দ্য অ্যালকেমিস্ট/ পর্ব-১ অণুকাহিনী ৫ ও পর্ব-২ অণুকাহিনী ৬

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০২/০২/২০২১ - ৫:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অণুকাহিনী ৫

ভোর হতে না হতেই স্ফটিকের দোকানীর ঘুম ভাঙ্গলো, আর যথারীতি আজকেও সেই একই দুশ্চিন্তা মাথা চাড়া দিচ্ছে। ত্রিশ বছর ধরে এই একই জায়গায়ঃ পাহাড়ী রাস্তার একেবারে মাথায় দোকানটা। হাতে গোনা মাত্র দু একজন করে খদ্দের আসে। কিন্তু এখন কোনকিছু যে নতুন করে ঢেলে সাজাবে সে সাহসও পাচ্ছেনা, কতকাল ধরে আছে এই দোকান- সারাজীবন সে এই একটা কাজই করা শিখেছে, স্ফটিকের বাসন-কোসন কেনা বেচা। এককালে কত লোক চিনত এই দোকানটাঃ আরব সওদাগর থেকে শুরু করে ফরাসীরা, ইংরেজ ভূবিজ্ঞানী, জার্মান সৈন্য সামন্ত, কত কি, ধর্নাঢ্য সব লোকেরা আসত এই দোকানে। প্রচুর বেচা বিক্রি ছিল সেসময় ~ তখন ভাবতো আস্তে আস্তে না জানি কত ধনীই হবে, সুন্দরী মেয়েরা তখন আশে পাশে ঘুরঘুর করবে।

কিন্তু সময় যত গেল, তাঞ্জিয়ের শহরটার অবস্থাও বদলালো। পাশের শহর স্যুতা, তাঞ্জিয়ের কে ছাড়িয়ে গেল একেবারে। লাটে উঠলো এখানকার ব্যাবসা বানিজ্য। আশে পাশের দোকান গুলো সব পাত্তাড়ি গোটালো। এখন পাহাড়ের এদিকটায় শুধু গুটি কয়েক ছোট্ট দোকান পড়ে আছে। লোকে কি আর ছোট দু-চারটা দোকানের জন্য এত কষ্ট করে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে এই উপরে আসবে!
অথচ স্ফটিকের দোকানী লোকটার কোন উপায়ও নেই। স্ফটিক বেচা কেনা করেই কাটল জীবনের ত্রিশটা বছর। নতুন করে অন্য কিছু একটা শুরু করার জন্য মনে হচ্ছে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

সারাটা সকাল বসে বসে সামনের রাস্তা ধরে পথচারীদের এদিক ওদিক যাওয়া আশা দেখল। গত কয়েক বছর ধরে এটাও তার একটা কাজ, তাই এদের সবার যাওয়া আশার সময় মোটামুটি মুখস্ত। কিন্তু দুপুরের খাবার খেতে যাবে ঠিক তার আগ মুহূর্তে, একটা ছেলে এসে দাঁড়ালো দোকানের সামনে। পোশাক আশাকে ভালোই মনে হচ্ছে, কিন্তু স্ফটিক দোকানীর অভিজ্ঞ চোখ দেখেই বুঝলো, ওর কাছে কোনো টাকাকড়ি নেই। তবুও সে ভাবলো আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে, ছেলেটার যাওয়ার পর দুপুরের খাবার সেরে নেবে।

***

দরজার ওখানটায় একটা কার্ড ঝুলানো- এই দোকানে বেশ কিছু ভাষার কথা বলা হয়। সান্টিয়াগো দেখলো কাউন্টারের পেছন থেকে একজন বেরিয়ে আসছে।

"আপনি চাইলে জানালার ওদিকের ঐ থালবাসন গুলো আমি পরিষ্কার করতে পারি।“ বলল সান্টিয়াগো। “ওগুলোর যা অবস্থা হয়েছে, মনে হয়না কেউ কিনতে চাবে।”

দোকানী ওর দিকে তাকালো, কিছু বললনা।

“তার বদলে, আপনি আমাকে কিছু খেতে দিয়েন।”

