দ্য অ্যালকেমিস্ট/ অণুকাহিনী ৮

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০১/১০/২০২১ - ৭:৪৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সূর্য উঠতে উঠতে সান্টিয়াগোর ঘুমও ভেঙ্গে গেল। যেখানে আগের রাতে চোখের সামনে তারার মত বিন্দু বিন্দু আলো দেখেছিল ও, এখন সেখানে শুধু সারি সারি খেজুর গাছ, যতদূর চোখ যায়।

“বাব্বাহ, আমরা শেষ পর্যন্ত আসতে পারলাম তাহলে!” বলল ইংরেজ, সেও উঠে পড়েছে।
সান্টিয়াগো কিছু বলছেনা। মরুর নৈঃশব্দ্য কে সায় দিয়ে ও ভেতরেই বসে থাকল। দু চোখ ভরে গাছপালা দেখতেই ভালো লাগছে। পিরামিড আসতে এখনও বহু বাকি। আজকের সকালের এই অনুভূতি একদিন স্মৃতি হয়ে যাবে। কিন্তু এটাই এখনকার মুহূর্ত- উট-চালক লোকটা কি এই মুহূর্ত মুহূর্তে বেঁচে থাকা জীবনের উৎসবের কথাই বলেছিল! যে মানুষ অতীতের পোড়খাওয়া, যার কাছে ভবিষ্যত স্বপ্নের মত, সেইতো মূহূর্তের আনন্দে বেঁচে থাকতে চায়। হয়ত একদিন এই খেজুর গাছের সারি শুধুই স্মৃতির পাতায় ঠাঁই নেবে, নিলইবা, এখনকার মত এটাইতো আশ্রয়, জল-খাবারের ভরসা, যুদ্ধের কবল থেকে বাঁচা। গতকাল উটের ঘোঁৎ ঘোঁৎ শুনে কি ভয়টাই না লেগেছিল- কী হয় কী হয় না ভেবেই কূল কিনারা পাচ্ছিলনা দলের লোকজন। সান্টিয়াগোও কম ভয় পায়নি, আর এখন এই সারি সারি খেজুর গাছ দেখে মনে হচ্ছে এ পর্যন্ত যে ওরা আসতে পেরেছে এটাইতো একটা অলৌকিক ঘটনা। সত্যি, এই দুনিয়া ক্ষণে ক্ষণে সুর পাল্টায়- এই সব হাবিজাবি ভাবছে সান্টিয়াগো।

সময় দ্রুত চলে যায়, কাফেলাগুলোও তাই, মরুবাগিচার শত শত নতুন মানুষ আর জীবজন্তুর নতুন আসা দলটা দেখতে দেখতে ভাবল অ্যালকেমিস্ট। পৌঁছেই লোকেরা একী হই-হুল্লোড় জুড়ে দিল! ওদের কোলাহল মুখর পদচারনায় শুষ্ক ধুলো উড়ছে, সেই ধুলো ভাসতে ভাসতে গ্রাস করে নিচ্ছে মরুসূর্য। আর মরুদ্যানের বাচ্চাগুলোও যা; নতুন লোকের দল এসেছে দেখে এমন মাতন জুড়েছে, চিৎকার চেচামেচিতে কী যে একটা অবস্থা!

অ্যালকেমিস্ট দেখল মরুদ্যানের গোষ্ঠী-প্রধানেরা নতুন আসা কাফেলাটার সর্দারের সাথে দেখা করতে গেলো, লম্বা সময় নিয়ে কথাও বলল।
কিন্তু তার এসবের কিছুতেই কিছু আসে যায় না। কত লোক এলো গেল, মরুভূমিতো সেই একই আছে। এই মরুর বুকের ওপর দিয়ে চলে গেছে কত রাজা, কত ভিখারি, সব দেখা আছে তাঁর। বালির টিলাগুলো বাতাসের তোড়ে অনবরত বদলে যায় ঠিকই, কিন্তু তাতে কি, শৈশব থেকে যে বালি দেখে আসছে সবতো সেই একই বালি, এখানে এই মরুতেই ঘুরপাক খায় সব।

