হাতি শিকার

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ১০/১০/২০১৫ - ৩:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বেশ অনেকদিন পর আবার লিখতে বসলাম। কিছুদিন থেকে ভাবছিলাম ফাইনম্যানকে আপাতত বসিয়ে রেখে অন্য কিছু অনুবাদ করি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়া জর্জ অরওয়েলের Shooting an Elephant গল্পটা মনে বেশ দাগ কেটেছিল, তাই ওটাই অনুবাদ করলাম।

-----------------------------------------------------------------------------------------------

বার্মার মুলমিনে থাকার সময় টের পেলাম, জীবনে আর কখনও নিজেকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি আমার। কারণ ওখানে আমাকে একেবারেই দেখতে পারে না এমন লোক ছিলো বিস্তর। আমি ছিলাম ওখানকার সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার। ইউরোপীয়দের প্রতি সেখানকার মানুষের এক রকম বিতৃষ্ণা ছিলো। বড় রকমের দাঙ্গা-হাঙ্গামা করার মতো সাহস কারও হতো না বটে, কিন্তু বাজারের ভিতর দিয়ে কোনও ইউরোপীয় নারী হেঁটে গেলে তার কাপড়ে পানের পিকের দাগটা খুঁজে পাওয়া যেতো ঠিকই। আর আমি তো ছিলাম পুলিশ, নিজের গা বাঁচিয়ে আমাকে অপদস্থ করার একটা সুযোগও ছাড়েনি কেউ। একদিন ফুটবল মাঠে এক বার্মিজ আমাকে দিব্যি ল্যাং মেরে ফেলে দিলো। দেখি রেফারি ব্যাটা, সেও আরেক বার্মিজ, উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে অন্য দিকে, দেখেইনি কিছু। ওদিকে মাঠের সব দর্শক হেসেই খুন হয়ে যাচ্ছে। এমন ঘটনা একবার নয়, বার বার হতো। যেখানেই যেতাম, দেখতাম এই হলুদমুখো লোকগুলোর ব্যাঙ্গবিদ্রূপ। সবচেয়ে শয়তান ছিলো কম বয়সের বৌদ্ধ ভিক্ষুগুলো। সারাদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে গুলতানি মারা আর ইউরোপীয় লোক দেখলেই টিপ্পনী কাটা ছাড়া যেন এদের আর কোনও কাজ নেই।

এই হতাশার মাঝে থাকতে থাকতে এক সময় মনের মধ্যে দুটো ধারণা বদ্ধমূল হলো- সাম্রাজ্যবাদ খুবই খারাপ জিনিস, আর এই চাকরিটা যত তাড়াতাড়ি ছাড়তে পারি ততই মঙ্গল। মনে মনে - এবং অবশ্যই গোপনে - আমি বার্মিজদের পক্ষেই ছিলাম, অত্যাচারী ব্রিটিশদের ভালো লাগতো না আমার। বিশেষ করে আমার চাকরিটার কারণেই এই ঘৃণাটা আরও বেড়ে গেছিলো। ব্রিটিশদের অত্যাচারগুলো আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। হাজতের দুর্গন্ধময় সেলে গাদাগাদি করে থাকা আসামী, দীর্ঘ মেয়াদের কয়েদিদের ফ্যাকাশে মুখ আর অসংখ্য বেতের দাগওয়ালা পিঠ - এসব দেখে দেখে মনে একটা অসহ্য অপরাধবোধ তৈরি হতো। কিন্তু বুঝতাম না অনেক কিছুই। তখন আমার বয়সও ছিলো কম, আর পড়াশোনায়ও ঘাটতি ছিলো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যে আস্তে আস্তে গুটিয়ে যাচ্ছে সেটাই বুঝতে পারিনি। শুধু বুঝতাম যে সাম্রাজ্যের অধীনে কাজ করি তার প্রতি ঘৃণা আর প্রতিনিয়ত আমার চাকরি-জীবনটাকে কঠিন করে তোলা বদমাশদের প্রতি আক্রোশ- এ দুয়ের মাঝে আমি আটকা পড়ে আছি। একদিকে মনে হতো ব্রিটিশ রাজ এই দুর্বল মানুষদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে যুগ-যুগান্তরের নির্যাতন, অন্যদিকে ভাবতাম একটা বৌদ্ধ ভিক্ষুর পেট বরাবর বেয়োনেট চালিয়ে দেবার মতো সুখ বুঝি পৃথিবীতে আর নেই। এই দ্বিধান্বিত চিন্তাধারাও সাম্রাজ্যবাদেরই ফসল। যে কোনো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অফিসারকে একান্তে এই কথা জিজ্ঞেস করলে তারাও এমনই উত্তর দেবে, আমি নিশ্চিত।