দোকানী নিরুত্তর, কিন্তু সান্টিয়াগো বুঝতে পারছে, লোকটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কি করবে। থলেতে জ্যাকেটটা আছে, আর এই মরুভূমির মধ্যে ঐ জিনিস নিশ্চয়ই আর দরকার হবেনা। জ্যাকেটটা বের করে কাঁচের জিনিস গুলো মোছা শুরু করলো সান্টিয়াগো। আধা ঘণ্টার মধ্যে জানালার পাশের সব থালবাসন মুছে একেবারে ঝাঁ চকককে। ও বাসন মুছতে মুছতেই দু জন খদ্দের আসলো দোকানে, কিছু জিনিস পত্রও কিনলো।
বাসন কোসন মোছা শেষ করে দোকানীর কাছে কিছু খাবার চাইল সান্টিয়াগো। “চলো, তাইলে খাইতে যাই,” বলল দোকানী।

দরজায় সাইন ঝুলিয়ে ওকে সাথে করে পাশের একটা ছোট রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুকলো। রেস্তোরাঁয় এই একটাই টেবিল। ওখানেই বসল দুজন। বসেই লোকটা হাসা শুরু করল।

“তোমার ঝাড়ামোছা করার কোনো দরকারই ছিলনা,” বলল দোকানী। কোরআনে বলা আছে, ক্ষুধার্ত কে খাইতে দিতে হয়।”

“তো আপনি আমাকে ঝাড়পোছ করতে দিলেনই বা কেন?” সান্টিয়াগো বলল।
“কারণ স্ফটিক গুলাতে এমনিতেও ধুলা জমছিল, আর তাছাড়া তোমার আমার দুইজনের মনের দুশ্চিন্তারও ঝাড়ামোছার দরকার ছিল।”

খেতে খেতে এক ফাঁকে দোকানী সান্টিয়াগোর দিকে ঘুরে তাকালো, বলল, “আমার মনটা বলতেসে আমার দোকানে তুমি কাজ কর। তুমি যখন ঝাড়ামোছা করতেছিলা তখন দুইজন খদ্দের আসছে, এইটা একটা ভালো লক্ষণ।”

লোকে লক্ষণ টক্ষণ নিয়ে ভালোই বলে, ভাবল সান্টিয়াগো, কিন্তু তারা জানেইনা যে কি বলছে। ঠিক যেমন আমি নিজেও বুঝিনি যে আমার ভেড়াদের সাথে বছরের পর বছর কোনো ভাষা ছাড়াই কথা বলে আসছিলাম।

“কি ভাব, কাজ করবা আমার দোকানে?” জিজ্ঞেস করলো লোকটা।

“আমি বাকি দিনটা আপনার কাজ করে দিতে পারি,” বলল ও। “সারা রাত কাজ করব, ভোর পর্যন্ত। আপনার দোকানের সব বাসন কোসন মুছে একেবারে ঝকঝকে করে দেব। কাল আমার মিশরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার ইচ্ছে। কাজের মজুরী হিসেবে আপনি আমার যাওয়ার টাকাটা দেবেন।“
সান্টিয়াগোর কথায় দোকানী হাসতে লাগল।

“আরে বাপরে বাপ, যদি সারা বছর আমার দোকানের থাল-বাসন মোছামুছির কাজ কর, এমনকি যদি দোকানের বেবাক বিক্রিতে ভালো পরিমাণ কমিশনও পাও, তারপরও মিশরে যাইতে তোমার টাকা ধার করতে হবে রে বাপ। এখান থেকে মিশর যাইতে মাঝখানে পড়বে হাজার হাজার কিলোমিটারের একটা বিশাল মরুভূমি, সেইটা জানো।”

