[b]নাবালের শব্দ-চিকিৎসা-১[/b]

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৬/০১/২০১৩ - ৪:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সঙ এর আলাপ- সংলাপ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০০৭ সাল থেকেই সংলাপ শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করতে শুরু করেছে। দেশের যে কোনও রাজনৈতিক সংকটের সময় এই শব্দ এবং তার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক নানা আলোচনা শুরু হয়। সম্প্রতি দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের নিরসনের জন্য সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ। এটা নতুন নয়, এর আগে মান্নান ভুঁইয়া রেখেছিলেন একই প্রস্তাব তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের প্রতি। তাতে সাড়া দিয়ে সংলাপে বসেন দলটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জলিল সাহেব। দুজনকেই এখন প্রয়াত বলা যায়। একজন আক্ষরিক অর্থে অপরজন রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে। আমরা সেই মহান সংলাপ দেখেছি। দেখেছি হাস্যোজ্জ্বল মান্নান ভুঁইয়া এবং বিপর্যস্ত জলিল সাহেবের মুখ। সেই সংলাপের পরিণতিও আমরা জানি। দুই বছরের ইমারজেন্সি।

একদিক থেকে সফলই বলতে হবে সে সংলাপকে। দেশের রাজনীতির একঘেয়েমীতে তা বেশ একটা বৈচিত্র্য এনে দিতে পেরেছিল। প্রসব করেছিল মিলিটারি ব্যাক পুতুল সরকার। এবার আবার সংলাপের প্রস্তাব। আমরা আশাবাদি হতেই পারি। তবে তার আগে একবার সংলাপের মূল অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে যাতে করে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি নিয়ে পরে হাহাকার করতে না হয়।

সঙ এর আলাপ- সংলাপ, সাধারণ কর্মধারয় সমাস। খুব সাধারণ ব্যাপার। কোনও ফাঁকিঝুকি নেই। মানে হলো সঙ যে আলাপ করে তাই সংলাপ। প্রাচীন কাল থেকেই সঙ সাজার বিষয়টি প্রচলিত। আগে মেলায় বা এ ধরনের আয়োজনে মানুষকে আনন্দ দেয়ার জন্যে কিছু লোক সঙ সাজতো। তারও আগে মেলা ছাড়াও বহুরূপি সাজার বিষয়টি প্রচলিত ছিল। মূলত পৌরাণিক বিভিন্ন চরিত্র সেজে মানুষকে আনন্দ দেয়া বা গল্প বলার জন্যে এই বহুরূপি সাজার বিষয়টি প্রচলিত ছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল মূলত অর্থনৈতিক। অর্থাৎ বহুরূপি সাজা বা সঙ সাজার বিষয়টি ছিল রুটি-রুজির সাথে সম্পর্কিত একটা ব্যাপার।

সার্কাসে আমরা যে সঙ দেখতে পাই, তাদেরকে আবার দুভাগে ভাগ করা যায়, এক অংশ নির্বাক (প্রাথমিক পর্যায়) অপরটি সবাক (পরবর্তি পর্যায়)। প্রথম দিকে যারা সঙ সাজতো তারা বিচিত্র পোষাক আর নানা অঙ্গভঙ্গি দিয়ে মানুষকে আনন্দ দিত। পরে এর সাথে যুক্ত হলো নানা চটুল ও বুদ্ধিদীপ্ত বাক্য। অর্থাৎ কসরতের সাথে সাথে হাজির হলো কথা, যা হাসির উদ্রেক করবে দর্শকদের। এখান থেকেই সংলাপের যাত্রা শুরু। অর্থাৎ মানুষকে আনন্দ দেয়ার জন্যে সঙদের রসযুক্ত বাক্য বা আলাপকেই সংলাপ বলা হলো।

