নগরনামা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/১২/২০১৩ - ৪:১৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১। দেশের বাইরে কতদিন ছিলাম, অনুভূতির ওপর যে সেটার একটা প্রভাব আছে, তা এবারই প্রথম টের পেলাম। দেশ থেকে দূরে ছিলাম প্রায় সাড়ে তিন বছর। এর আগে অবশ্য বার কয়েক বিদেশ গিয়েছিলাম কয়েক দিনের জন্য। সেসব স্বল্প সময়ের বিচ্ছেদ আর ৩ বছরের বিচ্ছেদের পর ফিরে আসার মাঝে কতটা পার্থক্য সেটা প্লেন ঢাকার মাটি স্পর্শ করা মাত্রই স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ল, আগেরবার ফিরে এসে খুশি লাগছিল যে- যাক পরিচিত পরিবেশে ফিরে এলাম।। এবার ল্যান্ড করার পর প্রথমেই মনে হল জানালা দিয়ে আমি একটু মাটি দেখব, আমার বাংলাদেশের মাটি!

অনেকদিন পর ফিরলে অনেক রকম প্রশ্নও শুনতে হয়: "এদেশ ভালো না বিদেশ ভালো?", "রান্না-বান্না পারো?", " ওখানো কালো(Black /African American) রা কি করে?" তবে, দেশের মানুষ (আমি যাদের সাথে কথা বলতে পেরেছি) সার্বিকভাবেই দেশের পরিস্থিতি নিয়ে খুবই ত্যক্ত-বিরক্ত বলে মনে হয়েছে আমার।

২। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে অনেক নতুন নতুন চেহারার (নকশার) টাকা চালু হয়েছে। ৫টাকা, ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ৫০০ টাকা আর ১০০০ টাকার নতুন চেহারা আমার পরিচিত হয়ে ওঠেনি এখনও পুরোপুরি। এখন আর দেখেই টুক করে বুঝতে পারি না কোনটা কত টাকার নোট। নতুন এক টাকার কয়েন আর দু'টাকার কয়েনও বের হয়েছে। এক টাকা মোটামুটি বাজার থেকে বিদায় নিয়েছে। দোকানদাররা এখন আরো বেশি উৎসাহের সাথে তাদের নিজস্ব মুদ্রা লজেন্স দেয়া শুরু করেছে।

৩। হাতিরঝিল জিনিসটা সুন্দর লেগেছে। ঢাকার বিভিন্ন রাস্তার পাশে নতুন নতুন ভাষ্কর্য চোখে পড়বে এখন। যদিও কয়েকটা বেশ দৃষ্টি পীড়াদায়ক মনে হয়েছে। আমি যদিও শিল্প সমালোচক নই, দেখে ভালো লাগলে ভালো বলি । এর মধ্যে বিমান বন্দর রোডের পাশে দেখা একটা আর শাহবাগ মোড়ে বসানো ফুলের কথা বিশেষভাবে মন থাকবে। অনেক সময় কিছু জিনিস না থাকলেই বরং ভালো লাগে। নগরের স্বাভাবিক নিয়মে, কিছু ছোট বিল্ডিং ভেঙে আরো উঁচু বিল্ডিং উঠেছে/ উঠছে।

৪। ঢাকার অভ্যন্তরে 'টেকনিক্যালি' অবরোধের কোন প্রভাব থাকার কথা না, তবে রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ ঝটিকা অভিযানে গাড়ি ভাঙার ঘটনা ঘটার কারণে প্রাইভেট গাড়ি প্রায় ৯৮% ভাগই মনে হয় বাসায় বসে থাকে। রাস্তাঘাট যানজট মুক্ত। রিক্সাও চলছে সবজায়গায়। এর আগে ভিআইপি রোড দিয়ে রিক্সাভ্রমণ শেষ কবে করেছিলাম মনে পড়ছে না।

