শুশুক (৩)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২৯/০৩/২০১৬ - ৫:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দ্বিতীয় পর্বের লিংকঃ
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/55688

জিপসি বুড়ি ইয়ালেল্লে

রণ শেখের গল্প ধীরজা পেরিয়ে এতদূর যাবে কে জানতো? শম্ভুনাথ তো চেয়েছিল কেবল হুন্দামুড়ির পেছনে লুকিয়ে থাকা আজব একটা দেশে যেতে, যে দেশের কথা সোনাপুর গঞ্জের হাটুরেদের মুখে মুখে ফেরে। অথচ নিয়তির কী খেলা দেখুন, তার জীবনটা জড়িয়ে গেলো বাগদাসারের সাথে।

বাগদাসার ভিনদেশি, হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো একজন মানুষ। বাগদাসার রাজপুরুষ, কিন্তু ভাগ্যবঞ্চিত । এই মুহূর্তে সে হতদরিদ্র, সম্পদ বলতে কেবল একটা সোনার চামচ, সেটিও আবার সংগে নেই। আরমানিটোলায় আগুন লাগার আগেই কী মনে করে যেন ফেরকার হাত দিয়ে ইরেওয়ানে পাঠিয়ে দিয়েছিল। থাকলেও যে খুব একটা উপকার হতো এমন নয়। কালের বিবর্তনে একদা অমূল্য সেই সোনার চামচ এখন ক্ষয়িষ্ণু একটা স্মৃতি মাত্র। বরং বাগদাসারের মাথার যা দাম তা দিয়ে কম করে হলেও পাঁচশ সোনার চামচ বানানো যাবে।

তবে সব খারাপেরই কিছু ভালো দিক থাকে। এই যেমন হায়াযদান তাকে খুঁজছে। গোপনে লোক লাগিয়ে নয়, খুঁজছে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে। বুদ্ধিমান মানুষেরও ভুল হয়। একটি নয়, দু দু’টি ভুল করেছে হায়াযদান। প্রথমত পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে বাগদাসারকে সে ফিরিয়ে এনেছে বিস্মৃতির অতল থেকে। তার উপর, পুরস্কারের অংকটা ধার্য করেছে বাড়াবাড়ি রকমের। হারিয়ে যাওয়া বাগদাসার কেবল ফিরেই আসেনি, সে যে এখনো কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে স্বর্ণমুদ্রার ঝলসানিতে। যারা প্রাচীন ইতিহাসের খবর রাখে, পুরনোকালের পুরাণে যাদের আগ্রহ, তারা সবাই এখন খুঁজবে আহুরামাযদার গেদালের উত্তরাধিকারীকে। কে জানে, ইরেওয়ান কিম্বা সিরাজের সেই সব মানুষেরা আনাসান্ত সানাসারের একমাত্র ছেলেকে হয়তো ফিরিয়ে দেবেনা।

