলেও সাধারণ্যে অক্সিজেন, হাইডোজেন প্রভৃতি শব্দই প্রচলিত এবং গ্রহণীয়। সুতরাং বিজ্ঞানের বইগুলোতে পারিভাষিক শব্দের পরিবর্তে এ জাতীয় মূল শব্দ ব্যবহার করলে তাতে ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। এমনিভাবে যে শব্দগুলোর ব্যাকরণসম্মত এবং শ্রুতিমধুর পরিভাষা সৃষ্টি করা সম্ভব নয় সেসব ক্ষেত্রে পাঠ্যবইয়ে মূল শব্দের ব্যবহার অবশ্যই করা যেতে পারে। এভাবে বাংলায় গ্রন্থ রচনার জন্য সকল বিষয়ে পণ্ডিতদের যেমন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন তেমনি সরকার প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে সমগ্র দেশ থেকে বিদেশি ভাষা শিক্ষা এবং অনুবাদ কাজে আগ্রহী মেধাবী তরুণদের খুঁজে বের করে তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে এ কাজে উপযোগী করে গড়ে তুলতে। কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই যাদের মূল দৃষ্টি থাকে নিজেদের গোপন-প্রকাশ্য ব্যাংক ব্যালেন্সের স্ফীতির দিকে তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ কাজে এগিয়ে আসবে কিনা সেটা তাদের বিষয়।

- আবিদুল ইসলাম


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

পড়লাম। গুরুত্বপূর্ণ টপিক। কিন্তু কঠিন শব্দের প্রয়োগের কথা বাদই দিলাম, এতো লম্বা লম্বা বাক্য কেন? লিখার শুরুতেই বলছেনঃ

"একটা বিষয় আপাত দৃষ্টিতে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করবার মতো, বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানি শাসনে এদেশের বাংলা ভাষাভাষি ইংরেজি শিক্ষিত বিদ্বান লোকজনের হাতে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতি হয়ে এর প্রভূত বিকাশ সাধিত হলেও স্বাধীন বাংলাদেশের ইংরেজি শিক্ষায় বিশেষ ভাবে শিক্ষিত লোকজনের হাতে পরবর্তীতে তার আর বিশেষ কোনো ধরনের উন্নয়ন না হয়ে বরং ক্রমান্বয়ে অবনতি ঘটে চলেছে। "

এক লাইনে ৫৯টা শব্দ? বাক্যের শেষে এসে ভুলেই গেলাম কি দিয়ে বাক্যটা শুরু হয়েছে। ভেঙে লিখা যায়না আবিদুল ইসলাম ভাই?

ভবিষ্যতে পাঠকের কথা ভেবে আরেকটু সহজপাচ্য লিখা দেবেন আশা করি হাসি

..................................................................
#Banshibir.

অতিথি লেখক এর ছবি

পুরনো ন্যারেটিভ বলতে আপনি নিশ্চয় বোঝাতে চাইছেন এ বিষয়ে আগেও লেখা হয়েছে? আমি এখানে যে বিষয়টি বক্তব্য হিসেবে তুলে ধরেছি ঠিক এভাবে কোথাও লেখাটা দেখি নি আগে। তবে অবশ্যই লেখার বিষয়ে প্রাসঙ্গিক আরো যেসব লেখা আমাকে সাহায্য করেছে সেগুলো এবং তাদের রচয়িতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তবে আলাদাভাবে তাদের নামোল্লেখের সুযোগ এখানে নেই- যেহেতু কবে কোথায় কখন সেসবের সাথে পরিচয় ঘটেছিল এখন আর মনে নেই। তবে যে রচনাগুলো মনের মধ্যে চিন্তার দাগ বসিয়েছিল তার সাথে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিজ্ঞতা যোগ করেই আমার বর্তমান রচনা।

আপনার দ্বিতীয় বক্তব্যের সাথে একমত। এসবই যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে সম্পৃক্ত একথা আমি নিজেও স্বীকার করি। তাছাড়া লেখাটাকে আমার নিজের কাছেই বিভিন্ন দিক থেকে অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছে। যেমন: ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উপাদানগুলো সম্পর্কে আরো ব্যাপক আলোচনা করা উচিত ছিল, সেটা হয় নি। তাছাড়া এখানে শুধু বাঙালিদের বিষয়টাই তুলে আনা হয়েছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রসীমার মধ্যে বসবাসরত অন্য জাতিসত্তাগুলোর বিষয়টি আসে নি। তাছাড়া আপনি যে অর্থনীতি আর রাজনীতি ঠিক করার কথা বলেছেন সেটাও আমার বোধে আছে। কিন্তু সেটা ঠিক করার জন্য বসে থাকলে এবং কেবল সেটা নিয়েই লেখালিখি করলে তো আমরা চারিদিকে যতো অব্যবস্থাপনা দেখতে পাই, যতো অন্যায় দেখতে পাই- তার কোনোটাই আলোচনায় আনা সম্ভব নয়। কেননা সবই তো সম্পৃক্ত অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে। সড়ক দুর্ঘটনা, নারী ও সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়ন সহ আরো যে বিষয়গুলো রয়েছে তার ওপর লেখার কোনো অর্থই হয় না। আর বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যেও যেটুকু করা সম্ভব সেটা কিন্তু আলোচনায় আসতে হবে। বৃটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আমাদের দৃষ্টিতে আদর্শ না হলেও বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোয় যেটুকু অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়েছিল সেটা এখন হচ্ছে না এটা বলাই ছিল আমার লেখার উদ্দেশ্য। সুতরাং বর্তমান অবস্থার মধ্যেও কিছুটা হলেও যে কাজ এগিয়ে নেয়া যায় সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তি- সেতো চূড়ান্ত লক্ষ্য। আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

