অপরাজিতা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০৫/০৫/২০১৫ - ৭:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মেয়েটির জন্মের সময় সমস্ত পরিবার মুখ অন্ধকার করে বসেছিল- কেউ হাসেনি, কেউ কেউ -'আহা রে। আবার মেয়ে!' বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে! জন্মের মুহূর্তে একটি মেয়েকে যে সমাজ এমন ভয়াবহ আমন্ত্রণ জানায় পৃথিবীতে- সেই সামাজিকতায় মেয়েটিকে প্রতিটি পদক্ষেপে যে অপমানিত, নিগৃহত, নির্যাতিত হতে হবে তার তো আর বলে দিতে হয় না! আমি বলছি না যে আমাদের সকল মেয়েদের কপালে এমন জন্ম মুহূর্ত জোটে- কারো কারো বাবা হয়তো হাসিমুখে কন্যাকে বুকে তুলে নিয়ে বলেন- আহা রে, আমার পরী! কিন্তু তাদের সংখ্যা আর কয়জন!

নারী সপ্তাহের গল্পগুলো পড়ে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই চোখের জল মুছেছি- গল্পগুলো লেখকের একার নয়। এই গল্প শরীর-মনে মেখে আমরা প্রায় সব মেয়ে চুপ করে জীবন কাটিয়ে দেই। আমাদের ঘৃণার বিস্ফোরণ ঘটে না, প্রতিবাদের কণ্ঠ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে- একসময় রুদ্ধ হয়ে মিলিয়ে যায়। একটা শুধুমাত্র 'মেয়ে' জীবন যাপন করতে বাধ্য হই -মানুষের জীবন নয়! আর যদি কেউ মানুষের শক্তি, অধিকারবোধ আর কণ্ঠস্বর তার সপ্তকে তুলে দাঁড়াতে চায়- চতুর্দিক থেকে সবাই তেড়ে এসে তাকে থামিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। এরকমই দেখি। এরকম দেখে দেখেই বড় হই- একদিন বুড়ো হয়ে যাবো।

একটা বিষয় খুব স্পষ্ট, এতোগুলো উদাহরণের মূল জায়গাটা কিন্তু ওই, একটি কিশোরী বা তরুণী তার মেয়ে পরিবারের যারা আপনজন, তাদের কাছেও নিরাপদ নয়। অধিকাংশ যৌন নির্যাতনের প্রথম অভিজ্ঞতা ওই পরিবারের মধ্য থেকে, আপনজনের হাতে! এবং তারপরে শুরু হয় একে লুকানো- পরিবারের সম্মান রক্ষার স্বার্থে। মেয়েটির সম্মান, মানসিক শারীরিক বিধ্বিস্ততা কারো কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়! বাংলাদেশে একটি কিশোরী মেয়ের বড় হওয়ার মতন বিড়ম্বনা বোধকরি আর কিছুই নয়। রাস্তায় নোংরা চোখ, নোংরা হাত এড়িয়ে যদি বাড়ি পর্যন্ত ফিরে আসা যায় , সেখানে অপেক্ষা করে থাকে আর এক অন্ধকার হাত, আর এক নোংরা চোখ। একটি মেয়ের ওড়নার বহর বাড়তে বাড়তে শাড়ির প্রশস্ততা ছাড়িয়ে গেলেও তার শরীর কিছুতেই আর ঢাকা হয় না। কতোবার যে রাস্তায় বেরিয়ে পাশ থেকে হেঁটে যাওয়া মধ্যবয়সী লোকটির চাহনি দেখে মনে হয়েছে এক্স্রে করে দেখে নিচ্ছে! জামার নিচে, চামড়ার নিচে, রক্তের মধ্যে, হাড়ের আড়ালে কী আছে সব দেখে নিচ্ছে। যেন আমি মানুষ নই- মাংসপিন্ড মাত্র! আর আমার শরীরে যৌনাংগ ছাড়া আর কিছু নেই! কতোবার বাড়ি ফিরে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে ইচ্ছে করেছে ঘষে ঘষে চামড়া তুলে ফেলে দিই- তবে যদি এই কদর্য দৃষ্টি ধুয়ে ফেলা যায়!

