দরজা চোর - ১

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৭/০৭/২০১৫ - ১২:৫৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(আগের পর্ব)

এমআইটিতে ছাত্রদের বিভিন্ন গ্রুপ আছে, ফ্রেটার্নিটি বলে এগুলোকে। প্রত্যেক ফ্রেটার্নিটিই নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রদের দলে নিতে নবীন বরণের মত একটা অনুষ্ঠান করতো, সেই অনুষ্ঠানকে বলা হত স্মোকার পার্টি। ইহুদি ছাত্রদের একটা ফ্রেটার্নিটি ছিলো, নাম ‘ফাই বেটা ডেল্টা’। এমআইটিতে যাবার আগেই নিউ ইয়র্কে তাদের একটা সভায় ডাক পেয়েছিলাম। তখনকার দিনে ইহুদি অথবা ইহুদি পরিবারে বড় হওয়া ছেলেদের জন্য ওই একটাই জায়গা ছিলো। ইহুদিদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য আমার আলাদা করে তেমন কোনো ইচ্ছা ছিলো না, আর দেখলাম ধর্মীয় ব্যাপারে ফাই বেটা ডেল্টার খুব একটা কড়াকড়িও নেই। সত্যি বলতে কি, আমি ধর্ম বিশ্বাস বা পালন কোনোটাই করতাম না। ওখানকার কয়েকজন আমাকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করলো, তারপর দুয়েকটা উপদেশও দিলো। একটা উপদেশের কথা মনে আছে - ওরা বলেছিলো আমি যেন প্রথম বছরেই যেন ক্যালকুলাস পরীক্ষা দিয়ে দিই, তাহলে পরে আর ক্যালকুলাস কোর্সটা নিতে হবে না। উপদেশটা কাজে লেগেছিলো। ওই ফ্রেটার্নিটির ছেলেদের ভালোই লাগলো, তাই আমি ওদের সাথেই যোগ দিই। আর যে দুজন আমার সাথে কথা বলতে এসেছিলো, পরে আমি তাদেরই রুমমেট হয়েছিলাম।

ইহুদি ছাত্রদের আরেকটা ফ্রেটার্নিটি ছিলো, নাম ছিলো ‘সিগমা আলফা মিউ’। তারা আমাকে বস্টনে নিয়ে গিয়ে তাদের সাথে থাকতে বললো, আমিও তাদের সাথে একটা ঘরে প্রথম রাতটা কাটিয়ে দিলাম। পরদিন সকালে উঠে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি অন্য ফ্রেটার্নিটির যে দুজনের সাথে নিউ ইয়র্কে দেখা হয়েছিলো তারা এসে হাজির, সিগমা আলফা মিউয়ের কয়েকজনের সাথে ইতোমধ্যে আলোচনা সভা বসিয়ে দিয়েছে। জানালা দিয়েই চেঁচিয়ে বললাম, “দেখুন আমার আসলে ওদের সাথেই থাকার কথা।”। বলেই চলে গেলাম। আমার তখনো খেয়াল হয়নি যে ওরা আসলে আমাকে দলে ভিড়াতেই এতকিছু করছিলো, তাই পৌঁছে দেওয়ার জন্য তেমন কৃতজ্ঞতাও বোধ করিনি।

ফাই বেটা ডেল্টা ফ্রেটার্নিটিটা আগের বছর দুটো দলে ভাগ হয়ে প্রায় শেষই হয়ে যাচ্ছিলো। একটা দলে ছিলো সমাজের উঁচু তলার ছেলেরা, যাদের পছন্দের কাজ ছিলো বিভিন্ন নাচের পার্টিতে যাওয়া আর পার্টি শেষে গাড়িতে করে ঘোরা। আরেকটা দলের ছেলেরা ছিলো ঠিক উলটো স্বভাবের - পার্টি-টার্টি বাদ দিয়ে দিনরাত পড়ত তারা। আমি ওখানে যাওয়ার কিছুদিন আগে এই দুটো দল একটা বড় মিটিং করে একটা পারস্পরিক সমঝোতায় আসে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় ফ্রেটার্নিটির সবাই পরস্পরকে সাহায্য করবে। প্রত্যেককে পরীক্ষায় একটা সর্বনিম্ন গ্রেড ধরে রাখতে হবে। সেখানে কেউ পিছিয়ে পড়লে পড়ুয়া সদস্যরা তাদের পড়াবে। আবার প্রত্যেক সদস্যকে প্রতিটা নাচের অনুষ্ঠানেও যেতে হবে। সেখানে কেউ যদি নাচের সঙ্গী না পায় তাহলে অন্যরা তাকে সঙ্গী খুঁজে দেবে। নাচতে না জানলে নাচও শিখিয়ে দেবে। মানে ব্যাপারটা দাঁড়ালো এমন যে এক দল অন্য দলকে চিন্তা করতে শেখাবে, আর অন্য দলটা তাদের শেখাবে সামাজিকতা।