এর মধ্যে একদিন ঘটল এক ঘটনা। তেমন বড় কিছু না, কিন্তু সেটাই সাম্রাজ্যবাদ আর সরকারের শোষণের স্বরূপটা আমার সামনে আরও ভালো করে তুলে ধরল। ভোরবেলায় এক সাব-ইন্সপেক্টর আমাকে ফোন করে ডেকে তুলল। বলল একটা হাতি বাজার লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে, আমি যেন একটু যাই। ওখানে আমার কী করার আছে জানি না, কিন্তু ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখতে ইচ্ছে হল। তাই ঘোড়ায় চড়ে রওনা দিলাম। আমার পুরনো উইনচেস্টার রাইফেলটা সঙ্গে নিলাম, যদিও একটা হাতির সামনে ওটা একটা খেলনা ছাড়া কিছুই না। তবু নিলাম, অন্তত দরকার হলে শব্দ করে ভয় তো দেখানো যাবে। পথে কয়েকবার লোকজন আমাকে থামিয়ে হাতির কথা বলল। সব শুনে ব্যাপারটা মোটামুটি বুঝলাম। হাতিটা বুনো নয়, পোষা হাতি, ক্ষেপে গেছে। ক্ষ্যাপা পোষা হাতিকে সবাই শিকলে বেঁধে রাখে। এটাও বাঁধা ছিলো, কিন্তু আগের রাতে ওটা শিকল ভেঙে পালিয়েছে। এখন ওটাকে বাগ মানানোর ক্ষমতা একমাত্র ওটার মাহুত ছাড়া আর কারও নেই। সেই মাহুত কাল রাতে ওটার খোঁজে বেরিয়েছে, কিন্তু গেছে উল্টোদিকে। সকালে আবার যখন হাতিটাকে শহরে দেখা গেলো ততক্ষণে মাহুত প্রায় বারো ঘণ্টার পথ পেরিয়ে গেছে। বার্মিজদের কাছে অস্ত্র বলতে তেমন কিছু নেই, তাই অসহায়ের মতো দেখা ছাড়া কিছু করারও নেই। এর মধ্যে হাতিটা একটা বাঁশের ঘর ভেঙেছে, গরু মেরেছে একটা, আর বাজারের বেশ কয়েকটা ফলের দোকানে হামলা করে সাবড়ে দিয়েছে সব। এরপর সামনে পেয়েছে মিউনিসিপ্যালিটির আবর্জনার ট্রাক, উলটে দিয়েছে সেটাকে। ড্রাইভার কোনওমতে পালিয়ে বেঁচেছে।

