বারেক ভাইয়ের তলাবিহীন ঝুড়ি

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: শনি, ২০/০১/২০১৮ - ৩:৩৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সতর্কতাঃ গল্পটা ক্লান্তিকর ও দীর্ঘ। লেখকও লিখতে গিয়ে ক্লান্ত। কিন্তু বারেক ভাই এখনো অক্লান্ত বলে লিখে রাখতে হলো সত্য ঘটনাটি।

বারেক ভাইকে আমি আত্মীয়তা সুত্রে ৩২ বছর ধরে চিনি। তখন তিনি বাস ট্রাকের ব্যবসা করতেন। পড়াশোনায় এসএসসি হলেও ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে এমএসসির বাড়া। ব্যবসা শুরুর অল্পদিনের মধ্যে বারো চৌদ্দটা বাস ট্রাক লরির মালিক হয়ে গেলেন। বস্তা বস্তা টাকা ব্যাংকে জমা করেন। বস্তা কথাটা আক্ষরিক অর্থে সত্যি। আমি নিজের চোখে বাজারের থলেভর্তি টাকা নিয়ে ব্যাংকে যেতে দেখেছি। চোর ডাকাত ছিনতাইকারীদের চোখে না পড়ার জন্য এই ব্যবস্থা। তবে তাঁর চলাফেরা জামাকাপড় এতই মলিন থাকে যে তাঁর দিকে তাকালে বাস ট্রাকের হেলপার ছাড়া কিছু মনে হবে না। তাঁর ভাগ্যরাশিতে টাকার এতই ছড়াছড়ি যে তিনি যেখানে হাত দেন তাতে টাকা ফলে।

কিন্তু সেই টাকাগুলো বেশিদিন তাঁর কাছে থাকে না। কোন না কোনভাবে বেরিয়ে যায়। টাকারা আসে এবং যায়। মাঝখানে ট্রানজিট বারেক ভাই। একদিন দেখা গেল তাঁর একটা গাড়িও নেই। সব বিক্রি করে দিয়েছেন দেনার দায়ে।

সব হারিয়েও মাথায় হাত দেবার মানুষ না বারেক ভাই। মাথার বদলে হাত দিলেন মাছে। একের পর এক পুকুর কিনে মাছ চাষ করতে থাকেন। তিন বছরের মধ্যে বিশ পঁচিশটি পুকুরের মালিক তিনি। মৎস্য সম্রাট হিসেবে এলাকায় নাম ছড়িয়ে যায় তাঁর। আবারো বস্তা বস্তা টাকা। থলে হাতে নিরীহ মুখে তিনি সেই টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে আসেন।

একদিন মাছের আছর নেমে গেল। একটার পর একটা পুকুর বিক্রি হতে হতে, ব্যাংকের টাকা ফুরোতে ফুরোতে আবারো শূন্য। এরকম সময়ে বসন্তের কোকিলরা পালিয়ে যায়। বারেক ভাইয়ের চারপাশও শূন্য হয়ে গেল। তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে শুয়ে থাকলেন একা।

সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর আমরা ধরে নিলাম এবার তিনি অবসর নিয়ে পরকালের চিন্তায় মশগুল হয়ে যাবেন। কেননা এবার তিনি বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না তেমন। সারাদিন ঘরে বসে কী করেন আমরা কেউ জানি না।

কিছুদিন পর দেখা গেল তাঁর বাড়িতে অচেনা এক লোক আসা যাওয়া করছে। এলাকার কেউ না। চেহারা আর পোষাকে দিনমজুর ধরণের। জানা গেল লোকটা টেকনাফ থেকে এসেছে। কিন্তু তাঁর সাথে বারেক ভাইয়ের কিসের লেনদেন বোঝা যাচ্ছে না। লোকটা শুধু আসা যাওয়া করছে না, কদিন পর তাকে দেখা গেল বারেক ভাইয়ের জমিতে একটা ছাপড়া ঘর তুলে বাস করতে শুরু করেছে। বারেক ভাই এলাকার লোকদের জানালেন চাষের কাজ দেখার জন্য লোকটাকে রাখা হয়েছে। লোকটার নাম কিসমত আলী।

