প্রতিদিনের গল্প- তৃতীয় পর্ব

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/০২/২০১৫ - ৮:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্ব এখানে
দ্বিতীয় পর্ব এখানে

মেসের জীবন আমার কখনই ভালো লাগতো না।

কিন্তু আমাকে যে কতবার মেস বদলাতে হয়েছে তার ঠিক নেই। প্রায়ই দেখা যায় আমাকে কেউ বলছে, “আরে তানিম! কি খবর?”

আমি বোকার মত হাসার চেষ্টা করতাম। কারণ পরিচিত মনে হওয়া সামনের মানুষটাকে আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না কোথায় দেখেছি।

“আরে চিনতে পারছিস না? আমি সাজিদ! সিটি মেসে তোর পাশের রুমে থাকতাম।”

আমি লজ্জা পেয়ে যেতাম। আমি চেয়েছিলাম আমার একটা কোলাহলমুক্ত জায়গায় ঠাঁই হবে, যেখানে আমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো। আমার লেখালেখি করতে পারবো। কিন্তু আশ্চর্য, আমাকে প্রতিবারই মানুষ গিজগিজ করছে এমন জায়গায় থাকতে হয়েছে।

তবে ঠিক করেছিলাম কারো বাসায় আমি কখনই রুম ভাড়া নিয়ে থাকবো না। পারুল ভাবীর ব্যাপারটা আমায় যথেষ্ট ভাবিয়েছে। একটা মেয়ে সারাদিন বাসায় পড়ে থাকে, স্বামী আসে রাত বারটার পরে- একটা ব্যাচেলর পুরুষের দিকে তার আকৃষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। স্বল্প-শিক্ষিত এরকম মেয়েদের ঘটনা অহরহই তো ঘটে। সেখানে নিজেকেও দেখতে পেয়ে খুব হাসি পায় আমার।

আচ্ছা আজকাল আমি কি সত্যিই এত সস্তা হয়ে গিয়েছি? এরকম মধ্যবিত্ত একটা পরিবারে জড়িয়ে যাওয়াটা আমায় মানিয়েছে? অবশ্য মানাবে না কেন, না মানাবার মত তো কিছুই করি নি।

সেবার সুফিয়ানের ওখানে কিছুদিন থেকে মেসে উঠেছি। মেসের খাওয়াদাওয়া প্রচন্ড খারাপ শুনেই এসেছি। ওদিক থেকে রিসাদ অবশ্য আমায় সস্তায় ভালো মানের হোটেলের সন্ধান দিয়েছিল। সারাদিন এদিক-ওদিক করে যখন রুমে যেতাম, দেখতাম রুমমেট বরকত ভাই শুয়ে আছে।

বরকত ভাইকে আমার অবশ্য খারাপ লাগে নি। চমৎকার মানুষ। কি একটা ছোট চাকরি করেন। ওটার কথা জিজ্ঞেস করতে গেলেই বলে, “আরে দূর এগুলো কিছু হল? চাকরি খুঁজতে হবে।”

সারাদিন ভাইকে পাওয়া যেত না। কাজে ব্যস্ত থেকে রাতে যখন এনাকে পাওয়া যেত সেটা আমার জন্য মোটেও সুখকর ছিল না।

বরকত ভাই মাদকাসক্ত ছিলেন। এমন কোন জিনিস নাই যেটা তার জানা ছিল না। কি কি সব বানাতেন আর বলতেন, “তানিম, দিবা না একটা সুখটান?”

“না ভাই”, আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, “আপনিই সুখটান দেন।”

“বুঝলা তানিম, সবসময় এই জিনিস খাই না। যখন ‘পিনিক’ ওঠে তখনই এই মাল খাইতে হয়।”

“আপনার কি এখন ‘পিনিক’ উঠছে?”