আমার ঠিক এটাই দরকার ছিলো, কারণ আমি বরাবরই অসামাজিক। আমি এতই লাজুক ছিলাম যে সিঁড়িতে বড়ভাইরা বান্ধবীদের সাথে বসে থাকলে পাশ দিয়ে যেতে হলেও সঙ্কোচে একেবারে পাথর হয়ে যেতাম। আর মেয়েদের কেউ যদি বলে বসত “ছেলেটা তো সুন্দর!”, তাহলে তো আর উপায় ছিলো না!

এর কদিন পর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা তাদের বান্ধবী আর বান্ধবীর বান্ধবীদের নিয়ে এলো আমাদের নাচের তালিম দিতে। এদের একজন পরে আমাকে গাড়ি চালাতেও শিখিয়েছিলো। আমাদের মত আঁতেল ছাত্রদের আরেকটু সামাজিক করে তুলতে ওদের বেশ খাটতে হয়েছিলো। ‘সামাজিক হওয়া’ মানে যে ঠিক কী এটা বুঝতে আমারও বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো। মেয়েদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটা ওদের কাছ থেকে ‘শিখে নেওয়ার’ পর একদিন এক রেস্টুরেন্টে খেতে গেছি, একাই। সেখানে খুব চেষ্টা করে সমস্ত সাহস এক করে এক ওয়েট্রেসকে পরের নাচের পার্টিতে আমার সঙ্গী হতে আমন্ত্রণ জানালাম, সেও রাজি হয়ে গেলো!

ফিরে এসে দেখি আমার সঙ্গী কীভাবে জোগাড় হবে তা নিয়েই আলোচনা হচ্ছে - বললাম আর দরকার নেই, আমি নিজেই সঙ্গী খুঁজে নিয়েছি। ব্যাপারটা গর্বের বৈকি। কিন্তু সঙ্গীটি ওয়েট্রেস শুনে বড়ভাইদের একটু আঁতে ঘা লাগলো। সোজা বলে দিলো এসব চলবে না, তারাই আমার জন্য একজন ‘উপযুক্ত’ সঙ্গী খুঁজে দেবে। তাদের হাবভাব দেখে মনে হলো আমি বোধহ্য় বিরাট একটা ভুল করে ফেলেছি। কাজেই ব্যাপারটা তারা নিজেদের হাতে নিয়ে নিলো। সেই রেস্টুরেন্টে গিয়ে সেই ওয়েট্রেসকে আমার সাথে না যাবার জন্য রাজি করিয়ে এলো, তারপর অন্য একটা মেয়েকেও জুটিয়ে ফেললো। পুরো ব্যাপারটা অনেকটা বনেদি বাবার বখে যাওয়া ছেলেকে লাইনে আনার মতো লাগলো, যদিও আমার ভালো লাগেনি সেটা। আসলে তখন সবে ভর্তি হয়েছি, প্রতিবাদ করার মতো আত্মবিশ্বাস তখনও আমার হয়নি।

ফ্রেটার্নিটিতে যোগ দেওয়ার অংশ হিসেবে বড়দের নানারকম উৎপাত আর হাসিতামাশা সহ্য করতে হত। একদিন আমাদের কয়েকজনকে চোখ বেঁধে অনেক দূরে একটা শীতে জমে যাওয়া লেকের উপর রেখে আসা হলো। চারপাশে কিছুই নেই - ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট কিচ্ছু না - সেখান থেকে আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে ফ্রেটার্নিটিতে! বয়স কম ছিলো তো, কমবেশি ভয় পেয়েছিলো সবাই। একজন বাদে - মরিস মেয়ারকে দেখলাম একটুও ভড়কায়নি। ছেলেটা সারাক্ষণই হাসিমুখে থাকে, ফালতু কৌতুক বলে হাসানোর অপচেষ্টাও করে মাঝেমধ্যে। এই সঙিন অবস্থায়ও সে বলে, “হে হে, বেশ মজা তো!”। মেজাজটাই খারাপ হচ্ছিলো ওকে দেখে। কোথায় যাবো কী করবো ঠিক নেই, এর মধ্যে ব্যাটা দাঁত বের করে হেলেদুলে হেঁটে বেড়াচ্ছে!