বার্মিজ সাব-ইন্সপেক্টর কয়েকজন ভারতীয় কন্সটেবলকে নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ওখানকার লোকজন বেশ গরিব, ঘরগুলো সব বাঁশের তৈরি, উপরে তালপাতা দিয়ে ছাওয়া। বাড়িগুলো সব পাহাড়ের খাড়া ঢালে। এখনও মনে আছে, দিনটা কেমন গুমোট ছিলো, আকাশে মেঘ, বৃষ্টি হবে হবে ভাব। গিয়েই হাতিটা কোন দিকে গেছে জানতে লোকজনকে প্রশ্ন করতে লাগলাম, এবং যথারীতি নানাজনের নানা উত্তর শুনে বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। প্রাচ্যের দেশগুলোর এই এক সমস্যা। যে কোনো ঘটনাই দূর থেকে শুনে বেশ বোঝা যায়, কিন্তু ঘটনাস্থলের যত কাছে যাওয়া যায়, ততই সেটা ঝাপসা হয়ে আসে। কেউ বলে এদিকে গেছে, কেউ বলে ওদিকে, আবার কেউ কেউ তো বলেই বসল যে তারা কোনও হাতির কথা শোনেইনি! আমি প্রায় ধরেই নিচ্ছিলাম পুরো ঘটনাটা স্রেফ একটা গুজব, এমন সময় একটু দূরেই গোলমালের শব্দ শুনলাম। দেখি এক বুড়ি “সরে যা! ভাগ এখান থেকে!” বলে কতগুলো ন্যাংটো ছেলেপুলেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। আশেপাশে কিছু মহিলা দাঁড়িয়ে, তাদের মুখের ভাব দেখে বুঝলাম ওখানে এমন কিছু আছে যা বাচ্চাদের দেখার মতো নয়। গিয়ে দেখি ওখানে কাদার ভিতর একটা মানুষের লাশ পড়ে আছে। দেখে বুঝলাম লোকটা ভারতীয়। শরীরটা প্রায় নগ্ন, খুব বেশি আগে মারা যায়নি। মানুষের কথা থেকে যা বুঝলাম, হঠাৎ লোকটাকে সামনে পেয়ে হাতিটা তাকে শুঁড় দিয়ে ধরে পা দিয়ে মাটিতে পিষে ফেলে। বর্ষাকালে মাটি এমনিতেই নরম, তার মধ্যে শরীরটা প্রায় এক ফুট ভিতরে ঢুকে গেছে। উপুড় হয়ে দুহাত ছড়িয়ে পড়ে আছে দেহটা, মাথাটা মুচড়ে ঘুরে গেছে একপাশে। সারা মুখ কাদায় ঢাকা, চোখ খোলা, দাঁতগুলো সব বেরিয়ে গেছে যন্ত্রণায়। হাতির পায়ের ঘষায় পিঠের চামড়া পুরো উঠে গেছে। কাছেই এক বন্ধুর বাসায় হাতি শিকারের বন্দুক আছে, একজন আর্দালিকে পাঠিয়ে দিলাম ওটা আনতে। ঘোড়াটাকে আগেই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি, যাতে হাতির গন্ধ পেয়ে আবার ওটাও পাগল হয়ে না যায়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পাঁচটা কার্তুজসহ রাইফেলটা চলে এল। কয়েকজনের মুখে শুনলাম হাতিটা এখন ধানক্ষেতে। বেশি দূরে না, কয়েকশ গজ হবে। ওদিকে এগোতেই দেখি এলাকার প্রায় সবাই আমার পিছু পিছু আসছে। আমার হাতে রাইফেল দেখে নিজেরা বলাবলি করছে যে আমি হাতিটাকে মারতে যাচ্ছি। হাতিটা যখন সবকিছু তছনছ করছিলো তখন তাদের এত আগ্রহ ছিল না, কিন্তু এখন তাদের উৎসাহের কমতি নেই। পুরো ব্যাপারটা তাদের কাছে মজার, সেটা অবশ্য ব্রিটিশদের বেলায়ও হতো। আর আছে হাতির মাংসের আকর্ষণ। তাদের এই অতি-উৎসাহ দেখে আমি বেশ অস্বস্তিতে পড়লাম। হাতিটাকে গুলি করার কোনও ইচ্ছাই আমার ছিল না। রাইফেলটা আনিয়েছি স্রেফ বেকায়দা হলে আত্মরক্ষা করার জন্য। পিছনে ক্রমবর্ধমান মানুষের মিছিল নিয়ে রাইফেল ঘাড়ে আমি ঢাল বেয়ে নামতে লাগলাম। নিজেকে একটা আহাম্মক মনে হচ্ছিল। নিচের দিকে নেমে দেখি একটা পাথুরে রাস্তা।, আর তার ওপাশে প্রায় এক হাজার গজ জুড়ে ধান লাগানোর জন্য চষা জমি। হাতিটা আমাদের দিকে পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তা থেকে প্রায় আট গজ দূরে। এতগুলো মানুষের উপস্থিতি মোটেও টের পায়নি ওটা। শুঁড় দিয়ে গোছা গোছা ঘাস উপড়ে নিজের হাঁটুতে ঝেড়ে পরিষ্কার করে মুখে পুরছে।

