শেষ গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২৬/০৫/২০১৩ - ৯:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রুমটায় খুব অস্বস্তি হচ্ছে আমার। যেন এখানে কিছু একটা অশুভ ব্যাপার আছে, যেন কেউ এ রুমটাকে কোন এক অভিশাপ দিয়ে গেছে। গা গুলানো একটা ভাপসা গরম এখানে, যেন এক টুকরো নরক। ছাড়াছাড়াভাবে কিছু স্মৃতি মনে পড়ল আমার। গত কদিন ধরে নতুন ধরনের এক হতাশায় ভুগছি আমি। জীবনের অর্থ, বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা, মহাবিশ্বের অপার বিশালতা- এসব বড় বড় ব্যাপার নিয়ে ভাবার চেষ্টা করছিলাম আমি। এক সময় বুঝতে পারলাম যে এই মহাবিশ্বের তুলনায় আমি খুবই ক্ষুদ্র এবং পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোন গ্রহে, এমনকি সবচেয়ে কাছের গ্রহটিতেও আমার পক্ষে সম্ভবত কখনোই যাওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে এতদিন ধরে সৃষ্টিকর্তার জন্য আমার সযতনে লালিত ভালোবাসাও এখন অপমৃত্যুর পথে- এটাও তো এক ধরনের হতাশা। ঈশ্বরবিহীন এক পৃথিবীতে অসহায়ের মত বেঁচে আছি- এ কথা কল্পনা করাও খুব সহজ নয়। এতদিনের ধর্মীয় আনুগত্যের অভ্যস্ততা আর আদর্শের দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলতে মস্তিষ্ক কম বাধা দেয় নি। আমার মধ্যে হতাশা বেশ তীব্রভাবেই ভর করেছে। জীবনটা এত ছোট কেন? যদি এক হাজার বছর বা তারও বেশি বেঁচে থাকতাম! যদি অমর হতে পারতাম! তাহলে হয়তো টাইম মেশিন আবিষ্কার দেখে যেতে পারতাম, হয়তো ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে মানুষ কীভাবে এক লাফে এক ছায়াপথ থেকে অন্য ছায়াপথে চলে যায় সেটা দেখে যেতে পারতাম! পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি কীভাবে হল- সেটা নিশ্চিত হওয়ার মত কোন ক্লু পেল কিনা মানুষ- সেটা জেনে যেতে পারতাম, পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহে মানুষ কিংবা প্রাণী আছে কিনা- তারও প্রমাণ পেতাম হয়তো। মহাবিশ্ব অসীম কিনা, একাধিক মহাবিশ্ব আছে কিনা, সত্যি সত্যি আমাদের কোন স্রষ্টা আছে কিনা- হয়তো এমন হাজার প্রশ্নের উত্তর জানতে পারতাম। এই ছোট্ট জীবনে আর কতটুকুই জানা সম্ভব? কিন্তু এগুলো আমার কাছে পুরনো স্মৃতি মনে হচ্ছে কেন? এগুলো নিয়ে তো আমি ইদানিং প্রায়ই ভাবি। তার চেয়ে বড় কথা হল- আমি কোন কিছু স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি না। আমি কি তাহলে ঘুমিয়ে আছি? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি? স্বপ্নের মধ্যে আবার গরম ঠাণ্ডার অনুভূতি? এমন নরকযন্ত্রণা হচ্ছে কেন আমার? নরকে নাকি প্রচণ্ড গরম থাকবে আর সেখানে সাপ বিচ্ছু মানুষকে কামড়াবে। আমারও যেন ঠিক এরকম অনুভূতিই হচ্ছে- কিন্তু আমি কি স্বর্গ-নরক অবিশ্বাস করি না?

