সোনার কাঠি রুপার কাঠি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৭/০৫/২০১৬ - ৩:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের দাদাবাড়িতে পাঁচটা আম গাছ ছিলো...আম গাছগুলোরও নাম ছিলো, মানে আমাদের দেয়া নাম আর কি। কুয়োতলায় ছিলো “কুয়োতলার আম”, ছোট ফুফুর ঘরের উপরেরটা “ত্যাততেরি আম”, বাড়ির পেছনে ছিলো “মিষ্টি আম” ও “ শ্যান্দরাই আম”, আর বাড়ির সামনে হাতপা ছড়িয়ে রাজপুত্রের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলো ফজলি আমের গাছ, এর আলাদা কোন নাম ছিলোনা...

আমের দিন এলে আমরা স্কুল থেকে ফিরে, লোডশিডিংয়ের সন্ধ্যায়, কিংবা রাতের খাবার পর আমতলায় বসে বসে থাকতাম আম কুড়ানোর জন্য। মনে আছে, সুনসান দুপুরগুলোতে যখন বড়রা সব কাজ শেষে একটু জিরিযে নেয়ার জন্য চোখ বুজে থাকতো, আমরা তখন আমতলায় ধ্যানমগ্ন থাকতাম... কখন একটা কাক এসে আমের ডালে বসবে... কখন একটা পশ্চিয়া বাতাস আমের বোটা নাড়িয়ে দিবে... কখন একটা থুপ করে আম পড়বে ! কে কয়টা আম পেয়েছে তার হিসেব নিকেশও আমরা রাখতাম... মূলত, সময়টা ছিলো চাপা প্রতিযোগিতামূলক ।
ডালে কাক বসলেই আমরা ছড়া কাটতাম,
“কাউয়ারে কা কা
আম ফেলে দে পাকা”
“কাউয়ারে কি কি
আম ফেলে দে ফিকি ”

প্রচন্ড গরমের রাতে আব্বু আমাদেরকে নিয়ে আম তলায় যেতেন হাওয়া খেতে । আমাদের সঙ্গে থাকতো সপ ( এক ধরনের শীতলপাটি) বালিশ, হারিক্যান, তালপাখা। তখন ভিতরে ভিতরে একটা ক্যাম্পিংয়ের ভাব কাজ করতো । আমরা এটাও বঝুতাম, আম তলায় সপে শুয়ে শুয়ে হাওয়া খাওয়া সব ছলনা, মূল আখ্যান তো ছিলো আম কুড়ানো ।

আমি ছিলাম ভয়ঙ্কর গেছো, যখন তখন আমগাছে চড়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকতাম, এই নিয়ে আম্মুর সে কি রাগ, পড়াশুনা না করে আমি নাকি সারাদিন আমগাছে বসে থাকি ! যেহেতু সামনে পরীক্ষা, পড়তে হবে খুব... কিন্তু আমতলার নেশায় ঘরে তো মন টিকেনা; তাই বাধ্য হয়েই বিকেলবেলাটায় অংক কষতে বসে যেতাম আমতলাতেই ।

