রয়েসয়ে

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: রবি, ০২/০৩/২০০৮ - ৬:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পুরনো লেখা সাধারণত সচলে দিই না, এই লেখাটার কথা বহুদিন পর মনে পড়লো। যাঁরা ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছেন তাঁদের কাছে ক্ষমা চাই। একটি মোবাইল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনবুলি "অন্যরা যা করে কয়েক বছরে, আমরা তা করেছি কয়েক মাসে"কে পঁচিয়ে লেখা। যাঁরা পড়েননি, তাঁরা একে সত্যকাহিনীর সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না। সত্য গল্পের চেয়েও খাইষ্টা।

হুঁ, একটু তাড়াহুড়ো করতাম সবকিছুতেই। আজন্ম এই হুড়োহুড়ি আমার।

জন্মের পর থেকেই আশেপাশের সবাইকে ব্যস্ত করে ফেলি। ট্যাঁ ট্যাঁ কান্না, গিগিগি হাসি, আর কাঁথা নষ্ট। আপত্তি করেনি কেউ, এ তো স্বাভাবিক।

কিন্তু অন্যদের যা করতে লাগে কয়েক বছর, আমি তা করে ফেলি কয়েক মাসে। হাঁটি, কথা বলি। দিব্যি বড়দের মতো। সবাই একটু নড়েচড়ে বসে। বলে, রয়েসয়ে!

আমি রইও না, সইও না। ব্যতিব্যস্ত করে ছাড়ি সবাইকে। এটা ধরি, ওটা ভাঙি। এক বড়দের কথা অন্য বড়দের কাছে শিশুতোষ সারল্যে চালান করে দেই। পাশের বাড়ির আঙ্কেল জানতে পারেন, আমার বাবা তাঁকে ইস্টুপিট ডাকেন। আন্টি জানতে পারেন, মা তাঁকে ডাকেন ব্যাটাতুন্নেসা। একটা খিটিমিটি লেগে যায়। আমি গা করি না। ওনাদের মেয়ে লুবনার সাথে আমার দারুণ দহরমমহরম। বাপমা তো দুদিনের মায়া, লুবনাই সব। দুপক্ষের বাবামাই পক্ষ ঝাপটান, বলেন, আরে রয়েসয়ে, এই বয়সেই এই!

ইস্কুলে গিয়ে আবার ব্যাপারটা একটু উল্টে যায়। অন্যরা যা কয়েক মাসে করে ফ্যালে, আমার তা করতে লেগে যায় কয়েক বছর। সব শালাশালি দেখি ফটাফট সরলাঙ্ক মানসাঙ্ক লসাগু গসাগু জ্যামিতি নিয়ে একটা দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে বসেছে। আমার তো ত্রিভূজ থেকে চতুর্ভূজের ফারাক করতেই ঝামেলা লেগে যায়। বাবা ক্ষেপে যান, মা বলেন, মনে হয় চোখের দোষ। চশমা লাগবে। লুবনা আমার কামড় খেয়ে হাসে, বলে, দুষ্টু, রয়েসয়ে।

তবে গালাগালিটা ওদিকে বেশ রপ্ত করে ফেলি। অন্যদের যা শিখতে কয়েক বছর লেগে যায়, আমি তা অনায়াসে শিখে ফেলি কয়েক মাসেই। কচি কচি সহপাঠীরা সবে শকার বকার করতে শিখেছে, সস্নেহে তাদের চ-বর্গীয় গালাগালি করি। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ওরা, আমি চোখ টিপি। মাস্টারদের কাছে বিচার ঠোকে কতিপয় বইখোর বোকাচো--, আমার ডাক পড়ে তদন্ত কমিটির সামনে। নিখাদ হাবলা সেজে দাঁড়াই, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি, সুন্দরী ম্যাডামের অস্বস্তি ভরে বুকের ওপর আঁচল টানেন। হতাশ হই আমি, হতাশ হন অ্যাসিস্টেন্ট হেডমাস্টারও। আমরা দুই খাঁজভক্ত একে অন্যের দিকে তাকাই। শুনতে পাই তিনি বিড়বিড়িয়ে বলছেন, রয়েসয়ে ...।