হাঁটতে হাঁটতে একটা চৌরাস্তায় এসে পৌঁছলাম। কিন্তু চারপাশে কিছুই নেই, কোন রাস্তা ধরে এগোবো বুঝতে পারছি না। এমন সময় মরিস এসে একটা রাস্তা দেখিয়ে বললো, “এদিক দিয়ে চলো।”

মেজাজ এমনিতেই খারাপ, এই কথা শুনে বললাম, “কেন? এদিকে কেন? সেই তখন থেকে তো ফাজলামি করেই বেড়াচ্ছ, কোনদিকে যেতে হবে তুমি তার কী জানো?”

“এ তো সহজ ব্যাপার, টেলিফোন লাইনগুলো দেখো। যেদিকে বেশি তার গেছে, সেন্ট্রাল স্টেশনটা নিশ্চয়ই সেদিকেই হবে।”

যাকে দেখে এতক্ষণ সমস্যাটা নিয়ে একটুও চিন্তিত মনে হয়নি, সেই কী চমৎকার একটা সমাধান বাতলে দিলো! এরপর আমরা আর কোনো ভুল না করে সোজা হেঁটে শহরে চলে গেলাম।

পরের দিন ছিলো আমাদের, মানে নতুন ছাত্রদের সাথে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রদের দড়ি টানাটানি আর কাদার মধ্যে কুস্তি। সেদিন সন্ধ্যার পর দ্বিতীয় বর্ষের বেশ ক’জন এসে হাজির, তাদের মধ্যে আমাদের ফ্রেটার্নিটিরও কয়েকজন ছিলো। তারা এসেছিলো আমাদের ‘অপহরণ’ করতে, যাতে পরের দিন আমরা জিততে না পারি।

ওরা আমাদের প্রায় সবাইকেই বেঁধে ফেললো খুব সহজে - কেবল আমাকে ছাড়া। আমি চাইনি ওখানে কেউ আমাকে নরমসরম মানুষ ভাবুক। এমনিতেই খেলাধুলায় আমি কখনো ভালো ছিলাম না। খেলার সময় বেড়ার উপর দিয়ে কোনো টেনিস বল উড়ে এলে আমার হত বিপদ - ওটা আবার বেড়া টপকে ফেরত পাঠাতেও পারতাম না আমি, এমনই ছিলো হাতের টিপ। কিন্তু এই নতুন জায়গায় এসে মনে হলো, এখানে আমার নিজের একটা শক্ত ভাবমূর্তি নিজেকেই গড়তে হবে। তাই ঠিকমত মারামারি করতে না জানলেও ‘অপহরণকারীদেরকে’ সেটা বুঝতে দিলাম না, লড়ে গেলাম প্রাণপণে। শেষমেশ ওদের তিন-চারজন মিলে আমাকে বাঁধতে পারলো। তারপর ওরা আমাদের নিয়ে গেলো দূরে বনের কাছে একটা কাঠের বাড়িতে, সেখানে মেঝের সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখলো আমাদের।

পালানোর সবরকম চেষ্টাই করলাম, কিন্তু সবসময় ওদের কেউ না কেউ পাহারায় ছিলো, তাই পারলাম না। একটা ছেলের কথা আলাদা করে মনে আছে - ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছিলো তার, থরথর করে কাঁপছিলো - ওকে বেঁধে রাখতেও ভয় পাচ্ছিলো ওরা। পরে জেনেছিলাম ছেলেটা এসেছিলো ইউরোপ থেকে, বয়স সবে বিশ পেরিয়েছে। সে বোঝেইনি পুরো ব্যাপারটা আসলে একটা মজা।

রাতে মাত্র তিনজন ছিলো পাহারায়, কিন্তু আমরা সেটা বুঝতেই পারিনি। আমরা যাতে বুঝতে না পারি সেজন্য ওরা একটাই গাড়ি নিয়ে আসা যাওয়া করছিলো ওখানে, যাতে মনে হয় অনেক লোকজন আছে। আমরাও কিছু বুঝিনি, তাই রাতটা কাটলো ওখানে শুয়ে শুয়েই।