বিদেশে ক'টাদিন কাটিয়ে আসলে সবারই ঢাকার রাস্তায় চলতে একটু ভয় লাগবে স্বাভাবিক। কিন্তু, এবার আমার মনে হচ্ছিল একটু বেশি বেপরোয়াভাবে সবকিছু চলছে। একটু পরেই বুঝতে পারলাম কারণটা। ঢাকার অনেক রাস্তার মোড়েই ট্রাফিক পুলিশ নেই, যে যেভাবে পারছে, রাস্তার দখল নিয়ে মোড় ঘুরছে। রাস্তায় গাড়ি তেমন নেই এটা ঠিক, তবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার শতকরা ৮০ ভাগই অনুপস্থিত এখন। ঢাকার কয়েকটা রাস্তারই একটা দিক বন্ধ করা আছে এখন। একই পাশ দিয়ে যানবাহন আসছে যাচ্ছে। এটা অনেকদিন দেখিনি ঢাকায়।

যখন অবরোধ থাকে না, তখন সবাই একসাথে রাস্তায় নেমে আসে, তৈরি হয় বিশাল জানজটের।

৫। ঢাকার পথে প্রচুর অ্যাম্বুলেন্স চোখে পড়বে আপনার। এমন না যে ঢাকার সব লোক এখন অসুস্থ এবং সবাই এখন হাসপাতালে যেতে চায়। অবরোধের কারণে এখন অনেক মাইক্রোবাসই অ্যাম্বুলেন্স লিখে, ছাদে লাল লাইট লাগিয়ে চলাচল করছে। একটা মাইক্রোবাসে উঁকি মেরে দেখেছিলাম, ভেতরে গাড়ির সিটই রয়ে গিয়েছে, রোগীর স্ট্রেচার নেবার জায়গা নেই।
সিগনালে/জ্যামে পড়লে রোগী না থাকলেও এরা সাইরেন বাজাচ্ছে, 'বঅপ বঅপ' করে ভিন্ন রকমের হর্ন দিচ্ছে এরা।

৬। ঢাকার শেয়ার বাজার এখন অনেক উত্তাপহীন। একটা ব্রোকারেজ হাউজে গিয়েছিলাম, ৪ বছর আগে যেখানে রুমভর্তি লোক ছিল, মুহুর্মুহু 'বাই-সেল' চলত, সেই রুমের অর্ধেক চেয়ারই খালি দেখলাম। যারা ছিল তারাও হালকা মেজাজে কথা বলছিল, এর ফাঁকে চলছিল কেনা-বেচা।

৭। পুরান ঢাকায় গিয়েছিলাম একদিন। এই একটা জিনিসের তেমন কোন পরিবর্তন খুঁজে পেলাম না। আগের মতই দোকানপাট, আগের মতই ট্রাফিক জ্যাম, আগের মতই হইহল্লা। ঠাঁটারি বাজারের বটগাছটা দেখলাম আরও আড়ালে চলে গিয়েছে। এটাকে ঘিরে আরো উঁচু বিল্ডিং তৈরি করার কারণে।

৮। আরেকটা জিনিসে বিরাট পরিবর্তন দেখলাম। অনেক রিকশাতেই ব্যাটারি চালিত এঞ্জিন লাগানো হয়েছে। আগে কিছু ব্যাটারিচালিত রিকশা দেখতাম যেগুলোর গঠন-কাঠামো আলাদা ছিল। আর, এখন সাধারণ রিক্সাতেই কিছু যন্ত্রাপাতি, মোটর, ব্যাটারি যোগ করা হয়েছে, এগুলো যে অন্যরকম রিক্সা সেটা চট করে ধরা যায় না।

তবে, আমার মাথায় যে চিন্তাটা আসলো তা হল:
এই বিপুল পরিমাণ ব্যাটারি ডিসপোজ করার কোন ব্যবস্থা মনে হয় আমাদের দেশে নেই। ব্যাটারিগুলোর আয়ু শেষে এগুলো কোথায় ফেলব আমরা সবাই?