- আবিদুল ইসলাম

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি আসলে একাধারে লিখে যাই সে কারণে কোনো বাক্য বড় এবং কোনোটা ছোট হয়। আপনি যে বাক্যের কথা বললেন তার চেয়ে বড় বাক্যও আছে লেখাটায়। আর কঠিন শব্দ প্রয়োগের বিষয়টা ঠিক বোধগম্য হলো না। আমার লেখার ধরনই এমন। চেষ্টা করি যতোটা সম্ভব সহজ ভাষায় লেখার। যা-ই হোক, কষ্ট করে লেখা পড়া এবং মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

- আবিদুল ইসলাম

শিশিরকণা এর ছবি

চোখ বুলিয়ে গেলাম আপাতত, বাড়ি ফিরে সময় করে পড়ব। তবে কয়েকটা পয়েন্ট বলে যাই।
১/ ভাষা গতিশীল এবং সব সময়ই পরিবর্তিত হতে থাকবে, সব উচ্ছন্নে গেল হৈ হৈ করার লোক সর্বকালেই ছিল, যেটুকু গ্রহণযোগ্য সেটুকু পরিবর্তন হয়েছে, বাকিটুকু ঝরে পড়ে গেছে। সুতরাং হল্লা করে একে থামানো যাবে না। যেটা হতে পারে, জোরকৃতভাবে যে বাংলিশ এখন রেডিও ডিজেরা চাপিয়ে দিচ্ছে সেই জোরজারের অংশটুকু সরাতে হবে।
২/ ইংরেজি বাংলা যেটাই হোক ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকে শেখা উচিত। ভাষা শুধু কথা বলার মাধ্যম নয় , বরং একটা সংস্কৃতিও বটে। ভিন্ন সংস্কৃতির এবং নিজস্ব সংস্কৃতি দুটোর প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা না থাকলে কোন ভাষাই ভালো ভাবে শেখা সম্ভব নয়।
৩/ বাঙ্গালীর বই পড়ার অভ্যাস আরও বাড়ান যায় কিভাবে এইটা আমাদের জাতি হিসেবে উত্তরণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাষা গতিশীল একথা মাথায় রেখেই আমি ওপরের লেখাটা লিখেছি। তা নাহলে ভিন্ন ভাষার সাথে মিথষ্ক্রিয়ার কথা বলার প্রয়োজন হতো না, ভাষার বিকাশের কথা বলার প্রয়োজন হতো না। ভাষার যে প্রবহমানতার কথা বলেছি সেটা পরিবর্তনের সাথেই সম্পৃক্ত। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় যে, আমরা বর্তমানে লেখালিখির ক্ষেত্রে বঙ্কিম-রীতি অনুসরণ করছি না। কিন্তু তাই বলে ভাষার বিকাশে তার অবদান খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আবার ধরুন, ঊনবিংশ শতাব্দ হতে শুরু করে বিংশ শতাব্দের মধ্যভাগ পর্যন্ত যে বিকাশ এবং পরিবর্তনের যে ধারা আমরা লক্ষ করি, সেটা এখনো শক্তিশালীভাবে বিদ্যমান কিনা? নাকি তার জায়গা নিয়েছে বিকারগ্রস্থতা, উন্মাদনা এবং খেয়ালখুশি-মাফিক ভাষাকে ব্যবহারের নৈরাজ্য? কোনটা বিকাশ এবং কোনটা বিকার আশা করা যায় সেটা আমরা সবাই বুঝতে পারি। যাদের হাতে বাংলার বিকৃতি সাধিত হচ্ছে, সেটা এজন্য হচ্ছে যে এই ভাষায় বুৎপত্তি দূরে থাক, এর ব্যাকরণ, সিনট্যাক্স প্রভৃতি সম্বন্ধে এদের ন্যূনতম ধারণা নেই। আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

- আবিদুল ইসলাম

মন মাঝি এর ছবি

আমার মতে এটা পুরনো ন্যারেটিভ। এর একটা মৌলিক বিভ্রান্তি আমার মনে হয়েছে এই প্রস্তাবনায় যে স্রেফ সঠিক ভাষাশিক্ষার মাধ্যমেই দেশে ভাষাচর্চা আর জ্ঞানচর্চার সার্বিক উন্নতি ঘটানো সম্ভব।