“হুম।”

ওই মেসে থাকা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ল। আমি নিজে প্রচুর সিগারেট খাই কিন্তু ওইসব জিনিস যে আমাকে কাবু করত না গ্যারান্টি কি? ওই মেস ছেড়ে দিলাম। আস্তে আস্তে আস্তে মেস বদলানো আমার স্বভাবই হয়ে গেল বলতে গেলে। চাকরি খোঁজার থেকে মেস খোঁজাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল।

চাকরি! সত্যি কথা বলতে আমার কেন জানি সেই চাকরি খোঁজাটাতেই আনন্দ হতে লাগলো। চাকরি পেলে সেরকম আনন্দ আর হবে কি না কে জানে? মাসে আব্বা একটা মোটা অঙ্কেরই টাকা পাঠাতো। আমিও চিঠি লিখে দিতাম চাকরি খোঁজা অব্যহত আছে। সারাদিন ফুর্তির মধ্যেই যেত বলতে গেলে।

আমার যে লিখতে পারি না আর এটা বুঝতে আমার অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। একটা বেশ ভালো সাহিত্যপড়ুয়া গ্রুপের সাথে কেমন করে জানি যুক্ত হয়ে গেলাম। অনেকেই শিক্ষার্থী, কেউ কেউ চাকরি-বাকরি করছেন। এদের মধ্যে লেখক-কবিও অনেকে। আমায় মুগ্ধ করল এরা পুরোটা সময় বই-পত্তর নিয়েই কথা বলে বেশ। এতদিন যেগুলোতে আড্ডা মারতাম সেগুলোতে এর-ওর হ্যানো-ত্যানো শুনতেই যেত। কিন্তু এটায় পুরোটা সময়ই সাহিত্যের আলোচনা হয়। কেউ তার নিজের কবিতাও পড়ে, আবৃত্তিও হয়। আমায় মুগ্ধ করল এখানে কবিতা প্রায় সবাই ভালোবাসে! যত বেশি এদের সাথে মিশতে শুরু করলাম মনে হতে লাগলো যে এতদিনে নিজের ভেতর যে অন্ধকারগুলো ঘুরতাম সেগুলো সরে যেতে লাগলো। আমি সবসময় মুগ্ধ শ্রোতা হয়েই থাকতাম, কিছু বলতে খুব লজ্জা পেতাম। মনে হত আমি তো কিছুই জানি না। আবার আগের মত সাহিত্য নিয়ে মেতে উঠলাম, প্রচুর বই পড়া শুরু করলাম এমন সময় জালাল আমার নতুন মেসের রুমমেট হল।

এই আনন্দ মেসটা সবদিক থেকেই ভালো লাগল। আমি তখনও জানতাম না এই মেসেই আমি বছরের পর বছর এই জালালের সাথেই থাকবো। চমৎকার একটা ছেলে, এখানে কোচিংয়ে ক্লাস নেয় আর সারাটা ক্ষণ যেন বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নেয়। আমি ভালোভাবেই জানতাম সেটা আমার দ্বারা হবে না তাই আগ্রহ পাই নি। আমি তখন দিন রাত বই পড়তাম আর ও পড়াশোনা করত। চমৎকার আন্ডারস্ট্যান্ডিং। নিয়মিত বই পড়তাম আর ওদের ওই আড্ডায় অংশ নিতাম।

ওখানে মহসিন ভাই, নীলিমাদি, শাখাওয়াত ভাই অনেকের সাথেই সম্পর্ক ভালো হয়ে গেল। সবচেয়ে ভাল সম্পর্ক হল সৈকতের সাথে। মহসিন ভাই একটা সাহিত্য ম্যাগাজিনের সম্পাদক। নাম ‘খেয়া’ । এই ‘খেয়া’ তখন সাহিত্য পাড়ার সবচেয়ে উন্নতমানের পত্রিকা। এর নাম আগেও শুনেছিলাম, সত্যি বলতে লেখাও পাঠিয়েছিলাম- যদিও ছাপায় নি। অনেক নামী লেখকরাও লিখতো। তাই এই আড্ডায় যুক্ত হতে পেরে যেন সোনা হাতে পেয়েছিলাম!

