প্রতিদিনের গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১২/০২/২০১৫ - ৪:১৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি প্রায়ই ভাবি, একটা ভাল কিছু লিখবো। খুব বড়, উন্নত মানের একটা লেখা। আমার লেখা পড়ে কেউ হাসবে, কেউ কাঁদবে। আমার বই শেষ না করে ঘুমোতে যেতে পারবে না। কিন্তু শেষমেশ আর কিছুই লেখা হয়ে ওঠে না। খুব সাধারণ একটা ঘটনা নিয়ে লিখতে চাই, কয়েকটি মানুষকে নিয়ে লিখতে চাই, কিছু সুখ-দুঃখের গল্প বুনতে চাই- কিন্তু এত ঘটনার ভিড়ে কোন একটা ঘটনাই মুখ্য হয়ে ওঠে না আমার। একটা সময় টুকরো টুকরো লিখতে পারতাম বোধহয়, সেই লেখা দেখলে আজ নিজের উপর প্রচন্ড হাসি পায় । কিসব ছাতামাথা লিখে নিজেকে বড় লেখক ভাবতাম! কিন্তু এখন হয়ত সেই ধ্রুব সত্যটাকে আর এড়াতে পাচ্ছি না। হয়ত নিজের অজান্তেই আমি মেনে নিয়েছি, আমি এখন আসলেই পারি না কিছু লিখতে।

আম্মা আমাকে প্রায়ই বলত, “আচ্ছা তানিম, এত যে বই পড়িস কিছু লিখলেও তো পারিস। তোর আব্বার কলিগ, খালেদ ভাই- উনার মত বই লিখলেও তো পারিস। জানিস উনাকে কত মানুষ সম্মান করে?” আমি হাসতাম। আমার মায়ের ছোট্ট দুনিয়াটার কথা ভেবে কেন যেন পরম মমতায় চোখটা ভিজে উঠত আমার। কত অল্পতেই না খুশি ছিল আমার আম্মা! বাইরের জীবনের কোন ধারণাই তার ছিল না। অল্প বয়সে বিয়ে। পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। কিন্তু পড়তে ভালবাসতেন। বিয়ের পর আব্বা অনেক বই কিনে দিয়েছিলেন আম্মাকে। আম্মার কাছে তাই লেখক মানে অন্যকিছু! মফস্বলের একটা ছোট অফিসে আব্বা কাজ করতেন। সেই অফিসে আব্বার কলিগ, খালেদ হোসেন স্থানীয় পত্রিকায় লিখতেন। একজন লেখক! মনে আছে, খালেদ চাচা যখন বাসায় এসেছিল আম্মা কিরকম অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। একজন লেখককে সামনাসামনি দেখা! তার জন্য বহুদিনের পোষা কবুতর দুটো রান্না করতেও দ্বিধাবোধ হয়নি।

আমি তো সেই খালেদ হোসেনও হতে পারলাম না। যদি একটা স্থানীয় পত্রিকাতেও লিখে যেতে পারতাম, খুব সাধারণ একটা মহিলাকে মুগ্ধ করতে পারতাম, তার হাতের রান্না খেতে পারতাম- তাহলেও কি আজকের মত দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম? লিখলামও তো বেশ কটি ওরকম স্থানীয় পত্রিকায়। কে পড়ল? কেউ না! এই সাতশো কোটির পৃথিবীতে একটা মানুষকেও বলতে পারলাম না, “এই যে শুনছেন, আমার না খুব বড় লেখক হওয়ার ইচ্ছে।”

আচ্ছা এই ইচ্ছেটার শুরু কোথায়? আমার শব্দ নিয়ে, বাক্য নিয়ে খেলা করার সুপ্ত বাসনাটা কবে জাগলো? কবে ইচ্ছে হল নিজের কোন লেখার কোন চরিত্রের জন্য কাঁদব? কবে ইচ্ছে হল আমার প্রিয় সন্ধ্যাবেলার বাড়ি ফেরার অনুভূতিটা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে? খালেদ হোসেন? আমার কাঁধে তার স্নেহের হাত রাখা? নাকি বাংলার হরিহর স্যারের কথাটা, “তানিম, আমি কারো খাতায় সেভাবে পড়ি না। তাদের মুরোদ কত আমার জানা আছে। কিন্তু তোর খাতার প্রতিটা লাইন মনোযোগ দিয়ে পড়ি। এত সুন্দর করে উত্তর দিস কিভাবে রে? তোকে হাইয়েস্ট না দিয়ে পারি না। তুই লেখার চেষ্টা কর, তোকে দিয়ে হবে।”

