মুক্তিযুদ্ধে মাসুদ রানা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৩/০৭/২০১৬ - ৫:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলাদেশের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত দুঃসাহসী স্পাই।
গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে।বিচিত্র তার জীবন।
অদ্ভুত রহস্যময় তার গতিবিধি।
কোমল কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর সুন্দর এক অন্তর।
একা,টানে সবাইকে,কিন্তু বাঁধনে জড়ায়না।
কোথায়ও অন্যায় অবিচার অত্যাচার দেখলে রুখে দাড়ায়।
পদে পদে তার বিপদ শিহরণ ভয়,আর মৃত্যুর হাতছানি।
আসুন এই দুর্ধর্ষ চিরনবীন যুবকটির সাথে পরিচিত হই।
সীমিত গন্ডিবদ্ধ জীবনের একঘেয়েমি থেকে একটানে তুলে নিয়ে যাবে ও আমাদের স্বপ্নের এক আশ্বর্য মায়াবী জগতে।
আপনারা আমন্ত্রিত।

১৯৬৬ সালের মে মাসে মাসুদ রানা যখন যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ নামক দেশটির তখনো জন্ম হয়নি। ফলে মাসুদ রানার পরিচয় ছিল পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টিলিজেন্সের এজেন্ট হিসেবে। দেশের তখনকার প্রেক্ষিত অনুযায়ী শত্রু দেশ মানে ভারত। তাই মাসুদ রানার প্রথম মিশন ‘ধ্বংস পাহাড়’ থেকে বাইশতম মিশন ‘শয়তানের দূত’ পর্যন্ত অনেক মিশনেই প্রধান শত্রু ভারত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবার পর যখন প্রেক্ষিত পরিবর্তিত হয়ে যায় তখন ‘শত্রু দেশ’ ব্যাপারটি আর থাকে না। ফলে বাংলাদেশ আমলের মাসুদ রানাতে কখনো ইসরায়েল, কখনো সোভিয়েত ইউনিয়ন (টিকে থাকা পর্যন্ত), কালেভদ্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ঠিক শত্রু দেশ নয়, তবে বৈরি প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হতে দেখা গেছে।

বিদেশী গল্পের কাহিনী অবলম্বনে লেখা মাসুদ রানা সিরিজের অন্তত সাড়ে পাঁচটি বই মৌলিক — ‘ধ্বংস-পাহাড়’, ‘ভারতনাট্যম’, ‘এখনো ষড়যন্ত্র’, ‘প্রমাণ কৈ?’ ও ‘পিশাচ দ্বীপ’। ‘আবার ষড়যন্ত্র’ বইটি আংশিক মৌলিক। ‘ধ্বংস-পাহাড়’ আর ‘ভারতনাট্যম’ লিখতে গিয়ে লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন বুঝে যান মৌলিক স্পাই থ্রিলার লেখা কতো পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজ। এই দেশের সীমিত সংখ্যক পাঠকদের জন্য ঐ পরিমাণ সময়, শ্রম, মেধা, অর্থ ব্যয় করাটাকে লেখক (কাম প্রকাশক) সম্ভবত বাণিজ্যিকভাবে যথার্থ মনে করেননি, তাছাড়া পাঠকেরা মাসুদ রানার মিশন আরও ঘন ঘন আশা করছিলেন তাই মাসুদ রানা’র তৃতীয় মিশন ‘স্বর্ণমৃগ’ থেকে তিনি বিদেশী গল্পের কাহিনী অবলম্বন করা শুরু করেন। রানা’র তেইশতম মিশন ‘এখনো ষড়যন্ত্র’-তে গিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন আবার মৌলিক গল্পে ফেরত যান। চব্বিশতম মিশন ‘প্রমাণ কৈ?’-ও মৌলিক গল্প। তারপর আবার বিদেশী কাহিনীর ছায়াতলে পুনর্গমন। এর পরে আজ পর্যন্ত প্রকাশিত বাকি মিশনগুলোর মধ্যে ‘পিশাচ দ্বীপ’ ছাড়া পুরো মৌলিক গল্প আর নেই। অনেক দিন পরে ‘আবার ষড়যন্ত্র’ মিশনটি একটি মুভির কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে লেখা।