কয়েক মুহূর্ত নীরবতা, পুরো শহর যেন ঘুমিয়ে পড়েছে এতোটাই নীরব মনে হচ্ছে সব। বাজার থেকে কোনো হাঁকডাক আসছেনা, দোকানীদের তর্কাতর্কি নেই, উঁচু মিনারে উঠে কারো আজান দেওয়ার নাম গন্ধ নেই। ওর স্বপ্ন, রোমাঞ্চকর ভ্রমণের আশা, কি বুড়ো রাজা, কি জীবনগল্পের গন্তব্য, গুপ্তধন, পিরামিড সব শেষ হয়ে গেল এই কথাটা শুনে, কিচ্ছু নেই আর। তাই যেন সান্টিয়াগোর মনের অবস্থাটা বুঝে সারা পৃথিবীতে পিন পতন নীরবতা। ওখানটায় বসে দরজা দিয়ে রেস্তোরাঁর বাইরে তাকিয়ে আছে সান্টিয়াগো, চোখে শূন্য দৃষ্টি। এর থেকে মরণও ভালো ছিল, মনে হচ্ছে সব ধ্বংস হয়ে যাক, সব ধ্বংস হয়ে যাক।

স্ফটিকের দোকানী লোকটা বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই দেখছে সান্টিয়াগোকে। তখন থেকে এত হাসি খুশি দেখল ছেলেটাকে, মুহূর্তের মধ্যে আবার কি হলো, কই গেল সব।

বলল, “বাপধন, চিন্তা কইরেননা, আমি আপনারে আপনার দেশে ফেরার খরচটুকু অন্তত দিতে পারি।”
সান্টিয়াগো কিছুই বললনা। উঠে পড়ল, পোশাক আশাক ঠিক করে নিয়ে থলেটা তুলে নিল।

“আমি আপনার দোকানে কাজ করব,” বলল সে।

আরো একটা দীর্ঘ নীরবতার পর বলল, “কিছু ভেড়া কেনার জন্য আমার টাকার দরকার।”

(এখানেই প্রথম পর্ব শেষ)

(দ্বিতীয় পর্ব শুরু)

অণুকাহিনী ৬

প্রায় মাসখানেক হতে চলল সান্টিয়াগো স্ফটিক দোকানীর দোকানটায় কাজ করছে। বেশ বুঝতে পারছে এসব ওকে দিয়ে হবেনা, কোন আনন্দই নেই এইসব কাজে। কাউন্টারের পেছন থেকে সারাদিন শুধু বুড়োর গজর গজর, যাতে ও সাবধানে কাজ করে, যাতে কিছু না ভাঙ্গে এই...।
দোকানী বুড়ো সারাদিন খিটখিট করলেও কাজটা সান্টিয়াগো চালিয়ে যাচ্ছে, কারণ বেতন দেবার বেলায় লোকটা এক্কেবারে হাতখোলা, ন্যায্য টাকা দেয়। উপরন্তু, প্রত্যেক বিক্রিতে সান্টিয়াগো ভালো কমিশনও পায়, আর এই করেই এর মধ্যে কিছু টাকাও জমাতে পেরেছে। সকালে একটু হিসেব করে দেখল, যদি এইভাবেই প্রতিদিন ও কাজ চালিয়ে যায় তাহলে আরো প্রায় বছর খানেক কাজ করলে কিছু ভেড়া কেনার মত টাকা জমবে।

“আমি একটা ডিসপ্লে বাক্স বানাতে চাই। সেটাতে আমরা স্ফটিকের থাল বাসন সাজিয়ে বাইরে পাহাড়ের নিচের ওইযে রাস্তাটা, ওখানে রেখে আসব যাতে ওদিক দিয়ে যাবার পথে লোকের নজরে পড়ে,” দোকানীকে বলল ও।

“আমি আগে কখনও ওইসব করিনাই, ওইভাবে স্ফটিকের থাল বাসন রাখিনাই,” বলল বুড়ো দোকানী। “লোকজন রাস্তা দিয়া যাওয়ার সময় ওই বাক্সের ওপর উশটা খাক আর সব ভাঙ্গুক আরকি, যত্তসব।”