মে মাসের ২৩ তারিখ, ভোর পাঁচটা আটাশ, সাল ২০১২। অর্ণবের ঘুম ভেঙ্গে গেছে আধা ঘণ্টা আগে, ঠিক গরমের কারণে নাকি মশার মশার কামড় খেয়ে সেটা বুঝতে পারল না ও; হয়তো দুটোই। অর্ণবকে অবশ্য সব সময়েই অন্যদের চেয়ে মশা একটু বেশিই কামড়ায় । আজ মশারি ছাড়া ঘুমিয়ে গিয়েছিল, তাই এ অবস্থা। এরকম আগেও অনেক হয়েছে। যখনই সে আলসেমি করে মশারি ছাড়া ঘুমাতে যায়, তখনই এই বিপত্তিটা ঘটে। সারারাত ধরে ঘুমোতে পারেনা মশার যন্ত্রণায়, তবু মশারি টানায় না। হয়তো মশার সাথে জেদ ধরেই করে এটা, কিন্তু শেষ রাতে বা ভোরে হলেও তাকে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হয়, তা না হলে ঘুমই হয়না তার। এমনও হয়েছে- সে শুয়েছে রাত ১২ টায়, আর সকাল ছটায় উঠে মশারি টানিয়েছে, মাঝের এই সময়টুকুতে এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি, অথচ মশারিও টানায় নি। এর কারণ যে শুধুই আলসেমি, তা কিন্তু নয়। এই রুমটা খুবই গরম, সত্যি বলতে- অন্য রুমগুলো থেকে অনেক গরম এটা। এর সাথেই একটা বারান্দা আছে, দক্ষিণমুখী। কিন্তু বারান্দা থেকে ভেতর পর্যন্ত আসতে সব বাতাসই যেন ফুরিয়ে যায়! তাছাড়া এ পাশটায় আবার ডাইনিং, তার সাথে রান্নাঘর। তাই অর্ণবের রুমের দরজাটা বেশির ভাগ সময় বন্ধই থাকে। বাতাস বইতে পারে না। আর বাতাস যদি বইতে না পারে, তাহলে তো গুমোট গরম জমাট বেঁধে থাকবেই। তার ওপর আবার ভেন্টিলেটর নেই একটাও। শীতকালে আবার উল্টোটা হয়। এই রুমে শীত বেশি থাকে! অর্ণবরা যখন প্রথম এ বাসায় ওঠে, তখন রুম ভাগাভাগির সময় অর্ণব এখন যে রুমটায় থাকে, তার পাশের রুমটা নিতে চেয়েছিল। ওই রুমটা বেশ বড় ছিল, কিন্তু ওটা বাবা-মা নিয়েছে। আর অর্ণবকে দিয়েছে সবচেয়ে ছোট আর গরম রুমটা। তার ওপর আবার বছরখানেক যেতেই ওর রুমে একটা সোফা ঢুকিয়েছে, আগে যেটা ড্রয়িং রুমে ছিল! তারপর ঢুকিয়েছে একটা আলমারি, অর্ণবের চাচির আলমারি ওটা। ওরা বিদেশে চলে গেছে, যাওয়ার আগে ওদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আলমারিতে করে রেখে গেছে, কখনো যদি দেশে বেড়াতে এসে কাপড়-চোপড় দরকার হয়! অর্ণব নিষেধ করেছিল অনেক, রাগও করেছিল। কিন্তু ও জানে এসব করে কোন লাভ নেই। বাবা-মা যেটা বলবে সেটা করবেই। তার রুম একটা ভাগাড় হয়ে যাচ্ছে- তাতে কার কি আসে যায়?