কি হবে? কিছুই তো হয় নি। সেই কবে আমাদের ঐ টিনের বাসায় ঝমঝম বৃষ্টিতে অংক খাতা ফেলে লাল রঙয়ের ডায়েরি বের করেছিলাম। উঠানে তখন আকাশভাঙ্গা পানি। পানিতে তাকিয়ে থেকে ডায়েরিতে কিছু লিখতে গিয়ে থমকে গিয়েছিলাম। ভাল কিছু লিখতে গিয়েও লিখতে পারছিলাম না। যা লিখছিলাম, মনে হচ্ছিল এটাই কি সেই লেখা যা কাউকে ভাল লাগাতে পারবে? এটাই সেই মহান সাহিত্য? কিচ্ছু না, যা দু-চার লাইন লিখলাম সব কেটে দিয়েছিলাম। সেই যে প্রথম আমায় হতাশা গ্রাস করেছিল আজও ছাড়েনি। সেদিন আমি কিছুই লিখতে পারি নি। সেদিন বৃষ্টির দুঃখের থেকে আমার ব্যর্থতাই আমায় ভীষণ কষ্ট দিয়েছিল। ডায়েরি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মন খারাপ করে বসেছিলাম। আম্মা মুড়ি মাখা নিয়ে এসে অবাক হয়ে বলেছিল, “কি রে? কি হয়েছে?” আমি অসহায়ের মত তাকিয়ে ছিলাম। কিছু বলতে পারি নি। আজও এই বত্রিশ বছর বয়সে এসে গভীর রাতে যখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি, মেসের রুমমেট জালাল ঘুম জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করে, “কি রে? কি হয়েছে?” আমি তাকেও উত্তর দিতে পারি না। খুব সুকৌশলে খাতাটা বালিশের তলে চালান করি। আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জালাল বলে, “ঘুমা, সকালে একটা ইন্টারভিউয়ে যেতে হবে মনে নেই?” আমি ঘুমোতে পারি না, খাতাটা বের করে দেখি, সেখানে কাটাকাটি ছাড়া আর কিছু নেই।

শহরে যখন পড়তে আসলাম, মনে হল এবার হয়ত লিখতে পারবো। এখানে হয়ত শহুরে বাতাসেই আমি আমার ঠিকানা পেয়ে যাবো। কিছুটা পেয়েও গিয়েছিলাম হয়ত, আমায় সবাই আঁতেল বলত- গাঁইয়া বলত। সেই গাঁইয়া আঁতেল যখন কলেজ-ম্যাগাজিনে সস্তা গোছের একটা লেখা দিয়ে সবার নজর কাড়ল, আমি ভেবে বসলাম মঞ্চ পেয়ে গিয়েছি। নিজেই সেই লেখা আবার পড়লাম। যে লেখা কিছুটা দায়সারাভাবেই লিখেছিলাম, সেটা পড়েই মুগ্ধ হতে লাগলাম। হয়ত মহান কিছু লিখব ভাবি জন্যেই লিখতে পারি না! প্রবল উৎসাহে তিনটা গল্প লিখে ফেললাম। বাসা থেকে যা খরচ আসতো, মাসের শেষের দিকে সতর্ক না হয়ে উপায় থাকত না। কিন্তু কি মনে করে দামী কাগজ কিনে ফেললাম, দুটো দামী কলম নিয়ে ফেললাম। সারাদিন ঘরের মধ্যে থেকে লিখতে চেষ্টা করতাম, প্রচন্ডরকম ক্ষুধা লাগত। চেপে থাকতাম, অবাক হয়ে একসময় লক্ষ্য করলাম, বেশ কিছু কবিতাও লেখা হয়ে গেছে। নিজের ক্ষুধাই কি কবিতায় সেইসব বিদ্রোহ নিয়ে আসছে? মাসের শেষ কয়েকদিন শুধু মুড়ি খেয়ে ছিলাম। আব্বা জানতে পেরে খুব বকেছিলেন, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম ছেলে আস্তে আস্তে লেখকের দিকে যাচ্ছে ভেবে কতটা খুশি হচ্ছেন ভিতরে। হয়ত আম্মাও তখন বলে বেড়াচ্ছিল, “জানিস রে হাসু, আমাদের তানিমও এখন লেখালেখি করে!”