১০। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৩য় প্রজন্মের মোবাইল সার্ভিস চালু হয়েছে। যদিও আমি ইন্টারনেটের যে স্পিডে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি দেশের বাইরে, সেটার মত না; তবুও সার্ভিস অনেকই ভালো বলব আমি বাংলদেশের প্রেক্ষাপটে। আমি দেশে এসে এতটা উচ্চগতির ইন্টারনেট, এই দামে পাবো বলে আশা করিনি -আগে অনেক দামে কিনতে হত একটা ৫১২ কেবিপিএস সংযোগ। তবে, দাম আরেকটু কমানো উচিত বলে আমার মনে হয়েছে। আর ডাটার লিমিট থাকায় (২ গিগা বা ৪ গিগা), এখন আর ইন্টারনেটে করার মত কিছু পাচ্ছি না। আমি টেলিটকের ইন্টারনেট ব্যবহার করছি। দেশের বাইরে থেকেই শুনেছিলাম, টেলিটকের কাস্টমার কেয়ারে ফোন করলে কেউ ধরে না। যদিও এটা ২৪ ঘন্টা খোলা থাকার কথা, আমি রাত ৮টা, সকাল ১০ বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেও লাইন পাইনি। লাইনে ১মিনিটের কিছু বেশি সময় অপেক্ষা করার পর সেটা আপনা আপনিই কেটে যায়।

১১। রাজধানী থেকে হলুদ ক্যাব প্রায় উধাও হয়ে গিয়েছে। যেটা শুনেছি তা হল, মারুতিগুলো রিটায়ার করেছে, আর কিছু টয়োটা বিআরটিএ'র লোকদের ম্যানেজ(!) করে রং বদলে প্রাইভেট কারে রূপান্তরিত হয়েছে। অবরোধের কারণে রাস্তায় মানুষ দরকার না থাকলে তেমন বের হচ্ছে না, কিন্তু সিএনজি অটোরিক্সার সংখ্যা প্রায় অপরিবর্তিত। ৩ বছর আগের চেয়ে অনেক সহজেই সিএনজি ভাড়া করা যাচ্ছে অবরোধের দিনগুলোতে।

১২। আগেই শুনেছিলাম যে আজকাল নাকি মোবাইল অপারেটররা সময়ে অসময়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে বিরক্ত করে। কথাটা যে মোটেই অতিরঞ্জন না সেটা বুঝতে পারলাম একদিনের মধ্যেই। এর সাথ আছে অটোমেটেড টেলিফোন, আপনার ব্যস্ত মুহূর্তে ফোন বেজে উঠবে, রেকর্ড করা কন্ঠ বলবে: "হাই, আমি অমুক (কোন সেলিব্রেটি), আমার সাথে কথা বলতে চাইলে ... ... ... " এটা চরম বিরক্তিকর। এটা থেকে মুক্ত থাকার উপায় কী,সেটা এখনও বের করতে পারিনি।

আজকের মত নগরনামা এখানেই শেষ করছি। এখন নদীভ্রমণে আছি, ছবিও তুলছি বেশুমার। একটা নদীনামাও লিখে ফেলব সময় পেলে।

সবাই ভালো থাকুন, অনেক শুভেচ্ছা সবাইকে হাসি

_মেঘলা মানুষ


মন্তব্য

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ধন্যবাদ প্রফেসর আপনাকে হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

এই বিপুল পরিমাণ ব্যাটারি ডিসপোজ করার কোন ব্যবস্থা মনে হয় আমাদের দেশে নেই। ব্যাটারিগুলোর আয়ু শেষে এগুলো কোথায় ফেলব আমরা সবাই?