নাহ, রুমটায় থাকতেই ইচ্ছে করছে না। এখানে ঢুকলেই মনে হচ্ছে কেউ একজন প্রতি মুহূর্তে প্রচণ্ড আক্রোশে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। নাকি হতাশার দীর্ঘশ্বাস? এর চেয়ে বারান্দায় গিয়েই বসে থাকা ভাল। বারান্দায় বসে পাশের সবুজ দেখতে লাগলাম আমি। আমাদের কলোনির এই একটা সুবিধা, গাড়িঘোড়ার কোলাহল নেই, বাসার পেছনে একটু খোলা জায়গা। এখানে আবার কেউ কেউ শখ করে কিছু গাছ লাগিয়েছে। কলাগাছও আছে অনেকগুলো, এগুলো তো একবার লাগালেই হল, বাড়তেই থাকে সংখ্যায়। আমগাছটায় মুকুল ধরেছিল, ছোট ছোট আমও হয়েছিল, দুষ্টু ছেলেগুলো সব আম পেড়ে খেয়েছে। কাঁঠাল গাছটায় বেশ কয়েকটা কাঁঠাল হয়েছে, বড় বড়, কদিনের মধ্যেই পেকে যাবে এগুলো। প্রায়ই নিজেদের লাগানো শাক-সবজি, কলা এগুলো দিয়ে যায় পাশের ফ্ল্যাট থেকে। গতবার যে কাঁঠালটা দিয়েছিল ওরা, বেশ ভাল ছিল ওটা। খাওয়ার কথা মনে হতেই আমার খুব বিরক্ত লাগল। কোথায় সুন্দর প্রকৃতি দেখছি- এর মধ্যে খাওয়ার মত একটা বাজে ব্যাপার টেনে আনার কোনই মানে হয়না। আর কখনোই এসব বাজে চিন্তা করা যাবে না, খাওয়ার কথা আর কখনোই মনে আনব না আমি। ভাবলাম ভোরের এই নির্মল হাওয়ায় একটুখানি ঘুরে আসবো বাইরে থেকে। যেই ভাবা সেই কাজ, হাঁটতে চলে গেলাম আমি। কী আশ্চর্য ব্যাপার, হাঁটতে কোন কষ্টই হচ্ছে না আমার। যেন আমি হাঁটছি না, যেন উড়ে বেড়াচ্ছি! দশ মিনিটের মাঝেই পুরো ঢাকা শহর চক্কর দিয়ে ফেললাম আমি! কিন্তু মিরপুরে এসে একটা এক্সিডেন্ট দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। রাস্তায় একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা লাগতে লাগতে লাগেনি আমার, কিন্তু সে ট্রাকটাই একটা বুড়োমতন মানুষকে চাপা দিয়ে গেল। লোকটা সম্ভবত মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিল, ওর পেটের মাঝ দিয়ে ট্রাকের চাকা চলে গেছে। রক্তের বন্যা বইছে ওখানে। লোকটার পকেট থেকে তার মোবাইল ফোনটা বের করতে চাইলাম আমি, ওঁর বাসায় একটা কল করে জানানো দরকার। কিন্তু শত চেষ্টা করেও পকেট থেকে মোবাইলটা বের করতে পারলাম না। তীব্র একটা আতঙ্ক নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম আমি, চোখের সামনে কখনো এমন এক্সিডেন্ট দেখিনি। কিন্তু আসল আতঙ্কটা অন্য জায়গায়, এত চেষ্টা করেও ফোনটা বের করতে পারলাম না কেন? কদিন থেকেই আমার শরীর খুব দুর্বল লাগছে। নতুন চাকরিটা নেয়ার পর থেকেই এ অবস্থা। প্রথম চাকরি, সারাদিন বসে থাকতে হয়- এটা নতুন অভিজ্ঞতা। কিন্তু তাই বলে হাঁটাচলা কম করা হয়, তাও তো না। ইচ্ছে করেই কিছুটা পথ আমি গাড়িতে না গিয়ে হেঁটে যাই, হাঁটা তো ভাল ব্যায়াম। কিন্তু এত দ্রুত পুরো ঢাকা শহর হেঁটে আসলাম, অথচ পকেট থেকে মোবাইলটা বের করতে পারলাম না শরীরে শক্তি পাচ্ছিলাম না বলে, এটা কখনোই বিশ্বাস করার মত কথা নয়।