আমি রাস্তার উপরে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাতিটাকে দেখার সাথে সাথে আমার মনে হল ওটাকে গুলি করা যাবে না। এত বড় একটা প্রাণীকে গুলি করা তো যা তা ব্যাপার নয়। বিশাল বড় আর দামী কোনো জিনিসকে ধ্বংস করে ফেলার মতোই লাগলো ব্যাপারটা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে হাতিটা খাচ্ছে - এ অবস্থায় ওটাকে দেখে একটা গরুর চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর লাগছে না। আমার মনে হলো ওটার পাগলামি হয়ত কমে এসেছে এখন, মাহুত এসে নিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত ওটা আর কিছু করবে না। আর ওটাকে মারার কোনও ইচ্ছাই আমার ছিল না। তাই ঠিক করলাম কিছুক্ষণ দেখব, যদি ওটা উলটাপালটা কিছু না করে তবে বাড়ি ফিরে যাব।

পিছনে তাকিয়ে মানুষের দলটাকে দেখলাম। কম করে হলেও দুহাজার মানুষ, মিনিটে মিনিটে তাদের সংখ্যা বাড়ছে। রাস্তার দুপাশ আটকে অনেক দূর পর্যন্ত ভিড় করে আছে ওরা। বিশাল এক হলুদ মুখের সমুদ্র - সবার মুখে আনন্দ আর উত্তেজনার ছাপ। হাতিটাকে গুলি করা হবে, তাই মজা দেখতে উদগ্রীব। এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন আমি এক জাদুকর, এখনই দারুণ কোনও জাদু দেখাব। আমাকে পছন্দ করে না ওদের কেউ, কিন্তু হাতে রাইফেলটা থাকায় এই মূহুর্তে আমিই সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। হঠাৎ করেই আমি বুঝতে পারলাম, হাতিটাকে আমার গুলি করতেই হবে। এতগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে এই দৃশ্য দেখার আশায়- তাদের সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তিকে প্রতিহত করার ক্ষমতা আমার নেই। ওখানে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে হঠাৎ নিজের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেল, প্রাচ্যে পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গদের শাসনের অসারতা গ্রাস করল আমাকে। স্থানীয় হাজার নিরস্ত্র মানুষের মাঝে একমাত্র বন্দুকধারী শ্বেতাঙ্গ পুরুষ আমি- দেখে মনে হবে রঙ্গমঞ্চে আমিই প্রধান নায়ক, কিন্তু আমি আসলে একটা পুতুল ছাড়া কিছু নই, যার সুতো ধরে আছে ওই হলুদমুখো লোকেরা। তখনই বুঝতে পারলাম, শ্বেতাঙ্গ শাসক যখন স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে তখন সে আসলে তার নিজের স্বাধীনতা হারায়। মানুষ থেকে সে হয়ে যায় মুখোশধারী অন্তঃসারশূন্য গতানুগতিক একজন ‘সাহেব’। তখন থেকে তার উদ্দেশ্য হয়ে যায় ‘নেটিভ’দের মন যুগিয়ে চলা, ‘নেটিভ’রা তার কাছ থেকে যা আশা করে সেটাই হয়ে যায় তার কর্তব্য। মুখোশটাই একসময় হয়ে যায় তার আসল মুখ। হাতিটাকে আমার গুলি করতেই হবে। রাইফেলটা যখন আনতে পাঠিয়েছি তখনই সেটা নির্ধারিত হয়ে গেছে। একজন ‘সাহেব’এর আচরণ হতে হবে সাহেবের মতোই, দৃঢ়চেতা ও কর্তব্যসচেতন। খবর পেয়ে এতদূর আসা, হাতে রাইফেল আর পিছনে দুহাজার লোক নিয়ে হাতিটাকে এত কাছ থেকে দেখে চুপচাপ ফিরে যাওয়া- অসম্ভব। লোকে হাসাহাসি করবে আমাকে নিয়ে। কিন্তু আমার সারা জীবন, এই দূর প্রাচ্যে একজন পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গের সংগ্রামী জীবন তো হাস্যস্পদ হওয়ার নয়!