একবার তো আম কুড়ানো নিয়ে কি কান্ডটাই ঘটে গেলো। সেদিন ছোট খালা এসেছে আমাদের বাড়িতে। আমি খালার সাথে ঘুমিয়েছি, তো অনেক রাতে খালা আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে বললো, বাতাসে অনেক আম পড়েছে চল, কুড়িয়ে আনি। আমি কোন রা করলাম না, আমি চুপচাম ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে খালার পিছন ফিছন গেলাম । আমতলায় গিয়ে দেখি, সত্যিই তো অনেক আম পড়েছে আজ। দুইটা টিনের ঘরের মাঝখানে ঢালুমত জায়গা আছে, খালা আমাকে দেখিয়ে বললো, ওখানেও আম পড়ে আটকে আছে মনে হয়। আমি বললাম, দাঁড়াও উঠতেছি... বলেই আমি তরতর করে গাছ দিয়ে চালার উপড়ে উঠে গেলাম; হ্যাঁ, বেশ কয়েকটা আম... আমি কুড়িয়ে নিচে খালাকে দিয়ে দিলাম। আর তখন হঠাৎ কি মনে করে যেন আমি আকাশের দিকে তাকালাম, রাতে আকাশ, কয়েকটা তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আকাশের গায়, আর তখন আমার খেয়াল হলো এটা গভীর রাত ! আমার কেমন হাতপা ঠান্ডা হয়ে গেলো... নি:শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো ! আমি তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলাম, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছলাম... খালা আমার অবস্থা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। বারবার জানতে চাচ্ছিলো, “কি হয়েছে ? কি হয়েছে ? কিছু কি দেখেছো ওখানে ?”
পরের দিন ভয়ের চোটে আমার খুব জ্বর এলো, আর সবখানে রটে গেলো রাতের বেলা গাছে ওঠার জন্য আমাকে নাকি জ্বিন আছড় করেছে ! এর দুদিন পর অবশ্য জ্বর ছেড়ে গেছলো, আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়েছিলাম । সেবার অবশ্য আম গাছে আর উঠা হয়নি, তবে পরের বার দিব্যি আগের মতন আমগাছে উঠতাম... আর ডালে বসে কাকের সাথে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে পাকা আমে ভাগ বসাতাম ।

ঝরের দিনে আম্মু আমাদের পাহারায় রাখতো, তারপরও আম্মুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে কখন যে এক দৌড়ে আমতলায় ! আমতলায় আমি কী আর একলা, ততক্ষনে জড়ো হয়ে যেত ২০-৩০ জন ! এত মানুষের ভীড়ে আম কুড়ানো সে কী আর মুখের কথা... আমতলা রীতিমত কুরুক্ষেত্র বনে যেত ।
তারপর, জলকাদাঁয় মাখামাখি হয়ে, কাঁচাপাকা আম, থেতলে যাওয়া আম বালতি ভর্তি করে ঘরে ফিরতাম । কখনো কখনো আম্মু বলতো, তোমরা ঘরে থাকো, আমি আম কুড়িয়ে নিয়ে আসি । আমরা বুঝতাম, আম্মুরও বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করে ।
আমার তো যখন তখন বৃষ্টিতে ভেজা, জলে খলবলানি কিন্তু জ্বরজারি হতনা খুব; সে সময় আমি বোধহয় ব্যাঙ্গের নাটু (ব্যাঙ্গাচি) ছিলাম... সবাই বলতোও তাই, এই তুই একটা গা পিছলা ব্যাঙ্গের নাটু... এই বলে বলে আমাকে ক্ষ্যাপাতো খুব !

সেই আমগাছগুলো এখন আর নাই... বাপচাচারা সবাই পুরোনো বাড়ি ভেঙ্গে নতুন নতুন বাড়ি করেছে... কত বছর হয়ে গেলো ! অথচ আম কুড়ানোর গল্প উঠলেই সবাই যেন দেখতে পায় সেই সব দিন; এইতো কয়েকদিন আগের ঘটনা যেন !

আমার শৈশব, কৈশোর দিনগুলোতে লেপ্টে থাকা আমতলা যেন জন্মজন্মান্তরের আনন্দযজ্ঞের চাবি ।

আকাশে মেঘ খারাপ করলেই... আমি জানালা খুলি, জানালায় দেখতে পাই আমার কৈশোরের আমিটাকে... যে হয়তো এই এখনি দৌড় দিবে আমতলায়... আর তার মা পিছন পিছন চিল্লে বলবে... এই, এই ছাতা নিয়ে যাও...

মিতা চার্বাক


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আম খাওয়া হয়নি এখনও মন খারাপ

লেখাটা 'অণুগল্প' না হয়ে 'স্মৃতিচারণ' হবার কথা কি?

শুভেচ্ছা হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।