অকবিতার অগল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ৩০/০১/২০১১ - ১২:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কবিতা লিখতে চাইতাম, কিন্তু কবিতা হতো না। প্রথম কবিতা লিখার চেষ্টা করেছিলাম সেই ছোটবেলায়। রবাহুত স্তব্ধ নিশীথিনীর পথমুখে পতিত কোন শ্রান্ত বিকেলের ক্রান্তিলগ্নে নয়, গগণবিদারী মেঘগর্জন শেষে নেমে আসা হিমচঞ্চল বারি বিন্দুকে মাথায় নিয়ে নয়, এমনকি রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিবসে- শাশ্বত সপ্তাশ্বরথের সারথি হয়ে নয়; আসলে আমার ঠিকঠাক মনেই নেই সেই মহেন্দ্রক্ষণটা কেমন ছিল। শুধু মনে পড়ে, স্মৃতির নাজুক অভিধানটা দাবড়িয়ে কতগুলো শব্দ এনে জড়ো করলাম আঙুলের আগায়, আঙ্গুল পেরিয়ে সেগুলো পৌঁছে গেল কলমের সূক্ষ্মতর নিবে। তারপর কিছু ছন্দ, কিছু ছত্র, কিছু মাত্রা যোগ করতে লাগলাম- ঠিক কবির মত করে নয়, অনেকটা কাব্য ব্যাবসায়ীর মত করে। তবে যে জিনিসটার অভাব আমার কবিতাকে কুরে খাচ্ছিল সেটা হল ‘আবেগ’।

আমার শিশুতোষ মন কোন ধরনের আবেগ এনে দাঁড় করাতে পারলনা। অবশ্য কবিতা যে আবেগে অবগাহিত করতে হয় সেটা আমার জানাও ছিলনা, থাকার কথাও না। আমার কবিতার সার্থকতা ‘গাছ’ এর মধ্যে ‘মাছ’ চড়ানো, কোন ‘হ্যাংলা’কে ‘ব্যাং’ এর ‘ঠ্যাং’ দিয়ে কষে ‘ল্যাং’ মারানো, অথবা ‘বৌ’ এর মুখে ‘মৌ’ গুঁজে দেওয়াতেই। এসবকে ছাড়িয়ে যে কবিতা হতে পারে সেটা আমার জানা ছিলনা। শচীন-লারা’র উইলো খণ্ডের খঞ্জরপণা আমার কাছে যতটা রাবীন্দ্রিক, ততটুকু নান্দনিক স্বয়ং গুরুদেবও আমার কাছে ছিলেননা। সিলি পয়েন্টে রোডস মশায়ের বল ধৃতকরণ-কল্পে প্রদত্ত ঝাঁপ যতটা ছন্দময়, ততটা ছান্দসিক খোদ সত্যবাবুকেও মনে হতো না। তাই, প্রকৃতি বন্দনা নয়, ঈশ্বর তোষন নয়, প্রেমোদ্দীপক প্রণয়োপাখ্যান তো নয়ই, আমার কাব্যের বিষয় বস্তু হয়ে উঠল ‘ক্রিকেট’। আমি যদ্দূর জানি, বাংলাদেশ প্রথম ভারতকে ক্রিকেটে হারায়, সেটা আমার নিজের ছড়ায়- হালের মাশরাফি-আশরাফিদের পশম-পালক গজিয়ে নাবালকত্ব তিলক মোচনের বহু আগেই।

ধীরে ধীরে এই হাঁড়ে অধিকতর ক্যালসিয়াম যুক্ত হল, তার ওপর গোশতের সাথে পাল্লা দিয়ে মোলায়েম মেদস্তর আশ্রিত হল, শরীরের আয়তন এবং ঘনত্বের মাত্রিক বিবর্ধন ঘটল তথাপি বৌদ্ধিক বিবর্তন কিছুমাত্রও যেন সাধিত হল না। কবিচৈতন্য চাইল্ড ন্যাপকিন পরে সেই শৈশবেই হামাগুড়ি দিচ্ছে এখনও। এখনও কবিতা বলতে- বিক্রমের ঘাড়ে ‘উথাল্পাতাল’ ‘বেতাল’ বাবুর ‘তাল’ ভেঙ্গে খাওয়াকেই বুঝি। তাই তিমিরকুন্তলা বনলতা সেনের ‘বিদিশা’র নিশায় আটকে এরশাদাদু হয়ে ওঠার অবকাশ অদ্যপি পাইনি।