ওই আড্ডায় আরো অনেকেই থাকত। ভার্সিটি পড়ুয়া ঝকঝকে ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে খুব হীনমন্যতায় ভুগতাম। ওরা যে শুধু স্মার্টই ছিল তা না, প্রচুর বই পড়ত। এমনকি ইংরেজীও, যা আমি জীবনে সাহস করে ধরেই দেখিনি। বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখকের নামও আমার অজানা ছিল।

আমি সবসময় সৈকতের সাথেই বসতাম। অসম্ভব ভালো একটা ছেলে। ওর সাথে তখন এত বেশি মিশতাম যে সম্পর্কটা তুই-তোকারিতে চলে গেল। আমার অনেক ঘটনাই ওকে বলেছিলাম। আম্মার মারা যাওয়া, বিন্তী, নাইমা এমনকি পারুল ভাবীর কথাও। খুব মন দিতে শুনতো ও। লেখালেখি ছাড়াও চমৎকার গান গাইতো । সেদিন গিটার দিয়ে শোনালো,

“হরি দিন তো গেলো সন্ধ্যে হলো পার করো আমারে
তুমি পাড়ের কর্তা জেনে বার্তা তাই ডাকি তোমারে...”

আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মহসিন ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “এই গান প্রথম কোথায় শুনেছিলাম জানিস? পথের পাঁচালীর ইন্দিরা ঠাকরুনের গলায়।”

আমি তন্ময় হয়ে শুনতাম। এরা এত জানে! ওদের সাথে কথা শুনতে এত ভাল লাগতো! একদিন মহসিন ভাই যেন ঘোষণাই করলেন, ‘খেয়া’র আগামী সংখ্যাটা নাকি শুধু এই আড্ডার মানুষরাই লিখবে। সবাই লাফিয়ে উঠল। মহসিন ভাই হেসে বললেন, “শোন, লেখা ভালো না হলে কারোটাই ছাপাবো না। যতই ক্লোজ হোস না কেন!” সাদিয়া নামের মেয়েটা হাসতে হাসতে বলে বসল, “হেহ, ভালো লেখা না হয় বুঝলাম, ভালো লেখার ভালো সম্মানী যাতে আসে সেটাও বলেন দাদা।”

মহসিন ভাই হো হো করে হেসে বললেন, “এই তো ধরে ফেলেছিস। শোন আগেই বলে দেই, সম্মানী দিতে পারব না। তবে যাদের লেখা ছাপা হবে তাদের জন্য একটা বড় ট্রিট দিবো এটুকু বলতে পারি!” সবাই সেদিন খুব উৎফুল্ল হল। সবার সাথে কথা বলতে বলতে মহসিন ভাই আমার দিকে চেয়ে বললেন, “কি তানিম। সারাক্ষণ তো চুপই থাকো। লিখে ফেলো কিছু।”

আমার বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। আমি এদের নেকনজর পাওয়ার অনেক চেষ্টাই করে যাচ্ছি। মহসিন ভাই কি আমাকে পছন্দ করেন? এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। দিব্যি কল্পনা করে ফেললাম একটা বিশাল রেস্টুরেন্টে আমি সবার সাথে বসে আছি। সবাই আমার লেখার প্রশংসা করছে। আমিও সাবলীলভাবে সবার সাথে কথা বলে যাচ্ছি!

সেদিন মেসে ফিরেই মহা উৎসাহে লিখতে বসলাম। ততদিনে জালালের যেন অনেক বেশি চেনাই হয়ে গেছি। আমার দিকে তাকিয়ে জালাল বলল, “লেখ তাহলে।”

আমি আমার খাতাটা বের করলাম। পাতা উলটে দেখি কয়েক মাসের কাটাকাটি ছাড়া যেন আর কিছুই নেই। লিখতে শুরু করবো এমন সময় থমকে গেলাম।

কি লিখবো? কবিতা? কবিতা নিয়ে যে আমার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে তার আর কি বলব? জীবনে কখনই এতটা ছোট হইনি আগে। অবশ্য এর শোধও ভাল তুলেছিলাম পরে।