কিসমত আলী সারাদিন জমিতে চাষাবাদে করছে ঠিকই কিন্তু সন্ধ্যার পর বারেক ভাইয়ের সাথে গুজগুজ। এটা এক নতুন কারবার। কিসমত আলী টাকা বানায়। যে কোন সাদা কাগজকে টাকায় রূপান্তরিত করার এক আজব বিদ্যা রপ্ত করা আছে তার। বিশ টাকার নোট থেকে পাঁচশো টাকার নোট সব। বারেক ভাই একটু খুঁতখুঁত করে, জাল টাকা ধরা পড়লে নিশ্চিত জেল। কিন্তু কিসমত আশ্বস্ত করে, এটা জাল টাকা নয়, আসল টাকা। এই বিদ্যার একটা গুপ্ত রহস্য আছে, যেটা কাউকে বলা যাবে না। পরীক্ষা করার জন্য বারেক ভাই কিছু খুচরো দশ বিশ টাকা বানিয়ে বাজার থেকে কেনাকাটা করে আসলো। বাজারের ঘাগু লোকদের কাছে টাকা দিয়ে জানতে চাইল এই টাকা আসল নাকি জাল। সবাই রায় দিল এটা আসল টাকা।

কাউকে কিছু বলা হলো না। তবে গোপনে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল বারেক ভাইয়ের। বিশ পঞ্চাশ ছাড়িয়ে একশো টাকাও বানিয়ে দেখালো কিসমত। চোখের সামনেই সাদা কাগজ টাকা হয়ে যায়। উপস্থিত সাক্ষী বারেক ভাইয়ের বউও।

কথাটা বেশীদিন গোপন থাকে না। ঘনিষ্ট কয়েকজন জেনে যায়। তারা এসে বারেক ভাইকে ধরলো কিছু বড় নোট বানিয়ে দিতে। ৫০০ টাকার নোট। বারেক ভাই দোনোমোনো করলেও পরে কিসমতের কাছে পাড়লো কথাটা। কিসমত বললো, বড় নোট করতে গেলে দামী কেমিক্যাল লাগবে, সেটা তার কাছে নেই। তাহলে কী উপায়? কিসমত জানালো সে উপায়ও আছে, তবে তাকে কক্সবাজার যেতে হবে। এই কেমিক্যালের চালান আসে সীমান্ত পেরিয়ে টেকনাফ হয়ে কক্সবাজারে। সেখানে কিসমতের লোক আছে তাদের কাছ থেকে আনা যাবে। তবে দাম খুব বেশী, তাই সে নিজে খুব আগ্রহী নয় তাতে।

কিসমত আগ্রহী না হলেও বারেক ভাই ও তার বন্ধুরা খুব উদগ্রীব। এই সুযোগ হেলায় হারানো বোকামি হবে। কথাটা খুব গোপন রেখে যে কোন উপায়ে কক্সবাজার থেকে সেই কেমিক্যাল আনাতে হবে। কিসমত তাদের সাথে বাটপারি করতে পারে, কেমিক্যালের টাকা নিয়ে উধাও হতে পারে- সে কথা ৫ জনই মাথায় রেখেছে। তাকে একা ছাড়া যাবে না টাকা দিয়ে। বারেক ভাইয়ের ৫ বন্ধু এই প্রকল্পে আড়াই লাখ টাকা বিনিয়োগ করবে। কিসমত জানিয়েছিল আড়াই লাখ টাকার কেমিক্যাল পেলে সে পঞ্চাশ লাখ টাকার নোট বানাতে পারবে।

বারেক ভাইকে দিয়ে কিসমতকে রাজী করানো হলো কক্সবাজার গিয়ে কেমিক্যাল আনার জন্য। তবে শর্ত হলো টাকাটা কক্সবাজার গিয়ে দেয়া হবে। ওরাও কক্সবাজার যাবে কিসমতের সাথে। দোনোমোনো করে কিসমত রাজী হলো। মুখে বললো, সে এসব ঝামেলায় জড়াতে চায় না। কৃষিকাজ নিয়েই সে সন্তুষ্ট ছিল। বেশী টাকা মানুষকে নষ্ট করে দেয়। শখে টাকা বানাতে গিয়ে সে এখন একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে মুশকিল। এত টাকা বানাতে গেলে অন্য কোন কাজ করা লাগবে না, ইত্যাদি ঘ্যান ঘ্যান করলো। তারপর বললো, এক মাসের বেশী সে এই কাজে থাকতে রাজী না। এর মধ্যে দিনরাত খেটে যতটা বানানো যায়।