খুবই সরল ও সংক্ষেপ করে বললে, ভাষা ও মৌলিক জ্ঞানচর্চা দুটিই ভাবের ফসল। দুই ধরণের ভাব। আর এই দুই ধরণের ভাবই আবার বিদ্যমান রাজনীতি ও অর্থনীতির ফসল। এই রাজনীতি আর অর্থনীতি ঠিক না করা পর্যন্ত শুধু ভাষাপরিকল্পনা-ভাষাশিক্ষা-পরিভাষা-অনুবাদের বাপের চৌদ্দপুরুষেরও ক্ষমতা নাই সৃজনশীল-উৎপাদনশীল-সাস্টেইনেবল, মৌলিক বা গবেষণাধর্মী, উল্লেখযোগ্য মানের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ব্যপক বিস্তার বা সেইধরণের জ্ঞানচর্চার মানের সাথে সহগামী নির্মেদ ও চিন্তার সফিস্টিকেশন ও গভীরতাযুক্ত ভাষার বিস্তৃতি। অর্থনীতি ও রাজনীতি ঠিক করতে পারলে বাকিটা আগে হোক পরে হোক হবেই। তা না করে শুধু ভাষা নিয়ে বিলাপ করে সামান্যই অর্জিত হবে। এমনকি অনুবাদ আর পরিভাষা দিয়ে দেশ ভাসিয়ে দিলেও কোন লাভ নেই, বড়জোর আমাদের দোকানদারি অর্থনীতির মতই দোকানদারি সাহিত্য সৃষ্টি হবে কিছুটা, তার বেশি কিছু না!

****************************************

অতিথি লেখক এর ছবি

পুরনো ন্যারেটিভ বলতে আপনি নিশ্চয় বোঝাতে চাইছেন এ বিষয়ে আগেও লেখা হয়েছে? আমি এখানে যে বিষয়টি বক্তব্য হিসেবে তুলে ধরেছি ঠিক এভাবে কোথাও লেখাটা দেখি নি আগে। তবে অবশ্যই লেখার বিষয়ে প্রাসঙ্গিক আরো যেসব লেখা আমাকে সাহায্য করেছে সেগুলো এবং তাদের রচয়িতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তবে আলাদাভাবে তাদের নামোল্লেখের সুযোগ এখানে নেই- যেহেতু কবে কোথায় কখন সেসবের সাথে পরিচয় ঘটেছিল এখন আর মনে নেই। তবে যে রচনাগুলো মনের মধ্যে চিন্তার দাগ বসিয়েছিল তার সাথে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিজ্ঞতা যোগ করেই আমার বর্তমান রচনা।

আপনার দ্বিতীয় বক্তব্যের সাথে একমত। এসবই যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে সম্পৃক্ত একথা আমি নিজেও স্বীকার করি। তাছাড়া লেখাটাকে আমার নিজের কাছেই বিভিন্ন দিক থেকে অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছে। যেমন: ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উপাদানগুলো সম্পর্কে আরো ব্যাপক আলোচনা করা উচিত ছিল, সেটা হয় নি। তাছাড়া এখানে শুধু বাঙালিদের বিষয়টাই তুলে আনা হয়েছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রসীমার মধ্যে বসবাসরত অন্য জাতিসত্তাগুলোর বিষয়টি আসে নি। তাছাড়া আপনি যে অর্থনীতি আর রাজনীতি ঠিক করার কথা বলেছেন সেটাও আমার বোধে আছে। কিন্তু সেটা ঠিক করার জন্য বসে থাকলে এবং কেবল সেটা নিয়েই লেখালিখি করলে তো আমরা চারিদিকে যতো অব্যবস্থাপনা দেখতে পাই, যতো অন্যায় দেখতে পাই- তার কোনোটাই আলোচনায় আনা সম্ভব নয়। কেননা সবই তো সম্পৃক্ত অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে। সড়ক দুর্ঘটনা, নারী ও সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়ন সহ আরো যে বিষয়গুলো রয়েছে তার ওপর লেখার কোনো অর্থই হয় না। আর বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যেও যেটুকু করা সম্ভব সেটা কিন্তু আলোচনায় আসতে হবে। বৃটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আমাদের দৃষ্টিতে আদর্শ না হলেও বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোয় যেটুকু অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়েছিল সেটা এখন হচ্ছে না এটা বলাই ছিল আমার লেখার উদ্দেশ্য। সুতরাং বর্তমান অবস্থার মধ্যেও কিছুটা হলেও যে কাজ এগিয়ে নেয়া যায় সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তি- সেতো চূড়ান্ত লক্ষ্য। আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

- আবিদুল ইসলাম

কৌস্তুভ এর ছবি

ট্যাগে পাইচার্ট দেখে তথ্যব্যবসায়ী হিসাবে উৎসাহ নিয়ে ঢুকেছিলাম, কিছুই পেলাম না মন খারাপ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।