সপ্তাহের পর সপ্তাহ পাণ্ডুর বালুরাশি আর নীল আকাশ দেখতে দেখতে ক্লান্ত মরুর পথিকের চোখ যখন প্রথম এই সারি সারি সবুজ খেজুর গাছ দেখতে পায়, সেই অনুভূতির কোনও তুলনাই হয়না, মনে হয় এই দুনিয়ায় খেজুর গাছের মর্ম ওরাই প্রথম বুঝতে পারল, আর তার জন্যই বুঝি খোদা এমন মরুভূমি বানিয়ে রেখেছে। অ্যালকেমিস্টের ভালোই লাগে মানুষগুলোর এই উল্লাস দেখতে।

যাইহোক, এবার কাজে মন দেয়া দরকার। মন বলছে, ওই কাফেলায় কেউ একজন আছে যাকে কিছু গোপন বিষয়ে তালিম দিতে হবে। ঐশ্বরিক কিছু ইঙ্গিত থেকে এমন মনে হচ্ছে অ্যালকেমিস্টের। কে সেই একজন তা সে এখনও জানেনা, কিন্তু সেই ব্যক্তির যখন আগমন ঘটবে তখন তার অভিজ্ঞ চোখ ঠিকই সেটা ধরে ফেলবে। এখন আশা শুধু একটাই; এবারেরটাও যেন অন্ততপক্ষে আগের ছাত্রটার মত হয়।

আমি বুঝিনা, এইসব বিদ্যা কেন মানুষকে মুখে মুখেই শেখাতে হবে, ভাবে অ্যালকেমিস্ট। এমনওতো না যে এগুলো তেমন আহামরি কোনো গুপ্ত কিছু; খোদাতো সব গুপ্ত ব্যাপার তাঁর সব সৃষ্টির মাঝেই উন্মোচন করেছেন।
ভেবে ভেবে এটার একটা কারণই বের করেছে অ্যালকেমিস্ট: এভাবে এইসব বিদ্যা মানুষকে মুখে মুখে শেখানোর কারণ হলো, এই কথাগুলো একদম জীবনের বিশুদ্ধতা থেকে নিঙরে নেয়া, যে জীবন-কথা কোনও মনুষ্যসৃষ্ট ছবি বা শব্দে ধরা পড়েনা। কারণ মানুষের কাজই হলো ছবি আর শব্দের আতিশয্যে মজে গিয়ে বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের ভাষা বলতে যে জিনিসটা আছে শেষমেশ সেটাই ভুলে যাওয়া।

সময় যত গড়াচ্ছে, সান্টিয়াগো যেন নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছে না, একী দেখছে! এই কি তবে মরুদ্যান!
মনে আছে ভূগোল বইয়ে মরুদ্যানের ছবি দেখেছিল- একটা জলাশয়ের চারপাশে কিছু খেজুর গাছ। কিন্তু এতো একেবারে এলাহি কান্ড! এই একটা মরুদ্যানইতো স্পেনের অনেক শহরের থেকেও অনেক বড়। তিনশ জলাধার আর পঞ্চাশ হাজার খেজুর গাছ নাকি এখানে; আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অগনিত বর্নিল সব তাঁবু।

“এতো দেখি ঠিক আরব্য রজনীর উপন্যাসের সেই এক হাজার এক রাত্রি’র মতো,” বলল ইংরেজ, অ্যালকেমিস্টের সাথে দেখা করার জন্য অধীর হয়ে আছে।

বাচ্চা কাচ্চাগুলোর একটা অতি উৎসাহী দল ওদের ঘিরে ধরে দেখছে।

মরুদ্যানের পুরুষেরা ওদের কাফেলার লোকজনদের জিজ্ঞেস করল আসার পথে কোনো যুদ্ধ বিগ্রহ দেখেছে কিনা। আর মেয়ে, বৌ সব একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে হামলে পড়ে দেখতে গেল নতুন আসা সওদাগরেরা কী কী জামা-কাপড়, সাজার জিনিস আর মনি-মুক্তা এনেছে।