“হ্যাঁ তা তো হতেই পারে, আমি যখন ভেড়া নিয়ে বের হই তখন কি হয়, তখন সাপের কবলে পড়লে আমার দুই একটা ভেড়া তো মরেও। কিছু কি করার আছে? কিছুই করার নেই, রাখাল আর ভেড়ার কপালে তো এইসব লেখাই থাকে।”

কোন খরিদ্দার তিনটা স্ফটিকের গ্লাস কিনতে চাচ্ছে দোকানী একবার তাকিয়ে তাকে দেখে নিলো। তার দোকানে সর্বকালের সেরা বিক্রি চলছে আজকাল... মনে হচ্ছে আবার সেই পুরাতন সময়টাতে ফিরে গেছে, যখন এই রাস্তাটা ছিল তাঞ্জিয়েরের প্রধান আকর্ষন গুলোর একটা।

“ব্যাবসাপাতি তো সত্যিই ভালো হইতেসে রে,” খরিদ্দার লোকটা চলে গেলে সান্টিয়াগো কে বলল সে। “আমার অবস্থা এখন অনেকটা ভালো, আর তুইও মনে হয় তাড়াতাড়িই তোর ভেড়াগুলার কাছে ফিরতে পারবি। জীবনে এর চেয়ে আর বেশি চাব ক্যান বলতো?”

“জীবনে এর চেয়ে বেশি চাব, কারণ আমাদের ঐশ্বরিক ইশারায় সাড়া দেওয়া উচিৎ,” কিছু না ভেবেই সান্টিয়াগো হুট করে বলে ফেলল কথাটা; পরক্ষণেই আফসোস হলো এটা বলার জন্য, কারণ স্ফটিক দোকানীর তো বুড়ো রাজাকে দেখার কথা না। এসব কথাতো বুঝবেনা সে।

“এটাকে বলে অনুকূলতার সূত্র, সূচনাকারীর ভাগ্য। কারণ জীবন চায় তুমি তোমার জীবনগল্পের একটা লক্ষ্যে পৌঁছাও তাই শুরুটা অন্তত করতে সাহায্য করে,” সেই বুড়ো রাজা সান্টিয়াগো বলেছিল এই কথাটা।

দোকানী অবশ্য তার মতো করে বুঝেছে কথাটার মানে। সান্টিয়াগো যবে থেকে তার দোকানে এসেছে সেদিন থেকে দোকানের সুদিন ফিরেছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই ড্রয়ার টাকায় ভর্তি হচ্ছে। ছেলেটাকে কাজে নিয়ে দোকানীর কোনো আক্ষেপ নেই। ওকে ওর প্রাপ্যর থেকেও বেশি বেতন দেয় সে। বেচা বিক্রি যে এতোটা ভালো হবে সেটা প্রথমটায় ভাবেইনি সে। তারপরও সান্টিয়াগো যাতে তাড়াতাড়ি নিজের দেশে নিজের ভেড়ার পালের কাছে ফিরতে পারে সেজন্য ওকে ভালো অঙ্কের কমিশন দেয়া শুরু করেছিল সে। তখন ভেবেছিল সান্টিয়াগো তো চলেই যাবে কটা দিন বাদে।

“তা, তুই পিরামিডের ওইদিকে যাইতে চাইস ক্যান?” ডিসপ্লে বাক্সের আলাপ থেকে সরে এসে মিশরের প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করল দোকানী।

“কারণ পিরামিডের কথা অনেক শুনেছি তাই” বলল সান্টিয়াগো, স্বপ্নের কথা কিছুই বললনা। গুপ্তধন এখন কেবলই দুঃসহ একটা স্মৃতির মত, সেইসব কথা এখন ভাবতেও চায়না আর।

“আমার জীবনেও শুনিনাই যে কেউ খালি পিরামিড দেখার জন্যই এই বিশাল মরুভূমি পার হবে,” বলল দোকানী। “শুধু গাদা গাদা কত্তগুলা পাথর। তুইতো চাইলে তোর বাড়ির পেছনের উঠানেও একটা পিরামিড বানায় নিতে পারবি।”

