নোবেল শান্তি পুরস্কারঃ প্রেক্ষিত এবং বিতর্কঃ পর্ব ২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৭/১০/২০১৪ - ১:২৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নোবেল শান্তি পুরস্কারঃ প্রেক্ষিত এবং বিতর্ক (পর্ব ১)

প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রেক্ষাপট, আলফ্রেড নোবেল প্রদত্ত শর্তাবলী, এবং এর ব্যাখ্যা। নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির গঠন, এবং এই পুরস্কারের রাজনীতিকিকরণ এবং বানিজ্যিকিকরণ নিয়ে Heffermehl-এর আলোচনার সারাংশ হবে এই পর্বের বিষয়বস্তু।

নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির গঠনঃ

নোবেলের ইচ্ছানুযায়ী শান্তি পুরস্কার কমিটি গঠনের দায়িত্ব পড়ে নরওয়ের আইনসভার (Stortinget) হাতে। পাঁচ-সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির সদস্যরা ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হন, এবং প্রতি তিন বছর অন্তর দুই থেকে তিনজন সদস্যের পদ নবায়ন করা হয়। প্রধান এবং উপপ্রধান মনোনয়ন; সচিব, পরামর্শক, অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগের কাজ শান্তি পুরস্কার কমিটি নিজেই পালন করে। কমিটির সচিব নোবেল ইন্সটিটিউটের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

বিংশ শতকের প্রথম চার দশক পর্যন্ত কমিটির সদস্যপদ লাভের প্রধাণ শর্ত ছিল যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলনে আগ্রহ এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ; নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্ব অথবা কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ এসময় কোন বিবেচ্য বিষয় ছিল না। প্রার্থীদের যোগ্যতা নোবেলের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা – এই ব্যাপারে Stortinget-এর সমসাময়িক রেকর্ডে বেশ জোরালো তর্কের খোঁজ পাওয়া যায়। পুরস্কারের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও প্রাথমিক পর্যায়ে কমিটির সিদ্ধান্তগুলি মোটের ওপর নোবেলের ইচ্ছাকেই প্রতিফলিত করে (Heffermehl, 2010: pp. 43-44)।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমিটি গঠনের নীতিমালায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। ১৯৪৮ সাল থেকে কমিটির সদস্য নির্বাচনের বেলায় দলীয় সিদ্ধান্ত প্রাধান্য পায়, এবং আইনসভায় রাজনৈতিক দলের আসনসংখ্যার সমানুপাতে কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়। Stortinget-এ কোন আলোচনা-বিতর্ক ছাড়াই রাজনৈতিক দলগুলির প্রস্তাবিত ব্যক্তিবর্গকে শান্তি পুরস্কার কমিটির সদস্য নির্বাচন এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির কার্যক্রম থেকে নরওয়ের আইনসভা এবং ক্যাবিনেট ক্রমান্বয়ে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নেয়ার ফলে বর্তমানে পুরো ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়িয়েছে অত্যন্ত যান্ত্রিক (Heffermehl, 2010: p. 44)।

কঠোর গোপনীয়তাঃ

নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির নীতিমালা অনুযায়ী পুরস্কার প্রার্থীদের নাম, কমিটির কার্যবিবরণী এবং ভোট – সবই ৫০ বছর পর্যন্ত গোপন থাকে। প্রার্থী বাছাই নিয়ে সদস্যদের মধ্যে কোন আলোচনা এবং ভিন্নমত (dissent) কার্যবিবরণীতে রেকর্ড করা হয় না; সেখানে কেবল কমিটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করা হয় (Heffermehl, 2010: p. 45)।

যেহেতু নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটি এখন কার্যত হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি, সেহেতু পুরস্কার প্রদানের বেলায় সদস্যরা সাধারণতঃ চেষ্টা করেন একজন ঐকমত্যের প্রার্থীকে বাছাই করতে। তবে সবসময় যে এই পলিসি বজায় রাখা সম্ভব হয় না, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল ১৯৭৩ সালের পুরস্কার (প্রাপকঃ হেনরি কিসিঞ্জার এবং লী ডাক থো)। সে বছর কমিটির ৫ সদস্যের মধ্যে তিনজন ভোট দেন কিসিঞ্জার/থো-কে, আর দুইজনের ভোট পড়ে ব্রাজিলের Helder Camara-র পক্ষে। কমিটির প্রধান যখন মিডিয়াকে জানান যে এই সিদ্ধান্ত “সর্বসম্মতিক্রমে” নেয়া হয়েছে, প্রতিবাদে দুই সংখ্যালঘু সদস্য পদত্যাগ করেন। প্রায় একযুগ পরে এদের একজন (Einar Hovdhaugen) কমিটির কার্যক্রমের কড়া সমালোচনা করে পত্রিকায় এক নিবন্ধ লেখেন। এই সমালোচনার ফলে নোবেলের শর্তের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হোক বা না হোক, ঐকমত্যের প্রার্থী বাছাই করার চেষ্টা এখন আরও জোরদার হয়েছে (Heffermehl, 2010: p. 47)।