মরুভূমির সেই নৈঃশব্দ্য এখন কোথায় হারালো! মনে হচ্ছে সেটা কোন দূরের স্বপ্ন ছিল; কাফেলার যাত্রীরা অনর্গল কথা বলছে, হাসছে, চ্যাঁচাচ্ছে, যেন এক আধ্যাত্মিক জগত থেকে বের হয়ে ওরা এই মাত্র নিজেদেরকে কোনও এক মানব জগতে আবিষ্কার করল। সবাই এখন কত খুশি, হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।

ওরা যখন মরুভূমিতে ছিল তখন সবাই অনেক সাবধান হয়ে ছিল, কিন্তু মরুদ্যানে সেই সাবধানতা, ভয় ভীতি নেই। উট চালক অবশ্য সান্টিয়াগোকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছে। ব্যাপারটা হচ্ছে- গোষ্ঠী গুলোতে যতই যুদ্ধ বাঁধুক, মরুদ্যানগুলো সবসময়ই একটা নিরপেক্ষ জায়গা হিসেবেই ছেড়ে দেয় ওরা, এর প্রধান কারণ- মরুদ্যানের অধিকাংশ বাসিন্দাই নারী ও শিশু। এই বিশাল মরুর নানান জায়গায় মরুদ্যান আছে, কিন্তু আদিবাসী গোষ্ঠীর লোকেরা যুদ্ধ করে শুধু মরুভূমি অংশ গুলোতে, মরুদ্যানে কিন্তু তারা আক্রমন করেনা, মরুদ্যান টাকে ওরা মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে ছেড়ে দেয়।

কাফেলার সবাইকে একজোট করতে সর্দার লোকটাকে খানিক কায়দা কসরত করতে হলো। তারপর সে কিছু নির্দেশনা দিল। বলল যতদিন না মরুভূমির গোষ্ঠীদের মধ্যকার যুদ্ধ শেষ হয় ততদিন দলের সবাইকে এই মরুদ্যানেই থাকতে হবে। যেহেতু ওরা সবাই আগন্তুক, তাই যারা এখানে আগে থেকেই আছে, তাদের সাথেই ওদেরকে জায়গা ভাগাভাগি করে থাকতে হবে। জানালো, ওদের থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো বন্দোবস্ত যেটা করা সম্ভব এদের পক্ষে, এরা সেটাই করবে। এটাই মরুদ্যানের প্রথাগত আতিথেয়তা। তারপর সর্দার বলল, দলের প্রত্যেকটা লোক, এমনকি তার নিজের রক্ষীবাহিনীর শান্ত্রীরাও যেন মরুদ্যানের গোষ্ঠী প্রধানদের দ্বারা নিযুক্ত পুরুষদের কাছে তাদের অস্ত্রগুলো জমা দিয়ে দেয়।
“অস্ত্র-শস্ত্র, ওসব যুদ্ধের কায়দা কানুন,” বুঝিয়ে বলল সে। “মরুদ্যানে অস্ত্রধারীদের, সৈন্য-সামন্তদের কোনো স্থান হবেনা।”

সান্টিয়াগোকে অবাক করে দিয়ে ইংরেজ থলের ভেতর থেকে একটা পিস্তল বের করল, ক্রৌমিয়ামের মিনা করা, তারপর যে লোকটা ওদের অস্ত্র সংগ্রহ করতে এসেছিল, ওকে দিয়ে দিল।

