।।বৃষ্টি, বিকাল, বিড়াল।।

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: শুক্র, ২৬/০৩/২০১০ - ৬:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হোটেলে কেবল তারাই আমেরিকান।
দোতালার ঘর, পর্দা সরালেই বিশাল সমুদ্র, জানলা জুড়ে। ঘন নীল তার রঙ। সমুদ্রের তীর জুড়ে সবুজ উদ্যান, বিগত যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মৃতিতে সৌধ। রোদেলা দিনে একজন চিত্রকর উদ্যানে বসে ছবি আঁকেন। আকাশমুখী পামগাছের সারি, হোটেলের দীর্ঘ জানলা, জানলা জুড়ে রঙ্গীন পর্দা, পর্দার ফাঁকে অবকাশ যাপনে আসা উজ্জ্বল রমনীগন- তাঁকে মুগ্ধ করে।
বহুদূর থেকে দলে দলে ইতালিয়ানরা আসে স্মৃতির সৌধ দেখতে, শ্রদ্ধা জানাতে। ব্রোঞ্জ তৈরী সৌধটি ছলকে উঠে বৃষ্টির দিনে এবং আজ সারাদিন প্রবল বৃষ্টিপাত।

জানলায় গাল ঠেকিয়ে বৃষ্টি দেখছিলো আমেরিকান মেয়েটি। উদ্যানে ছড়িয়ে থাকা ক'টি টেবিল। একটি টেবিলের নীচে গুটিসুটি মেরে থাকা একটি বিড়াল। ছোট্ট, বৃষ্টিতে ভেজা। জানলার ওপার থেকে কোমল মেয়েটি টের পায়, বিড়ালটি কাঁপছে থরথর, তার উষ্ণতা প্রয়োজন।

-'আমি নিচে যাচ্ছি। বেড়ালের বাচ্চাটাকে নিয়ে আসতে।'
বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে চোখ না ফিরিয়েই স্বামীটি বললো
-'তুমি থাকো, আমি নিয়ে আসছি'
-'না আমিই যাচ্ছি। আহা, ছোট্ট বিড়ালটি কাঁপছে।'
-'ঠিকাছে। খেয়াল রেখো, তুমি যেনো না ভিজো'
পায়ের কাছে পরে থাকা কম্বল টেনে নিয়ে সে আরো বেশী মনোযোগ দিলো বইয়ের পৃষ্ঠায়।

মেয়েটি সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলো। অভ্যর্থনা কক্ষের শেষ মাথায় বড় একটি টেবিল। পেছনে বসা হোটেলের মালিক। আমেরিকান মেয়েটিকে দেখে ইতালিয়ান লোকটি উঠে দাঁড়ালো। মধ্যবয়স্ক, দীর্ঘদেহী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই ইতালিয়ানকে মেয়েটির ভালো লাগছে। ভালো লাগছে তার মনোযোগ, তার ভব্যতা, তার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা।
-'সেঁনোরা, দেখেছেন কেমন সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছে'

প্রসন্ন ঠোঁটে সে হাসলো কেবল। এগিয়ে গেলো মুল দরোজার দিকে। ঐ দরজ়া খুলেই উদ্যান। উদ্যানে টেবিল। টেবিলের নীচে সেই উষ্ণতাপিয়াসী ছোট্ট বিড়াল।
দরোজা খোলামাত্রই মাথার উপর ছাতা ধরলো কেউ। হোটেলে কাজ করা মেয়েদের একজন
-'মালিক আমাকে পাঠালেন যেনো আপনি বৃষ্টিতে না ভিজেন'
আহ! মনোযোগের এই স্নিগ্ধতা যেনো বৃষ্টির কোমল ছোঁয়া।