নোবেল শান্তি পুরস্কারের রাজনীতিকিকরণঃ

নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির সাবেক প্রধান Francis Sejersted-এর মতে “সহজ কথায় বলতে গেলে শান্তি পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত” (Heffermehl, 2010: p. 70)। পুরস্কারের রাজনীতিকিকরণ বুঝতে হলে আমাদের তাকাতে হবে নরওয়ের সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত নরওয়ে ছিল শান্তিবাদি এবং যুদ্ধবিরোধী একটি দেশ (যে কারণে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের জন্য এই দেশকে বেছে নিয়েছিলেন)। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান আক্রমণ এবং অধীনতার ফলে নরওয়ের জনগণের মধ্যে সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়, এবং pro-military মনোভাব দানা বাঁধতে শুরু করে; “৯ই এপ্রিল আর নয়” হয়ে দাঁড়ায় একটা জনপ্রিয় শ্লোগান (Heffermehl, 2010: p. 63; ৯ই এপ্রিল ১৯৪০ তারিখে জার্মান বাহিনী নরওয়ে আক্রমণ করে)। সামরিক বাহিনীর বিলুপ্তি ছিল যেখানে নোবেলের উইলের অন্যতম শর্ত, সেখানে নরওয়ে ১৯৪৯ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে (ন্যাটো) যোগদান করে। জনমতের এই প্রতিফলন ঘটে সংসদের অধিকাংশ সদস্যের চিন্তাধারার মধ্যেও; শান্তি পুরস্কার কমিটিতে এমন লোকেরা বসতে থাকে, শান্তি বিষয়ে যাদের দর্শন নোবেলের উইলের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এর মোটফল হল নোবেলের ইচ্ছাকে সঠিকভাবে বোঝার এবং বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে কমিটির ক্রমহ্রাসমান এবং নিজেদের সুবিধামত শান্তিকে সংজ্ঞায়িত করার ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টা। আর বর্তমানে কমিটির সদস্যরা যেহেতু দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচিত হন, সুতরাং শান্তি পুরস্কার এবং নরওয়ের সরকারী/পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই, এ কথাও বলা যায় না। পুরস্কার কমিটি যদিও দাবী করেন যে তাঁরা নোবেলের উইলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বাস্তবে নরওয়ের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাঁরা সাধারণতঃ এমন সব প্রার্থী বাছাই করেন যারা মূলতঃ অরাজনৈতিক এবং অসামরিকায়ন/নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে যাদের ভূমিকা নগন্য অথবা শুন্য, (Heffermehl, 2010: p. 72)। বিভিন্ন সময়ে এমন প্রার্থীকেও পুরস্কার দেয়া হয়েছে যুদ্ধ (এবং শান্তি) বিষয়ে নোবেলের শর্তের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে যারা অবস্থান করেন (Heffermehl, 2010: p. 53)। (১)

নোবেল শান্তি পুরস্কারের বানিজ্যিকীকরণঃ

গোড়া থেকেই নোবেল পুরস্কার শক্ত অর্থনৈতিক ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আলফ্রেড নোবেলের বিপুল তহবিলের কারণে পুরস্কার প্রদানকারী সংগঠনগুলি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারে; ঊর্ধ্বতন কোন কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের জবাবদিহিতা নেই। এমনকি নরওয়ে নোবেল কমিটি এবং নোবেল ইন্সটিটিউটের সমস্ত প্রশাসনিক খরচ বহন করা হয় স্টকহোমের নোবেল ফাউন্ডেশন থেকে।

