২৫ মার্চ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৫/০৩/২০১৬ - ৩:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যতদূর মনে পড়ে ১৯৭১ এর মার্চে রোদের তীব্রতা যেন একটু বেশিই ছিলো। এই উত্তাপ প্রকৃতির খেয়াল না বাঙ্গালীর মনের ক্ষোভের প্রতিফলন – তা ৪৫ বছর পর আজ আর স্মৃতি আলাদা করতে পারেনা।

১৯৭১ এ আমি কলেজের ছাত্রী। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। সেই সুবাদে আমরা থাকতাম আজিমপুর কলোনিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর তৎকালীন পিলখানা এলাকার মাঝামাঝি আজিমপুর কলোনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বড় দুই ভাই বোন তখন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী। ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান থেকেই পাকিস্তান থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করি, তখন থেকে বাঙ্গালীর মাঝে যে আন্দোলন দানা বাঁধা শুরু হয়েছিলো, তার ছোঁয়া ছিলো আমাদের রাজনীতি সচেতন পরিবারেও। ১ মার্চ ইয়াহিয়া গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলেন, ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়লো, শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। বিভিন্ন এলাকায় বাঙালি বিহারী দাঙ্গা, সচিবালয়ে মিলিটারির আনাগোনার খবর নিয়ে আসতেন আব্বা। এরপর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, বাসার জানালা দিয়ে আমরা দেখছি সকাল থেকেই মানুষ লাঠি হাতে নিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে রেসকোর্সের দিকে যাচ্ছে। সংগ্রামের সেই উদাত্ত আহ্বানের পর আমাদের সামনে ছিলো এক অদ্ভুত, অপূর্ব সম্ভাবনার নাম, স্বাধীনতা।

৭ মার্চের পর ইয়াহিয়ার সাথে বঙ্গবন্ধুর সংলাপ শুরু হয়, যা পশ্চিম পাকিস্তানের তরফ থেকে কালক্ষেপণের প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু ছিলোনা। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক পরিচিত বাঙ্গালী পরিবার ফিরে আসা শুরু করলো, একইসাথে বিমান মারফত আনানো হচ্ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছিলো, কিছু একটা হতে যাচ্ছে। কিন্তু পরবর্তী নয় মাসের ভয়াবহতার পরিসর ২৫ মার্চের আগে আমরা দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি হয়তো।

২৫ মার্চ সন্ধ্যায় পরপরই ভাইয়া পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে তার নিয়মিত আড্ডা থেকে বাড়ি ফিরে আসে। বলে চারিদিকে মিলিটারিরা বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাতে পারে যেকোন সময়ে, সংলাপ নাকি ব্যর্থ হয়েছে। রাত দশটার দিকে ভাইয়া বলে উঠলো সে দূরে ট্যাঙ্কের আওয়াজ পাচ্ছে, কল্পনাপ্রবণ ভাইয়ের কথায় আমরা তখন তেমন গুরুত্ব দেইনি – রাত সাড়ে দশটায় যথাসময়ে শুয়ে পড়লাম আমরা।

ঘুম ভাংলো প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে। আব্বা-মা তাদের ঘর থেকে আমাদের ঘরে চলে এলেন। চারিদিকে তীব্র আওয়াজ, বারান্দা দিয়ে বাইরে দেখা যায় আগুনের ঝলকানি, এইবার সবাই-ই শুনলাম সেই ট্যাঙ্কের শব্দ – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে। কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতা তখনো আঁচ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। ছাত্র-শিক্ষক-সাধারন মানুষের এমন নির্বিচার হত্যা সবার চিন্তার বাইরে ছিলো। আমরা সবাই গুলির ভয়ে ঘরের মেঝেতে শুয়ে রইলাম, এই শব্দের মধ্যে ঘুম ছিলো অসম্ভব। গোলাগুলির শব্দ ক্রমাগত বাড়তেই থাকলো, বিভিন্ন দিকে আগুনের শিখা। প্রতি মুহূর্তে ভাবছিলাম এই বুঝি মিলিটারি আজিমপুর এলাকায় ঢুকে পড়লো। ভেবেছিলাম হয়তো ফজরের নামাজের সময় অন্তত এই ভয়াবহ পরিস্থিতির অবসান হবে। কিন্তু তা হয়নি। একদিকে আযানের শব্দ, পরমুহূর্তেই আক্রমণের আওয়াজ একে অন্যের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলো শুধু।