সে মাস থেকে আলাদা একটা খরচ পেতে থাকলাম আমার লেখালেখির জন্য। আব্বার ওদিকে হয়ত একটু টান পড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম আমার জন্য বাসায় প্রত্যাশা কতটা। আমি দ্বিগুণ উৎসাহে লিখতে শুরু করলাম। কিছু বন্ধু জুটে গেল। তারাও আমার মত একই পথের যাত্রী। তাদের সাথে একের পর এক গুরুগম্ভীর সাহিত্য আলোচনা চলতে লাগল। টাউন হলে বসে চা-পান, পাঠচক্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সব কিছুতেই আমি। স্থানীয় পত্রিকায় লেখা আমার কাছে কিছুই লাগল না আর। সেই খালেদ হোসেনদের আর তোয়াক্কাই করতাম না আমি। আমার মনে হতে লাগল আমি আরও বড় কিছুর জন্য। আমার মনে হতে লাগল আমি আমার স্বপ্নের পথে ভাসছি।

শহরে এসে প্রথম আমি মেয়েদের সাথে কথা বলি। এক ধরণের জড়তায় থাকতাম আমি, কিছু বলার পরে নতুন কি কথা বলতে হয় জানতাম না। আতংকে থাকতাম কখন তারা আমার হাঁটুর দিকে তাকায়। দর্জির রিপুটা যে একদম বাজে হয়েছিল তখন অনুভব করতে শুরু করলাম। আস্তে আস্তে জড়তা কাটিয়ে উঠলাম, নিজের প্রতি সচেতন হওয়া শুরু হল। গায়ের রং একটু ময়লা ছিল আমার, কিন্তু উচ্চতা ছিল বেশ। বুঝতে পারলাম গায়ের রঙয়ের থেকে উচ্চতাই মেয়েদের আকৃষ্ট করে খুব। রীতিমত গর্ব অনুভব হল নিজের উপর। কোন মেয়েকে আলাদাভাবে ভাল লাগত না, সব মেয়ের সঙ্গই উপভোগ করতাম। কিন্তু নাইমাকে দেখার পর কেন যেন ওকে নিয়েই ভাবতে শুরু করলাম। মেয়েটা আমার সাথেই পড়ত, কিন্তু সেভাবে ক্লাস না করায় খেয়াল করি নি। পাঠচক্রে আসার পরই ওকে দেখলাম। একদম কথা বলত না, কেন জানো খুব লজ্জা পেত। কথা বলার সময় বারবার চশমা ঠিক করত। আহামরি সুন্দরী কেউ না, তবে ওর সাধারণ বেশটাই আমার অসাধারণ লাগতে শুরু করল। ও হয়ত আমার লেখা পড়েছে, একবার এক আড্ডায় ও নিজেই সেটা বলায় বেশ গর্ব হল আমার। কেন যেন মনে হল নাইমাও আমায় পছন্দ করে। ওর একটু ঘনিষ্ট হতে চাইলাম, কিন্তু কিভাবে করব বুঝতে পারলাম না। আমার মনে আছে একদিন ক্লাস শেষে আমি সরাসরি নাইমাকে বলে বসলাম, “নাইমা তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। একটু শুনবে?”

নাইমা ছিল ওর বান্ধবীদের সাথে। আমার ডাকে কিছুটা বিব্রত হলেও এগিয়ে আসল। খুব হালকা স্বরে বলল, “কিছু বলবে?”

আমি যে সাহস নিয়ে এসেছিলাম তার কিছুই অবশিষ্ট ছিল না ওর সামনে থাকা অবস্থায়। কলেজে জনপ্রিয় আমি, যেখানেই যাই “তানুদা তানুদা” করে ঘিরে ফেলে সবাই আর এই মেয়েটির সামনে নার্ভাস হলে চলবে? বললাম, “বুঝতেই পারছো নানা কাজে ব্যস্ত থাকি, ক্লাস করা হয় না তেমন। তুমি কি পড়াগুলো দেখাতে পারবে? আর নোটগুলো?”