মাথার উপর ছাতা। আলতো পায়ে সে পেরিয়ে এলো ভেজা ঘাস।তাদের জানালার নীচে সেই টেবিল। টেবিলের নীচে সেই বিড়াল।
নেই!
সমগ্র উদ্যান জুড়ে খুঁজে বেড়ালো সে। নেই সে!
ইতালিয়ান মেয়েটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো
-'কি খুঁজছেন সেঁনোরা?'
-একটা বিড়াল ছিলো এখানে
-বিড়াল? এই বৃষ্টিতে হতচ্ছাড়া বিড়াল?
- ছিলো তো।
-বৃষ্টি আরো বাড়ছে। আপনি ভিজে যাচ্ছেন। ফিরে চলুন সেঁনোরা।
-কিন্তু বিড়ালটা?
-আপনার ফিরে যাওয়া দরকার।
প্রবল হতাশায় সে কাঁধ ঝাকালো। কোন কথা না বলে ফিরে চললো। অভ্যর্থনা কক্ষে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী ইতালিয়ান। আমেরিকান মেয়েটি চোখ তুললোনা আর।

।।
-'পাওয়া গেলো?'
-'না'
বই থেকে চোখ ফেরালো জর্জ।
-'গেলো কোথায়?'
-'ছোট্ট বিড়ালটা নিশ্চয় কষ্ট পাচ্ছে। ঠান্ডায় কাঁপছিলো'
বইয়ের পৃষ্ঠায় আবার চোখ ফেরালো জর্জ।

মেয়েটি গিয়ে বসলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে। আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি। খুব মনোযোগ দিয়ে সে নিজেকে দেখলো দীর্ঘক্ষন। হাত দুটো পেছনে নিয়ে টেনে ধরলো নিজের চুল
-'চুল লম্বা করলে আমাকে কেমন লাগবে বলোতো?'
চোখ তুলে সে তাকালো। খোলা ঘাড়। ছেলেদের মতো ছাঁটা চুল।
-'আমার তো এমনিই ভালো লাগে। যেমন আছো তেমনি'
-' যেমন আছি তেমনি থাকতে থাকতে আমার অসহ্য লাগছে। এবার চুল লম্বা করবোই'
মেয়েটির দিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই ছেলেটি বললো
-' বিশ্বাস করো। তুমি যেমন আছো তেমনই সুন্দর।'

আয়নার সামনে থেকে উঠে গিয়ে সে দাঁড়ালো জানলার পাশে। বাইরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।
-'আমি চুল অনেক লম্বা করবো। অনেক বড় খোঁপা হবে আমার। বিড়ালটাকে কোলে নেবো। দুষ্টুমি করবে। আমি তাকে চুমো খাবো অনেক অনেক।'
-'হুম!'
-'আমাদের খাবার টেবিলে থাকবে মৃদু মোমের আলো। বসন্ত আসবে। বড় জানলার পাশে আমি খুলে দেবো দীঘল চুল। আমার কোলে একটা ছোট্ট বিড়াল চাই-ই চাই। আর কিছু নতুন পোশাক।'
-'তুমি থামবে এবার? আমাকে পড়তে দাও'
-'না থামবোনা। আমার লম্বা চুল নেই, নতুন পোশাক নেই। না থাক। কিন্তু ছোট্ট বিড়াল আমার চাই-ই চাই। এখুনি চাই। এখুনি।'

জর্জ মুখ ফিরিয়ে নিলো। সে কিছুই শুনছেনা। সে কিছুই শুনবেনা আর। সমস্ত মনোযোগ এবার বইয়ের পৃষ্ঠায়।
জর্জ বিরক্ত হয়ে চোখ তুলে বললো
-'দয়া করে দরজাটা খুলে দেখবে, কে এলো?'

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হোটেলে কাজ করা সেই মেয়েটি। তার কোলে সেই বিড়াল। ছোট্ট। বৃষ্টি ভেজা। থরোথরো। উষ্ণতাপিয়াসী।
-'সেঁনোরা। আমাদের মালিক এটি পাঠিয়েছেন- আপনার জন্য'


মুলগল্পঃ 'Cat in The Rain'- Ernest HEMINGWAY


মন্তব্য

মূর্তালা রামাত এর ছবি

অনুবাদ ভালো হয়েছে। একবোরে ঝরঝরা। শুধু 'ঠিকাছে। খেয়াল রেখো, যেনো তুমি না ভিজো'এই বাক্যটাকে কানে খটোমটো লাগছে। ..............,তুমি যেনো না ভিজো" হলে মনে হয় ভালো হতো। ধন্যবাদ।