বারেক ভাইয়ের বন্ধুরা তাতেই রাজী।

একদিন দুপুরে খেয়ে সবাই মিলে একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে কক্সবাজার রওনা দিল। সন্ধ্যায় কাজ সেরে সম্ভব হলে মাঝরাতে ফিরে আসবে চট্টগ্রাম। কিসমত জানালো ঘন্টা তিনেকের মামলা। পার্টিকে খবর দেয়া হয়েছে। তারা জিনিস নিয়ে তৈরী থাকবে। এক হাতে টাকা অন্য হাতে জিনিস।

সন্ধ্যে সাতটার দিকে বারেক ভাইদের গাড়ি কক্সবাজার পৌঁছে একটা বাজারের গলিতে ঢুকলো। গলির মুখ থেকে কয়েকটা দোকান পর একটা পুরোনো আমলের বাড়ি। বড় একটা লোহার গেট। গেটের একাংশ ভেঙ্গে ঝুলে পড়েছে। ভেতরে অন্ধকার। কারেন্ট চলে গেছে মনে হয়। একটা হ্যারিকেন জ্বলছে বাড়ির বারান্দায়।

কিসমত গাড়ি থেকে নেমে গেটের ভেতর ঢুকে কিছুক্ষণ পর বের হয়ে আসলো। এসে বারেক ভাইদের বললো রাস্তায় চোখ রাখতে। পুলিশের নজর আছে বাড়িটার দিকে। পুলিশ দেখলে যেন গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে ওদিকে সরে যায়। মালের বস্তা বেশী বড় না, গাড়ির সিটের নীচে লুকিয়ে রাখা যাবে। জিনিস কোথায় রাখবে সেটাও ঠিক করলো কিসমত। মাঝের সিটের ঠিক নীচে।

সব ঠিকঠাক করে টাকাটা হাতে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো। বারেকভাই সঙ্গীদের নিয়ে রাস্তায় কড়া পাহারায়। পুলিশ আসলে কেলেংকারী। ভয়ে বুক কাঁপছে খানিকটা। প্রতিটা মুহুর্ত টেনশান।

এক ঘন্টা পার হবার পরও কিসমত বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না দেখে বারেক ভাইয়ের এক বন্ধু ভেতরে ঢুকে খোঁজ লাগালো। কিন্তু বাড়ির কেউ কিসমতকে চেনে না। তবে বাড়ির পাশ দিয়ে একটা লোককে পেছনের গলিতে যেতে দেখেছে। পেছনেও গলি আছে নাকি? সর্বনাশ!

ততক্ষণে পাখি উড়ে গেছে। সারা কক্সবাজার তন্ন তন্ন করে খুঁজেও লাভ হলো না। কাউকে বলাও যাচ্ছে না কেসটা কী? বললে উল্টো পুলিশী ঝামেলার সম্ভাবনা। কিল খেয়ে কিল হজম করে মাঝরাতে ফিরে এল বারেক ভাই ও তার দলবল।

এবারের ধাক্কাটা বারেক ভাইয়ের জন্য বড় কিছু ছিল না। হাজার পঞ্চাশেক গেছে তাঁর। আগে এর চেয়ে অনেক বেশী টাকার ধাক্কা সামলেছেন তিনি। তাই তিনি বাড়ি ফিরে মুখ চুন করে থাকলেন না। কৃষিকাজে মন দিলেন নতুন লোক লাগিয়ে।

কিন্তু তাঁর অদ্ভুত সৌভাগ্যের মশাল তখনো নেভেনি।

এক ভরদুপুরে মলিন চেহারার আরেক অচেনা লোক তাঁর কাছে এসে জানতে চাইল বিলের ধারে পুকুর পাড়ের গোয়ালের পাশের ঘরটা তিনি ব্যবহার করেন কিনা।

ওই ঘরটা বহুকাল পরিত্যক্ত। গরুর রাখাল থাকার জন্য বানানো হয়েছিল কোন এক প্রাচীনকালে। এখন সাপখোপের আড্ডা হয়েছে। কেউ ভয়ে ওদিকে মাড়ায় না। পুকুরটি পৈত্রিক সুত্রে প্রাপ্ত। পুকুরে মাছ আছে। মাঝে মাঝে শুধু মাছ ধরার জন্য ওদিকে যাওয়া হয়। বাড়ি থেকে একটু দূরেই জায়গাটা।

লোকটার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বারেক ভাই জিজ্ঞেস করলো, ব্যাপার কী?