“পিস্তল ছিল আপনার সাথে?” জিজ্ঞেস করল সান্টিয়াগো।

“হ্যাঁ ছিল। এতে আমি মানুষের উপর কিছুটা ভরসা করতে পারি,” বলল ইংরেজ।

এতোসব কিছুর মধ্যেও সান্টিয়াগোর মাথায় গুপ্তধনের চিন্তাই ঘুরঘুর করছে। স্বপ্ন পুরণের দিকে যতই আগাচ্ছে, ততই সব কিছু কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বুড়ো রাজা কোন কাজের শুরুতে যে সূচনাকারীর সুপ্রসন্ন ভাগ্য বলতে একটা ব্যাপারের কথা বলেছিল সেটা এখন আর খাটছেনা। স্বপ্নের দিকে যতই ধাবিত হচ্ছে যেন ততই ওর ধৈর্য্য আর সাহসের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। তাই চটজলদি করে যে কিছু একটা করবে সেটাও পারছেনা, আবার ধৈর্য্য হারাও হতে পারছেনা। যদি ঝোঁকের বশে হুট করে কিছু করে ফেলত তাহলে সারা পথে ঈশ্বরের দেখানো লক্ষণ আর ইশারা-ইঙ্গিত যা ছিল সেসব ধরতেই পারতোনা।
ঈশ্বর সত্যিই ওসব ইশারা-ইঙ্গিত আমার চলার পথে ফেলে রেখেছিল! ভেবে আপনাআপনি বিস্মিত হলো সান্টিয়াগো। এতদিন পর্যন্ত ভাবত ইশারা-ইঙ্গিতের ঘটনাগুলো দুনিয়ার আর সব কিছুর মতই কিছু। খাওয়া, ঘুম, ভালোবাসা খোঁজা, চাকরি খোঁজা এসবের মতই কিছু একটা। সে কী করবে না করবে সেই সঙ্কেত দেওয়ার জন্য ঈশ্বর বসে আছে, আবার ইশারা ইশারা-ইঙ্গিতও পাঠাচ্ছে, সেগুলো ঈশ্বরের ভাষায় বলা কথা- এইসব চিন্তাতো কখনোই মাথায় আসেনি!

“অধৈর্য্য হইয়ো না,” আবার স্বগতোক্তি করল ও। “উট চালক যেমনটা বলেছিল: 'খাওয়ার সময় খাও। তারপর আগে বাড়ার সময় আগে বাড়ো।' ”

আসার পর প্রথম রাতে ক্লান্ত শ্রান্ত সবাই ভোঁসভোঁস করে ঘুমালো, এমন কি ইংরেজও। সান্টিয়াগোর জায়গা হয়েছিল তার থেকে দূরের একটা তাঁবুতে, আরও পাঁচটা ছেলের সাথে, বয়সের দিক থেকে ওরা ওর সমানই হবে। এখানকার মরুভূমিরই ছেলে ওরা। সকাল সকাল উঠেই সান্টিয়াগোর কাছ থেকে বড় শহরের গল্প শোনার জন্য একদম হা আছে, কী চিল্লাপাল্লাই না জুড়ে দিয়েছে ছেলেগুলো।
সান্টিয়াগো রাখাল জীবনের গল্প সল্প খানিকটা বলল ওদের, তারপর স্ফটিকের দোকানে কাজ করার কথা বলতে নিয়েছিল এমন সময় ইংরেজ উঁকি দিল।

“সারা সকাল ধরে তোমাকে খুঁজে মরছি হে,” ওকে নিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল ইংরেজ। “তোমাকে আমার দরকার, ওই অ্যালকেমিস্ট লোকটা কোথায় থাকে সেটা বের করতে হবে, চল চল।”

প্রথমে ওরা নিজে নিজেই খোঁজার চেষ্টা করল খানিকক্ষণ। মরুদ্যানের আর সব লোক যেভাবে থাকে সেভাবেতো আর অ্যালকেমিস্ট থাকবেনা, সে থাকবে অন্য কোনোভাবে, যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে - ওর তাঁবুতে সারাক্ষণ একটা চুলা জ্বলতেই থাকবে। ওরা সবখানেই খুঁজল, টের পেল কল্পনার চেয়েও বিশাল এক জায়গা এই মরুদ্যান; শত শত তাঁবু।