তবে কাব্যপ্রতিভাটা ব্যুলভার্দ দিয়ে না দৌড়োলেও চোরাগলি দিয়ে লেংচে হাঁটতে ছাড়েনি। আশেপাশের সব আবাল্য বন্ধুবর, তাদের বয়োসন্ধি অতিক্রমণোদ্যত কলেবর আর ক্রমবিকশিত মানসলোকের সুলুকে আটকে থাকা অজ-নিতম্বভূক অজগর, এসমস্তই আমাকে অনেকখানি প্রেরণা যুগিয়ে গেছে। দুষ্টু মন্দ কথাগুলো আর গতেবাঁধা ছন্দগুলো তাই মসীকে অসী বানিয়ে অবিরাম ছেঁড়াকুটার চেষ্টা করেছে উত্তরাধুনিক প্যাপিরাসকে। মাঝে মাঝে তারা দলে দিয়েছে সমস্ত পার্থিব শালীনতার সম্ভ্রমকে, মলে দিয়েছে ভদ্রতা-লৌকিকতার গর্দভবৎ কর্ণকে। না, ওগুলো ‘কামরাঙ্গা ছড়া’ নয়, ‘নিমকি ছড়া’ও নয়- রীতিমত ‘খিস্তিকাব্য’। সেখানে শরতকালের পাকনা ‘তাল’ ‘হাল’ ছেড়ে দিয়ে ‘খাল’এ পড়তে পড়তে ‘ইন্দ্রজাল’ মহিমায় ফেঁসে যায় জালে। কিসে বোনা ‘জাল’, সেটা না হয় বেসামাল মনের বেশুমার ফ্যান্তাসি হয়ে উহ্যই থাক। সেইসব কাব্যের মধুসূদন কেবলমাত্র মধুকে বধ করেই ক্ষান্ত হয় না; স্বোপার্জিত বিশেষণের মধ্যপদী বর্ণকে অবর্ণনীয় ঔদ্ধত্যে ‘চ’ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে কুৎসিত নেক্রোফিলিয়ায় ভোগে।

যাই হোক, এতে করে সুশীল সমাজ আমাকে ত্যাগ করেছে, কুলীন সম্প্রদায় আমাকে কুলাঙ্গার বলেছে। কবিরা আমাকে ‘অকবি’ বলে কটাক্ষ করেছে, অকবিরা আমাকে ‘কবি’ বলে গালাগাল দিয়েছে। কবিতা শুনে ব্রাহ্মণ পুরুত আমাকে বলেছে- ‘নমশুদ্র বর্মণ’, ক্যাথলিক ফাদার বলেছে ‘শালার্ভাই মর্মন’, পোলিশ বন্ধু পল্ডেক বলেছে- ‘হাঁড়বজ্জাত জর্মন’। এমনকি বৈদ্যরাজ বদ্যি-বিদ্যা-বিভূষন বৈদ্যনাথ বাবু অদ্যি বলেছেন আমার গ্রন্থি-রন্ধ্রে নাকি ক্ষরছে ‘হার্মাদীয় হর্মন’। হুজুরে আলাহ, ছৈয়দ ছালাউদ্দিন ছাল-ছালাহ, কবিতা শুনে আমাকে লা’নত করেছেন, জাহান্নামে গিয়ে আন্না কুন্নিকুভার সাথে বহ্নিদাহ হবার ইয়াকিন জানিয়েছেন। তাই আমি আজ নিঃস্ব। আমার কবিতাগুলো আজ গুমরে কেঁদে মরে অন্তরের অন্দরমহলে। থোরাসিক কেইজের অস্থিসার ফাঁদে ফেঁসে গিয়ে, হৃদস্পন্দনের তালে তালে সেগুলো কামদেবী বাস্তেতের নাম গুজরে জিকির-আসকার করে। প্রেমদেবী আফ্রোডাইটির সাথে এথেন্সের উপকন্ঠে, ভূমধ্যসাগরীয় লহরে জলকেলী করার প্রবল প্রয়াসে প্রাণতেজে মরে।