এভাবেই একসময় সেরাতের সকাল হলো।

রাতে ঘুমোনো আগে আমরা বাইরের দরজায় তালা মারতাম, সকালে খুলতাম, সেদিন আর তালা খোলা হলোনা। আজিমপুর কলোনির জানালার ভেতরে কাঁচ, বাইরে কাঠের খড়খড়ি, আমরা কাঠের খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করছি। কোন রকমে সকালের নাশতা খাওয়া হলো। আটটার দিকে মিলিটারি গাড়ি গুলো আমাদের কলোনিতে ঢুকলো। আমাদের বিল্ডিং এর পর মাঠ, তার ঠিক পাশের ফ্ল্যাটকে আমরা ডাকতাম আজব ফ্ল্যাট, তার ছাদে তখনো উড়ছে স্বাধীন বাংলার পতাকা – বেশিরভাগ ফ্ল্যাট আগেই পতাকা নামিয়ে ফেলেছে। আজব ফ্ল্যাটের পাশে লাইন করে বিল্ডিং এর ছেলেদের দাঁড়া করিয়েছে। একজনকে ছাদ থেকে পতাকা নামিয়ে আনতে পাঠানো হলো, নামতেই তাতে মিলিটারি আগুনে পুড়িয়ে দিলো সেটাকে।আরেক ছাদের পতাকাকে নিচ থেকেই গুলি করে পুড়িয়ে ফেললো। ছেলেদের আবার ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সেরাতে আজব ফ্ল্যাটের সবাই প্রাণে বেঁচে গেলেও বাড়ির বাসিন্দা জ্যোতিরা দুদিন পরেই চলে যায়, যখন বুঝতে পারে সংখ্যালঘুদের সুচিন্তিতভাবে মারা হচ্ছে।

মিলিটারি গাড়ির বহর এসময় বাড়ির ঠিক সামনের রাস্তায়, আমরা ভীষণ আতঙ্কে ছিলাম। আশ্চর্যজনক ভাবে আর কোন গোলাগুলি না করে মেশিনগান উঁচু করে গাড়িবহর একসময় চলে গেলো।অনুমান করলাম সরকারি আবাসিক এলাকা বলে আর কিছু করেনি। বিশ্বাস হচ্ছিলোনা যে বেঁচে আছি আমরা। এর মাঝেই খবর পেলাম কারফিউ দেওয়া হয়েছে, দূরে নতুন পল্টন লাইনের দিকে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছিলো। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শুনতে পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অগুনতি শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীকে হত্যা করা হয়েছে, ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হক হল), জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্রকে নাকি মেরে ফেলেছে। দশটা এগারোটার দিকে দেখলাম বাসার পাশ দিয়ে আতঙ্কিত চেহারার কয়েকজন গেঞ্জি পরা ছেলে পালাচ্ছে, আমরা ভাবছিলাম এরাও হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। কারফিউ এর মাঝে বাইরে গিয়ে কোন তথ্য পাওয়া সম্ভব ছিলোনা। ২৭ তারিখ পর্যন্ত আমরা কম্পাউন্ড থেকে বাইরে যাইনি, আসেপাশের প্রতিবেশীদেরও একই অবস্থা। এর মাঝে এলাকার পানির সাপ্লাই ও বন্ধ হয়ে গেলো, আব্বা আর ভাইয়া গিয়ে দূরের টিউবওয়েল থেকে পানি আনলেন, তারা না ফেরা পর্যন্তও অবর্ণনীয় আতঙ্ক।

এরই মাঝে বুবু রেডিও ঘুরাতে ঘুরাতে পেয়ে গেলো স্বাধীনতার ঘোষণা, বুঝতে পারছিলাম এ স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হচ্ছে অনেক মৃত্যু আর ত্যাগের মধ্যে দিয়ে। ২৭ তারিখ আব্বা অফিসে গেলেন, ভাইয়া গেলো ইউনিভার্সিটি এলাকায়। সেখানকার দৃশ্য, নীলক্ষেত বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পরের ধ্বংসস্তূপ, শিক্ষকদের হত্যাকান্ডের ভয়াবহতা শুনি তার কাছ থেকে। যেন এক দুঃস্বপ্নের মাঝে বসবাস করছিলাম আমরা। আব্বা শুনলেন ভাইয়ার বয়সী ছেলেদের টার্গেট করে করে মিলিটারিরা মারছে, ঠিক করলেন আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে। ২৯ তারিখেই আব্বা ছাড়া বাকিরা ঢাকা ছেড়ে চলে গেলাম নরসিংদীর হাতিরদিয়ায়, আব্বার অফিসের এক পিওনের সাথে। সেই যাত্রাও এক ভয়াবহ স্মৃতি। ঢাকার সামান্য বাইরে একটা ফ্যাক্টরির পাশে ডোবাতে দেখেছি লাশ পড়ে থাকতে। এইসব দৃশ্য কখনো ভোলার নয়।

