সোফিয়া

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: মঙ্গল, ০৯/০৬/২০১৫ - ১:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সতেরো বছর আগে সোফিয়াকে যখন আমি প্রথম দেখি তখন সে ঘুমন্ত মায়ের পাশে হামাগুড়ি দিচ্ছিল। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার সারাহ রেস্তোঁরার পাশে অগ্রণী ব্যাংকের বন্ধ কলাপসিবলের সামনের ছায়াটুকুতে মা মেয়ের অস্থায়ী নিবাস। আর ঠিক সেই জায়গায় আমার অফিসের গাড়ি থামতো। সকাল সাতটায় প্রতিদিন অফিস যাবার সময় আমাদের দেখা হতো। অমন সুন্দর শিশু আমি এই শহরে আর একটিও দেখিনি। সবুজ চোখের সোনালী কোঁকড়া চুলের দুধে আলতা বর্ণের শিশুটি আমার দেখা আর দশটি পথ-শিশুর চেয়ে একদম আলাদা। এক ফুটপাতচারিনীর কোলে অমন দেবশিশুকে কেমন বেমানান দেখাতো।

আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম মেয়েটার বাবা কে? বাবা কি বিদেশী কেউ? এত মায়াময় একটি শিশুকে দেখে যে কারো আদর করতে ইচ্ছে করবে- আমারো করতো। কিন্তু সেই ইচ্ছে পর্যন্তই। আমি প্রতিদিন শিশুটিকে দেখতাম আর ভাবতাম যদি একটি ভালো পরিবারে বড় হতো মেয়েটি নিঃসন্দেহে সুন্দর একটি জীবন পেতো। শিশুটি যদি ইউরোপে জন্মাতো তাকে সবাই সোফিয়া লোরেন বলে ভুল করতো। মেয়েটির চোখের সাথে সোফিয়া লোরেনের কেমন অদ্ভুত মিল। তখন থেকে মনে মনে ওকে আমি সোফিয়া বলে ডাকতে শুরু করি।

জীবন চলতে থাকে। প্রতিদিন আমি অফিসে যাই নিয়ম করে। দিন মাস বছর কাটে। আমাদের চাকরীতে প্রমোশন হয়, বেতন বাড়ে, সুযোগ সুবিধা বাড়ে। আমরা ক্লাবে যাই, পার্টিতে যাই, দেশ বিদেশ ঘুরতে যাই। আমাদের চাকচিক্য ঊর্ধ্ব গগনে পাখা মেলে। সোফিয়াও সময়ের সাথে সাথে বড় হতে থাকে। হামাগুড়ি শেষে একদিন দাঁড়াতে শেখে, গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে শেখে, নিজে নিজে মুখে খাবার তুলে নিতে শেখে। কিন্তু তার ঠিকানা বদল হয় না। হয়তো আজ অগ্রণী ব্যাংকের বারান্দা, কাল সোনালী ব্যাংক, পরশু রূপালীর ফুটপাতে। ঘুরে ফিরে আগ্রাবাদের সেই ব্যাংক পাড়াতেই বড় হতে থাকে সোফিয়া। অনেকটা আমার চোখের সামনেই, প্রায় প্রতিদিন এক ঝলক দেখতাম ওদের। যেন আমি দীর্ঘ মেয়াদী এক নির্বাক সিনেমার দর্শক।

আমি ওদের কিছুই জানি না, শুধু সোফিয়ার বড় হওয়া দেখতে থাকি। আরো পাঁচ বছর পর্যন্ত সোফিয়ার নিটোল শিশু সৌন্দর্য প্রায় অটুট থাকে। কখনো তার মাকে সাথে দেখি, কখনো সে একা। তাকে রেখে মা কোথাও কাজ করতে যায়? জানি না ঠিক। একদিন হয়তো সেই মা কোথাও হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় বলেছি- কেননা, আমি দেখি সোফিয়া একা একাই ঘুরে বেড়াচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে।

একদিন সোফিয়া আমার সামনে এসে হাত পাতে। আমি কয়েক সেকেন্ড নির্বাক তাকিয়ে থাকি শিশুটির দিকে। কেমন একটা কষ্ট হতে থাকে। পকেট থেকে একটা কয়েন বের করে ওর হাতে দেই। এরপর থেকে সোফিয়া প্রায়ই এসে সামনে দাঁড়ায়, আমি একটা কয়েন বা ছোট নোট দিয়ে দায় সারি। সোফিয়ার জন্য কিছু করতে না পাড়ার অক্ষমতা আমাকে পোড়ায়। আবার বাসায় গিয়ে সাহস করে বলতে পারি না, ওই শিশুটিকে আমাদের সাথে রেখে মানুষ করলে কেমন হয়। তাছাড়া আমি ওসব বলার কে? সোফিয়ার মা কোথায় জানি না, কার কাছে ওকে চেয়ে নেবো? তাছাড়া চাইলেই কি দেবে ওকে? আর নিলেই কি আমার পরিবার জায়গা দেবে? হয়তো দিত, হয়তো দিত না। কিন্তু যাচাই করাই তো হয়নি।