সেদিন অবশ্য কেউই ছিল না প্রায়। টুপটাপ বৃষ্টিতে মহসিন ভাই, লিটু ভাই স্বপ্না আপা। আর দুটা স্মার্ট ছেলেমেয়ে। এগুলোকে দেখলেই কেন যেন আমার গা জ্বলে যেত। মাঠে যখন বসা সম্ভব না আমরা ওই “খেয়া” অফিসেই গেলাম। মহসিন ভাই “অ্যাই সাগর চা-পুড়ি আন” বলে বসে পড়লেন। আড্ডার ফাঁকে স্বপ্নাদি বলে বসল কবিতা পড়া হোক। কে পড়বে? ওমা! মহসিন ভাই আমার কথা বলে বসলেন। আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। এখানে নিয়ম হল কাউকে কিছু করতে বললে সেটা করতেই হবে। আমি বললাম যে, “ভাই পাবো না।” ওদিক থেকে লিটু ভাই খোঁচা দিলেন, তুমি ফারহানের ফ্রেন্ড না? ও যে বলল তুমি ভালো লেখো? আর নিজের কবিতাও আবৃত্তি করো?”

জিভ কাটলাম। এই ফারহান নামের একটা বন্ধুটাই আমায় এই আড্ডায় যুক্ত করেছে। সবাই চেপে ধরল। “না না, তোমার একটা কবিতা শোনাতেই হবে!” লজ্জার মাথা খেয়ে একটা পুরোনো কবিতা শোনালাম, নাইমার জন্য মুখস্থ করেছিলাম। কবিতাটা ছিল এরকম,

যতবার আমি ভুলে যাই তবু তার থেকে পড়ে মনে
এই জীবনের সেরা সঞ্চয় নিয়ে বাঁচি নির্জনে।
যতবার তাকে চেয়ে দেখি শুধু অপলক বিস্ময়ে
কিছু মনে পড়ে কিছু ভুলে যাই প্রকৃতির অভিনয়ে।
কোথায় দেখেছি বাঁধভাঙ্গা হাসি কোথায় ছুঁয়েছি তাকে
কাছেও গিয়েছি দূরেও সরেছি পেয়েছি শূন্যতাকে।
তাকে ভুলে যাবো তাই বারবার তাকে নিয়ে পড়ে থাকি
আমার আবেগে আকাশের তারা মিছে করে ডাকাডাকি।
কোথাও পাইনি উত্তর কোন কোথাও পাইনি আলো
না এলেই হতো এই বসবাসে- সেই ভালো সেই ভালো!
সেই তো হয়েছে মাদক আমার তার নেশাতেই বুদ
জীবন-যাপনে প্রয়োজনে শুধু তাকে চাই- অদ্ভুত!
সেই তো আমার সব থেকে চেনা তবু রহস্যময়ী
প্রতিদিন দেখে মুগ্ধ হয়েছি সে কি শুধু আমারই?

চোখ বন্ধ করে গড়গড় করে বলে গেলাম। চোখ খুলে দেখি সবাই মিটমিট করে হাসছে। স্মার্ট হারামজাদা দুটো থাকতে না পেরে ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো। অপমানে আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। এটা কী কবিতাই হয় নি? আমি তো ঠিকই মাত্রাবৃত্তে ছয় ছয় আট ছন্দে লিখেছিলাম। এগুলো এতই হাস্যকর?

মহসিন ভাই হয়ত আমার চোখের পানি দেখেছিলেন। কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, “তানিম, কবিতা ভালই হয়েছে তবে একটু বেশিই ন্যাদন্যাদা মনে হল। এটা অনেকটা ছড়া হয়ে গিয়েছে। আজকাল কেউ এরকম লেখে?” মহসিন আভি যদিও আমায় সেদিন সান্তনা দিয়েছিলেন কিন্তু তার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ঠিকই দেখতে পেয়েছিলাম। স্মার্ট হারামজাদাগুলো এরপর রবার্ট ফ্রস্ট আর এমিলি ডিকেনসনের কিসব কবিতা আবৃত্তি করেছিল সেদিন। এরা কবিতা মানে যেন ইংরেজীই বোঝে। আর বাংলায় জীবনানন্দ ছাড়া যেন কেউ কবিতাই লেখে না।