লোকটা ইতঃস্তত করে জানালো, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য তাই সে বলতে সাহস পাচ্ছেন না।

বারেক ভাই অভয় দিলে লোকটা বললো, তার নাম গোলাম কুদ্দুস। সে বার্মার রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা মানে রোহিঙ্গা। বার্মা থেকে পালিয়ে এসেছে নিরাপদ আশ্রয় ও কাজের সন্ধানে। আসার আগে সে রাখাইনের এক বৃদ্ধ মগ বাসিন্দার কাছ থেকে এই গ্রামের ঠিকানা পেয়েছে। সে তাকে ওই পুকুরের কথা জানিয়েছে। পুকুরপাড়ে একটা গোয়ালঘর, সব মিলে গেছে। ওই গোয়ালঘর আর আশপাশে কিছু পুরোনো জিনিসপত্র আছে। সেই মগের পূর্বপুরুষ একসময় এখানকার বাসিন্দা ছিল। এখান থেকে পালিয়ে যাবার আগে দামী স্বর্নের আসবাবপত্রগুলো পুকুরপাড়ে আর ওই ঘরের নীচে পুঁতে রেখে গিয়েছিল।

রাখাইনের সেই অলৌকিক ক্ষমতাধর বুড়ো বলেছে, ওই সম্পদের মালিকানা শুধুমাত্র জায়গার মালিকের। আর কেউ ওই সম্পদে নজর দিলে সাপের কামড়ে মারা পড়বে। ওই সম্পদ শত শত বছর ধরে পাহারা দিচ্ছে একদল বিষাক্ত সাপ।

গাঁজাখুরি গল্পগুলো শুনতে শুনতে বারেক ভাই মহা বিরক্ত। বললেন, যা ভাগ এখান থেকে। বাটপারি কথাবার্তা সব!

কুদ্দুস মিয়ারে বেঁধে ধোলাই দিলে আসল মতলব বের করা যাবে। পাড়ার লোকদের খবর দেয়া দরকার। এই ব্যাটার সাথে বাটপার কিসমতের কোন সম্পর্ক আছে কিনা ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন বারেক ভাই। কুদ্দুস তখনো হাল ছাড়েনি। পিছু পিছু আসছে। বারেক ভাই কড়া করে তাকাতেই দেখলেন চোখেমুখে নিরীহ মিনতি ঝরে পড়ছে।

কী চাস? ভাগ, মার খাবার আগে এলাকা ছেড়ে চলে যা। গর্জে উঠলেন বারেক ভাই।

নাছোড় কুদ্দুস বললো, ভাই আমারে আজ রাতের মতো ওই গোয়ালঘরে থাকতে দেন। কাল সকালেই চলে যাবো।

কী একটা ভেবে কুদ্দুসকে গোয়ালঘরে থাকার অনুমতি দিলেন। বললেন, সাপের কামড়ে মরলে আমার দোষ নাই। সকালে উঠেই চলে যাবি, আর যেন কিছু বলতে না হয়।

বাড়ি থেকে একটু দূরই আছে ওই গোয়াল। অনুমতি না নিয়েও যদি কেউ থাকে, বারেক ভাইয়ের জানার উপায় নেই। ওখানে চুরি হবার মতো কিছুই নাই। দরোজা জানালা কিছুই নাই। খা খা খোলা। শুধু একটা বেড়ার ঝাঁপি আছে নড়বড়ে।

পরদিন সকালে চা নাস্তা সেরে বারেক ভাই যখন মাঠে ধান কাটার ব্যবস্থা করার জন্য লোকের খোঁজে বেরিয়েছেন তখন দেখলেন কুদ্দুস পথের ধারে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়ানো।

ব্যাপার কী? যাস নাই এখনো?