১৯৭২ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত মৌলিক গল্পের মিশন ‘এখনো ষড়যন্ত্র’। সম্পূর্ণ বাংলাদেশের পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাসের মূল বিষয় মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী দেশী-বিদেশী চক্রের ষড়যন্ত্র। বিজয়ের মাত্র চার মাসের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় এমন মানের একটা মৌলিক স্পাই থ্রিলার লেখা এই ক্ষেত্রে কাজী আনোয়ার হোসেনের মেধার প্রমাণ করে। এই উপন্যাসে মাসুদ রানাসহ সাবেক পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের অন্য এজেন্টরা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, সেখানে কী কী হয়েছিল তার বর্ণনা আছে। মেজর জেনারেল (অবঃ) রাহাত খানের অনুপস্থিতিতে চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ব্রিগেডিয়ার সোহেল আহমেদ কীভাবে সব এজেন্টদের জড়ো করছে, রানাকে চীফের পদ গছানোর চেষ্টা করছে সেসব কথাও আছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে মেজর জেনারেল (অবঃ) রাহাত খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজিন্সের এজেন্ট হিসেবে রানাকে আমরা যখন কাজ করতে দেখি তখন তার যে সব সদ্গুণ দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য তার শর্তহীন প্রেম। শুধু মাসুদ রানা নয়, সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত কোন বইয়ে আমরা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোন কিছু দেখতে পাই না। সেগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা, স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থন বা ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁঠালপাতার গন্ধ ছড়ানোর ব্যাপার নেই।

তবু কিছু খটকা আছে। এই পোস্টটা লেখার উদ্দেশ্য সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা এবং পাঠকদের সহায়তায় সত্যটা খুঁজে বার করার।

মাসুদ রানার একুশতম মিশনের নাম ‘ক্ষ্যাপা নর্তক’ প্রকাশকাল জুলাই ১৯৭১। ইউরোপ আর মিশরের পটভূমিতে বিজ্ঞানীদের হারিয়ে যাবার গল্প। এখানে রানার পরিচয় পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজিন্সের এজেন্ট

মাসুদ রানার বাইশতম মিশনের নাম ‘শয়তানের দূত’ প্রকাশকাল নভেম্বর ১৯৭১। ইউরোপের পটভূমিতে রানার প্রধানতম শত্রু কবীর চৌধুরীকে নিয়ে গল্প। এখানেও রানা ও সোহানার পরিচয় পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজিন্সের এজেন্ট

আমরা জানি, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে প্রথমে অপারেশন সার্চলাইটের নামে ঢাকায়, পরে সারা দেশে পাকিস্তান বাহিনী আর তাদের সহযোগীরা প্রতিদিন গণহত্যা চালিয়ে গেছে। মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যে ঘটানো গণহত্যার মধ্যে জিঞ্জিরা, গোপালপুর আর চুকনগরের গণহত্যার মতো বীভৎস ও নারকীয় ঘটনা আছে। ঢাকায় বসে গোপালপুর বা চুকনগরের খবর না পাওয়া গেলেও জিঞ্জিরার খবর ঢাকার সবাই জানতো। আর ২৫শে মার্চের রাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তো ঢাকাবাসী প্রতিটি মানুষ। আমার একটা খটকা হচ্ছে এই পরিমাণ গণহত্যা নিজের চোখে দেখে বা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে শোনার পরেও কাজী আনোয়ার হোসেন কীভাবে তার সৃষ্টি দেশপ্রেমিক মাসুদ রানাকে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট হিসেবে রেখে স্পাই থ্রিলার লিখে যান?