হ্যাঁ, জীবনানন্দ! সেদিন লিখতে বসার আগে আমার অপমান আর জীবনানন্দ বলতেই ওদের অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটাই মনে হচ্ছিল বারবার। জীবনানন্দের কবিতার বইটা বের করেছিলাম। সূচিপত্র দেখতে দেখতে আমার একটা আইডিয়া এলো। একটা কবিতা লিখে ফেললাম। যদি সেই কবিতা ছাপায় তাহলেই ওদের মুরোদ বোঝা যাবে। লিখে ফেললাম,


মাঘসংক্রান্তির রাতে আমাকে একটা কথা দাও,
তোমাকে নিয়ে যাবো পৃথিবীর রৌদ্রে
প্রিয়দের প্রাণে অবরোধ যেন মহাগোধূলির যাত্রী,
যতদিন আমি যতিহীন হয়ে থাকবো বিস্ময়ে।
যদিও দিন আসবে দেখতে জয়জয়ন্তীর সূর্য
অনেক নদীর জলে পাওয়া যাবে পৃথিবীলোকের ঘ্রাণ
ভালোবেসে যেন সন্ধ্যা নামবে এখানে প্রাণের স্রোতে
নির্জন সাক্ষরে লিখে যাবো আমি জীবন অথবা মৃত্যু।
একদিন যদি আমি দূর পৃথিবীর গন্ধে শুনতে থাকি
একটি কুয়াশার শব্দ; সেই শব্দে আমি ব্যাকুল হয়ে
চলে যাব শুকনো পাতা-ছাওয়া ঘাসে সূর্য সাগর তীরে।
স্বপ্নের ধ্বনিরা ডাকবে দেখো হৃদয় প্রেমের দিন
নগ্ন নির্জন হাত বাড়িয়ে দেবো ভিজে হয়ে আসা মেঘে
ঘুমায়ে পড়ব আমি একদিন সোনার খাঁচার বুকে।

কবিতার প্রতিটি লাইনই জীবনানন্দের বিভিন্ন কবিতার শিরোনাম। সূচিপত্র দেখে দেখে লিখে ফেলেছি। কবিতা আর দেখতে হয় নি। কবিতার নাম দিলাম “ছায়াশীতল।” কেন দিলাম কে জানে। পাঠিয়ে দিলাম “খেয়া”তে।

খেয়ার ওই সংখ্যা যেদিন বের হল সেদিন আর কি বলব! কবিতার সূচীতে ‘ছায়াশীতল” জ্বলজ্বল করছে। কবির নাম তানজিউর রহমান তানিম। আমাদের আড্ডারই অনেকেই লিখেছে। সৈকতও দেখি একটা গল্প লিখেছে। ওর গল্প পড়তে গিয়ে থমকে গেলাম। গল্পের নাম “অপরাহ্ণ”- গল্পটা আমার আর পারুল ভাবীকে নিয়ে লেখা। আমার নাম ওখানে হিমেল, আর পারুল ভাবীর নাম চিত্রা। নাইমার নাম ওখানে আয়না। চমৎকার টানাপোড়নের গল্প। শেষটা করেছে একটা দ্বিধা আর বিভ্রান্তি দিয়ে। বোঝা যাচ্ছে হিমেলের আয়নার সাথেও সম্পর্ক আছে কিন্তু চিত্রাদির জন্যেও তার হৃদয়ে উষ্ণতা আছে। কে প্রকৃত নায়িকা? হিমেল কার কাছে যাবে?