ঘটনাক্রমে পরদিন সকালেই মা-বাবা বস্টনে এলেন তাঁদের ছেলেকে দেখতে। আমাদের ‘অপহরণ’ ধামাচাপা দিতে ফ্রেটার্নিটির বাকিরা নানারকম ভুুজুংভাজুং বোঝাচ্ছিলো তাঁদের। মারামারি করে আর রাতে না ঘুমিয়ে আমার চেহারাটাও হয়েছিলো দেখার মতো! মা-বাবা দুজনেই বেশ ভড়কে গেছিলেন এমআইটিতে তাঁদের ছেলেকে ওই অবস্থায় দেখে।

আমার ঘাড়েও ব্যথা হয়েছিলো। পরদিন বিকালে আরওটিসির লাইনে ঘাড় বাঁকা করে দাঁড়িয়ে আছি, কমান্ডার এসে আমার মাথাটা ধরে সোজা করে দিতে গেলেন। ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে বললাম, “পারছি না, স্যার!”। সাথে সাথেই উনি “ওহ, দুঃখিত” বলে ছেড়ে দিলেন আমাকে।

তবে কাজের কাজ একটা হয়েছিলো - সেই কঠিন লড়াইয়ের পর আমার নাম ছড়ালো ভালোমতোই। সেই নরমসরম মানুষের ভাবমূর্তি আর রইলো না, সে দুশ্চিন্তা থেকে একেবারে মুক্ত হয়ে গেলাম আমি।

আমার দুই রুমমেটই ছিলো আমার সিনিয়র, মাঝে মাঝেই তাদের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান কোর্সের আলোচনা শুনতাম। একদিন দেখলাম একটা অঙ্ক নিয়ে দুজনেই হিমশিম খাচ্ছে, কিন্তু আমার কাছে সেটা সহজই মনে হল। বললাম, “তোমরা বারনোল্লাইয়ের সমীকরণটা কাজে লাগাচ্ছ না কেন?”

“সে আবার কী?”, দুজনেই বলল অবাক হয়ে।

বুঝিয়ে বললাম কীভাবে কী করতে হবে। দেখা গেলো সমীকরণটা ওরাও জানে, আর এটাকে বলে বার্নুলির সমীকরণ (Bernoulli’s equation)। আমি এটা শিখেছি কোনো একটা এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে, কারও সাথে কখনও কোনো কথা বলিনি এটা নিয়ে, তাই নামটার উচ্চারণ জানতাম না।

রুমমেট দুজনের জন্য ভালোই হলো, এর পর থেকে পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যাগুলো তারা আমাকে সাথে নিয়েই আলোচনা করত। সবসময় যে আমি সমাধান করতে পারতাম তা নয়, কিন্তু এর ফল পাওয়া গেলো পরের বছর। আমি যখন কোর্সটা নিলাম, এগিয়ে যেতে লাগলাম তরতর করে। কোনো কিছু শেখার দুটো ভালো উপায় জানলাম - উপরের ক্লাসের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা, আর শব্দের উচ্চারণ ঠিকভাবে করা।

রেমর অ্যান্ড প্লেমোর বলরুম নামে একটা জোড়া বলরুম ছিলো ওখানে, মাঝে মাঝে মঙ্গলবার রাতে আমি ওখানে যেতাম। আমার ফ্রেটার্নিটির ছেলেরা এসব ‘সবার জন্য উন্মুক্ত’ নাচের অনুষ্ঠানে যেত না, যেত নিজেদের অনুষ্ঠানে, সাথে থাকত তাদের ‘উপযুক্ত’ নৃত্যসঙ্গী। নতুন কারও সাথে দেখা হলে সে কোত্থেকে এসেছে, কী করে এসব নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা ছিলো না, তাই এসব উন্মুক্ত নাচের অনুষ্ঠানে আমি যেতাম। ফ্রেটার্নিটির বড়ভাইদের এটা পছন্দ হত না। কিন্তু ততদিনে আমিও তো আর প্রথম বর্ষের বাচ্চা ছেলে নই, তাই তাদের চোখ রাঙানির তোয়াক্কা করতাম না।