এসএসসি পরীক্ষার সময় সাথের পোলাপানের সবে কচি কচি রোমের রেখা নাকের নিচে, আর আমার রীতিমতো আঁচড়ে রাখা গোঁপ। হুঁ, অন্যদের যা বাগাতে কয়েক বছর লেগে যায়, আমার সেটা কয়েক মাসেই গজিয়ে একেবারে ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা। ইনভিজিলেটর খাবি খায় আমাকে দেখে। এক গ্লাস পানি খেয়ে ধাতস্থ হয়ে বলে, রয়েসয়ে! লুবনা ওদিকে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। চুটিয়ে রোমান্স করছি আমরা। আমার ইস্কুলের সহপাঠীরা বিষন্ন হয়ে পড়ে আমাদের হুড়োহুড়ির নমুনা দেখে। বলে, রয়েসয়ে। আমি হাসি। কিছু বলি না। আরে ওরা তো নিছক আবাল, লুবনার সিনিয়র ভাইয়েরাই আমাদের চালচলনে ঘাবড়ে যায়, বলে, রয়েসয়ে ... আর এরা তো মোটে ইস্কুল ছেড়ে বেরোচ্ছে।

তো, হয়তো অন্য কেউ হলে আরো কয়েক বছর সময় নিতো, কিন্তু আমি তা করে ফেলি কয়েক মাসেই। লুবনার সাথে বিয়েটা সেরে ফেলি কাজী অফিসে গিয়ে। কাজী দুষ্টুটা কলমা পড়ায়, আমরা মিটিমিটি হাসি। বিয়ে হয়ে যাবার পর লুবনাকে চুমু খাই সিনেমার ইশটাইলে। কাজী আঁতকে ওঠে। ইউ মে কিস দ্য ব্রাইড বলা তো আর ওর ধাতে নেই। আমরা সামলে নেই, কাজী নিজের বুক আঁকড়ে কী একটা ট্যাবলেট খায়, তারপর বলে, আলহামদুলিল্লাহ, রয়েসয়ে!

বাড়ি ফিরে দেখি আরেব্বাপস, বাপ মা দুজনেই চটে লাল। কত অভিযোগ। ইস্টুপিটের মেয়ে ঘরে আনলাম, ব্যাটাতুন্নেসার মেয়ে ঘরে আনলাম। দুজনে মিলে কয়েক ঘন্টায় যা বকাঝকা করে, অন্য কেউ হলে তা করতে লেগে যেতো কয়েক মাস। আমি অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকি, লুবনা মুচকি মুচকি হাসে। শেষে মায়ের কানে কানে আসল কথাটা বলে। শুনে তো মা ফিট! হায়রে মা, সুসংবাদ শুনে কোথায় একটু হই হল্লা করবি তা না ... এজন্যেই তো মুরুবি্বরা বলে, রয়েসয়ে। লুবনাকে বকা দেই। তখুনি বলার কী দরকার ছিলো?

যা ভাবছেন তাই, অন্যরা বিয়ের পর যা করতে কয়েক বছর লাগিয়ে দেয়, আমরা তা করে ফেলি কয়েক মাসেই। যমজ এসে হাজির। সবার মুখ কিন্তু অন্ধকার, বাচ্চাগুলোই খলখল করে হাসে। পাড়ার বড় ভাইরা এসে পিঠ চাপড়ে দেয়, চোখ টিপে বলে, রয়েসয়ে!

বাবা নোটিশ দেয়, চাকরি বাকরি জোটা, নইলে জুতিয়ে বার করে দেবো। আমি হাসি, বলি, আরে ইস্কুল পাসের পর অন্যদের যা করতে কয়েক বছর লেগে যায়, আমাকে তা কয়েক মাসে করতে বলছো, এ-ই কি ইনসাফ? রয়েসয়ে! বাবা জুতো হাতে তেড়ে আসেন।

চাকরি একটা ধরাধরি করে পাই। সম্মানজনক কিছু নয়। পড়ালেখার পর করতে হয়। বড় চাপ। বাড়ি ফিরে এসে দেখি বাপমাবউবাচ্চা দিয়ে ঘর বোঝাই। ভাল্লাগেনা। অন্যরা হয়তো কয়েক বছর পর ধরতো, আমি কয়েক মাস পরেই ধরে ফেলি। দেশি ভদকা। একটু লেবু চিপে পান করলেই দুনিয়াটা বেশ ডগোমগো হয়ে ওঠে। হামলা করতে গেলে লুবনা বিরক্ত হয়, বলে, আহ কী হচ্ছে আবার, রয়েসয়ে!

তো এভাবেই চলছে গত কয়েক বছর, বুঝলেন। অন্য কেউ হলে কয়েক মাস পরই সব ছেড়েছুড়ে তাবলীগের চিল্লায় চলে যেতো, কিন্তু আমি আঁকড়ে আছি। ভালোবাসার টান, কী করবো বলুন?