কুদ্দুস ফিসফিস করে বললো, জিনিস আছে!! খাটি সোনা!

শুনে বারেক ভাইয়ের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। কিন্তু বিশ্বাস হয় না। এই ব্যাটা নিশ্চিত ধোঁকাবাজ। কোন বদ মতলবে এসেছে। কড়া ধমকে ভাগিয়ে দিতে যাবার আগেই কুদ্দুস একটু থেমে থেমে বললো, 'সাপের পাহারা। আপনি ছাড়া কেউ তুলতে গেলে মারা পড়বে। আজ রাতে আসেন। কাউকে বলবেন না। সোনার দোকানে যাচাই করে আসবেন। আমি আছি। রাতে কথা হবে।'

সে রাতেই গোয়াল ঘরে গর্ত করে একটা ছোট্ট হরিণ মুর্তি উদ্ধার করলো কুদ্দুস। পরদিন দুপুরে শহরের নিউমার্কেট এলাকার স্বর্নের দোকানে যাচাই করে জেনে এসেছে কুদ্দুসের উত্তোলিত হরিনটা খাঁটি সোনা।

কুদ্দুসের আর পাড়া ছেড়ে যাওয়া হলো না। গোয়াল ঘরেই ঠাঁই হলো তার। ঘরটা মেরামত করে দিল বারেক ভাই।
পাড়ার লোককে বলা হলো গরুর খামার করার জন্য ভিনদেশী রাখাল এনে রেখেছে।

কিন্তু বেশিদিন খবর চাপা থাকলো না। কানে কানে ছড়িয়ে গেল বারেক ভাই একটি স্বর্নের ডেকচি পেয়েছে। স্বপ্নে পাওয়া সেই ডেকচি পাহারা দিত একটি বিষাক্ত সাপ। সেই সাপের কাছ থেকে ডেকচি উদ্ধার করার পুরস্কার হিসেবে থাকার জায়গা দিয়েছে গোয়াল ঘরে। এরকম নানা গল্প রটে গেল পাড়ায়। কিন্তু সাপের ভয়ে কেউ ওদিকে মাড়ায় না।

স্বপ্ন সত্যি দেখেছিলেন বারেক ভাই। কয়েকদিন পর স্বপ্নে দেখলেন গোয়ালঘরের পাশে জাম গাছ তলায় একটা সাপ ঘুরছে। কুদ্দুসকে বলা হলো স্বপ্নের কথাটা। সন্ধ্যের পর সেখানে খুঁড়ে মিললো একটা সোনার বালা। এরপর তাঁর বিশ্বাস আরো পোক্ত হয়ে গেল। কুদ্দুসকে ছাড়া যাবে না। ঘরের আশপাশ খুঁড়ে প্রায় কয়েক কেজি সোনার জিনিসপত্র উদ্ধার করে ঘরের আলমারীতে তালা মেরে রাখা হলো।

আমি একদিন দেখতে গেলাম কৌতুহলী হয়ে। ইচ্ছে ছিল কুদ্দুসের একটা ইন্টারভিউ নেবো। ছবি ভিডিও করে রাখবো যদি সম্ভব হয়। কিন্তু আমি যেদিন গেলাম সেদিন কুদ্দুস কী কাজে যেন বাইরে গেছে। আমাকে বারেক ভাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব দেখালেন। পুকুরপাড়ে যখন হাঁটছিলাম তখন ওপার দিয়ে একটা সাপ পার হচ্ছিল। বারেক ভাই ফিসফিস করে বললেন, যখনই আমি এদিকে আসি ওই সাপটা দূর থেকে আমার সাথে সাথে হাঁটে। সে এই গুপ্তধন পাহারা দিচ্ছে। রোমাঞ্চিত হয়ে উঠার মতো দৃশ্য। এমন জীবন্ত রূপকথা জীবদ্দশায় কখনো দেখবো ভাবিনি।