মাসুদ রানা’র ঊনিশতম মিশন ‘অটল সিংহাসন’-এর প্রকাশকাল জানুয়ারী ১৯৭১ এবং বিশতম মিশন ‘মৃত্যুর ঠিকানা’-এর প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারী ১৯৭১। তাহলে ধারণা করা যায় ফেব্রুয়ারী থেকে জুলাই পর্যন্ত কাজী আনোয়ার হোসেন ‘ক্ষ্যাপা নর্তক’ লিখে গেছেন। ঢাকায় বসে থেকে ঢাকার বাইরের খবর যদি একেবারেও পাওয়া না গিয়ে থাকে তাহলেও ঢাকায় ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর চালানো অপারেশনগুলোর কথা ঢাকাবাসীদের অজানা ছিল না। জুলাইয়ের আগে ৯ই জুন শাহ্‌বাগের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে চালানো প্রথম আক্রমণের কথা সবার মুখে মুখে ফিরেছে। ক্র্যাক প্লাটুনের চালানো মোট ৮২টি অপারেশনের কিছু কিছু জুলাই পর্যন্ত সময়ে ঘটেছে, তবে তার তীব্রতা বেড়েছে অগাস্ট থেকে। মুক্তিযুদ্ধ যখন ঢাকায় পৌঁছে গেছে তখনও কী করে কাজী আনোয়ার হোসেনের মনে হয়েছে মাসুদ রানাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট ও ভারতবিরোধী হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হবে?

প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আরেকটা কথা বলি, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে কাজী আনোয়ার হোসেন যখন ‘ক্ষ্যাপা নর্তক’-এর শেষ সম্পাদনাগুলো করছেন, ছাপাখানায় ছাপাচ্ছিলেন, এমনকি ‘ক্ষ্যাপা নর্তক’ যখন ছাপা হয়ে বিক্রির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্রে তখন রবিশংকর-জর্জ হ্যারিসনরা ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনে ব্যস্ত। অগাস্টের ১ তারিখে কনসার্টটা অনুষ্ঠিত হয়। এই দুটো ঘটনাকে পাশাপাশি রেখে একটু ভাবুন তো। কী মনে হচ্ছে আপনার?

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যে মাসটি সবচে’ কঠিন যুদ্ধময় কাটিয়েছে সেই মাসটা সম্ভবত নভেম্বর। আজমিরীগঞ্জের যুদ্ধ, বয়রার যুদ্ধ, গরীবপুরের যুদ্ধের মতো বড় মাপের যুদ্ধগুলো নভেম্বরে হয়েছে। এই মাসে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এর আগে সেপ্টেম্বরে বিমান বাহিনী আর এপ্রিল মাস থেকে সেনা বাহিনী আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। তার মানে নভেম্বরে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান বাহিনীর ওপর জল-স্থল-অন্তরীক্ষ সর্বত্র আক্রমণ হেনে গেছে। সেই সাথে ভারতীয় মিত্র বাহিনীও হামলা চালিয়ে গেছে। পাকিস্তান বাহিনী আর তাদের স্থানীয় সহযোগীরা তখন মরণ কামড় দিয়ে চলছে। এমন মহা দুর্যোগের কালে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে ২৪/৪ সেগুনবাগিচা থেকে ‘শয়তানের দূত’ প্রকাশিত হচ্ছে।

শুধুমাত্র অগাস্ট মাসে ক্র্যাক প্লাটুনের অপারেশনগুলো একটু ফিরে দেখি। ৭ই অগাস্ট ফার্মগেট চেক পয়েন্টে আক্রমণ, ১১ই অগাস্ট শাহ্‌বাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দ্বিতীয় দফা আক্রমণ, ১৪ই অগাস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে ঢাকা জুড়ে গ্যাস বেলুনের সাহায্যে অসংখ্য বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো, ১৯শে অগাস্ট সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে হামলা, ২৫শে অগাস্ট ধানমন্ডিতে অ্যাটাক অন দ্য মুভ পরিচালনা। বোঝা যাচ্ছে অগাস্ট মাস থেকেই ঢাকাস্থ পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের স্থানীয় সহযোগীদের নরক দর্শন শুরু হয়ে গিয়েছিল।