কিন্তু হাতিটাকে গুলি করতে চাই না আমি। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওটার ঘাস খাওয়া দেখছি। গোছা গোছা ঘাস হাঁটুতে ঝেড়ে খাওয়ার মধ্যে কেমন যেন একটা বুড়োমানুষি ধীরতা আর গাম্ভীর্য আছে। ওটাকে গুলি করে মারাটা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার মতোই মনে হলো আমার। আমার যা বয়স তাতে পশু শিকার করতে আর ভয় লাগে না, কিন্তু আমি কখনও হাতি শিকার করিনি, করতে ইচ্ছাও হয়নি কখনও। মনে হয় বড় পশু মারতে একটু বেশি খারাপ লাগে আমার। তাছাড়া হাতিটার মালিকের কথাও তো ভাবতে হবে। জ্যান্ত একটা হাতির দাম কম করে হলেও একশ পাউন্ড। মরে গেলে তার দাঁত দুটোই শুধু মূল্যবান, তাও পাঁচ পাউন্ডের বেশি হবে না। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে অভিজ্ঞ চেহারার কয়েকজনের সাথে কথা বললাম। জানতে চাইলাম হাতিটার হাবভাব কেমন। ওরা সবাই একই কথা বলল, হাতিটাকে বিরক্ত না করলে ওটাও কিছু বলবে না। কিন্তু বেশি কাছে গেলে তেড়ে আসতে পারে।

কর্তব্যস্থির করে ফেললাম। ঠিক করলাম, হাতিটার কাছাকাছি যাব, মোটামুটি পঁচিশ গজের ভিতর। দেখব ওটা কী করে। যদি তাড়া করে, গুলি করব, নয়তো ওটার মাহুত ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। কিন্তু এও জানি সেটা আর সম্ভব না। রাইফেলে আমার হাত ভালো না। মাটিও খুব নরম, হাঁটতে গেলে পা দেবে যাচ্ছে। যদি গুলি করতেই হয়, আর সেটা যদি না লাগে, আমার অবস্থা হবে স্টিম রোলারের নিচে পড়া কোলাব্যাঙের মতো। আর চারপাশ থেকে ঘিরে থাকা হলুদ মুখগুলোর সামনে শুধু প্রাণ বাঁচালেই তো চলবে না। ভয় আমি তেমন পাচ্ছি না। একা থাকলেও হয়তো কিছুটা ভয় পেতাম, এত মানুষের মধ্যে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া ‘নেটিভ’দের সামনে শ্বেতাঙ্গ মানুষের ভয় পেতে নেই। আমার শুধু একটাই চিন্তা, এই দুহাজার বার্মিজের সামনে আমার অবস্থা পাহাড়ের উপরের দাঁত বের করা লাশটার মতো হয় কি না। আর সেটাও যদি হয়, এদের মধ্যে কারও না কারও জন্য সেটা হাস্যকর ব্যাপারই হবে। সেটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না।