সেই আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা পরবর্তী নয়মাস প্রতিনিয়ত আমাদের সাথে ছিলো, কেউই তো নিরাপদ ছিলাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যখনই হাঁটি, সেই রক্তের ধারা যেন আজও দেখতে পাই। আজও যখনি ২৫ মার্চ তারিখটা বছর ঘুরে আসে, সেই রাতের ভয়াবহতা, সেই গুলির শব্দ, সেই আগুন এখনো যেন স্পষ্ট অনুভব করতে পারি।

- স্বাতী ফজলী সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত বাংলার অধ্যাপক।

১৯৭১ সালে আমার মা স্বাতী ফজলী সুলতানা কলেজের ছাত্রী, আম্মুকে গত কয়বছর ধরেই বলছি ধীরে ধীরে যুদ্ধের সময়ের অনুভূতিগুলো লিখে রাখতে। এইবছর ২৫ মার্চের সেই রাতের স্মৃতির উপর অল্প হলেও লিখেছে। আম্মুর পক্ষ থেকে আমি টাইপ করে আপলোড করে দিলাম। আমার মনে হয় আমাদের যাদের বাবা-মা সেইসময় কি ঘটছে তা বোঝার বয়সে ছিলেন, তাদের উচিত এই অভিজ্ঞতাগুলো লিখে ফেলা, হারিয়ে যেতে না দেওয়া। - অনন্যা রুবাইয়াত


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ধন্যবাদ অনন্যা রুবাইয়াত।

[আপনার আম্মার ভাণ্ডারে নিশ্চয় আরো অনেক স্মৃতি আছে। অপেক্ষায় রইলাম। ]

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অনন্যা রুবাইয়াত  এর ছবি

আপনাকেও পড়ার জন্য ধন্যবাদ হাসি

হাসিব এর ছবি

একটা পরামর্শ দেই। ফোনে একটা রেকর্ডার সফটওয়্যার ইন্সটল করে নেন। সময় পেলেই আপনি আপনার মায়ের সাথে পুরনো বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবেন। এটা নিয়মিত করতে পারলে একটা সময় আপনার অর্জিত সকল সম্পদ থেকে এসব রেকর্ডিং মূল্যবান মনে হবে।

অনন্যা রুবাইয়াত  এর ছবি

ধন্যবাদ চমৎকার আইডিয়ার জন্য। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ স্বাতী ফজলী সুলতানা, আর ধন্যবাদ অনন্যা রুবাইয়াত আপু অসাধারন ভালো একটা কাজ করেছেন। একাত্তরের দিনগুলোর আরো স্মৃতিকি লিপিবদ্ধ করা যায়না? এরকম আরো স্মৃতি কথার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। আমি নিজে বাংলার ছাত্র ছিলাম বাংলা পড়ান বা পড়েছেন এমন সবাইকেই আত্মীয় মনে হয়, স্বাতী ফজলী সুলতানা ম্যাডামকে আমার শ্রদ্ধা আর অনুরোধটা জানাবেন।

সোহেল ইমাম

অনন্যা রুবাইয়াত  এর ছবি

আমারো সেটাই ইচ্ছা। চেষ্টা করবো। অনেক ধন্যবাদ।

মুদ্রা সংগ্রাহক এর ছবি

চমৎকার কাজ। আমিও ঠিক এ্ই ধরণের একটা কাজ করছি - আমার বাবার মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিপিবদ্ধ করার কাজ। খুব সহজ হচ্ছে না। বাবার সাথে বছরে দেখা হয় ১০-১২ দিন, সেটাও ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটে যায়। হাসিব ভাইয়ের বুদ্ধি কাজে লাগালে হয়ত কাজটা তাড়াতাড়ি এগোবে।

অপেক্ষায় থাকলাম আপনার পরবর্তী পোস্টের।

এক লহমা এর ছবি

চলুক
এই রকম আরও লেখা পড়বার অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

Ahmed  এর ছবি

১৯৭১ এ প্রতিটা পরিবারের গল্প এক এক্ টা কাহিনী। Thanks you for the effort to collect it.

সামিয়া সাইফ  এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ অনন্যা তোমার এই সুন্দর প্রয়াস এর জন্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।