শুধু অগাস্টের এই আক্রমণগুলো নয়, গুলিস্তানের (পুরানা পল্টনের) গ্যানিজ পেট্রোল পাম্পে বা দাউদ পেট্রোল পাম্পে, এলিফ্যান্ট রোড-যাত্রাবাড়ী-আশুগঞ্জ-রামপুরা উলন পাওয়ার স্টেশনে চালানো আক্রমণগুলোর মতো ডজন ডজন আক্রমণের এক বা একাধিক ঢাকাবাসী কারও জ্ঞাতে আসেনি তা কি হতে পারে?

এই ব্যাপারে সত্য জানার জন্য আমার নিজের বৃহত্তর পরিবারের যে সব সদস্য ১৯৭১ সালে ঢাকা শহরে ছিলেন, এবং এখনো জীবিত আছেন, তাদের শরণাপন্ন হই। তাদের কাছ থেকে যে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো জানতে পারি সেগুলো হচ্ছেঃ

১. তারা জানতেন পাকিস্তানী বাহিনী সারা দেশে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।
২. তারা জানতেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এবং সুযোগ পেলেই সেখানে যোগ দেয়াটা কর্তব্য।
৩. তারা জানতেন জুন মাস পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারেননি, তবে বর্ষাকাল শুরু হবার পর থেকে পাকিস্তানীরা মার খেতে শুরু করেছে।
৪. ক্র্যাক প্লাটুন নামটা জানা না থাকলেও ঢাকাতে প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ চালাচ্ছে সেটাও তারা জানতেন।
৫. তারা জানতেন তাদের বৃহত্তর পরিবারের অনেকেই ইতিমধ্যে পাকিস্তানীদের হাতে শহীদ হয়েছেন।
৬. লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা কারও অবিদিত ছিল না, এবং তাদের কাউকে কাউকে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে অত্যাচারও চালিয়েছে। ধরে নিয়ে যাওয়া অনেকেই যে আর কোনদিন ফিরে আসবে না সেটাও তারা জানতেন।
৭. তারা জানতেন অনেকে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন এবং সেখানে তারা চরম দুর্দশায় আছেন।

এবং মোটেও আশ্চর্যের বিষয় নয় —

৮. তারা জানতেন যে যুদ্ধ দু-চার-দশ বছর চললেও এরপরে দেশ স্বাধীন হবেই। তাদের এই ধারণাটা ৭ই মার্চেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল, আর যুদ্ধ যে অত্যাসন্ন সেটা ইয়াহিয়া-ভুট্টোদের টালবাহানা এবং এখানে সেখানে পাকিস্তানী বাহিনী ও বিহারীদের চালানো হত্যাযজ্ঞ থেকে।