তবে বিংশ শতকের শেষদিক থেকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের আন্তর্জাতিক প্রোফাইল যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, বাজার অর্থনীতির সঙ্গে এর সম্পর্কও তত ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিয়েছেন শান্তি পুরস্কার কমিটির সচিব Geir Lundestad (১৯৯০-২০০৯)। নতুন সহস্রাব্দে আন্তর্জাতিক এই হাই-প্রোফাইলের সবচেয়ে দৃশ্যমান তিনটি বৈশিষ্ট্য হলঃ জাঁকজমকপূর্ণ বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, বার্ষিক নোবেল পিস কনসার্ট, এবং অসলোতে প্রতিষ্ঠিত নোবেল পিস সেন্টার। এসব “গ্রোথ” প্রজেক্ট চালু করার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে খরচ হয়েছিল ২০-২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; এদের বার্ষিক পরিচালনা ব্যয় হল ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (Heffermehl, 2010: p. 92)। নোবেল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে এসব প্রকল্পের কোন সম্পর্ক না থাকায় এই বিশাল ব্যয়নির্বাহের জন্য শান্তি পুরস্কার কমিটিকে জোট বাঁধতে হয়েছে প্রাইভেট এবং পাব্লিক স্পন্সরদের সঙ্গে। প্রাইভেট স্পন্সররা মূলতঃ বিভিন্ন কর্পোরেট সংগঠন (যেমনঃ Telenor, Hydro, KPMG, Yara, Orkla, ইত্যাদি; Heffermehl, 2010: p. 94)। মুনাফাভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে এদের অনুদানকে একধরণের বিনিয়োগ হিসেবে ভাবাটা অযৌক্তিক না। অসামরিকায়ন এবং নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে নরওয়েতে যেসব সংগঠন কাজ করছে (এবং যাদের কাজ নোবেলের ইচ্ছাপত্রের সঙ্গে অনেক বেশী সঙ্গতিপূর্ণ), সেগুলি প্রাইভেট/কর্পোরেট সেক্টর থেকে এধরণের কোন অনুদান পায় না (Heffermehl, 2010: p. 93)। অন্যদিকে, পাব্লিক স্পন্সরদের অন্যতম হল নরওয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাহলে নরওয়ের পররাষ্ট্রনীতি পুরস্কারের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলে না – এটা ভাবারও কোন কারণ নেই। আর যখন স্পন্সরদেরকে খাতির-তোয়াজ করা হয়ে দাঁড়ায় নোবেল ইন্সটিটিউটের পরিচালকের (যিনি একই সঙ্গে শান্তি পুরস্কার কমিটিরও সচিব বটে!) মূল কাজ, তখন পুরস্কারের প্রকৃত দর্শন এবং লক্ষ্যও প্রভাবিত হতে বাধ্য। ২০০৫ সালের Bilderberger Conference-এ Lundestad অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু নোবেল কথিত সামরিকায়ন এবং যুদ্ধবিরোধী কোন সম্মেলন/আন্দোলনে তাঁকে দেখা যায় না (Heffermehl, 2010: p. 97)। সুতরাং, মিষ্টি কথার বাইরে Lundestad নোবেলের উইলকে আদৌ কোন গুরুত্ব দেন কিনা - Heffermehl এই প্রশ্নও তুলেছেন (2010: p. 97)। একসময় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান এবং ব্যানকোয়েটে হাজির থাকতেন প্রধানতঃ সংস্কৃতি, রাজনীতি, এবং শান্তি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ; আর এখন এসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের মধ্যে কর্পোরেট স্পন্সরদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি লক্ষণীয় (Heffermehl, 2010: p. 95)।

এখন কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনঃ প্রাইভেট সেক্টর যদি নোবেল শান্তি পুরস্কারের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়, তাতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হল এখানে কনফ্লিকট-অফ-ইন্টারেস্ট পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আগেই বলেছি যে প্রাইভেট সেক্টর অনুদানকে ইন্টারপ্রেট করবে ব্যবসায়িক বিনিয়োগ হিসেবে। আর তারা নিশ্চয়ই এমন কোন প্রজেক্টে মোটা বিনিয়োগ করবে না, যার লক্ষ্য তাদের ব্যবসায়ের লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। এতসব আপোষের কারণে পুরস্কার এখন এমন প্রার্থীকে দেয়া হয় যারা সমস্ত stakeholder-এর কাছেই গ্রহণযোগ্য, যারা সহজে নৌকা দোলাবেন না। Heffermehl-এর মতে ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক এবং মুহাম্মদ ইউনুস-কে প্রদত্ত পুরস্কার এই আপোষের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ (2010: p. 96)। অত্যন্ত সুকৌশলে পুরস্কারকে লেভারেজ হিসেবে ব্যবহার করে ইউনুস টেলিনরের সঙ্গে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবসাসংক্রান্ত একটি লাভজনক চুক্তি সম্পাদন করেন (Heffermehl, 2010: p. 96)। ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাঙ্কের পুরস্কারপ্রাপ্তির পিছনে টেলিনরের (যারা আবার নোবেল পিস সেন্টারেরও অন্যতম প্রধান স্পন্সর) ভূমিকা নিয়েও সেসময় বাজারে ব্যাপক গুজব ছড়ায়। টেলিনরের কোন ভূমিকা থাকুক বা না থাকুক, ইউনুসের এই পুরস্কার এবং সংশ্লিষ্ট বিতর্ক টেলিনরের জন্য বিশাল মাথাব্যথার জন্ম দেয় (Heffermehl, 2010: p. 96)। তবে তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল এই বিতর্ক নোবেল শান্তি পুরস্কারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। জনগণ দেখতে পায় শান্তি পুরস্কারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটা পৃথক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। আমরাও নিশ্চিন্তে ধরে নিতে পারি যে শান্তি পুরস্কার কমিটি এবং নোবেল ইন্সটিটিউটের এক্সট্রাকারিকুলার কার্যক্রমের সঙ্গে নোবেলের স্বপ্ন এবং তাঁর উইলের লক্ষ্য সরাসরি সাংঘর্ষিক।