সেই ভয়াবহ বিকেলটার কথা মনে পড়ে বাগদাসারের। সেদিন ছিল নওরোজ, নতুন বছরের শুরু, দুপুরের গনগনে সূর্যটা কমলা বরন হয়ে ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। পথে লোকজন খুব একটা নেই, সবাই গিয়েছে ইরেওয়ানের ভার্নিসাজ বাজারে। সেখানে সন্ধ্যায় আলোর উৎসব, হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য। বাগদাসারের মনটা আইঢাই করছে ভার্নিসাজে গিয়ে ফানুস ওড়াতে, কিন্তু সানাসার বংশের রেওয়াজ অনুযায়ী তাকে প্রথমে যেতে হবে আহুরামাজদার মন্দিরে। বাবার হাত ধরে বিরস মনে হাঁটছিল বাগদাসার, সামনে পেছনে রক্ষীদের দল। একটু ভয় ভয় লাগছিল তার, প্রথমবারের মতো পবিত্র আগুনের মুখোমুখি হবে সে। জামার বুক পকেটে মা’র সেলাই করে দেওয়া পাদানটাকে অনুভব করে শিহরিত হয় বালক। আগুন সে পবিত্র সন্দেহ নেই, কিন্তু আগুন তাদের দেবতা নয়। অগ্নিকে তারা উপাসনা করেনা। আগুন শুধুই দেবতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার মাধ্যম, তার আঁচে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে দেবালয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে একটি অনুষঙ্গ। সকাল থেকে কিছুই খায়নি বাগদাসার, এমনকি পানিও না। কলজেটা শুকিয়ে কাঠ, কিন্তু এটাই নিয়ম। আগুনকে কলুষিত হতে দেওয়া যাবেনা, নিজের প্রশ্বাসকেও বিশ্বাস নেই। উৎকৃষ্টতম কার্পাসের সুতোয় বোনা ধবধবে সাদা পাদান দিয়ে মুখ-নাক ঢেকে আগুনের চার পাশে ঘুরে ঘুরে আউড়ে যেতে হবে মাশিয়া-মাশিয়ানার প্রতিশ্রুতি। যা কিছু অপবিত্র, যা কিছু পঙ্কিল শুষে নেবে শ্বেত শুভ্র পাদান। বাবা বলেছেন অভিষেক শেষে তাকে একটা উপহার দেবেন। কী সে উপহার জিগ্যেস করার সাহস হয়নি হবু যুবরাজের, খুব রাশভারী মানুষ আনাসান্ত সানাসার।

একটা হ্যাঁচকা টান লেগে হোঁচট খেতে খেতে সামলে নিলো বাগদাসার, বাবা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছেন। মুখ তুলে তাকাতেই চোখে পড়লো লাল রঙের তীরটা, বাবার বুকের বাঁ দিকে আমূল প্রোথিত। রক্ষীরা ছুটে আসছে, বাগদাসারের গলার কাছে একটা চিৎকার, একটা আর্তনাদ দলা পাকিয়ে উঠে এসে আটকে গিয়েছে। এই পড়ন্ত বিকেলেও যেন মধ্যরাতের নিকষ কালো অন্ধকার নেমে এসেছে তার চোখে। ইস্পাতে ইস্পাতে ঝনঝন আওয়াজ উঠে চারিদিকে, সহসা অন্ধকারের চাঁদর ফুঁড়ে বাগদাসার দেখতে পায় দুরে দাঁড়িয়ে হায়াযদানের ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে মুর্তিমান মৃত্যু, তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে অন্তত একশ জন যোদ্ধা। ধনুকের ছিলা টানটান করে তৈরি তারা। কোথা থেকে যেন ছুটে এলো বাবার বিশ্বস্ত প্রহরী সেভর্গ, একটানে বাগদাসারকে তুলে নিয়ে ধেয়ে আসা তীরের বৃষ্টি ছাড়িয়ে ছুটে চলল চিতার ক্ষিপ্রতায়।

সেভর্গ ছুটছে, পেছনে পড়ে আনাসান্ত সানাসারের মৃতদেহ। সেদিকে তাকাবার অবসর নেই তার, বহুদিনের অভিজ্ঞতায় সে জানে যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে হবে এখান থেকে বহুদূর। কিছুদিন ধরেই গুজবটা শুনতে পাচ্ছিল সে। আনাসান্তকে সাবধান করতে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। নিজের ভাইকে এতোটা অবিশ্বাস করলে কি চলে! সে বিশ্বাসের মূল্য চুকিয়ে সানাসার বংশের মহান পুরুষ আজ মৃত। হায়াযদান বুদ্ধিমান, একটা দল নিশ্চয়ই এতক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে প্রাসাদে। কোথায় যাবে সেভর্গ! হঠাৎ করেই মনে পড়ে ইয়ালেল্লের কথা। প্রতি বছরের মতো এবারও জিপসি বুড়ি তার দলবল নিয়ে ভার্নিসাজ বাজারে এসেছে, নওরোজের উৎসবে সামিল হতে।