কিন্তু যারা তথাকথিত সারা দুনিয়ার সেরা সেনা বাহিনীর দক্ষতার ওপর আস্থা রেখেছিল, ফিটফাট-প্রশিক্ষিত নিয়মিত সামরিক বাহিনীর বিপরীতে লুঙ্গিপরা খালি গায়ের খালি পায়ের চাষাভুষোদের মুক্তিযুদ্ধে আস্থা রাখেনি, যারা বিশ্বাস করেছিল উত্তর থেকে হলুদরা আর দক্ষিণ থেকে সাদারা এসে ভারতীয় বাহিনী আর তার দালালদের ধুলায় মিশিয়ে দেবে তারা পাকিস্তান রাষ্রেদরর অখণ্ডতা সম্পর্কে নিঃসংশয় ছিল। সুতরাং তারা উপরোক্ত পয়েন্টগুলোর কোনটাকে ধর্তব্য জ্ঞান করেনি। এবং তারা সবকিছু স্বাভাবিক প্রমাণের ও পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মহড়া দিয়ে চলেছিল।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে জানতে পারি ঢাকার জীবনযাত্রা তখন মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। কেউ ঘর থেকে বের হলে সে ঘরে ফিরে আসবে সে নিশ্চয়তা ছিল না। জীবিকা নির্বাহ করা দুরূহ হয়ে পড়েছিল। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব লেগেই ছিল। মানুষের আয়রোজগার প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। নারীদের পক্ষে ঘরের বাইরে বের হওয়াটা আগুনে ঝাঁপ দেবার শামিল ছিল। যাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল তারা গ্রামের দিকে, সীমান্ত পার হয়ে ভারতে বা অন্য কোথাও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছিলেন।

এমন অবস্থায় কারা পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এজেন্টের বীরত্বব্যঞ্জক স্পাই থ্রিলার কিনে পড়তেন? কারা সেসব বই বিক্রি করতেন? কারাই বা সেগুলো ছাপাতেন? ঐসব বই বিক্রি না হলে প্রকাশক নিশ্চয়ই পাঁচ মাসের মধ্যে আরেকটা মিশনের কাহিনী নিশ্চয়ই বের করতো না! বইগুলো নিশ্চয়ই শুধু ঢাকায় বিক্রি হয়নি। তাহলে ঢাকা থেকে কী করে সেগুলো চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, কুমিল্লা, রংপুর, যশোর, বরিশালের মতো বড় শহরের দোকানগুলোতে গেল?

সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বই পড়ে আমি জীবিনে যা কিছু জেনেছি, বুঝেছি, শিখেছি আর কোন একক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বই পড়ে সেটা সম্ভব হয়নি। আমি জানি, এই কথাটা শুধু আমি না পাঠকদের অনেকেও বলবেন। তাই সেবা প্রকাশনীর কাছে আমাদের ঋণ অশেষ। সাহিত্যিক হিসেবে কাজী আনোয়ার হোসেনের ক্ষমতা, যোগ্যতা ও মেধার ব্যাপারে আমার কোন সংশয় নেই। তাই তাকে ঘিরে এই খটকাগুলো নিজের মনে পুষে রাখতে চাই না। পাঠকদের কেউ কেউ হয়তো এই খটকাগুলো দূর করতে পারবেন — সেই আশা রেখে গেলাম।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

অতিথি লেখক হিসেবে সম্পাদনার সুযোগ নাই তাই যে ভুলগুলো চোখে পড়লো সেগুলোর সংশোধনী এখানে দিলামঃ

১। শুরুর কোটেশনে, আশ্বর্য > আশ্চর্য
২। ৮ নং পয়েন্ট এমন হবেঃ তারা জানতেন যে যুদ্ধ দু-চার-দশ বছর চললেও এরপরে দেশ স্বাধীন হবেই। তাদের যুদ্ধজয়ের এই ধারণাটা ৭ই মার্চেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল, আর যুদ্ধ যে অত্যাসন্ন সেটা ইয়াহিয়া-ভুট্টোদের টালবাহানা এবং এখানে সেখানে পাকিস্তানী বাহিনী ও বিহারীদের চালানো হত্যাযজ্ঞ থেকে তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
৩। তার পরের অনুচ্ছেদে রাষ্রেদরর > রাষ্ট্রের