বারান্দায় পায়চারি করছে অর্ণব। এ পর্যন্ত কতগুলো হাঁচি দিয়েছে তার হিসেব নেই। কদিন আগেই গরমে সর্দিগর্মি হল, অফিস কামাই করল একদিন। এখনই আবার হাঁচি, সাথে সর্দিও লেগে গেছে। এ বছর গরম পড়েছে ভালই, গরম তো এ সময়টাতে প্রতি বছরই পড়ে। তাই বলে দুই সপ্তাহ অন্তর সর্দি লেগে গেল, তাও এই গরমের জন্যই। পাশের ড্রয়িং রুমে ওর বাবা শুয়ে আছে। ও রুমটায় মশারি টানানো আছে, তাছাড়া ওই রুমের ফ্যানটাও বেশ জোরে জোরেই ঘোরে। এদিকে অর্ণবের রুমের ফ্যানের বাতাস লাগে না বললেই চলে। অর্ণব পাশের রুমে গিয়ে মশারির নিচে শুয়ে পড়ল। কিন্তু বিশ মিনিট শুয়ে থেকেও তার ঘুম হল না। কী একটা অস্বস্তি যেন কাজ করছে তার মাঝে। রুম থেকে আবার চলে এল বারান্দায়। উদ্ভট সব স্বপ্ন দেখছিল ঘুম থেকে ওঠার আগে। কীসব সমীকরণ মেলাতে হবে, এটা একজন করতে দিয়েছে তাকে। আরেকজন কিছু প্রোগ্রাম করতে দিয়েছে। একটা ওয়েবপেজের ডাটা, ইউজার লগ মনে হয়। এত এত ডাটা অথচ কোন ডাটা কোথা থেকে আসছে কিছুই মেলাতে পারছে না সাগর। অন্যদিকে ওই সমীকরণ, মাথার চুল ছেঁড়ার অবস্থা ওর। শেষমেষ মশার কামড় খেয়েই ঘুম ভাংল। অর্ণব ভাবল, একটা গল্প লিখে ফেলা যাক। ঘুম তো আসছেই না, তাছাড়া গল্প লেখার মুডও যখন আছে। কম্পিউটারটা অন করে লিখতে শুরু করে দিল ও।

বাসায় এসে আমি দরজা নক করতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না। নক করার শক্তিটুকুও কি আমার নেই? আমার মনে হচ্ছিল আমি স্বপ্ন দেখছি। আমি মনে প্রাণে চাইলাম এটা যেন স্বপ্ন হয়। শেষ পর্যন্ত আমার রুমের পাশের সেই বারান্দা দিয়েই আমি ঢুকে গেলাম বাসায়! আমি ততক্ষণে মোটামুটি নিশ্চিত এটা স্বপ্নই, ঘুম থেকে উঠলেই দেখব আমি বিছানায়। রুমে ঢুকলাম আমি, ঢুকে বিছানায় শুতে যাব মশারি ভেদ করেই যেন চলে গেলাম বিছানায়। হঠাৎ দেখলাম কম্পিউটার টেবিলের সামনের চেয়ারে কে একজন বসে আছে; ওর মাথাটা টেবিলে রেখে ঘুমোচ্ছে যেন। সাথে সাথে আমি কয়েক হাজার ভোল্টের শক খেলাম। এটা তো আমি! কাছে গিয়ে দেখলাম ওর চোখ দুটো খোলা, জ্বলজ্বল করছে, ওখান থেকে ঠিকরে আগুন বের হচ্ছে যেন। এল ই ডি মনিটরে পুরো গল্পটাই লেখা আছে। শেষ কটা লাইন এমন- “...আমি এভাবে অমর হতে চাইনি। আমার চোখের সামনে সব অন্যায় ঘটবে আর আমি কিছুই করতে পারব না। আমি অনুভব করতে পারব, দেখতে শুনতে পারব অথচ স্পর্শ করতে পারব না। এভাবে আমি অমর হতে চাইনা, আমি চাই সবাই আমাকে মনে রাখুক। আমার কথা শোনার মত যদি কেউ থাক তাহলে আমার অমরত্ব ফিরিয়ে নাও, আমাকে মুক্তি দাও। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনল না। সৃষ্টিকর্তা নামক সত্তাটি বরাবরই নিষ্ক্রিয়। আমি এই অমরত্বের ফাঁদে আটকে গেলাম, অথচ কেউ তা জানতে পারল না। আমি যে পৃথিবীতে ছিলাম এটাই হয়ত কেউ জানতে পারবে না। জানার মত কিছুই আমি করতে পারিনি...”

অর্ণবের সেই গল্পটার নাম ছিল- “শেষ গল্প।”

- ক্ষুদ্র সত্তা


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

৪৫

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।