একদিন একটা মেয়ের সাথে কয়েকবার নাচলেও কথা তেমন বলা হয়নি। শেষে মেয়েটিই অস্পষ্টভাবে কী যেন একটা বলল। বুঝলাম ও কথা বলতে পারে না ঠিকমতো। আবছাভাবে মনে হলো আমার নাচের প্রশংসা করলো, তাই বললাম, “ধন্যবাদ”। এরপর একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম আমরা। ওখানে মেয়েটির এক বান্ধবী ও তার নাচের সঙ্গী ছেলেটাও ছিলো। দেখা গেলো আমাদের চারজনের মধ্যে একটা মেয়ে কানে শোনে না, আরেকজন প্রায় বোবা। এই মেয়েদুটো নিজেদের মধ্যে ইশারা-ইঙ্গিতে কথাবার্তা চালিয়ে গেলো। বুঝলাম না সেসবের কিছুই। তবে তাতে কিছু আসে যায় না, আমার সঙ্গী মেয়েটি নাচেও ভালো, মানুষও ভালো।

আরও কয়েকদফা নাচের পর আবার আমরা চারজন একই টেবিলে বসলাম। মেয়েদুটো ইশারায় কথা বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে - তারপর আমার সঙ্গীটি জানতে চাইলো (মানে আমি তার অস্পষ্ট কথা থেকে যা বুঝলাম) আমরা ওদের সাথে একটা হোটেলে যেতে চাই কি না। সাথের ছেলেটাকেও আমি জিজ্ঞেস করলাম একই কথা।

“হোটেলে? কেন?” জানতে চাইলো সে।

“জানি না, ওর সাথে তো আমার তেমন কোনো কথাই হয়নি - তাও দেখা যাক।”, বললাম আমি। আসলেই তো, কী হবে এত ভেবে? দেখাই যাক না কী হয় শেষমেশ!

ছেলেটা ভয় পেয়েছে মনে হলো, সোজা না করে দিলো। কাজেই আমি একাই মেয়ে দুটোর সাথে একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম ওখানে। গিয়ে দেখি ওখানে একটা নাচের অনুষ্ঠান চলছে, আর অংশগ্রহণকারীরা সবাই বোবা নয়তো বধির। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! তারা সবাই ক্লাবের সদস্য। দেখলাম ওরা সবাই সঙ্গীতের তালটা ঠিকই বুঝতে পারে, আর তার সাথে নাচেও। আবার নাচের শেষে সবাই একসাথে হাততালিও দিচ্ছে।

অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। মনে হলো যেন আমি এমন একটা দেশে এসে পড়েছি যেখানকার ভাষার বিন্দুবিসর্গও জানি না। আমি কথা বললেও কেউ শুনবে না। সবাই সবার সাথে কথা বলে যাচ্ছে নীরব ইশারায়, আর আমি তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার সাথের মেয়েটিকে বললাম আমাকে কিছু ইশারা শিখিয়ে দিতে, ঠিক যেমন বিদেশে গিয়ে আমরা সেখানকার ভাষার দুয়েকটা শব্দ শিখি।

সবাই কথা বলছে, হাসছে - কিন্তু কাউকে দেখে মনে হলো না যে এভাবে যোগাযোগ করতে তার কষ্ট হচ্ছে। আসলে এই ইশারাগুলো তো একটা ভাষাই, অন্য ভাষার সাথে এর পার্থক্য হলো এটা নিঃশব্দ। আরেকটা ব্যাপার দেখলাম, সবাই খুব ঘন ঘন ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ে। বুঝতে পারলাম কেন। দুজনের কথার মধ্যে যদি তৃতীয় কেউ কথা বলতে চায়, কিংবা কেউ যদি কাউকে ডেকে কিছু বলতে চায়, তাহলে তারা তো আর মুখে কিছু বলতে পারবে না, তাই ‘শ্রোতারই’ দায়িত্ব সেদিকে নজর রাখা।

সবাই সপ্রতিভ, সচ্ছন্দ - এর মাঝে আমিই শুধু জড়সড়। সমস্যাটা তো আমারই। তারপরেও, অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা।

নাচ চললো অনেকক্ষণ, তারপর সবাই মিলে গেলো একটা ক্যাফেটেরিয়ায়। সবাই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে অর্ডার দিচ্ছে। একজন আমার সঙ্গীটিকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কোত্থেকে এসেছে। মেয়েটিও বানান করে দেখালো “নি-উ-ই-য়-র্ক”। আমাকেও সবাই খুব সহজভাবেই নিয়েছিলো।