আমি নারীবাদী নই। কিন্তু সত্য বলতে গেলে আমায় স্বীকার করতে হবে- আমার এ পর্যন্ত কাছে থেকে দেখা খুব কম পুরুষকেই আমি দেখেছি নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে। নারীর ওপরে অন্যায় অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যাদের দেখেছি তাদের দলে আমার বাবাও পড়বেন- অন্যদের কথা না হয় বাদ দিলাম।
তুমি মেয়ে তাই তুমি উঠবে আমার কথায়, বসবে আমার কথায়, হাঁটবে আমার কথায়, রাস্তায় বেরোবে আমার কথায়, আমি চাইলে তুমি পড়তে স্কুলে যাবে, আমি চাইলে তুমি বই ফেলে দিয়ে রান্নাবান্না সূচীশিল্পের কাজ শিখবে। আমি তোমাকে অচেনা পুরুষের সাথে বিয়ে দেবো, আমি দরকার হলে সেখান থেকে তোমাকে ছাড়িয়ে আনবো-- তুমি যেহেতু মেয়ে, তাই তোমার নিজের কোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা কিংবা অধিকার নেই। আর স্বাধীনতা- আমি চাইলে তোমাকে একটু বা বেশি স্বাধীনতা দিতে কিংবা না দিতে পারি। একটা মেয়ের জীবন থেকে তার প্রাপ্ত স্বাধীনতা, অধিকার কেড়ে নেয়াও নির্যাতন। পার্থক্য শুধু- এই নির্যাতন আমাদের চোখেই পড়ে না- শুধু ভিক্টিম জানে তার কষ্ট, অথবা জানেও না। শুধু ব্যাথার জায়গাটা চেনে সে। কারণ খোঁজার সাহসও তার কোনদিন হয় না!

এবার একটু প্রতিবাদের কথা বলি। নয় বছর বয়সে যে মধ্যবয়ষ্ক লোকটি অন্ধকার ঘরের কোনে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন- তাকে সেদিন কিছু বলার ক্ষমতা আমার ছিল না, আমার মা পারিবারিক সকল বাঁধার সামনে দাঁড়িয়ে ওই লোক আর তার পরিবারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় শিক্ষক যেদিন শাড়ির আঁচল ছাপিয়ে হাভাতের মতন শরীর দেখতে শুরু করলো- লোকটাকে সাহস করে বলতে পেরেছিলাম- আপনার থেকে কুকুরের দৃষ্টিও বেটার। তখনও আমি জানতাম না- কুকুরের দৃষ্টি আসলে মানুষের থেকে সুন্দর। একুশের বইমেলায় যে ছেলেটি ভীড়ের মধ্যে বুকে হাত দিয়েছিলো- আমার দুই হাতের দশটা নোখ বিদ্ধ করে আঁচড়ে দিয়েছিলাম তার মুখ- যতোদিন আয়নায় নিজের চেহারা দেখবে, কোনো মেয়ের বুকে হাত দেবার আর সাহস হবে না!

কিন্তু, তারপর? যে লোকটা বছরের পর বছর নিজের অসুস্থতার কথা গোপন রেখে আমার চার চারটা শিশুকে পৃথিবীতে আসতে দিল না- এক অর্থে পর পর নিহত করলো, তাকে কি কিছু বলতে পেরেছিলাম? পারিনি; বরং তার সাথেই শুতে হয়েছে বছরের পর বছর। অনবরত মানসিক নির্যাতন সহ্য করে সংসার নামক জোয়াল কেঁধে করে টেনে নিয়ে যেতে হয়েছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত সময়। নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গ এলে সবাই শরীরের আঘাতের কথা বলে। কিন্তু আমি বলি- মানসিক নির্যাতন এর থেকে অনেক বেশি ভয়াবহ! - তুমি কিছু পারো না, তুমি কিছু জানো না, তোমার দ্বারা কিছু হবে না, তুমি আর যাবেটা কোথায়, হয়েছো তো একটা মেয়ে--- এগুলো নির্যাতন! আমার গালে একটা চড় মারলে যেমন ব্যথা লাগে, আমায় অপমান করলে তার থেকেও বেশি ব্যথা লাগে। শুধুমাত্র আমি মেয়ে বলে এই ব্যথা দেয়া, এই অপমান করার কোনো অধিকার কারও নেই। এই অনধিকারচর্চা এক অর্থে নির্যাতন। যে নির্যাতন সহ্য করতে করতে মানুষ একদিন নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভাবতে শুরু করে-- এর প্রতিবাদ করা দরকার।