নাইমা মাথা নাড়ল। সেদিন প্রথমবারের মত একটা মেয়েকে নিয়ে অনেক দূর হাঁটলাম আমি। কলেজের এই ইট-সুরকির রাস্তাটাকে দুই ধারের বড় বড় গাছ ছায়ানিবিড় করেছিল। আমার খুব ইচ্ছা ছিল ঢাকায় পড়ার, সেখানে হয়ত লেখালেখিকে অন্য একটা মাত্রা দিতে পারতাম। কিন্তু সেদিন প্রথম শহরের এই কলেজকে জীবনের অন্য যে কোন জায়গার থেকে প্রিয় মনে হল আমার। নাইমা কি বুঝতে পেরেছিল আমি ওর কাছে আসতে চাচ্ছি? বুঝতে পেরেছিল বোধহয়। হয়ত আমাকেও ভালবাসতে শুরু করেছিল ও। বিকেলগুলো ওর জন্য আমার প্রিয় হতে লাগল। ওকে নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করলাম। কি প্রচন্ড আবেগ কাজ করত! ওকে শোনাতাম,

আজকে তোমায় চুমোটা দিলাম রাতের তারার মত
বিশাল আকাশ থাকছে থাকুক পাহারায় অবিরত।
ঠান্ডা হাওয়া নীরব আজকে দুজনের উত্তাপে
কাছাকাছি বসে আঁধার দেখেছি আলোদের পরিমাপে।
তোমার নরম গালের রংটা গাঢ় হয়ে গেল একি!
আমাদের দেখে হাসছে দেখেছো অন্ধকারে জোনাকি?
সাগর দেখেছি পাহাড় দেখেছি দেখেছি গভীর বন
কোথাও পাইনি আজকের মত উত্তাপ শিহরণ।
সুন্দর দেখে লাগেনি আপন দেয়নি কিছুই সুখ
চাঁদের আলোয় দেখেছি যেমন আমার প্রিয়ার মুখ।
নেই তো আমার রাজার রাজ্য নেই কোন কিছু ঘরে
সব একদিন ঠিক চলে যাবে দৃষ্টির অগোচরে।
তুমিই আমার জীবন যাপনে সাতটা রাজার ধন
তুমি থাকতেও কোন সুখটার দরকার প্রয়োজন?
ফিসফিস করে তোমায় বলছি শুনছো এই যে নারী?
আঁধার হারাক ভোরের আলোতে তুমি শুধু আমারই।

কিসব কবিতা লিখতাম তখন! আজকাল এসব দেখলে প্রচন্ড লজ্জা লাগে আমার। অথচ ওর হাত ধরে যখন এসব ছন্দ মেলানো ছড়া শোনাতাম, ও আমার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরত। ওকে কখনও আমায় “আমি তোমায় ভালবাসি” বলতে হয় নি। কিন্তু ও ঠিকই বুঝে নিয়েছিল। আমায় যে বড় লেখক হতে হবে সেই বাসনা আরও তীব্রভাবে হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছিল ও। নিজে লিখত না, কিন্তু খুব পড়ত। আমার লেখার সবচেয়ে বড় সমালোচক হয়ে উঠল সে। ও নিজেও গ্রামের মেয়ে, শহরে আপা দুলাভাইয়ের বাসায় থাকত। একদিন ওর আপার বাসায় ভাগনির জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করল আমায়। চকোলেট আর ফুল নিয়ে যেয়ে দেখি কেউ নেই! নাইমা লজ্জা পেয়ে আস্তে আস্তে বলল, “বাসায় কেউ নেই, তোমায় সাথে একান্তভাবে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কলেজে তো আর সেটা হত না।”