চলুক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার এক আত্মীয় ঢাকার বাইরে পুরাতন ব্যাটারি মেরামত, নতুন ব্যাটারি উৎপাদন (রপ্তানি সহ) এর একটি কারখানা এক মাসের মধ্যে চালু করবেন।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারনে চাইনিজ ইঞ্জিনিয়াররা দেশ এ আসছে না।

mahinaaa@gmail.com

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আমাদের দেশের অনেক কিছুই এরকমভাবে চলছে, "আপাতত তেমন সমস্যা নেই, পরে দেখা যাবে"

ধন্যবাদ আপনাকে সাক্ষী দিয়ে যাবার জন্য হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

দেশে থাকার সময় টা আনন্দময় হয়ে উঠুক কোলাকুলি

মাসুদ সজীব

শব্দ পথিক এর ছবি

দীর্ঘ প্রবাসজীবনে দেশে গিয়েছি দুইবার, এতো অল্প সময় ছিলাম যে কিছুই দেখা হয়নি। আমার কাছে তাই দেশ কয়েকবছর আগেও যা এখনো তাই আছে। আপনার লেখা থেকে কিছুটা আপডেটেড হলাম।

নদীনামার অপেক্ষায় থাকলাম।

----------------------------------------------------------------
''বিদ্রোহ দেখ নি তুমি? রক্তে কিছু পাও নি শেখার?
কত না শতাব্দী, যুগ থেকে তুমি আজো আছ দাস,
প্রত্যেক লেখায় শুনি কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস!''-সুকান্ত ভট্টাচার্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আমার একটা সূক্ষ্ম উদ্দেশ্য ছিল আপনার মত যারা অনেক দিন দেশ থেকে দূরে তাদের আপডেট করা।
আসলেই। এত পরিবর্তন দেখলে অবাকই হত হয়।

শুভেচ্ছা হাসি

দীনহিন এর ছবি

দোকানদাররা এখন আরও বেশি উৎসাহের সাথে তাদের নিজস্ব মুদ্রা লজেন্স দেয়া শুরু করেছে।

দেখুন, তাহলে সেই কবেকার দ্রব্য বিনিময় প্রথার পুনর্জন্ম ঘটেছে বাংলাদেশে!

যদিও কয়েকটা বেশ দৃষ্টি পীড়াদায়ক মনে হয়েছে।

কোনগুলি?

যখন অবরোধ থাকে না, তখন সবাই একসাথে রাস্তায় নেমে আসে, তৈরি হয় বিশাল যানজটের।

এজন্যই অবরোধের কয়েকজন নিয়মিত যাত্রী সেদিন বলছিলেন, যান সৃষ্ট অবরোধের চেয়ে বিরোধী দল সৃষ্ট অবরোধই তো ভাল!

এই বিপুল পরিমাণ ব্যাটারি ডিসপোজ করার কোন ব্যবস্থা মনে হয় আমাদের দেশে নেই। ব্যাটারিগুলোর আয়ু শেষে এগুলো কোথায় ফেলব আমরা সবাই?

এভাবেই গতি বেড়েছে আমাদের দেশের অনেক কিছুর, পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে!

অবরোধের কারণে এখন অনেক মাইক্রোবাসই অ্যাম্বুলেন্স লিখে, ছাদে লাল লাইট লাগিয়ে চলাচল করছে।

আমাদের দেশটা এখন খুব অসুস্থ, তাই অ্যাম্বুলেন্সে ভরে যাচ্ছে এর সড়কগুলো!

খুব ভাল পর্যবেক্ষণ আপনার। চলুক।

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

মেঘলা মানুষ এর ছবি

" দ্রব্য বিনিময় প্রথার পুনর্জন্ম ঘটেছে বাংলাদেশে!" ভাল বলেছেন।

"কোনগুলি?" শাহবাগের নতুন বানানো ফুল থেকে দেখলাম বাতিগুলো ঝুলে পড়ছে, এটা ভালো লাগেনি।

"এভাবেই গতি বেড়েছে আমাদের দেশের অনেক কিছুর, পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে!" -এর মূল্য একদিন মানবজাতিকে দিতে হবে।

"আমাদের দেশটা এখন খুব অসুস্থ, তাই অ্যাম্বুলেন্সে ভরে যাচ্ছে এর সড়কগুলো!" -অসাধারণ বলেছেন।
দেশটা সেরে উঠুক তাড়াতাড়ি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।