যে প্রতিবাদ আরেক বৈশাখে, বাংলাদেশের অন্যান্য শহরের তরুণদের মাঝে দেখলাম তাতে সাহসে বুক বাঁধতে ইচ্ছে করে- নিশ্চই আমাদের সন্ততিরা আমাদের থেকে নিরাপদ পৃথিবী পাবে। অথবা আমরাই বা কেন নয়- চাইলে অপরাজিতা আমরাই তো হতে পারি। আমাদের শক্তিমত্তা, সাহস, সবই আছে, শুধু প্রয়োজন নিজেকে আর একটু ভালো করে জানা।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার লিখেছেন চলুক

রাসিক রেজা নাহিয়েন

তিথীডোর এর ছবি

সাবাশ! চলুক
এতোকিছুর পরও লিখতে তো পেরেছেন। হাসি

মানসিক নির্যাতন সহ্য করে ভাঙা জোয়ালের সংসার টানার এই টিপিক্যাল মানসিকতাটা দূর করতে হবে। বিবাহ এমন কোন জনম -জন্মান্তরের আরাধ্য গিঁট না যে দড়ি ফেঁসে গেলেও লোকে কী বলবে, কই গিয়ে দাঁড়াবো সেসব ভেবে লাথিগুঁতা খেয়ে আর গালিগালাজ শুনেও ছেঁচড়ে টেনে নিতেই হবে।

যে নির্যাতন সহ্য করতে করতে মানুষ একসময় নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভাবতে শুরু করে, সোয়ামী মহারাজ যাতে সেটা শুরু করার মতো আদৌ সাহস-ই না পায়, সংসার হিমাচলে ঢোকার আগে পায়ের নিচের মাটি সেরকম শক্ত করা জরুরি।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

রানা মেহের এর ছবি

লেখাটা পড়ে অনেক ভাল লাগলো। অনেক কষ্ট হলো।

মানসিক নির্যাতন কখনো কখনো এমনকি শারিরীক নির্যাতন থেকেও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
তুমি পারোনা এই কথাটা দিয়ে একটা মানুষকে যেভাবে তিলে তিলে শেষ করে দেয়া যায়, এই জিনিসটা আসলে ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না।

আর নারীর কন্ঠ? সমাজ ধরেই নেয় নারী হবে কোকিলের মতো মধুক্ষরা। সে খাবে দাবে কলকলাবে আর খোকাকে ঘুম পাড়াবে। এই কলকলের ফাঁকে নারী নারীই রয়ে যায়, মানুষ আর হওয়া হয়না তার।

লেখা চলুক। এই কথাগুলো সামনে আসা জরুরী।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

আয়নামতি এর ছবি

আমাদের শক্তিমত্তা, সাহস, সবই আছে, শুধু প্রয়োজন নিজেকে আর একটু ভালো করে জানা।

একথায় ভরসা থাকুক। লিখুন ভাই আরো। শুভকামনা।

সুমিমা ইয়াসমিন এর ছবি

আমাদের শক্তিমত্তা, সাহস, সবই আছে, শুধু প্রয়োজন নিজেকে আর একটু ভালো করে জানা।

ঠিক তাই। নিজেকে জানতে হবে। এবং নিজেকে সাহায্য করতে হবে নিজেরই।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঐযে বইমেলাতে একটা ইতরের মুখে দুহাতের দশটা নখ বিঁধিয়ে দিয়েছিলেন অমনটাই আসলে করতে হয়। আপনার মা জানোয়ারের সাথে বসবাসকে অস্বীকার করেছিলেন। তার মানে, প্রতিবাদের ব্যাপারটি আগে থেকেই আপনার কোষে কোষে লেখা আছে। প্রতিটা প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ঘটনাই আপনাকে আপনার নিজের কাছে আরেকটু ভালো করে জানিয়ে দেবে, চিনিয়ে দেবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

rtl এর ছবি

অথবা আমরাই বা কেন নয়- চাই্লে অপরাজিতা আমরাই তো হতে পারি।

একমত চলুক

চরম উদাস এর ছবি

চলুক

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

অপরাজিতা হয়েই থাকুন।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

এভাবেই থাকুন, অপরাজিত হয়ে।

মানসিক যন্ত্রনা পাবার সমস্যাটা কি জানেন? এর কথা না কাউকে বলা যায়, না কাউকে বোঝানো যায়। সবাই যতই বলুক এরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে আমিও গিয়েছি, তা আসলে কখনই হয়না! Nobody can actually be in anybody else's shoe!

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।