দুপুরে খাওয়ার পর আমাকে উদ্ধারকৃত কয়েকটা সোনার ছোট ছোট থালা ইত্যাদি দেখালেন বারেক ভাই। দেখে কিন্তু একটু পিতল পিতল লাগে। তবে আমার আনাড়ি চোখে সোনাও যা পিতলও তা। কিছু বললাম না আমি। বারেক ভাই বললেন, আজকাল ইমিটেশনের চকচকি দেখতে দেখতে লোকের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। কুদ্দুস সেদিন আর ফিরবে না বলে ইন্টারভিউ না নিয়েই আমি ফিরে এলাম শহরে।

কয়েকদিন পর খবর পেলাম, সেই যে কুদ্দুক গেল, আর কখনোই ফিরে আসেনি। ওইদিন বারেক ভাই ওর হাতে দু লাখ টাকা দিয়ে একটা কাজে পাঠিয়েছিল। যে মানুষ কোটি টাকার স্বর্ণ উদ্ধার করে দিয়েছে তাকে দু লাখ টাকার বিশ্বাস করা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়।

তবে মুশকিল হলো তখনই যখন বাজারের পরিচিত স্বর্ণকার এসে উত্তোলিত সোনার জিনিসপাতিগুলো সব পিতল বলে ঘোষণা দিল। সেই সব জিনিসের মধ্যে শুধু একটি বস্তু অনুপস্থিত ছিল। প্রথমদিনের সেই হরিণমুর্তিটা কখন গায়েব হয়ে গেছে এত স্বর্নের ভিড়ে বারেক ভাই তা খেয়াল করেনি। জিনিসপত্র আনার অজুহাতে কুদ্দুসের পা বেডরুম পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। সম্ভবতঃ ওটা আসল সোনা ছিল। তাই বিশ্বাস অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল।

****** ******* *******

গল্প এখানেই শেষ। তবে বারেক ভাইয়ের সর্বশেষ খবরটা জানিয়ে শেষ করাই ভালো হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বারেক ভাই জমি হাত বদলের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। যথারীতি টাকার জোয়ারে ভেসে যান তিনি। গত চার বছরে জমির ব্যবসা ফুলে ফেঁপে কয়েক কোটি টাকা উৎপাদন করেছিল। জমি কিনতে কিনতে লোভের ফাঁদে পা দিয়ে একসময় নিজের এলাকা ছাড়িয়ে সুদূর চকরিয়ার সমুদ্রতীরেও ৫০০ বিঘা জমি কিনে ফেলেছিলেন সস্তায়।

দুবছর পর আড়াই কোটি টাকার জমি পাঁচ কোটি টাকায় বিক্রি করে ফেললেন। দশ লাখ টাকা আগাম নিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়ে বাকী টাকার চেক নিয়ে ব্যাংকে জমা দিলেন শহরে এসে। এই পদ্ধতিতে হরদম জমিজমা কিনেছেন তিনি গত কয়েক বছর। কোথাও সমস্যা হয়নি। এবার ঝামেলা হয়ে গেল। ব্যাংক থেকে পরদিন জানানো হলো পর্যাপ্ত টাকার অভাবে চেক ফেরত এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ওই একাউন্টে পাঁচ লাখ টাকাও নাই। জমিটা কিনেছে চকরিয়ার বিশিষ্ট এক পাণ্ডা। খুন খারাবি যার কাছে সকাল বিকাল নাস্তা করার মতো সহজ কাজ। চেক নিয়ে এখন প্রতারণা মামলা চলছে কোর্টে। তবে বারেক ভাই সুদূর চকরিয়ায় তাঁর জমির কাছেও ঘেঁষতেও পারছে না আর।

মামলার ফলাফল কী দাঁড়াবে জানি না। কিন্তু বারবার এটাই প্রমাণ হয়েছে যে বারেক ভাইয়ের টাকা বাইন মাছের চেয়েও পিছলা।


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গল্পটি দীর্ঘ নয়, তবে দীর্ঘ হলে ভালো হতো। তাতে পাঠক কোন তেলেসমাতিতে বারেক ভাইয়ের টাকাকড়ি 'নাই' হয়ে যায় সেটা ভালো করে বুঝতে পারতেন। এখানে কোন "বিশাল ছোট" সাইজের "মায়াগহ্বর"-এর(সমূহের) ভূমিকা আছে কিনা সেটা স্পষ্ট হতো।