“আপনি দেশ বিদেশ ঘোরার স্বপ্ন দেখেননি, আপনি বুঝবেননা এইসব,” বলেই সদ্য ঢোকা এক খদ্দেরের দিকে ফিরল সান্টিয়াগো।

দুদিন পরে, দোকানী নিজেই সেই ডিসপ্লে বাক্সের প্রসঙ্গ তুলল।

“শোন, ওইসব বদল টদল আমার তেমন একটা ভাললাগেনা বুঝলি,” বলল দোকানী।
“তুই, আমি, আমরা তো আর হাসানের মত না। ঐ ধনী ব্যাবসায়ী হাসান আছে না? ব্যাবসায় কোনো ভুলটুল হইলে, ওর খুব একটা কিছু যায় আসেনা। কিন্তু আমাদের কি হবে তাতো জানিসই, আমরা তো আর হাসানের মত ধনী না। ভুল হইলে আমাদের মত মানুষের ভুলের মাশুল দিতে হয়।”

কথা সত্য, মনমরা হয়ে ভাবে সান্টিয়াগো।

“তোর কেন মনে হইল আমাদের একটা ডিসপ্লে বাক্স থাকা দরকার?”

“কেন আবার, আমার তাড়াতাড়ি আমার ভেড়াগুলোর কাছে ফেরা দরকার। আর তাছাড়া, এখন ভাগ্য যখন সদয় হয়েছে তখন আমাদের সুযোগের সদ্ব্যবহার করা দরকার। ভাগ্য যেমন আমাদের জন্য করছে, তেমন আমাদেরও ভাগ্য’র জন্য কিছু করা উচিৎ। এটাকে বলে অনুকূলতার সূত্র। সূচনাকারীর ভাগ্যও বলতে পারেন।”

দোকানী কতক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “নবীজি আমাদের কোরান এনে দিছেন, জীবদ্দশায় আমাদের পাঁচটা কাজ অবশ্যই করতে হবে। সবার আগে একজন এক অদ্বিতীয় সত্যিকারের খোদার উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। বাকি গুলা হইলো; দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করা, রমজান মাসে রোজা রাখা, আর গরিব মানুষরে দান খয়রাত করা।”
বলতে বলতে থেমে গেল সে। নবিজির কথায় চোখ পানিতে ছলছল করছে বুড়োর। লোকটা অস্থির প্রকৃতির হলেও পরহেজগার, খোদাভক্ত মুসলমান।

“আর পাঁচ নম্বর কাজ টা কি?” জিজ্ঞেস করল সান্টিয়াগো।

“দুইদিন আগে তুই বললি না, আমার নাকি দেশ বিদেশ ঘোরার স্বপ্ন নাই,” বলল দোকানী। “পাঁচ নাম্বার কাজটা হইলো হজযাত্রা, প্রত্যেক মুসলমানেরই করতে হবে। জীবন অন্তত একবারের জন্য হইলেও পবিত্র মক্কা ভূমি ঘুইরা আসতে হবে।
“মক্কা পিরামিডের থেকেও আরো বহুদূরে বুঝলি? জোয়ান বয়সে ভাবতাম সব টাকা একসাথে কইরা এই দোকানটা দাঁড় করাব। ভাবছিলাম একদিন না একদিন অনেক বড়লোক হব, মক্কা দর্শনে যাব। টাকা অবশ্য কিছু জমাইতেও পারছিলাম, কিন্তু কখনও কারো ভরসায় দোকানটা ছাইড়া যাইতে পারিনাই; স্ফটিকের জিনিসপত্র, ভাঙ্গতে টাঙ্গতে পারে। সেই সময়, মক্কা যাওয়ার পথে সবসময় আমার দোকানে লোক আসত, তাদের কেউ কেউ অনেক ধনী ছিল, উট, চাকর বাকর সব সহ কত বড় বড় কাফেলা নিয়া সফরে বের হইছে, তবে বাদ বাকিরা অবশ্য আমার চাইতেও গরিব ছিল।
“ধর্ম-কর্মের জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হইলে লোকগুলার মনে কি আনন্দ। বাড়ির দরজায় তারা পবিত্র ভূমি-যাত্রার নিশান লাগাইয়া সফরে বাইর হইতো। এঁদেরই একজন ছিল পেশায় মুচি, লোকের জুতো সারাইতো, সে কইসিল সে এক বছর ধরে মরুভূমি পার হইসে মক্কা যাওয়ার জন্য। অথচ এই তাঞ্জিয়েরের রাস্তায় রাস্তায় জুতার জন্য চামড়া খুঁজতে বের হইলেই নাকি সেই লোকের ক্লান্ত লাগত।”