অতএব, সামনে একটাই পথ খোলা। কার্তুজগুলো ম্যাগাজিনে ভরে লক্ষ্যস্থির করার জন্য শুয়ে পড়লাম। স্তব্ধ হয়ে গেল ভিড় করে থাকা সব মানুষ, যেমন করে মঞ্চের পর্দা ওঠার অপেক্ষা করে দর্শক। যে মজা দেখার জন্য তারা এসেছে সেটা ঘটবে অচিরেই। রাইফেলটা জার্মান, বেশ সুন্দর। লক্ষ্যস্থির করার জন্য ক্রস-হেয়ারও আছে। আমি তখনও জানতাম না হাতি মারতে হলে গুলি করতে হয় দুই কানের মাঝখানে। হাতিটা আমার দিকে পাশ ফিরে ছিলো, তাই লক্ষ্যস্থির করলাম ঠিক তার কানের ভিতর। ঠিক কানের ভিতরও না, মগজটা আরেকটু সামনে হবে ধরে নিয়ে লক্ষ্যস্থির করলাম কানের একটু সামনে।

ট্রিগার টানলাম, কিন্তু গুলির শব্দ বা বন্দুকের ধাক্কা কোনওটাই টের পেলাম না। অবশ্য গুলি লক্ষ্যে পৌঁছলে কোনও শিকারীই সেটা টের পায় না। কিন্তু পিছনে মানুষের গর্জন শুনতে পেলাম ঠিকই। এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো, হাতিটার ভিতর কেমন যেন একটা পরিবর্তন হচ্ছে। ওটা নড়ল না, পড়েও গেল না, কিন্তু আমার মনে হল ওটার শরীরের প্রতিটা দাগ যেন আস্তে আস্তে পালটে যাচ্ছে। ওটা যেন আমার চোখের সামনেই বুড়ো হয়ে গেল। বুলেটের আচমকা আঘাতে ওটা যেন মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেছে। অনন্তকালের মতো দীর্ঘ পাঁচ সেকেন্ড পর ওটা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। মুখটা হাঁ হয়ে লালা ঝরছে। দেখে মনে হল হঠাৎ প্রবল বার্ধক্য এসে হাজির হয়েছে হাতিটার মধ্যে, যেন হাজার বছর বয়স ওটার। আমি আবার গুলি করলাম, ঠিক একই জায়গায়। দ্বিতীয় গুলিতেও ওটা পড়ে গেল না, বরং ধীরে, খুব ধীরে, কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়াল। মাথাটা ঝুলে আছে সামনের দিকে। আবার গুলি করলাম। এই তৃতীয় গুলিটার আঘাত যেন এক ঝটকায় ওটার শরীরের সমস্ত শক্তি শুষে নিল। পড়ে গেল হাতিটা। পিছনের পা জোড়া ভাঁজ হল আগে, আর শুঁড়টা বাড়িয়ে দিল উপরে, তাই এক মূহুর্তের জন্য মনে হল ওটা বুঝি আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। প্রথম আর শেষবারের মত ডেকে উঠল হাতিটা, তারপর বিরাট শরীরটা ঢলে পড়ল মাটিতে। পড়ে যাওয়ার কম্পন আমিও টের পেলাম ভালোমতোই।