ভার্নিসাজে তখন ধুলোর পাহাড়, খবর পৌঁছে গিয়েছে। আতংকিত মানুষ ছুটছে যে যেদিকে পারে। ইয়ালেল্লে চিন্তিত হলেও আতংকিত নয়। তার একষট্টি বছরের জীবনে এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। কত দেশে কত রাজ্যেই না ঘুরেছে সে জীবনভর! রাজপ্রাসাদের ঢেউ ভার্নিসাজে এসে ঝাঁপটে পড়তে এখনো কয়েক প্রহর। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ছুটোছুটি না করে ঠাণ্ডা মাথায় ঘুছিয়ে নিতে হবে সবকিছু।

ঃ তাঁবু গোটানোর কোন প্রয়োজন নেই। যা কিছু পারো গাধার পিঠে চাপিয়ে বেরিয়ে পড় তোমরা, যেন নগর দেখতে বেরিয়েছ। তিনটে দলে ভাগ হয়ে রাতে উত্তরের জঙ্গলে গিয়ে মিলবো সবাই। রাত থাকতে থাকতেই নদী পার হয়ে চলে যাবো নোরাওয়াত শহরে।

ঃ কেমন আছো ইয়ালেল্লে?

ঃ আরে সেভর্গ যে! জিপসি মেয়েদের পেছনে ঘোরার স্বভাব তোমার এখনো যায়নি বুঝি? তোমার কপালটাই মন্দ, মেয়েরা আজকে নগর দেখতে বেরুচ্ছে। কাল এসক্ষণ।

ঃ বাজে কথা রাখো, জিপসি মেয়ের পেছনেই একবারই ছুটেছি আমি, সেটাও আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে।

ইয়ালেল্লের চোখে ক্ষণিকের জন্য একটা আভা ছড়িয়ে পড়ে, সে আভায় খানিকটা সুখ, খানিক ছোঁয়া বিষণ্ণতার।

ঃ কী চাও সেভর্গ? তোমার পেছনে ওটা কে? তোমার নাতি বুঝি!

ঃ ছেলেটাকে কোথাও লুকিয়ে রাখো, পারলে নিয়ে যাও তোমাদের সাথে। সময় কিন্তু বেশি নেই। আমি সময় সুযোগ মতো তোমাদের খুঁজে নেব। আরেকটা কথা, শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর এই বাক্সটা ওকে দেবে। সাবধান, কিছুতেই যেন হাতছাড়া না হয়।

ইয়ালেল্লের জবাবের অপেক্ষা না করেই যেমন এসেছিল তেমনি দমকা হাওয়ার মত তাঁবু থেকে বেরিয়ে যায় সেভর্গ।

ঃ কেউ একজন এসে ছেলেটার জামাকাপড় খুলে অন্য কিছু পরিয়ে দাও। বড় বেশি ঝলমলে এগুলো, জিপিসিদের দলে মানায় না। ছেলেটাও যেন মুক্তোর মালার মতো ঝকঝক করছে, মুখে গায়ে একটু কালিঝুলি মাখিয়ে দিও। ও হ্যাঁ, চুলের রঙটা পাল্টে দিতে ভুলো না। যত সব যন্ত্রণা এসে পড়ে এই ইয়ালেল্লের ঘাড়ে!

গজগজ করতে করতে বাগদাসারের দিকে ভালো করে তাকায় ইয়ালেল্লে। নাহ, এই ছেলে সেভর্গের কেউ হতে পারেনা।

ঃ দেখি, একটু আমার কাছে এগিয়ে এসো তো?