আমি গল্পটা কতবার পড়লাম জানি না। সেদিন বুঝতে পারলাম নিজের জীবনের সামান্য ঘটনা অসামান্য হয়ে ওঠে লেখকের বর্ণনায়- যেটা আমার নেই। স্বীকার করে নিলাম যে এরকম কিছু আমাকে দিয়ে লেখা সম্ভব না। সেবারই প্রথমবারের মত মেনে নিলাম যে আমি লিখতে পারি না। তবে সেদিনের আড্ডাটা ছিল স্মরণীয় একটা আড্ডা। আমি যেমন মনে রাখবো ওরাও বুঝতে পারলে মনে রাখবে ঠিকই।

সেদিনের আড্ডায় মধ্যমণি ছিল সৈকত। সবাই ওকে ওর “অপরাহ্ণ” গল্পের জন্য প্রশংসায় মাতিয়ে দিলো। ও আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। আমিও হাসলাম। মহসিন ভাই সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ওর গল্পটা ছাড়াও একটা কবিতা কিন্তু আমার খুবই ভাল লেগেছে। কোনটা জানিস?”

সবাই মাথা নাড়লো। মহসিন ভাই “খেয়া” বের করে “ছায়াশীতল” আবৃত্তি করলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তানিম সেদিন একটা হাস্যকর কবিতা আবৃত্তি করেছিল। আমরা হেসেছিলাম। কিন্তু এই তানিমই যে এইরকম মারাত্মক কবিতা লিখবে কে জানতো! আমার দিকে চেয়ে বললেন, “কবি এখন থেকে কবি এখন থেকে প্রতি সংখ্যায় আপনার কবিতা চাই।” আমি আশেপাশে শাখাওয়াত ভাইকে খুঁজতে লাগলাম। উনি আমাদের জীবনানন্দ এক্সপার্ট। উনি কাজে চিটাগংয়ে যাওয়ায় কয়েকমাস ধরে তার দেখা নেই। এ ছাগলদের মাঝে যদি আমাকে কেউ ধরে ফেলত তাহলে সেটা উনিই। তাকিয়ে দেখি সেদিনের স্মার্ট হারামজাদা দুইটা স্রদ্ধার সাথে আমার দিকে চেয়ে আছে। তখনই একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। কোথাও খাওয়া হবে যখন আলোচনা চলছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসলাম। ঠিক করলাম আর কখনই যাব না।

এরাও আমার মত অনেক জায়গায় দূর্বল। কিন্তু একটা মুখোশ পড়ে বেড়ায় আর ভাব ধরে থাকে এরাই শ্রেষ্ঠ, এদের থেকে কেউ আর জানে না। আমি না লিখতে পারি, কিন্তু এদের এই উঁচু শ্রেণীর ঢং আমাকে মানাবে না। এরা সবসময় ছিল, এরা থাকবে। আমি ওদের দলের কেউ না। আমার পথ আমাকেই বের করতে হবে।

সেদিন কেন জানি অদ্ভুত একটা ভাল লাগায় ডুবে গেলাম। এতদিন যে হীনমন্যতায় ভুগতাম সেটা চলে গেল। বুঝতে পারলাম এরকম হীনমন্যতা কাটানোর জন্যই এরা এই সবজান্তার স্মার্টলুক নিয়ে ঘোরে সবসময়। আমার এদের দরকার নেই।

সন্ধ্যার দিকে খুশিমনে মেসে ফিরলাম। জালাল বলল, একটা মেয়ে নাকি এসেছিল আমার খোঁজে।

“কি নাম?” জিজ্ঞেস করলাম।

“নাইমা,” জালাল বলল।

রাসিক রেজা নাহিয়েন


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

কিছু টাইপিং মিসটেকের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। লেখার শেষে চলবে লিখতে ভুলে গিয়েছি।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

গগন শিরীষ  এর ছবি

চলুক! ভাল লাগছে গল্প।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

এই তো চাইছিলাম! এমনটাই! ঝরঝরে বর্ণনা, স্বচ্ছন্দে এগিয়ে গেছে! বেশ ভালো লেগেছে!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অতিথি লেখক এর ছবি

সত্যি কথা বলতে ৩য় পর্বের শুরুটা কেমন জানি লাগছিল কিন্তু মাঝের থেকে শেষ পর্যন্ত ভাল লেগেছে । এবং ঐ একই কথা ছদ্মবেশের আড়ালে দাড়িয়ে থাকা মানুষগুলো আসলেই কি মানুষ!!!

-----------
রাধাকান্ত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।