আমি উঠে দাঁড়ানোর আগেই দেখি পিছনের লোকজন হুড়মুড়িয়ে ছুটছে হাতিটার দিকে। হাতিটা আর উঠে দাঁড়াবে না ঠিকই, কিন্তু ওটা মরেওনি এখনও। খুব ধীরে, নিয়মিত বিরতিতে সশব্দে শ্বাস নিচ্ছে ওটা। বিশাল শরীরের একটা পাশ উঠছে আর নামছে। মুখটা পুরো খোলা, তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে গলার ভিতরের গোলাপি গহ্বর। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম ওটার মরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু মরল না ওটা। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি কমল না একটুও। শেষমেশ বাকি দুটো গুলি ছুঁড়লাম ওটার হৃদপিণ্ড তাক করে। ঘন রক্ত লাল গালিচার মতো ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে, কিন্তু মারা গেল না হাতিটা। শরীরটা একটু কাঁপল না পর্যন্ত। যন্ত্রণাময় শ্বাস-প্রশ্বাস চলতে থাকল বিরতিহীন। ধীরে ধীরে, প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে মারা যাচ্ছে হাতিটা, কিন্তু ওটার এখন এমন অবস্থা যে বুলেটে আর তার কোনও ক্ষতি হবে না। ওই ঘড়ঘড়ে শ্বাসের শব্দটা আর সহ্য হচ্ছে না। অত বড় একটা প্রাণী পড়ে আছে, নড়তে পারছে না, এমনকি মরতেও পারছে না, আর আমারও কোনও ক্ষমতা নেই এই যন্ত্রণা শেষ করে দেওয়ার। আমার নিজের রাইফেলটা আনিয়ে হাতিটার গলার ভিতর দিয়ে হৃদপিণ্ড বরাবর গুলি করলাম একটার পর একটা, কিন্তু তাতে কিছুই হল না। ঘড়ির কাঁটার মতো চলতে থাকল সেই তীব্র যন্ত্রণাময় শ্বাস-প্রশ্বাস।

আর সহ্য করতে না পেরে আমি চলে গেলাম ওখান থেকে। পরে শুনেছিলাম হাতিটা আরও আধঘণ্টা ওভাবেই বেঁচে ছিল। আমি ফিরে আসার আগেই দেখেছিলাম লোকজন ঝুড়ি নিয়ে এসেছে। শুনলাম বিকেল নাগাদ ওখানে হাতিটার হাড়গোড় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।

পরে অবশ্য অনেক কথা হয়েছিল এই হাতি শিকার নিয়ে। হাতির মালিক খুব ক্ষেপে গিয়েছিল, কিন্তু সে তো ভারতীয়, আমার আর কী আর করবে সে? তাছাড়া আইনের দিক থেকেও আমি কোনও ভুল করিনি। পাগলা হাতি তো মেরে ফেলাই উচিত, পাগলা কুকুর মেরে ফেলি না আমরা? তবে ইউরোপীয়দের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখলাম। যারা বয়স্ক তারা বলল আমি ঠিকই করেছি। আর কম বয়সী যারা তারা বলল কাজটা খুবই লজ্জাজনক। একটা ভারতীয় ‘কুলি’কে মারার জন্য এত বড় হাতিটা মেরে ফেললাম আমি? হাতির চেয়ে কি ওই লোকটার মূল্য বেশি? তবে লোকটা মারা যাওয়াতে আমার সুবিধাই হয়েছিল, হাতি শিকারের জন্য কোনও আইনগত ঝামেলায় পড়তে হয়নি। তবে আমি মাঝে মাঝেই ভাবি, এদের কেউ কি জানে, আমি হাতিটাকে মেরেছি কেবল মানুষের সামনে হাসির পাত্র হওয়া থেকে বাঁচার জন্য?

- উদ্দেশ্যহীন


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

সচলায়তনে প্রায়ই নানা ছোটোগল্পের অনুবাদ আসে। আগামী গল্পটা অনুবাদের আগে একটু গুগল করে দেখে নিতে পারেন, আপনার আগে কেউ সেটা অনুবাদ করে সচলে পোস্ট করেছে কি না। শুটিং অ্যান এলেফ্যান্ট এর আগে "পদব্রজী" নিকের এক অতিথি অনুবাদ করেছিলেন (সূত্র)।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি খুব নিয়মিত পাঠক নই, পদব্রজীর অনুবাদটা এবছরই লেখা, কিন্তু চোখ এড়িয়ে গেছে কোনও কারণে। এরপর থেকে খোঁজ-খবর নিয়েই লিখব।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ হিম্ভাই হাসি