বাগদাসার এখনো একটা ঘোরের মধ্যে, তার পাশ দিয়ে সাই সাই করে দৌড়ে চলেছে সময়, বিহ্বল বালক বুঝতে পারছেনা কী হচ্ছে, কী হতে চলেছে। বুড়ি ইয়ালেল্লে যেন গল্পে শোনা সেই ডাইনি। তার মাথাভর্তি জট বাঁধা চুল, মুখে অজস্র বসন্তের দাগ। দেখলে ভয় লাগে। তবে বুড়ির চোখদুটো বড় মায়াময়, দেখলে ভরসা জাগে।

ঃ নাও, জামাটা খুলে ফেল দিকিনি।

বাগদাসার একটা একটা বোতাম খুলে জামাটা ইয়ালেল্লের হাতে দিয়েই ফিরিয়ে নেয় আবার। মা’র সেলাই করে দেওয়া পাদানটা রয়ে গিয়েছে ওখানে। চোখে পড়ে বুড়িরও। জিপসির চোখ ঠিক ঠিক চিনে নেয় মহার্ঘ কার্পাসে বোনা রেশমি ঝালরে মোড়ানো ওই শুভ্র কাপড়ের টুকরো টিকে। আতংকে গলা শুকিয়ে আসে তার। এ কিছুতেই হতে পারেনা, এই দায়িত্ব সে নেবেনা।

ঃ এই কে কোথায় আছিস দৌড়ে গিয়ে দেখ সেভর্গ কে পাস কিনা।

সেভর্গ কি আর এখানে আছে! জিপসিদের দল আর একমুহুর্ত সময় নষ্ট না করে ঝটপট বেরিয়ে পরে ভার্নিসাজ ছেড়ে। দুটো গাধার পিঠে পাশাপাশি চলেছে ইয়ালেল্লে আর বাগদাসার। সানাসার বংশের শেষ সূর্য ঢাকা পড়ে আছে কালিঝুলি মাখা ময়লা কাপড়ের নিচে, তাকে চেনা যায়না।

ঃ দাঁড়াও তোমারা। মেলা ছেড়ে কোথায় চলেছ?

বাগদাসারের হৃদপিণ্ডটা ধক ধক করছে যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। লোকটাকে সে চেনে, হায়যদানের রক্ষীদলের একজন। নিষ্ঠুরতায় আসুঘিগ হায়াযদানের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

ঃ মেলা ছেড়ে তো যাচ্ছি না। সারাদিন তাঁবুতে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, তাই ভাবলাম একটু বেরিয়ে দেখি। ভালো ভালো কিছু সিল্কের জামা এনেছিলাম। বাজারে বিক্রি করার আগে একবার প্রাসাদে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল।

ঃ প্রাসাদে যেতে হবেনা, অন্য কোথাও ভাগো। জামাগুলো রেখে যাও এখানে, আমার লোকেরা এসে প্রাসাদে নিয়ে যাবে।

আসুঘিগ চলে গিয়েছে এটা বিশ্বাস হয়না বাগদাসারের। তার বুকটা এখনো ওঠানামা করছে হাপরের মতো। ইয়ালেল্লে তাকে জড়িয়ে ধরে। বুড়ির গায়ে রাজ্যের দুর্গন্ধ, কিন্তু বাগদাসারের তাতে খারাপ লাগেনা। তার অবসন্ন দেহটা জিপসি বুড়ির কাঁধে এলিয়ে পড়ে।

ঃ ছেলেটাকে কোলে করে গাধার পিঠে তুলে দে, ঘুমিয়ে পড়েছে বেচারা। ধরে রাখিস শক্ত করে যেন পড়ে না যায়। এখনো পড়ে যাবার সময় হয়নি ওর।

------চলবে
(মোখলেস হোসেন)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখার শুরুতেই একটা মুগ্ধতা ছিল, এখন পর্ব গুলোর জন্য অপেক্ষাটা আরো অধীর। কাহিনীর বুননটা ভালো লাগছে। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

সোহেল ইমাম

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সোহেল ইমাম।

-----মোখলেস হোসেন

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ইটা রাইখ্যা গেলাম... ইটা রাইখ্যা গেলাম... ইটা রাইখ্যা গেলাম...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ সাক্ষী সত্যানন্দ। পাটকেলের (নতুন কিস্তি) জন্য তৈরি থাকুন।

---মোখলেস হোসেন

এক লহমা এর ছবি

চলুক। দেঁতো হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ এক লহমা।
----মোখলেস হোসেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।