সময় এসেছে কবিতাগুলোকে মুক্তি দেওয়ার। কপটতার কার্পেটে মোড়া কর্পোরেট কবি, দক্ষিণপন্থীর দক্ষিণায় দক্ষযজ্ঞে নামা বামবুলি-সর্বস্ব বামহস্ত-পরায়ণ ‘বাতিল’ কবি, প্রণয়িনীর প্রসাধনাবৃত-পশ্চাতদেশ পূজারী প্রেমপিয়াসী ‘প্রেমাতাল’ কবি, সবাইকে ছাড়িয়ে ঘনিয়ে এসেছে খিস্তিকাব্যের সস্তা বস্তাপচা কবির মাথাচেড়ে ওঠার দিন। তাই আজ গলা ছেড়ে বলতে মঞ্চায়-

শব্দ গুলো জব্দ কেন, সব্বনাশার খপ্পরে

ভাঙ্গবে এবার, মস্ত প্রাকার, কামরাঙ্গা এক চাপ্পড়ে


ধৈবত


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই, যতই চাপা না মাইরা না থাকেন না কেন, 'না' বলিতে কোনো বস্তু এখনও আপনার অভিধানে না থাকতে দেইখা নানারকম অবিস্মরণীয় প্রতিভার অনুপস্থিতি না স্বীকার না করা ছাড়া পারলাম না। মন খারাপ

-অতীত

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ , (কমেন্ট না বুঝতে পারায় মাথা চুলকানোর ইমো)

ধৈবত

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশ তো হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

লইজ্জা লাগে

ধৈবত

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধৈবত ভাই,
আপনার অন্তর্দ্বন্দ্ব বেশ উপভোগ করলাম!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অতিথি লেখক এর ছবি

রোম পুড়ে যায় আগুনে, আর নিরু বাজায় বাশি
ধৈবত ধ্বসে অন্তর্দ্বন্দ্বে; চৌধুরীর মুখে হাসি দেঁতো হাসি
-ধন্যবাদ

ধৈবত

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

নিরোর বাঁশী স্বল্পদহন, রোম পুড়ে যায় তাতে
বিষম দহন শ্যামের বাঁশী মনের আঙ্গিনাতে
পোড়ায় যেন অনলদহন এক যমুনা ধরে
পাগলিনী রাধার তবু পুড়েই মরা চাই
ধৈবতের ধ্বসের মাঝে সুরটি এমন পাই
চৌধুরীর মুখের হাসি তাইতো উপচে পড়ে! হো হো হো হো হো হো হো হো হো

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অতিথি লেখক এর ছবি

খাইছে
ধৈবত

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

হালার্বাই এইটা কি কইলি !!!

কবিতা শুনে ব্রাহ্মণ পুরুত আমাকে বলেছে- ‘নমশুদ্র বর্মণ’, ক্যাথলিক ফাদার বলেছে ‘শালার্ভাই মর্মন’, পোলিশ বন্ধু পল্ডেক বলেছে- ‘হাঁড়বজ্জাত জর্মন’। এমনকি বৈদ্যরাজ বদ্যি-বিদ্যা-বিভূষন বৈদ্যনাথ বাবু অদ্যি বলেছেন আমার গ্রন্থি-রন্ধ্রে নাকি ক্ষরছে ‘হার্মাদীয় হর্মন’।

হাততালি

অতিথি লেখক এর ছবি

হুম, হাততালি টা আসলেই প্রেরণামূলক। চোখ টিপি কিন্তু আসল ব্যাপারটা হইল গিয়া, সেই বিখ্যাত স্ক্রীনশটটা আমাকে আজকেও সারাদিন হাসাচ্ছে।
সেই বিখ্যাত অনুবাদ মূলক প্রারম্ভিকাঃ "ধুম তা না না না শাকা লাকা বুম বুম" গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

--------------------
নিক : সবুজ পাহাড়ের রাজা ।

কৌস্তুভ এর ছবি

লিখেছেন চমৎকার। নতুন আরেকটা লেখার স্টাইল ধরলেন, সেটাতেও জমিয়ে দিয়েছেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ কৌস্তুভদা। আসলে আনকোরা অলেখকের স্টাইলের অভাব হয়না, অভাব হয় কনসিসটেন্সির।

ধৈবত

অতিথি লেখক এর ছবি

কবিরা আমাকে ‘অকবি’ বলে কটাক্ষ করেছে, অকবিরা আমাকে ‘কবি’ বলে গালাগাল দিয়েছে।

যা বলেছেন! কবি হইতে যাওয়া বহুত হ্যাপা। কাছের মাইনষেরাই গালাগালি করে, আর দুর-জনদের( চোখ টিপি ) কথা কি বলব। আপনে চালায় যান।

------------------------------
মৌন কথক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।