অতিথি লেখক এর ছবি

অত্যন্ত কৌতহল উদ্রেককারী লেখা। অপেক্ষায় থাকলাম খটকা গুলো দূর করবার আশায়।

অনন্যা

সোহেল ইমাম এর ছবি

হ্যাঁ সত্যিই, এভাবে কখনওই ভেবে দেখিনি। সেবা প্রকাশনী অন্তত কয়েকটি প্রজন্মের কাছে খুবই প্রিয় একটা প্রকাশনী, সে হিসেবে অন্যরকম একটা প্রত্যাশা থাকেই। সে হিসেবেই এটা ভাবতে ভালো লাগতো ঠিক সেই সময়টায় রানা সিরিজের বই প্রকাশিত আর করা হলোনা। পাকিস্তান বিষয়ে বিরূপতা থাকতেই পারতো। আবার মাসুদরানা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে এটা দেখানোর বিপদটাও ছিল, বিশেষ করে ঢাকার মত জায়গায় বসে। কিন্তু বই গুলো প্রকাশ হয়েইছে। হতে পারে প্রকাশণীর সাথে জড়িতদের রুজিরোজগারের প্রয়োজনেই সেবাকে এভাবে বই প্রকাশ চালিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু আবার প্রশ্ন জাগেই সে সময় বই কেনার ব্যাপারটা সত্যি কি রকম ছিল। এখন আমরা যেভাবে দেখি তখন সত্যিই কি সবাই ভেবেছিলেন দেশটা স্বাধীন হয়ে যাবে? নাকি যুদ্ধটাকে দর্শকের দূরত্ব নিয়ে দেখছিলেন কেবল। এখন সত্যিই প্রশ্ন জাগছে সে সময় আরো কি কি বই প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশে, সেগুলোর বিক্রিবাটাই বা কেমন ছিল।

লেখক তার নাম দিতেও ভুলে গেছেন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

চিন্তাজাগানিয়া লেখা।

দুটো বই প্রকাশের মধ্যের সময়টাতেই যে দ্বিতীয় বইটা লেখা হয়েছে তেমন নাও হতে পারে। এমনও হতে পারে বইগুলো আগেই লেখা, প্রকাশিত হয়েছে একাত্তর জুড়ে। একাত্তরে কিন্তু সবকিছুর মাঝেও মানুষের জীবন চলছিলো। স্বাভাবিকভাবে নয়, কিন্তু জীবন চলমান ছিলো। মুদি দোকানদারেরা যেমন দোকান খুলেছিলো যতটুকু সম্ভব তেমন অন্য অনেক ব্যবসায়ী চাকরিজীবীরাও পেটের দায়ে কাজে গিয়েছিলেন যতটুকু সম্ভব। সেইজন্য প্রকাশনার উপর এককভাবে দোষ চাপানোর আগে পরিস্থিতিটা বিবেচনা করা উচিত বলে মনে হয়। মাসুদ রানা সিরিজ তো মাসে একটা প্রকাশিত হতো বলে জানি। একাত্তরের আগে এবং একাত্তরে প্রকাশনার হারের কোনো পরিবর্তন কী লক্ষ্য করেছেন? জানা আছে আপনার?
বলে রাখি, কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রতি দূর্বলতা আছে বলেই এই যুক্তিগুলো বেশি গ্রহনযোগ্য মনে হচ্ছে আমার কাছে। সংশয় দূর হচ্ছে না যদিও।

সচলদের অনেকেই কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত। আশা করছি তাদের কেউ ওনার মুখে আমাদের সংশয় দূর করবেন।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