মূর্তালা রামাত

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বাহ। অনেক মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন। ধন্যবাদ। বদলে দিলাম।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

অনুবাদ পড়ে ভাল লাগল। গল্পটা খুব বিখ্যাত।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

হ্যাঁ অনেক বিখ্যাত। এই গল্পের ইংগিতের সাথে কাম্যু'র আরেকটা গল্পের ইংগিত মিলে যায়, যদিও সময়ের ব্যবধান কম না।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

দ্রোহী এর ছবি

চলুক

হাসান মোরশেদ এর ছবি

হাসি
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

চলুক চলুক

... নির্মেদ অনুবাদ। গল্পটা বহুআগে পড়েছিলাম, শেষে এসে মনে পড়ে গেলো।

_________________________________________

সেরিওজা

হাসান মোরশেদ এর ছবি

হাসি হাসি
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অতিথি লেখক এর ছবি

মূল গল্পটা যদিও পড়া নেই, এখানে পড়তে পড়তেই বুঝেছি অনুবাদ খাসা হয়েছে। ভাল অনুবাদ করা, বলা বাহুল্য, অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ।

ফারাবী

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ভালো অনুবাদ আসলেই হয়তো কঠিন।
তবে আমার কাছে অনুবাদ হচ্ছে ফাঁকিবাজি চর্চা। মৌলিক লেখা যখন হয়না তখন অনুবাদের টুকিটাকি হাসি
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নিবিড় এর ছবি
আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

অনুবাদ খুব ভাল লাগল।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনুবাদটা আসলেই বেশ ভাল হয়েছে।

===অনন্ত ===

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

স্পর্শ এর ছবি

বাহ! গল্পটা পড়া ছিলো না। ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

এক কথায় চমৎকার!
'আউটসাইডার' আর চলবে না?

মামুন হক এর ছবি

দূর্দান্ত!! আগে জানা থাকলে এটা হয়তো আমিই অনুবাদ করতাম। বৃষ্টি আর বেড়াল দু'টোই আমার খুব প্রিয় হাসি

হাসান মোরশেদ এর ছবি

মুল গল্প পড়ে আরেকটা অনুবাদ নামিয়ে ফেলেন।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মামুন হক এর ছবি

আপনার অনুবাদটাই খুব ভালো হয়েছে ভাই। এর চেয়ে ভালো আমার পক্ষে বোধহয় করা সম্ভব হবেনা। তারচেয়ে বরং আমাকে আরেকটা হোমওয়ার্ক দেন ( শুভাবিষদা'র মতো অতি জটিল কিছুনা, উনি একটা দিসেন দুই মাস আগে, এখনও সাইজ করতে পারি নাই), অনুবাদ করে আপনারে দেখাই হাসি

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

চিঙ্গিস আইমাতভের 'জামিলা' সাইজ করেন মিয়া তাত্তারি। দুই মাস অইয়া গেছে।

এখানে কিছু পাবেন। ইচ্ছামতো অনুবাদ করেন। চেকভের গল্পগুলোর একটা লিঙ্ক দিছিলাম। কিছু কিছু গল্প বেশ ছোট। চাইলে করতে পারেন। দ্রোহী মেম্বরের উপ্রে বেশি ভরসা করতেছি না।

এডগার এলেন পো'র 'দা পার্লোয়ন্‌ড লেটার' এর অনুবাদ চাইছি। করবেন নাকি কোন মুমিন বান্দা?

তিথীডোর এর ছবি

অনুবাদ পড়তে ভাল্লেগেছে!

--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- ক্যাটাগরিতে চোখ যায় নাই। প্রথম লাইন থেকেই পড়া শুরু করেছিলাম। শেষের লাইনে আসার আগ পর্যন্ত বুঝি নাই এইটা অনুবাদ!

গল্পটার মূল প্রতিপাদ্য কী দাদা? "ভুল মানুষের সাথে গৃহবাস, আসল মানুষ কে চাস!" কিছু?
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।