- উদ্দেশ্যহীন

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা! অনুবাদকর্ম চলুক, তবে হিমু ভাইয়ের পরামর্শটিও ভেবে দেখা হোক কোন নব অনুবাদকর্মে হাত দেয়ার আগে!
।।।।।।।।
অনিত্র

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার ও মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ হাসি

- উদ্দেশ্যহীন

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

গল্পটা পড়ার সময়ই মনে হচ্ছিল আগেও কোথায় যেন পড়েছি। হিম্ভায়ের মন্তব্যে
মনে পড়ল। (আমার কাছে এই অনুবাদটিই ঝরঝরে লেগেছে) লিখতে থাকুন। হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ হাসি

(এই প্রথম মনে হয় আপনি আমার লেখায় কোনো মন্তব্য করলেন পপকর্ন না খেয়ে খাইছে )

- উদ্দেশ্যহীন

এক লহমা এর ছবি

সহমত।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

কপি এন্ড পেস্ট

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ এক লহমা ও আব্দুল্লাহ এ. এম. ভাইকে।

(মাঝখানে আমার মন্তব্য চলে আসছে, তাই ভাবছিলাম আমার সাথে আপনারা দুইজন সহমত জানাইলেন কি না খাইছে )

- উদ্দেশ্যহীন

মরুদ্যান এর ছবি

একমত।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ফাইনম্যানকে বসিয়ে রাখলেন ক্যানো? আর বসালেনই বা কোথায়? হাতির পিঠে নাকি? খাইছে
(একটু রসিকতা করলাম, যা মনে আসলো তাই বলে ফেললাম। কিছু মনে করলেন না তো?)

অতিথি লেখক এর ছবি

রাখলাম আরকি। হাতির পিঠে বসাই নাই, শেষে পায়ের তলে পড়বে। লোকটারে বিশ্বাস নাই খাইছে

(আর এইটুক রসিকতার জন্য আবার কিছু মনে করছি কি না জিজ্ঞেস করলেন? ক্যামনে কী ইয়ে, মানে... )

- উদ্দেশ্যহীন

অতিথি লেখক এর ছবি

'পদব্রজী' নিকধারীর অনুবাদটা পড়ে দেখুন, বেশ প্রাঞ্জল। আপনার অনুবাদ তুলনামূলকভাবে আড়ষ্ট।

(আনা)

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়া ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। চেষ্টা করব পরের লেখায় আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠতে।

(পদব্রজীর অনুবাদ ভালো লেগেছে, তবে কয়েক জায়গায় জটিল বাক্য আর প্রায়-আক্ষরিক অনুবাদে একটু হোঁচট খেয়েছি)

- উদ্দেশ্যহীন

এক লহমা এর ছবি

"কয়েক জায়গায় জটিল বাক্য আর প্রায়-আক্ষরিক অনুবাদে একটু হোঁচট খেয়েছি" - চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সো এর ছবি

এই অনুবাদটা সচলে আগে পড়েছি। কোনো একটা বইয়েও পড়েছিলাম অনেক আগে। সচলেরগুলোর মধ্যে এটা বেশি ভালো লেগেছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

মূল গল্প পড়েছিলাম ২০০৮ এর দিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি কোর্সে। ঝোঁকের মাথায় অনুবাদ করে ফেললাম।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ হাসি

- উদ্দেশ্যহীন

এক লহমা এর ছবি

আগে প্রকাশিত অনুবাদটিও উপভোগ করেছিলাম। তবে, আপনার করা অনুবাদটি বেশী ভাল লেগেছে। আর হ্যাঁ, ফাইনম্যানের জন্য বসে আছি। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ হাসি

ফাইনম্যানের লেখা আবারও অনুবাদ করব, স্বাদ বদলের জন্য এইটা লেখা।

- উদ্দেশ্যহীন

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ হাসি

- উদ্দেশ্যহীন

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার অনুবাদের হাত দারুণ। গল্প ভালো লেগেছে হাসি

দেবদ্যুতি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।