মুস্তাফিজ এর ছবি

অনেক ব্যবসায়ী চাকরিজীবীরাও পেটের দায়ে কাজে গিয়েছিলেন

কথাটা "পেটের দায়ে" না হয়ে "জীবন রক্ষার জন্য" হবে ।

...........................
Every Picture Tells a Story

মুস্তাফিজ এর ছবি

যুদ্ধকালীন সময়ে যারা দেশে ছিলেন/বাইরে যেতে পারেন নাই/থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন তাদের প্রায় সবাইকেই প্রচন্ড কষ্ট আর উৎকণ্ঠা নিয়ে বাইরে থেকে সবকিছু স্বাভাবিক দেখাতে হয়েছিলো।
কাজী আনোয়ার হোসেনদের ব্যাপারটাও এরকমই একটা কিছু।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি চতুর্থ শ্রেনীতে পড়তাম, আমাদের পরিবার যতদিন পর্যন্ত না শহর থেকে বাইরে যেতে পেরেছি ততদিন পর্যন্তই প্রতিদিন আমাদের বাধ্যতামূলক ভাবে স্কুলে যেতে হয়েছে। স্কুলে প্রথম পিরিয়ডের পরই হাজিরার খাতা স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে পাঠানোর বাধ্যবাধকতা ছিলো।
উপরের ঘটনাটা উল্লেখ করলাম শুধুমাত্র পরিস্থিতিটা বোঝানর জন্য। কাজী আনোয়ার হোসেনের পরিবার যেহেতু ঢাকাতেই ছিলেন (ধরে নিচ্ছি) সেহেতু সে সময়ে সেবা প্রকাশনী থেকে বই বের হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। বরঞ্চ উনি ঢাকায় আছেন আর বই বেরুচ্ছে না সেটাই হতো অস্বাভাবিক।

...........................
Every Picture Tells a Story

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

লেখকের নাম জানা হল না। যাই হোক, কিছু অব্জারভেশন আমারও ছিল, সেটা পরে জানাচ্ছি। এখন একটা অসঙ্গতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই- মাসুদ রানা যদি ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসেও পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের একজন স্পাই হিসেবে কর্মরত থাকেন, তাহলে তিনি মুক্তিযুদ্ধটা করলেন কখন? একাত্তরের নভেম্বরে সদ্য প্রকাশিত শয়তানের দূতে মাসুদ রানাকে একজন পাকিস্তানি স্পাই হিসেবে কর্মরত দেখলে সমসাময়িক কালে তাকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কল্পনা করাটা বোধ হয় একটু বেখাপ্পাই দেখায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনন্যা, সোহেল ইমাম, অনার্য সঙ্গীত, মুস্তাফিজ ভাই ব্লগ পড়ার ও মন্তব্য পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে যারা ছিলেন তাদের জীবন কেমন কেটেছে, কীভাবে কেটেছে সেটা আমি ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে শুনেছি। জীবন রক্ষার জন্য কাজে যোগ দিতে বাধ্য হওয়া বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালানোর কথা আমরা জানি। সেই বিবেচনায় কাজী আনোয়ার হোসেনও হয়তো তখন সেবা প্রকাশনী থেকে বই প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন – কিছুটা নিজের ও কর্মীদের রুটিরুজি রোজগারের জন্য, বাকীটা জীবন বাঁচানোর জন্য। হয়তো উনাকে বাধ্য করা হয়েছিল মাসুদ রানাকে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট হিসেবে দেখিয়ে বই প্রকাশ করতে। হয়তো ঐ অবরুদ্ধ সময়ে উনি রানাকে নিয়ে আসলে যা লিখতে চেয়েছিলেন সেটাই ‘এখনো ষড়যন্ত্র’তে লিখে দেখিয়েছেন। সত্যটা আসলে কী সেটা খোদ কাজী আনোয়ার হোসেন বলতে পারবেন। এই জন্য পাঠকদের সহযোগীতা চেয়েছি। কেউ কী উনার কাছ থেকে ঐ অবরুদ্ধ সময়ের কথাগুলো জেনে আমাদের জানাবেন?

অতিথি লেখক এর ছবি

আব্দুল্লাহ ভাই, এই অসঙ্গতিটা আমিও খেয়াল করেছি। হয়তো কাজী আনোয়ার হোসেন ইচ্ছে করেই এই অসঙ্গতিটা রেখে দিয়েছিলেন।

দুনিয়া  এর ছবি

লেখককে ধন্যবাদ ! এভাবে কখনো ভাবি নি । আশা করছি সেবা প্রকাশনী এই বিষয়ে তাদের মতামত দেবে ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।