“ধুর, দিনটাই গচ্চা,” সান্টিয়াগোকে নিয়ে একটা কুপের পাশে বসতে বসতে বলল ইংরেজ।

“আচ্ছা এভাবে না খুঁজে এখানকার কাউকে জিজ্ঞেস করলে ভালো হয় না?” বলল সান্টিয়াগো।

মরুদ্যানে আসার কারণটা আসলে ইংরেজ কাউকে জানাতে চাচ্ছিলনা, তাই সেটা ঠিক হবে কিনা~ দোনোমনো করছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাজি হলো।

ঠিক হলো, সান্টিয়াগো যেহেতু তার চেয়ে ভালো আরবি জানে তাই ওই খোঁজ খবর করবে।

একটু পর দেখল, কূপের দিকে একটা মহিলা আসছে, হাতে ছাগলের চামড়ার মশক, পানি নিতে আসছে বোঝাই যায়। সেদিকে এগোল সান্টিয়াগো।

“এই যে। এই যে, শুনছেন? এই মরুদ্যানে একজন অ্যালকেমিস্ট থাকে, কোথায় থাকে বলতে পারবেন?”

মহিলা ভীষণ অবাক। বলল, অমন লোকের কথা নাকি বাপ জনমেও শোনেনি, বলে তড়িঘড়ি করে কেটে পড়লো। যাওয়ার আগে বলল, "শোনো বাপু, কালো কাপড় পড়া মহিলাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা না করাই ভালো। কালো কাপড় পড়া মেয়ে মানুষ দেখলে বুঝবে, ওরা বিবাহিত। তোমাদের দেশের কথা জানিনা বাবা, কিন্তু আমাদের দেশে এটাই নিয়ম। সে দেশে যে আচার, মনে থাকবে?"

ইংরেজের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। শুধু শুধু এ কোথায় আসল!

লোকটার জন্য সান্টিয়াগোরও খারাপ লাগছে; বেচারা কী সব জীবনখাতার গল্পের পেছনে ছুটতে ছুটতেই এতদূর আসল। কিন্তু কেউ যখন জীবনে এমন সাধনায় নামে, তখনতো এই বিপুল বিশ্বচরাচরের কায়দা কসরত করতে থাকার কথা যাতে তার সাহায্য হয়, যাতে সে সফল হয়- বুড়ো রাজাতো এটাই বলেছিলেন। তাঁর কথাতো বৃথা হতে পারেনা।

“অ্যালকেমিস্ট নামে কারো কথা বাপ জনমেও শুনিনি,” মহিলার কথাটাই বিড়বিড় করল সান্টিয়াগো। “এখানে কেউই মনে হয় অ্যালকেমিস্ট নামে কারো কথা শোনেনি।”

একথা কানে যেতেই ইংরেজের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। “আরে, তাইতো! একদম ঠিক! অ্যালকেমিস্ট কি জিনিস তা হয়তো এখানকার কেউ জানেইনা। আমরা যাকে অ্যালকেমিস্ট নামে জানি, সভ্যজগত থেকে দূরে এখানকার লোকজনও কি তাকে অ্যালকেমিস্ট নামে চিনবে নাকি অ্যা? আমাদের খুঁজতে হবে, এখানে কে এদের অসুখ বিসুখ সারায়।”

এর মধ্যে কালো কাপড় পরা আরও কয়েকটা মহিলা পানি নিতে এসেছিল। ইংরেজের সে কী জোরাজুরি, সান্টিয়াগোর এখনই ওদের সাথে গিয়ে কথা বলতে হবে। ঠিক হতোনা সেটা, ওদের সবার পড়নে আপাদমস্তক কালো কাপড়, তারমানে বিবাহিত, কথা বলাটা ভদ্র দেখায়না।

খানিক বাদে এক লোককে আসতে দেখা গেল।

তাকে দেখে ধরে বসল ও, “এইযে শুনছেন, আচ্ছা, এখানে কি কাউকে চেনেন যে অসুখ বিসুখ সারায় আপনাদের?”