তবে আপনাদের জন্য একটাই উপদেশ আমার।

রয়েসয়ে।

(রচনাকাল: অগাস্ট, ২০০৬)


মন্তব্য

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

রয়েসয়ে তত্ত্বে আমি বিশ্বাসী নই। সবুরে মেওয়া হয়তো ফলে, তবে সবুরে মেওয়া পচে যাবার সম্ভাবনাই বেশি হো হো হো

ভালো কথা। পুরনো-লেখা-দেবো-না টাইপের ধনুর্ভঙ্গ পণ না করাটাই উত্তম হবে। যাঁরা আগে পড়েছেন, তাঁদের বিরক্ত হবার কোনও কারণ তো দেখি না।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

শেখ জলিল এর ছবি

নাহ্, পুরনো হলেও বিরক্ত না হয়ে রয়েসয়ে পড়লাম।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

জব্বর। এই লেখা রয়েসয়ে খাওয়ার জিনিস নয়! অন্য কেউ কতো সময় লাগাতো জানি না, আমি তো কয়েক মিনিটেই ...

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

রায়হান আবীর এর ছবি

পুরনোরা কি দোষ করল?
তাড়াহুড়া করাই ভাল। রয়েসয়ে যা দেখতে লাগবে দীর্ঘদিন, তাড়াহুড়ায় না হয় আগেই দেখা হল। দেখতে তো হবেই একদিন তাই না?

---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...

দ্রোহী এর ছবি

বলতে দ্বিধা নেই। আমি হিমুর একান্ত ভক্ত। এই লেখাটাকে "হিমু ক্লাসিক" বলা যেতে পারে। ................

বহুদিন আগে হিমুর ব্লগ রয়েসয়েতে কয়েকবার উঁকি দিয়েছিলাম শুধুমাত্র এই লেখাটি পড়ার জন্যই। আজ অনেকদিন পর আবারও লেখাটি পড়লাম। যতবারই পড়ি.......ততোবারই ভালো লাগে।


কি মাঝি? ডরাইলা?

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

আরেব্বাস। জবর খুব জবর।

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

ইফতেখার নূর এর ছবি

রয়েসয়ে তত্ব মানতে গিয়ে আজন্ম রয়েসয়েই থেকে গেলুম, আর কিছু হলনা আমার...

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ব্যাটাতুন্নেসা দেঁতো হাসি



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

পরিবর্তনশীল এর ছবি

হে হে হে।
খু-উ-ব মজা পাইলাম

---------------------------------
চোখের পাতায় হাত রেখে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখার যন্ত্রণা দেয়।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

জন্মের পর থেকেই আশেপাশের সবাইকে ব্যস্ত করে ফেলি। ট্যাঁ ট্যাঁ কান্না, গিগিগি হাসি, আর কাঁথা নষ্ট। আপত্তি করেনি কেউ, এ তো স্বাভাবিক।

সিলেটি প্রবাদ

অতঅতির ঘরো অইছিল নাতি
কাটতো আছিল নাড়ি। কাটিলাইছে বটই

শব্দার্থ
অতঅতি= সারাক্ষণ যারা তাড়াহুড়ো করে
বটই= যেটা দেখে দাই চিৎকার দিয়ে বলে- তোমার পোলা হইছে গো...

সাবকান্ট্রি

ধীরেয কার্য সিদ্ধ
কার্য সিদ্ধ ভোজনে
জাগরণে গৃহ সিদ্ধ
নারী সিদ্ধ দমনে
(প্রথম লাইন ছাড়া বাকি তিন লাইনের (বিশেষত শেষ লাইনের) দায় দায়িত্ব আমার নয়)

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আপনার মন্তব্যে বিপ্লব আর হিমুর লেখায়।
দুটোই ব্যপক।

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

সৌরভ এর ছবি

হ, পুরোনো জিনিষ। তবে ক্ল্যাসিক।
চলুক রয়েসয়ে।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

রাবাব এর ছবি

খ্যাক!

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

খুব মজাদার লেখা। জমিয়ে বারবার পড়া যায় এমন।

মামুন হক এর ছবি

এইডা তো আগেই পড়ছি, লুবনা আমার প্রথম প্রেম আর আপ্নে তারে বিয়া কইরা বাচ্চা পয়দা কইরা ফালাইলেন...তবেরে!

সাইফ তাহসিন এর ছবি

জটিলস্য জটিল চোখ টিপি

রয়েসয়ে
গড়াগড়ি দিয়া হাসি

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

অমিত আহমেদ এর ছবি

আবার সমান আমোদ নিয়ে পড়লাম।


ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

সিরাত এর ছবি

উত্তম জাঝা!

মনমাঝি_লগ্‌ডআউট এর ছবি

হাঃ হাঃ হাঃ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।