কাউন্টারে এক বোতল দুধের অর্ডার দিতে গেলাম। কাউন্টারের লোকটাকে শুধু মুখ নেড়ে নিঃশব্দে “দুধ” বলে বোঝাতে চাইলাম, বুঝলো না।

এরপর ইশারায় বোঝাতে চাইলাম। ইশারা বলতে দুই হাত মুঠো করে উপর-নিচ করা, দুধ দোয়াতে গেলে মানুষ যেটা করে। লাভ হলো না।

দুধের দাম লেখা কাগজটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখালাম, লোকটা বুঝলো না ঠিক কোনটা দেখাচ্ছি।

এমন সময় পাশেই আরেকজন দুধের অর্ডার দিলো, সাথে সাথে আঙুল দিয়ে দেখালাম সেটা।

“ও! দুধ!”, বলে উঠলো লোকটা, আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

দুধের বোতলটা হাতে নিয়ে বললাম, “অনেক ধন্যবাদ।”।

“পারোও বটে তুমি”, বলে উঠলো লোকটা, মুখভরা হাসি।

(পরের পর্বে বাকি অংশ)

- উদ্দেশ্যহীন


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

সঙ্গে আছি, ভাল লাগছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ হাসি

সো এর ছবি

ঝরঝরে অনুবাদ। হাততালি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগছে, চলুক।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ পড়ার জন্য হাসি

আবদুর এর ছবি

চালিয়ে যান, ভালো লেগেছে, পরের পর্বের জন্য বসে রইলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দারুণ অনুবাদ। পড়ছি

অতিথি লেখক এর ছবি

লীলেনদা, আপনি পড়েছেন আমার লেখা! উৎসাহ পেলাম আরও লেখার।

অনেক ধন্যবাদ! হাসি

- উদ্দেশ্যহীন

তাহসিন রেজা এর ছবি

বইটি পড়া আছে।
তবু চমৎকার অনুবাদটি পড়ে ভালো লাগল।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

সত‌্যিই খুব সাবলীল অনুবাদ। চলতে থাকুক। আে গত পর্বে বোধহয় একজন পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রতিটি পর্বের আলাদা নাম না দিয়ে একটা নামেই ১,২ এভাবে এগোতে। তাহলে আমাদেরও অনুসরণে সুবিধা হয়। চাইলে পর্বের নামগুলো প্রতিটি লেখার শুরুতে বড় ও বোল্ড করে দিতে পারেন।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ প্রফেসর হাসি

এরকম পরামর্শ কেউ দিয়েছেন বলে দেখছি না, তবে পরামর্শটা ভালো। আমারও মাথায় চিন্তা ছিলো কীভাবে সিরিজ আকারে লেখাগুলো রাখা যায়। উপায় না দেখে ট্যাগে রিচার্ড ফাইনম্যান আর আমার নিকটা বসিয়ে দিয়েছি, রিচার্ড ফাইনম্যান ট্যাগে খুঁজলেই এই সিরিজের সব লেখা পাওয়া যাবে। আর প্রত্যেক পর্বের শুরুতে দিয়ে দিচ্ছি আগের পর্বের লিঙ্ক। বইয়ের নামেও একটা ট্যাগ দেওয়া উচিত ছিলো হয়তো।

আরেকটা কারণ আছে। এই বইয়ের অধ্যায়গুলোতে যেসব কাহিনী বর্ণিত আছে সেগুলো পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত নয়। একটা সময়ানুক্রম আছে, কিন্তু বইটা পড়তে সেই অনুক্রম মেনে চলা জরুরি নয়। তাই পুরো বইয়ের নামের সাথে নম্বর না দিয়ে অধ্যায়গুলোকে যার যার নাম দিয়ে লিখছি। আর বড় অধ্যায়গুলো ভেঙে লিখতে হলে (যেমন এইটা) অধ্যায়ের নামের সাথে নম্বর দিয়ে দিচ্ছি। আর রিচার্ড ফাইনম্যান ট্যাগে তো সবগুলো লেখা পাওয়াই যাবে।

- উদ্দেশ্যহীন (কেন যে নাম লিখতে ভুলে যাই বারবার মন খারাপ )

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

পোফেসার সায়েবের মন্তব্যে ভুটাইলাম হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার পপকর্ন কি শেষ হয় না? খাইছে

- উদ্দেশ্যহীন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।