এতো গেল প্রাইভেট স্পন্সরদের কথা। নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রতি নরওয়ে সরকারের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গিও হতাশাজনক। ২০০৮ সালে সেদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রী Trond Giske ঘোষণা করেন যে নোবেল শান্তি পুরস্কার নরওয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। মন্ত্রির কথার সমর্থনে নোবেল পিস সেন্টারের তৎকালীন পরিচালক Bente Erichsen-ও বলেন যে ভাল স্পন্সর শিকারের জন্য “নরওয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড”-এর লেবেল অত্যন্ত কার্যকর (Heffermehl, 2010: p. 99)। এধরণের চিন্তাভাবনার পরিণামে শান্তি পুরস্কার পরিণত হয়েছে ব্যবসা (এবং রাজনীতির) হাতিয়ারে। কিন্তু নোবেল কি এই শান্তি পুরস্কার চেয়েছিলেন? তিনি কি আশা করেছিলেন যে তাঁর আস্থার অপমান করে এই পুরস্কারকে ব্যবহার করা হবে বহির্বিশ্বে নরওয়ের ব্যবসায়িক স্বার্থ বিস্তারের কাজে? এসব প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার। এক সময় যে কমিটির একমাত্র দায়িত্ব ছিল পুরস্কারের একজন উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করা, সেই কমিটি এখন শান্তি পুরস্কারকে বানিয়ে ফেলেছে ব্যয়বহুল এক বিনোদন ব্যবসার অংশ; রাজনীতি এবং স্পন্সরদেরকে তোয়াজ করতে যেয়ে তলিয়ে গেছে নোবেলের পুরস্কারের প্রকৃত লক্ষ্য, স্বাতন্ত্র্য, এবং সততা।

(সমাপ্ত)
Emran Huq

টীকাঃ
১. ১৯০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত মোট ১২০ জন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান নোবেল শান্তি পুরস্কার জয় করেছেন। Heffermehl-এর মতে এদের মধ্যে ৫০জনের ক্ষেত্রে নোবেলের শর্তাবলী পূরণ করা হয়নি; সুতরাং এদের পুরস্কারকে “নোবেল পুরস্কার” না বলে “কমিটি পুরস্কার” বলাই ভাল। উল্লেখ্য, এই ৫০জনের মধ্যে ৪৪জনই শান্তি পুরস্কার জয় করেছেন ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর (Heffermehl, 2010: pp. 53-55)। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম হলঃ থিওডোর রুজভেল্ট (১৯০৬), এলিহু রুট (১৯১২), আন্তর্জাতিক রেডক্রস (১৯১৭, ১৯৪৪, ১৯৬৩), জর্জ মার্শাল (১৯৫৩), ইউনিসেফ (১৯৬৫), আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (১৯৬৯), নরমান বরলগ (১৯৭০), হেনরি কিসিঞ্জার/লী ডাক থো (১৯৭৩), অ্যামনেসটি ইন্টারন্যাশনাল (১৯৭৭), মাদার তেরেসা (১৯৭৯), লেস ওয়ালেসা (১৯৮৩), এলি উইজেল (১৯৮৬), রিগবার্তা মেঞ্চু (১৯৯২), ইয়াসির আরাফাত/শিমন পেরেয/ইতঝাক রাবিন (১৯৯৪), ডক্টরস উইদাউট বরডারস (১৯৯৯), কিম দায়ে-জং (২০০০), শিরীন এবাদি (২০০৩), ওয়াঙ্গারি মাথাই (২০০৪), মুহাম্মদ ইউনুস/ গ্রামীণ ব্যাঙ্ক (২০০৬), আল গোর/ পরিবেশ পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারী পরিষদ (২০০৭), মারতি আহতিসারি (২০০৮), এবং বারাক ওবামা (২০০৯)।

সূত্রঃ
Heffermehl, Fredrik S. (2010) The Nobel Peace Prize: What Nobel Really Wanted. Santa Barbara, CA: Praeger.


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

হিমু এর ছবি

এই পোস্ট থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম।

ইউনূসের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারকে আসলে টেলিনর পুরস্কার ডাকা উচিত।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।