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এতদিন শহরে থেকে বেশ কিছু কায়দাকানুন জানা হয়ে গিয়েছিল আমার। এরকম একটা ফাঁকা বাসায় একটা মেয়ের সাথে সময় কাটানো কতটা বিপদজনক বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু চলে আসতে পারছিলাম না। আমি আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। নাইমা এগিয়ে এসে আমার ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু খেল। আমি ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠলাম। কবিতা-গল্পে প্রচুর চুমুর কথা লিখলেও এরকম অভিজ্ঞতা একেবারেই আমার জন্য নতুন। এই শান্তশিষ্ট মেয়ে কিভাবে এত সাহসী হয়ে উঠল আমি ভেবে পেলাম না। সেদিন কতক্ষণ ওখানে ছিলাম আমি জানি না। সময় থমকে গিয়েছিল। যতবার ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখছিলাম মনে হচ্ছিল এর থেকে বড় অতৃপ্তি আর কিছুই হতে পারে না। ওর ঠোঁট ছুঁয়ে দেখলেই মনে হচ্ছিল এই প্রথম কোন ফুলের পাপড়ি আমি স্পর্শ করছি।

সেদিন বাসায় ফিরেই লিখে ফেলেছিলাম দুটো দীর্ঘ প্রেমের কবিতা। আগে যা লিখতে ভীষণ সংকোচ হত সেসবেই আস্তে আস্তে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করলাম। লেখালেখি চলছিল বেশ ভালভাবেই, কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার আগে একটা ঘটনা আমার পুরো জীবনকে উলটপালট করে দিল। সেই প্রথমবারের মত জীবনকে খুব কাছাকাছি দেখলাম।

চৈত্রের কোন এক দুপুরে আমার আম্মা মারা গেল।

হাসপাতালে আনতে আনতেই এক ভ্যানের মধ্যে আমার আম্মা তার ছোট্ট দুনিয়াটা রেখে গেল।

আমি তখন কলেজের ক্যাম্পাসে আড্ডা দিচ্ছি, আমারই এক বন্ধু বলল আমাদের গ্রামের কোন এক লোক নাকি আমায় খুঁজছে। আমি যেয়ে দেখি মকবুল চাচা। উনার সাথে হাসপাতালে গিয়ে দেখি একটা পিলারে আমার আব্বা হেলান দিয়ে আছেন। চোখের পানি গাল বেয়ে নিচে পড়ছে। আব্বা নিঃশব্দে কাঁদছেন। আব্বার কলিগ, আমার আম্মার প্রিয় লেখক খালেদ হোসেন আমার কাঁধে হাত রাখল। ওদিক থেকে ওয়ার্ডে কান্না ভেসে আসছে। গিয়ে দেখি একটা মেঝেতে কাঁথা বিছিয়ে আমার আম্মা শুয়ে আছে। আনতে আনতেই যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্য একটা বেডের ব্যবস্থা করা যায় নি। আমার মনে হল এর থেকে ফিরে গেলেই তো পারত। কেন হাসপাতালে নিয়ে আসল তারা? ওরা কি বোঝে নি আমার আম্মা মারা গিয়েছে? আব্বাকে অফিস থেকে আনা হয়েছে, আব্বা ছিল না সাথে। আম্মা তার ছোট্ট দুনিয়ার কাউকেই মারা যাওয়ার সময় পেলেন না।

আম্মা কি সহজভাবেই না শুয়ে আছে! মৃত্যুর সময় কি আম্মার বড্ড কষ্ট হয়েছে? দেখে মনে হচ্ছে কি নিশ্চিন্তভাবেই না আম্মা ঘুমোচ্ছে। ঘুম থেকে উঠেই বলবে, “তানিম! কিছু খাবি? মুড়ি মেখে দেবো?” আম্মার মুখ দেখে আমার মনে পড়ে গেল বিন্তীর কথা, আমার ছোট বোন। পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল আট বছর বয়সে। ওর মুখ দেখেও সেবার আমি শুনতে পাচ্ছিলাম যেন ও বলছে, “দাদাভাই! কই তুই? আচ্ছা আলাব্বুউ! বের হয়ে আয় না, আমার ভয় করছে এখানে!”