এই বহুরুপি ও সঙ সেজে গল্প বা কথা বলা থেকেই ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে পরিণতি পেতে থাকে লেটোর দল, ঘেটু গান, ঘুঙুরের দল, যাত্রা ইত্যাদি। এদের প্রত্যেকটিই আবার বক্তব্য তুলে ধরতে গানকে আশ্রয় করে। প্রথম দিককার যাত্রাপালারও অধিকাংশই সঙ্গীত নির্ভর। সঙ্গীত না বলে ছন্দনির্ভর বলাটা বোধ হয় আরো বেশি যথার্থ। প্রাচীন যে কোনও সাহিত্য বা শিল্প এমনকি যে কোনও ধরনের জ্ঞানের সঞ্চারের ক্ষেত্রেই এই ছন্দনির্ভরতা প্রযোজ্য। আমাদের বেদ থেকে শুরু করে, আর্যভট্টের গণিত সবই ছন্দনির্ভর ছিল। প্রাচীনত্ব ধরে রেখেছে বা আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বিকশিত হয়নি এমন প্রায় সকল মাধ্যম এখনও ছন্দ নির্ভরই রয়ে গেছে।

ছন্দকে পাশ কাটিয়ে গদ্য ধাঁচে ঢুকে পড়া যাত্রাপালার আধুনিক পরিণতি মঞ্চনাটকে। যাত্রা থেকে লাফ দিয়ে মঞ্চনাটকে উত্তরণ হয়তো একবারে সম্ভব হতো না যদি বৃটিশদের নিজস্ব মনোরঞ্জনের তাগিদে প্লে হাউস প্রতিষ্ঠা না পেতো। কিন্তু যা হোক এই ইতিহাস বর্ণনা এখানে অবান্তর। মূলত সংলাপের উৎপত্তি ও চলমানতাই প্রসঙ্গ। সঙ এর মুখের বয়ান যে সংলাপের যাত্রা শুরু তা যাত্রা এবং নাটকের মাধ্যমে একটা পথ অতিক্রম করে আমাদের সামনে একটা বিশেষ অর্থ নিয়ে হাজির হয়েছে। এখন আমরা আর সংলাপ বললে সঙ এর আলাপ বুঝি না। প্রথমেই মাথায় আসে নাটকের বা সিনেমার পাত্র-পাত্রির মধ্যে যে আলাপ বা কথা বিনিময় হয়, যার দ্বারা নাটক তার কাঠামো পায় তার কথা। অর্থাৎ সংলাপ এখন আর হালকা বা চটুল হাসির উদ্রেককারী কোনও কথা নয় শুধু। ভারী এবং করুণ সংলাপের উদাহরণও প্রচুর মিলবে।

সার্কাসের সঙ এর সংলাপের সাথে নাটকের বা সিনেমার সংলাপের পার্থক্য আছে পরিণতিতে এবং উদ্দেশ্যে। সঙ এর আলাপ সরল ও অপরিণত এবং তার উদ্দেশ্য হাসানো। অন্যদিকে নাটক বা সিনেমার সংলাপ পরিণত, বহুলাংশে জটিল এবং উদ্দেশ্য শুধু দর্শকদের হাসানো নয়। তবে দুটোরই একটা অভিন্ন লক্ষ্য হচ্ছে বিনোদন বা আনন্দ। হাস্যরস ছাড়াও করুণরস বা দ্রোহ কী করে মানুষের বিনোদনের অংশ সে আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।

এবার আসা যাক আবারো সেই রাজনৈতিক সংলাপে। কিন্তু সমাসসিদ্ধ এই শব্দের উৎস নিয়েপ্রথমেই আমাদের শুরুতেই বিপাকে পড়তে হয়। এখানে প্রথমেই যে প্রসঙ্গটি সামনে আসে তা হলো, কাদের মাঝে এই সংলাপ? তাদেরআমরা কী হিসেবে অভিহিত করব? আবার, সংলাপের উৎস, চরিত্র বা প্রকরণগত বিস্তারের সাথে বিনোদন বিষয়টি এখন পর্যন্ত অবিচ্ছেদ্য। সে অর্থে আমাদের এই সাম্প্রতিক আবিষ্কার রাজনৈতিক সংলাপও বিনোদনের অংশ কিনা তা বিবেচনা করার ফুরসৎ থেকেই যায়। বিগত রাজনৈতিক সংলাপ দেশের বিবেচনায় করুণরসের মাধ্যমে কতটা বিনোদিত আমাদের করেছে তা তর্কসাপেক্ষ তবে তা যে করুণ ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