“তো, এখনইবা আপনি মক্কায় যাচ্ছেন না কেন, এখনও তো যেতে পারেন?” সান্টিয়াগো জিজ্ঞেস করল।

“কারণ মক্কায় যাবো এই কথা ভাবতে ভাবতেই তো বাঁচতেছি রে। দেখনা এই বাক্স বন্দী স্ফটিকের জিনিস পত্র, দুপুর আর রাত্রে সেই একই জঘন্য হোটেলের খাবার। এইসবের মধ্যে মক্কায় যাওয়ার কথা ভাবলে আজকাল মনে একটু শান্তি পাই। আমারতো মনে হয় আমার এই স্বপ্নটা যদি পূরণ হয় তাইলে তো আমার বাঁচার ইচ্ছেই নষ্ট হয়ে যাবে।
“তুই স্বপ্ন দেখিস যে তুই পিরামিড দেখতে যাবি, তোর ভেড়াগুলার কাছেও ফিরবি একদিন। তুই আর আমি আলাদা, কারণ তোর জীবনের স্বপ্নটা কি তুই সেইটা বুঝতে চাইছিস, নিজের কাছে জানতে চাইছিস। কিন্তু আমি খালি মক্কা নিয়াই স্বপ্নই দেখতে চাই। হাজারবার কল্পনা করসি একই জিনিস, আমি মরুভূমি পার হচ্ছি, সেই পবিত্র পাথরের ওখানটায় গেলাম, ছোঁয়ার আগে সাতবার সেটাকে ঘুরলাম, আরো কত কি! কারা কারা আমার সাথে থাকবে, কারা আমার সামনে থাকবে, আমাদের কি কি কথা হবে, কি দোয়া করব সব ভাবা শেষ। এই যে এত আশা করছি, পরে আবার আমার আশার গুড়েবালি হোক, তার থেকে আমার স্বপ্ন দেখতে থাকাই ভালো।”

দোকানী সেদিন সান্টিয়াগোকে ডিসপ্লে বাক্স বানানোর অনুমতি দিল। কে জানে কার স্বপ্ন কিভাবে সত্যি হয়।

***

আরো দুই মাস চলে গেছে। পাহাড়ের নিচের ওই রাস্তার পাশে ডিসপ্লে বাক্সটা রাখায় দোকানে এখন অনেক লোক আসছে। সান্টিয়াগো হিসেব করে দেখেছে এভাবে যদি আরও প্রায় ছয় মাস কাজ করা যায়, তাহলে স্পেনে ফিরতে পারবে সে, ষাটটা ভেড়া তো কিনবেই, তারপর আরও ষাটটা কিনতে পারবে। এক বছরেরও কম সময়ে দ্বিগুণ ভেড়ার মালিক হবে। তারপর আরবদের সাথেও ব্যাবসা শুরু করবে, কারণ আরবদের ভাষাটাতো এখন জানা। সেদিনের বাজার চত্বরের সেই ঘটনার পর থেকে সে আর ইউরিম, থাম্মিম পাথর দুটো ব্যবহার করেনি, কারণ দোকানীর কাছে মক্কা যেমন একটা স্বপ্ন তেমন ওর কাছেও মিশর এখন সেরকমই একটা স্বপ্ন। যাইহোক, ও এখন এই কাজটায় মোটামুটি খুশিই বলা যায়। আর তাছাড়া সবসময় এখন মাথায় একটাই চিন্তা- কবে বিজয়ীর বেশে ও তারিফায় নোঙর করবে।