আমি পেছন থেকে বেরিয়ে এসে ভয় দেখাতাম। ও কাঁদতে শুরু করত। তারপর এমন লুকালো আর খুঁজেই পেলাম না ওকে। কখনই না। আমার আম্মাটাও হারিয়ে গেল, যাওয়ার আগে আর কাউকেই দেখল না।

ফাইনালের রেজাল্ট খুব ভাল হল না। সেকেন্ড ক্লাস নিয়েই সন্তুষ্ট হতে হল। আব্বা জোর করে আমায় ঢাকায় পাঠায় দিল। বলল, এখানে থেকে নাকি ভাল কিছু হবে না। একটা ঠিকানা লিখে দিল, বলল যোগাযোগ করতে। আমি ঢাকায় চলে আসলাম। নাইমার কাছে বিদায় নেওয়াটা সহজ ছিল না, যদিও সে সময়টা আমাদের ভাল ছিল না। কেন যেন আম্মা মারা যাওয়ার পর থেকে মনে হতে লাগল ওর কারণেই আম্মার থেকে দূরে চলে গিয়েছি আমি। তবুও ওর প্রতি আমার একটা দায়িত্ববোধ ছিল, ওকে তো ঝেড়ে ফেলতে পাবো না! ও এখানেই একটা চাকরি খুঁজে নেবে বলল, তারপর মৃদু স্বরে বলল- “তুমি চাকরি পেলেই বাড়িতে বলব বিয়ের কথা। কিন্তু বেশি দেরি করে ফেলো না।”

আমি জবাব দিলাম না। ঢাকায় চলে আসলাম। শুরু হল বেঁচে থাকার আরেকটা গল্প, লেখক না হতে পারার আরেকটা গল্প।

[চলবে]

রাসিক রেজা নাহিয়েন


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চলতে থাকুক। ভাবতে ভাবতে লেখাটা ফুটে উঠছে সচলের ক্যানভাসে। ভাল লাগলো।

----------------
রাধাকান্ত

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে। সাথে থাকবেন।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

এক লহমা এর ছবি

চলুক চলুক। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

রাসিক রেজা নাহিয়েন

মাসুদ সজীব এর ছবি

হাততালি
শুরুটা দারুন হয়েছে, আপনার অন্য যে কোন লেখা থেকে অতি উত্তম, পরের পর্বের জন্যে অপেক্ষায় থাকলাম হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

রাসিক রেজা নাহিয়েন

অতিথি লেখক এর ছবি

এটা কি গল্প নাকি বাস্তব জীবনের কথা???

মহাবিশ্বের পরিব্রাজক

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পই তো!

রাসিক রেজা নাহিয়েন

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুন গল্প।
ভালো লাগার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা - লেখালেখি নিয়ে গল্পের ওপর আমার আলাদা একটা আকর্ষণ আছে।
এটা কি বড়গল্প, না উপন্যাস হবে?

- সো।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমারও আকর্ষণ ওরকম গল্পে।

উপন্যাস হয়তো হবে না, সেক্ষেত্রে প্রচুর ডিটেইল দিতে হত। গল্পই চলুক।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

মুক্তমন এর ছবি

বাবা-মা চান ছেলে লেখক হোক-এমনটা শুনিনি৷ নতুন ধরণের চিন্তা৷ ভাল লাগল৷ পরের পর্ব জলদি দিয়েন ৷

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে। সাথে থাকবেন।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ভাল লাগল পড়ে। চমৎকার গাঁথুনি, আর গতি। ভাল লেগেছে। আরও লিখুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে। শুভেচ্ছা।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

চলুক প্রতিদিন। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

রাসিক রেজা নাহিয়েন

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

চলুক, সাথে আছি।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

রাসিক রেজা নাহিয়েন

আয়নামতি এর ছবি

চলুক হাসি
ইয়ে একটা বিষয়ে এট্টু কনফিউশন হলু....কিন্তু কিভাবে বলি বুঝলেম না বলে চুপ থাকলেম খাইছে

অতিথি লেখক এর ছবি

চোখ টিপি

রাসিক রেজা নাহিয়েন

অতিথি লেখক এর ছবি

ধারাবাহিকটা পড়লাম যদিও বেশ লম্বা লেখা। ব্লগে ধারাবাহিক পর্ব আরো ছোট হলে ভালো হয়, ব্যস্ত পাঠকের জন্য।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো। পরের পর্ব কবে দিচ্ছেন?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।