দেশের রাজনৈতিক ইজারা নেয়া দুই রাজনৈতিক দল বা জোট নিজেদের মধ্যে আরো একটি সংলাপে বসতে যাচ্ছে হয়তো। তার পরিণতি আমাদের জন্যে কতটা আনন্দদায়ক হবে তার ভার সময়ের উপর। তবে এই আশু সংলাপের এজেন্ডা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্দলীয় সরকারের দাবি যা ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়ার বিষয়টির সাথে সম্পর্কিত। আরো ভালোভাবে বললে দেশের ষোলকোটি ভেড়াকে আগামী মেয়াদে কে চরাবে তা নির্ধারণের জন্যে এই সংলাপের প্রস্তাব এবং গুঞ্জন। এই সংবাদে আমরা কতটা বিনোদিত হবো তা আমাদের নিজ নিজ ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে একটা আবেদন আমরা মানে ষোলকোটি করতেই পারি যে, নাটক বা সিনেমার মতো এই সংলাপও সবার জন্যে উন্মুক্ত থাকুক। শ্রবণগ্রাহ্য হোক প্রতিটি বাক্য। এতে অন্তত পরিণতি যাই হোক না কেন, সংলাপের সময়টাতে আমরা বিনোদিত হওয়ার সুযোগ পাব সন্দেহ নেই।

স্বয়ম


মন্তব্য

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

বুঝি নাই চিন্তিত

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

আমিও বুঝি নাই। কোনটা বুঝেন নাই? সংলাপ শব্দের ধারা বর্ণনা নাকি রাজনৈতিক প্রসঙ্গটা? অস্পষ্টতা ঠিক কোথায় বুঝি নাই। বিস্তারিত বল্লে ভালো লাগতো।
সংলাপ শব্দের উৎস বর্ননা প্রামাণ্য না, আমার ধারনাগত এবং শ্বদগুলোকে ভেঙে দেখার প্রবণতা থেকে করা। এ কারণে মজা করেই এতগুলো পরষ্পরবিরোধী ট্যাগ লাগানো। যা একইসাথে গবেষণা ও হুদ্দাই প্যাঁচাল।
রাজনীতির বিষয়টা সাম্প্রতিক সময়ের সংলাপের প্রস্তাবের সাথে মিলিয়ে দেখা। কিছুই না হুদ্দাই বুজরুকি আর কি।
না বোঝাতে পারার ব্যর্থতাটা আমার।মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। অস্পষ্টতা কোথায় জানালে ঋদ্ধ হবো।

স্বয়ম

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

পড়লাম। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার ও মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ।

দীপ্তি এর ছবি

বোধহয় বিষয়টি এও হতে পারে , ‍একদিন যে ক্ষমতাতন্ত্র বা অভিজাত তন্ত্র বা রাজতন্ত্র বিনোদনের ব্যবস্থা হিসেবে সঙ মঞ্চে নট-নটী নামিয়েছিল তারা গণতন্ত্রের বনে বিরোধী ভূমিকায় নেমে সংস্কৃতির নামে রাজনীতিবিদদের চালিত করার সুযোগে সন্ধানী হয়ে উঠায়
সঙ মঞ্চে রাজনীতিবিদরা নিজেরাই অবতীর্ন হয়েছেন গণতন্ত্রের জনসেবার মূল মন্ত্রের দীক্ষাতেই।

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিক। ক্ষমতা কাঠামো এখন বিস্তৃত বাণিজ্য আর অভিজাতদের হাত ধরে। গণমাধ্যমও একটা অংশিদার। আর এখানেই রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হিসেবে গোষ্ঠী পরিবর্তন যা আর রাজনীতিকের হাতে থাকে না, নিয়ন্ত্রিত হয়। সংলাপে না বসেও সঙের আচরন থেকে বের হতে পারে না। আমাদের মত দেশে দাতাদের হাতে পুতুলনাচতো আছেই।

স্বয়ম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।