লোকটা কিভাবে তাকাচ্ছে সান্টিয়াগোর দিকে, “আল্লাহপাক আমাদের রোগ বালাই সারায়!” বোঝা যাচ্ছে এই দুই আগন্তুক দেখে ভড়কে গেছে। “কী জানি বাবা, কোন ডাকিনী বদ্যি খুঁজছ তোমরা কে জানে!” তাড়তাড়ি সটকে পড়ল ওখান থেকে, যেতে যেতে কোরান শরীফের কয়েকটা আয়াত আওড়ালো।

হাতে একটা ছোট্ট বালতি নিয়ে আরেকটা লোককে আসতে দেখা গেল। বয়সে আগের জনের চেয়ে বড়। একেও সান্টিয়াগো একই কথাই জিজ্ঞেস করল।

আরব লোকটার ভ্রূ-জোড়ায় কৌতুহল, “ক্যান্‌?”

“কারণ আমার এই বন্ধুটি মাসের পর মাস ধরে এত দূর রাস্তা পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছে তার সাথে দেখা করতে।”

“আপনেগো কী ধারণা, সে কি আপনেগোরে দেখা দিব? এইখানে তেমন লোক যদি থাকেও, সে হবে হাপর শ্রেনীর মানুষ,” কয়েক মুহূর্ত ভেবে উত্তর দিল লোকটা। “আমাগো বাঘা বাঘা নেতারাও চাইলে তার লগে দেখা করতে পারেনা, শুধু সে নিজে থেইক্যা যখন দেখা দেয় তখনই তার দেখা মেলে। শোনেন ভাই, যুদ্ধটুদ্ধ শেষ হওয়া নাগাদ থাকেন, যুদ্ধ শেষ হইলে পাত্তারি গোটাইয়া কাফেলার লগে বিদায় হন। আমাগো জীবনের ভেতর ঢুইক্যা নাক গলাইয়েন না,” বলে চলে গেল লোকটা।

একথা শুনে ইংরেজকে আর পায় কে। লোকটার এই প্রচ্ছন্ন হুমকিতে ইংরেজের মনে হলো ওরা ঠিক পথেই এগোচ্ছে।

একটা অল্প বয়সী মেয়েকে আসতে দেখা গেল। সে অবশ্য কালো পোশাক পরেনি। কাঁধে করে একটা কলসি বয়ে আনছে। মুখটা অনাবৃত, মাথায় ঘোমটা টানা। অ্যালকেমিস্ট এর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে মেয়েটার দিকে এগোলো সান্টিয়াগো।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে হলো মহাকাল থেমে গেছে। পৃথিবীর অন্তরাত্মার কি ডানা গজালো! সেই অন্তরাত্মা শত তরঙ্গের ঝাপটায় বুকের ভেতরে এ কী কান্ড জুড়ে দিল! ওই দুটি গভীর কালো চোখের দিকে সান্টিয়াগোর চোখ পড়তেই ও দেখলো- এক অখন্ড স্তব্ধতার মাঝে সেই ঠোঁট জোড়ায় ঝুঁলে আছে এক টুকরো হাসি। তখনই, ঠিক তখনই সান্টিয়াগো টের পেল গোটা পৃথিবীর এক অনন্য ভাষায় লেখা বইয়ের সবথেকে মূল্যবান এক অধ্যায়ের কথা~ যে কথা কাউকে বলে দিতে হয়না, যে কথা মর্মের গভীরে গিয়ে অনুরণিত হয়, যে কথা জগতের সকলেই নিজের হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করে নিতে পারে, এ সেই কথা। এর নাম কি তাহলে ভালোবাসা? এই অনুভূতির বয়স মানবতার চাইতে বেশি, এর বয়স মরুর চাইতে আরও কত যে প্রাচীন! আজ এখানে এই জলাধারের পাশে চার চোখের মিলনে দুটো হৃদয় সমান ভাবে টের পেল পৃথিবীর সেই সুপ্রাচীন অনুভবের কী তেজ। মেয়েটা হাসল। সেটা নিশ্চয় একটা দৈব ইশারা – ওইরকম একটা ইশারার জন্য নিজের অজান্তেই সান্টিয়াগো অপেক্ষায় ছিল ওর সারাটা জীবন। আন্দালুসিয়ার সুবৃহৎ চারণভূমিতে ভেড়ার পাল নিয়ে চরে বেড়াবার সময় যে ইশারা ও খুঁজেছিল, খুঁজেছিল ওর পড়া বইগুলোর পাতায় পাতায়, শুভ্র স্ফটিকের মাঝে, খুঁজেছিল মরুর নিঃসীম নীরবতায়।
ওটা পৃথিবীর সেই খাঁটি ভাষা। যেমন বিপুল মহাবিশ্ব এইযে নিরবধি বয়ে চলেছে অনন্তকাল তার কোনো ব্যাখ্যা লাগেনা, ঠিক তেমনই পৃথিবীর সেই খাঁটি ভাষার কোনো ব্যাখ্যা প্রয়োজন হয়না। ওই মুহূর্তে সান্টিয়াগো টের পেল সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওর জীবনের একমাত্র নারী, কাউকে কিচ্ছু বলে দিতে হলোনা, টের পেল মেয়েটাও অবধারিত ভাবে জেনে গেছে ওর হৃদয় আর মগজে ঘটে চলা এতোসব কিছু। এই নিশ্চিত অনুভবের চেয়ে জীবনে আর কোনো কিছুই সান্টিয়াগোর কাছে এতোটা অমোঘ হতে পারেনা।