কয়েক বছর পেরিয়ে যায়। সোফিয়াকে প্রতিদিন দেখি না আজকাল। মাঝে মাঝে দেখি, মাঝে মাঝে দেখি না। যখনই দেখি, সময়ের নিষ্ঠুর আঘাতে ক্ষয়ে যেতে থাকে সোফিয়ার সৌন্দর্য। আস্তে আস্তে তার সবুজ চোখে ছাই জমতে থাকে, কমতে থাকে উজ্জ্বলতা, চুলের সোনালী রঙ ফ্যাকাসে বাদামী হতে থাকে, মুখের চামড়ায় ময়লার আস্তরণ, রুক্ষতা দেখা দেয় চাহনিতে। আমি ভেতরে ভেতরে কেমন আহত হতে থাকি। অমন একটা শিশুকে রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতা নিজের ভেতর খচ খচ করতে থাকে।

তিন কি চার বছর পরে একদিন অফিসের গাড়িতে ওঠার সময় একটু দূরেই সারাহ রেস্তোঁরার সাইনবোর্ড পিলারের সাথে হেলান দেয়া বেঢপ পেট ফুলে থাকা ক্লান্ত এক কিশোরীকে দেখে চমকে উঠলাম। মেয়েটার বয়স দশ বছর পেরিয়েছে কি? এত বড় পেট কেন ওর? এখনো বয়ঃসন্ধিকাল আসেনি মেয়েটার। অতটুকুন বাচ্চাকে কোনো অমানুষ গর্ভবতী করে ভেগে গেছে? হেলান দিয়ে দাঁড়ানো মেয়েটা সোফিয়া। চোখ দুটো ঝাপসাই থাকে অফিসের বাকী পথটুকু যেতে।

বছরখানেক পর অগ্রণী ব্যাংকের ওই বারান্দাতেই দেখি সোফিয়া তার মায়ের জায়গাটাতে শুয়ে আছে, পাশে হামাগুড়ি দিচ্ছে একটি শিশু। অবিশ্বাস্য একটা দৃশ্য। সে নিজেই এখনো একটা শিশু। তার কোলে আরেকটি শিশু? শিশুপালনের কী জানে অতটুকুন মেয়েটি? এত ছোট্ট কিশোরী মা আমি এর আগে কখনো দেখিনি। গত কয়েক বছর সোফিয়া হাত পেতে দাঁড়ায়নি কখনো। এখন হয়তো তাকে শরীর বিক্রি করে জীবন ধারণ করতে হয়। কিরকম একটা অসভ্য সমাজের অযোগ্য বাসিন্দা আমরা!

আর দশটা ভদ্রলোকের মতো আমিও শরীর থেকে ময়লা ঝেড়ে সাবধানে থাকি। উর্বর যত ভাবনা মনে মনেই ভাবি, বাস্তবায়নের ধারে কাছেও যাই না। বড়জোর মনে মনেই মানবিকতার গল্প সাজাই, দু চারটে লিখি এখানে সেখানে। সোফিয়াকে নিয়ে আমার আদ্র করুণা ফিকে হতে থাকে। আমি প্রায় ভুলেই যাই ওকে। সোফিয়াকে নিয়ে না ভাবলে কারো কিচ্ছু আসে যায় না। এমনকি সোফিয়ারও না।

ফিরে আসি বর্তমানে।

ব্যাংকে গিয়েছিলাম আজ দুপুরে। কাজ সেরে একটা সিএনজি টেক্সি নিয়ে ফেরার পথে বাদামতলী মোড়ে ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেলাম। প্রচণ্ড গরমে ভাপ উঠছে রাস্তা থেকে। ড্রাইভার স্টার্ট বন্ধ করে দিলে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস। পকেট থেকে মোবাইলটা নিয়ে ফেসবুক লাইটে লগইন করে দেখছিলাম নতুন কোন নোটিফিকেশান আছে কিনা। হ্যাঁ মেসেজটার জবাব এসেছে। এত জলদি আসবে ভাবিনি। বাসায় ফিরে লিখবো পরে। নেট অফ করে মোবাইল পকেটে রাখতে না রাখতেই সিএনজির লৌহবেষ্টনির বাইরে থেকে হাত বাড়ালো উস্কোখুস্কো একটা মানুষ। মলিন বিধ্বস্ত কালশিটে চেহারার এক মহিলা। অভাবে অনাহারে ক্ষুধায় যন্ত্রণায় মহিলার চেহারা অমানবিক রূপ নিয়েছে। চেহারা শরীর এতটাই ভগ্ন বিধ্বস্ত যে দেখে মনে হবে ষাট সত্তরের কোন বৃদ্ধা। শেষ বয়সে যখন মানুষ সব হারিয়ে যখন মৃত্যুর প্রহর গোণে তখন এরকমই হয়।