“তুমি কি চাও সেটা তোমাকে অবশ্যই জানতে হবে,” বুড়ো রাজার কথা এটা। সান্টিয়াগোও সেটা জানে, সেইজন্যই এখন উঠে পড়ে লেগেছে। এই আজব জায়গায় এসে চোরের কবলে পড়ে এমন বিধ্বস্ত হওয়াটাই হয়তো ওর ভাগ্যে ছিল। সেই চুরির ঘটনাটা ঘটেছিল জন্যেই হয়তো আজ এক কপর্দকও খরচ না করে ও ভেড়ার সংখ্যা আগের থেকেও দ্বিগুণ করতে পারবে, এইটাই হয়তো ওর সেই গুপ্তধন।

নিজেকে নিয়ে তার এখন একরকম গর্বই হচ্ছে। আর ফাঁকতালে কিছু দরকারি জিনিস শেখা হয়ে গেল, স্ফটিকের জিনিসপত্তরের যত্নআত্তি কিভাবে করতে হয়, শব্দ বাক্য ছাড়াও কত কথা বলা যায়, আর ঐশ্বরিক ইশারা বুঝতে পারার ব্যাপারতো আছেই। একদিন বিকেলে, ও দেখেকি এক লোক পাহাড়ের এই এত উপরে উঠে এসে চা-পানির কোনো দোকান না পেয়ে গজর গজর করছে। আর সান্টিয়াগোতো দৈব ইশারায় অভ্যস্ত হয়েই উঠেছে। মালিকের সাথে কথা বলল ও চায়ের ব্যাপারটা নিয়ে।

“পাহাড়ের উপরে এই জায়গায় একটা চায়ের দোকান হলে খারাপ হয়না, আমরা একটা চায়ের দোকান দিলে কেমন হয়?”
“কি! এখানে চা না থাকলে নাই, তাতে কার কি, চায়ের জন্য তো আরো অনেক জায়গা আছে,” বলল দোকানী।
“কিন্তু আমরা স্ফটিকের গেলাসে চা বিক্রি করতে পারি। লোকে তাহলে চা খেয়েও মজা পেল আর সেই সাথে গ্লাসও কিনল। আমি শুনেছি, সৌন্দর্যই নাকি সেই জিনিস যেটা যে কোনো মানুষের মন জয় করতে পারে।”

দোকানী সেই মুহূর্তে কিছু বললনা, তবে বিকেলের নামাজের পড়ে দোকান বন্ধ করে যখন হুঁকা টানতে বসলো, সান্টিয়াগোকেও ডাকল।

“আচ্ছা তোর মতলবটা কি বলতো?” জিজ্ঞেস করলো বুড়ো।
“আপনাকে তো বলেইছি। আমাকে দেশে ফিরে আবার আমার ভেড়াগুলো কিনে নিতে হবে, যাতে আমি সেই পরিমান টাকা নিয়ে ফিরতে পারি তাই এই সব চিন্তা।”

হুঁকায় আরো কিছু নতুন কয়লা পুরল দোকানী, জোরে টানল।

“ত্রিশ বছর ধরে আমার এই দোকান। কোনটা ভালো স্ফটিক, কোনটা খারাপ সব চিনি, এগুলোর নাড়িনক্ষত্র জানি আর স্ফটিকের ক্ষমতাও আমার জানা। আমরা যদি স্ফটিকের গেলাসে চা বিক্রি করা শুরু করি, কি অবস্থা হবে জানিস? দোকানের রমরমা অবস্থা হবে, আর তারপর আমার জীবন হয়তো পাল্টায় যাবে।”

“হ্যাঁ! তো, সেটাই তো ভালো, নয় কি?”