বাপ দাদার কাছ থেকে কত কী শুনেছে। প্রেম হতে হলে প্রথমে নাকি খুব ভালো করে জানা-শোনা হতে হবে, সম্পর্কের অঙ্গীকার, দায়-দায়িত্ব এইসবকিছু বুঝতে হবে। অবশ্য যারা এমনভাবে চিন্তা করে তারা হয়তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভাষার ব্যাপারটাই জানেনা, ওদেরকে দোষ দিয়ে কি লাভ। কারণ ওই ভাষা জানা থাকলে অনেক বোঝাবুঝিই সহজ হয়ে যায়। সহজেই বুঝে নেয়া যায় যে এই পৃথিবীতে এমন একজন আছে যে তার প্রতীক্ষাতেই আছে, তা সেটা রুক্ষ ঊষর মরুর মধ্যেখানেই হোক আর সুরম্য নগর-সভ্যতাতেই হোক। আর যখন এমন দুজন মানুষের দেখা হয়ে যায়, এমন দু-জোড়া চোখ যখন একে অন্যের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন অতীত, ভবিষ্যৎ সব তুচ্ছ হয়ে যায়। সেখানে টিকে থাকে শুধু ওই মুহূর্তটুকু, ওই মুহূর্তটুকুই মহাকাল থেমে যাওয়া এক মহা-লগন। তাই আজ এখানে টিকে থাকল অবিশ্বাস্য এক অনিবার্যতা, যে অনিবার্যতার আবেশ বলে দেয়- সূর্যের আচ্ছাদনের নিচে যত কিছু আছে, সব শুধু একটি হাতেই লেখা। এ সেই হাত যে হাত প্রেমকে মাথাচাড়া দেওয়ায়, এ সেই হাত যে হাত পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য একটি দ্বৈত আত্মা সৃষ্টি করে।
প্রেমের এই প্রকান্ড অনুরণন যদি না থাকত, তাহলে মানুষের স্বপ্নগুলোরও কোনও অর্থ থাকতনা।

(চলবে)

পাওলো কোয়েলো

অনুবাদ- জে এফ নুশান


অণুকাহিনী ৭

অণুকাহিনী ৫ ও ৬
অণুকাহিনী ৪
অণুকাহিনী ৩
অণুকাহিনী ২
অণুকাহিনী ১


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।