সমকালীন বিষয়কে সাহিত্যে ধরে রাখা একটা স্বীকৃতি ধারা। এই গল্পে সমকালীন অনেকগুলো বিষয় উঠে এসেছে যেগুলো আরেকটু বিস্তারিত লিখলে ভবিষ্যতের পাঠকেরা আজকের পাঠকদের সমান রস গ্রহন করতে পারতেন।

অটঃ বস্‌, সচলে জমে ওঠা আপনার মোট গল্পের সংখ্যা তো খুব কম না। ফেব্রুয়ারী মাস আসতে আরও দিন দশেক বাকি আছে। একটা গল্প সংকলন বই মেলাতে নামিয়ে ফেলবেন নাকি? অন্তত একটা ই-বুক?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আসলে বারেক ভাইয়ের এই ঘটনাগুলো একটা উপন্যাস হবার মতো মালমশলা সমৃদ্ধ। কিন্তু আপাততঃ উপন্যাস লেখার এলেম/ধৈর্য কিছুই নেই বলে সেটাকে ছোট করে গল্পের আকারে নামাতে হয়েছে। ভবিষ্যতে কখনো সময় পেলে বিস্তারিত কাজ করা যাবে।

এলেবেলে গল্প জমেছে অনেক। কিন্তু সেই গল্প টাকা দিয়ে কেউ কিনবে সেটা বিশ্বাস করি না। বিনামূল্যে ইবুক করা যায়, ওটা মাথায় রাখলাম। তবে চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে যে কাজটা করছি সেটা প্রকাশের পরিকল্পনা আছে। ওটা কেউ কিনলে ঠকবে না এটা বলতে পারি। কাজটা শেষ হলে আপনার পরামর্শ নেয়ার ইচ্ছে আছে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

হিমু এর ছবি

চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে আপনার কাজের একটুখানিক ঘুলঘুলিদৃশ্য সচলে আমাদের দেখান না কেনু কেনু কেনু?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

কাজটা আরেকটু গোছানো হলে দেয়া হবে এনশাল্লাহ হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১। 'ভবিষ্যতে সময় পেলে' বলে কোন কথা নেই। এই ভবিষ্যত কখনো আসে না, আর সময়ও পাওয়া যায় না। সুতরাং মাভৈ বলে একটা উপন্যাসে হাত দিয়ে ফেলেন।

২। হাতে গোনা খুব অল্প কিছু বাজার চলতি লেখক ছাড়া আর কারও বই লোকে চেয়ে কেনে না। তাই বলে কি লোকে বই বের করবে না! বই প্রকাশ যদি শুরুই না করেন তাহলে ব্লগবহির্ভূত পাঠক আর আপনার কথা জানবে কী করে!

৩। শুনে খুবই আনন্দিত হলাম যে আপনি চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে লিখছেন। অপেক্ষায় নাজির! হিমু'র সাথে গলা মিলিয়ে আমিও ওখান থেকে কিছুমিছু'র দাবি জানিয়ে গেলাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সত্যপীর এর ছবি

চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে যে কাজটা করছি সেটা প্রকাশের পরিকল্পনা আছে। ওটা কেউ কিনলে ঠকবে না এটা বলতে পারি।

..................................................................
#Banshibir.

নীড় সন্ধানী এর ছবি

অ্যাঁ অ্যাঁ

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

এক লহমা এর ছবি

চলুক বারেকভাইরা এইরকম-ই। আর, বারেকভাইরা যখন টাকার পাহাড় থেকে পড়ে যান, তখন তাদের সাথে সাথে আরো যারা সর্বস্ব হারায়, তাদের অনেকের-ই আর উঠে দাঁড়ানোর উপায় থাকে না।
চট্টগ্রামের ইতিহাস-কথার অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

অতিলোভ অনেক বারেক ভাইয়ের জীবনকে শেষ পর্যন্ত দুর্বিসহ করে তোলে।

অনেকদিন পর দেখলাম আপনাকে। নতুন লেখা দেন, পড়ি। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মন মাঝি এর ছবি

স্বাক্ষী > সাক্ষী। হাসি

****************************************

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ঠিক করে দিলাম। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মন মাঝি এর ছবি

চলুক

****************************************

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

দারুণ গল্প।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ লেখা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।