আর দশজন লোক তাই ভাববে। কিন্তু এই মানুষটি আমার চেনা। এই মেয়েটার কোঁকড়া খয়েরী চুল আমার চোখে খুবই পরিচিত। আমি জানি এটা সোফিয়া। যার বয়স এখনো আঠারো হয়নি। আঠারো হবার আগেই মেয়েটা যেন সত্তর বছরের দুঃসহ জীবনপথ পাড়ি দিয়ে এখন মৃত্যুর মুখোমুখি।

তাড়া দিল মহিলা। হাতে সময় নেই, আমি না দিলে অন্য গাড়িতে যেতে হবে। আমি তড়িঘড়ি পকেট হাতড়ে কিছু খুচরো টাকা ওর হাতে গুঁজে দিয়ে ভদ্রলোকের মতো বসে রইলাম। বুঝতেও দিলাম না ওকে আমি কত বছর ধরে চিনি। দুঃসময়ে চেনা মানুষই অচেনা হয়ে যায়- এ তো রাস্তার একটা মেয়ে মাত্র। তবে হ্যাঁ এরকম জীবন নিয়ে গল্প লেখা নেহাত খারাপ হবে না। ওকে নিয়ে একটা গল্পতো লেখা যায়। গল্পের শুরুটা হবে- "সতেরো বছর আগে সোফিয়াকে যখন আমি প্রথম দেখি তখন সে ঘুমন্ত মায়ের পাশে হামাগুড়ি দিচ্ছিল...."

সোফিয়াদের নিয়ে মর্মান্তিক গল্প লেখা সম্ভব হলেও কখনো বলা হয় না – তোমার এমন দশা কে করলো? এই সমাজকে তুমি কতটা ঘেন্না করো? সোফিয়াদের চোখে একটু গভীরভাবে তাকালে বোঝা যায় ওখানে জল রাখার আধারটুকুও শুকিয়ে পাথর হয়ে গেছে।

৩১ মে ২০১৫


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চুপ করে পড়ে গেলাম মন খারাপ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সত্যপীর এর ছবি

হ্যাঁ।

..................................................................
#Banshibir.

মাসুদ সজীব এর ছবি

মন খারাপ

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

অতিথি লেখক এর ছবি

সাবলীল ভাষার গুনে সোফিয়াকে দেখতে পাই সারা গল্প জুড়ে। গল্পের শেষে এসে লজ্জায় মাথা নত হয়। সমাজের চরম সত্য উঠে আসে এই লেখাতে।
----------------------------------------------
ইচ্ছে মত লিখি।
http://icchemotolikhi.blogspot.in/2015/05/for-blogger-to-blogger.html

সুবোধ অবোধ এর ছবি
সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়তে পড়তে চোখ জলে ভরে গেল।
আমিও যে আপনার মতোই নির্বাক দর্শক!!!!
আরশিতে নিজের চেহারা দেখে চমকে উঠলাম।

জোছনা

এক লহমা এর ছবি

মন খারাপ
(এ লেখা পড়ার পর লগ-ইন করার মত সময় নেই বলাটা অসভ্যতার পর্যায়ে পড়ত। জানিনা যদিও, সভ্যতার দাবী আমার মত লোকের জন্য আদৌ কতটা যৌক্তিক। আর, এ লেখা ভাল হয়েছে জাতীয় অদরকারী কথা বলা থেকে বিরত থাকলাম।)

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মেঘলা মানুষ এর ছবি

মন খারাপ

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

মন খারাপ

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

মরুদ্যান এর ছবি

আহারে!

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

আয়নামতি এর ছবি

মন খারাপ
-----
ফুটপাতচারিনী/চারিণী

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

"জল রাখার আধারটুকুও শুকিয়ে পাথর হয়ে গেছে" ঠিক যেমনটি এখন আমি বাকরুদ্ধ পাঠক গুরু গুরু

মোস্তফা কামাল

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ
কিছু বলবার মতো ভাষা নেই

@জিল্লুর রহমান সোহাগ

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পড়া এবং সহমর্মীতার জন্য আপনাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ-
@নজরুল ইসলাম/ সত্যপীর/ মাসুদ সজীব/ ইচ্ছে মত লিখি/ সুবোধ অবোধ/ সাক্ষী সত্যানন্দ/ জোছনা/ এক লহমা/
মেঘলা মানুষ/ ত্রিমাত্রিক কবি/ মরুদ্যান /আয়নামতি/ দেবদ্যুতি/ মোস্তফা কামাল/ জিল্লুর রহমান সোহাগ

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

কত চোখে দ্বিতীয়বার তাকাইনি, সেই অক্ষমতার কথা মনে পড়ে গেল। চলুক

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

সুজন ভৌমিক এর ছবি

দুঃখী অসহায় মানুষগুলোর জন্য খুব বড় কিছু করার সামর্থ্য যাদের নেই, তাদের কষ্টটা অনুভব করার বোধটুকু অন্তত থাকুক।
গুরু গুরু হাততালি
- সুজন ভৌমিক।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

...

বাস্তবতা!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।