“আরে বাবা, যেভাবে দিন যাচ্ছে যাক না, আমি তো এতেই অভ্যস্ত। তুই আসার আগে আমি ভাবতাম কত সময় নষ্ট হলো এই ব্যাবসাটার পেছনে। আমার বন্ধুরা সবাই যে যার মত করে খাচ্ছে। কেউ কেউ ফতুরও হইল, কেউ কেউ আবার আগের থেকে ভালো অবস্থায় গেল। তখন ভাবলে এক রকম খারাপই লাগত। কিন্তু এখন যখন সেইসব ভাবি মনে হয়, কই, খুব একটা খারাপ সময়তো আমার যায়নাই। দোকানটা একদম ঠিক যতবড় করতে চাইছিলাম ততটাই করছি। এইবেলা আর কোনো কিছু বদলাইতে চাইতেসি না রে বাপ। অদল-বদল গুলো আমি ঠিক হজম করতে পারিনা। কি দরকার, ভালোই তো আছি।”

এর উত্তর কি হতে পারে সান্টিয়াগোর জানা নেই।

বুড়ো বলে গেল, “তুই আসলে আমার জন্য সত্যিই একটা আশীর্বাদ। একটা জিনিস আজকে বুঝতেছি, আগে বুঝিনাইঃ আশীর্বাদ কে যদি অবহেলা করা হয়, তবে সে আশীর্বাদ অভিশাপের রূপ নেয়, বুঝলি? জীবনে আমার আর কিছুই দরকার নাই। কিন্তু তুই ব্যাটা আমাকে ধন সম্পদের দিকে, অচিন সব ব্যাপার স্যাপারের দিকে উষ্কানি দিচ্ছিস। এখন যখন আমার চোখ খুলতেসে, আজকে যখন আমার এত সম্ভাবনা দেখতেসি, তখন তুই আসার আগে আমার যেমন খারাপ লাগত তার চেয়েও বেশি খারাপ লাগতেসে। খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারতেসি আমি কতদূর কি করতে পারতাম, কতদূর কি করতে পারি, কিন্তু সমস্যা হইলো, আমি সেইসব করতে চাচ্ছিনা।”

ভালো হয়েছে, তারিফার ঐ রুটির দোকানী কে ভাগ্যিস সেইদিন কিছু বলিনি, মনে মনে ভাবলো সান্টিয়াগো।

সূর্য ডুবতে বসেছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই দুজন হুঁকা টেনে চলল। আরবিতে কথা চলছে, আর সান্টিয়াগোর নিজেকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে, ও অন্য একটা ভাষায় অনর্গল কথা বলছে এই ভেবে। এক সময় ও ভাবতো ওর ভেড়ারা হয়তো ওকে দুনিয়াদারির সবই শেখাবে। কিন্তু কই, আরবি ভাষাতো আর ভেড়ারা ওকে শেখাতে পারলো না।

পৃথিবীতে আরো কতকিছুই হয়তো আছে যা আমার ভেড়ারা আমাকে কখনো শেখাতেও পারবেনা, বুড়ো দোকানীর কথা শুনতে শুনতে ভাবে ও। ওদের খাবার পানি খোঁজা ছাড়া কি আর কিছু করার ছিল কখনো! আর হয়তো ওরা কখনো আমাকে কিছু শেখায়ইনি, আমি নিজেই ওদের থেকে শিখে নিয়েছি।

“মাক্তুব,” এতক্ষণে আবার কথা বলল বুড়ো।

“মানে?”

“আরবের ঘরে জন্মাইলে বুঝতি এর মানে কি,” বলল বুড়ো। “তবে তোর ভাষায় মনে হয় এইটার মানে, ‘কপালের লিখন না যায় খণ্ডন।’”
হুঁকায় কয়লা ঠাসতে ঠাসতে বুড়ো বলল, সান্টিয়াগো স্ফটিকের গেলাসে চা বিক্রি শুরু করতে পারে। কি আর করা, জীবনপথের এই নদী কখনও কখনও কোনোভাবেই আর আটকানো যায়না।

পাওলো কোয়েলো

অনুবাদ- জে এফ নুশান

পর্ব-১ অণুকাহিনী ৪
পর্ব-১ অণুকাহিনী ৩
পর্ব-১ অণুকাহিনী ২
পর্ব-১ অণুকাহিনী ১


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।