ভিতুশা পাহাড়ের নিমন্ত্রণে

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৯/১০/২০১৫ - ৪:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


আমার সেজ মামা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলে আমি রীতিমতো ভয়ে কুঁকড়ে থাকতাম। কারণটা হল মামার চোখে পরা মাত্রই মামা নানাভাবে প্রমাণে চেষ্টা করতেন যে ছাত্র হিসেবে আমি খুবই নিম্নপদস্থ। কারক, সমাস, ক্রিয়া-পদ এসব নিয়ে নিরন্তর প্রশ্ন তো করতেনই, মাঝে মাঝে আবার বলতেন তার হটাৎ মনে আসা কোনও বিষয়ে ইংরেজিতে ক’পাতার রচনা লিখতে। বলাই বাহুল্য তাতে ভুলের মাত্রা বেশি হলেই শুনতে হতো তার বিদ্রূপ এবং ভর্ৎসনা । একবার ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে বেশ চুটিয়ে গল্পের বই পড়ে সময় কাটিয়ে দিচ্ছি এমন এক দিনে মামা এলেন আমাদের বাড়ি। স্বভাবসুলভভাবে এবারও দিয়ে বসলেন এক রচনা লেখবার ভার, আর ভবিষ্যতবাণী করে দিলেন আগেই- সেই রচনা লিখতে গিয়ে নাকি আমার নাক আর চোখের জল এক না হয়ে পারেই না। তাই নাকি? আর যদি সেই ধারণা ভুল হয়? তাহলে নাকি মামা আমার পছন্দ মতো কয়েকটি গল্পের বই কিনে দেবেন সে বেলাতেই। বহু চেষ্টা চরিত্র করে মামা আমার লেখায় ভুল ধরতে পারলেন মাত্র দুটি এবং কিছুটা বিমর্ষ হয়ে ঘোষণা দিলেন আমিই জিতে গেছি। অতঃপর মামাকে সাথে নিয়ে গেলাম আমাদের পাড়ার বইয়ের দোকানটিতে। তখনও ঢাকা শহরে প্রায় প্রতি পাড়াতেই একটি দুটি করে বই-খাতা-কলমের দোকান ছিল। পড়ার বইয়ের পাশাপাশি সেখানে মিলত অল্পস্বল্প গল্পের বইও। সেদিন মামার কাছ থেকে যে তিনটি বই আদায় করেছিলাম তার একটি হল “বার্চবনে ঝড়”। বইটির গল্পের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় এক বাংলাদেশী কিশোর এবং তার বন্ধু এক বুলগেরিয়ান কিশোরের দুরন্ত অভিযানের কীর্তিকলাপ নিয়ে। এই বইটি হাতে নিয়ে মনে হতো ওই গল্পের রবিন নয়, যেন আমিই ঘুরে বেড়াচ্ছি আমার বন্ধু রিষ্টর হাত ধরে ভিতুশা পাহাড়ের পাতা-ঝরা বার্চবনের মাঝ দিয়ে, যেন এই আমিই রিষ্টর বিপদে ছুটে যাচ্ছি সোফিয়ার অদূরের বয়ানা গ্রামে। গতবছর দেশে বেড়াতে গিয়ে আমার ধুলোমাখা বইয়ের আলমারির এক কোণে হটাৎই খুঁজে পেলাম এই বইটিকে। তামা-পেতলের তৈজসে বহুকালের পরে থাকা ধুলো অপসারণের পর আবার যেমন ঝকঝক করে ওঠে পৃষ্ঠদেশ, দেশ থেকে ফেরার সময় সাথে করে নিয়ে এসে “বার্চবনে ঝড়” নতুন করে পড়বার মধ্য দিয়ে আমার শৈশবের স্বপ্নগুলোর উপর তেমনি করে জমে থাকা বহুকালের এক বিস্মৃতির আস্তরণ যেন কর্পূরের মতো উবে গেল। মনে হল সেই ভিতুশা পাহাড়ের বার্চবন, বয়ানা গ্রাম, প্লভদিভ- তারা যেন আমায় বহুকাল আগেই নিমন্ত্রণ করে রেখেছিল, শুধু যাবার পালাটি ছিল বাকি। এবার সেই বাকি চুকোবার পালা।

প্রসারিত মুষ্টিবদ্ধ হাতের কনুইয়ে এক লক্ষ্মী প্যাঁচা নিয়ে মায়াময়ী যে নারী আমাকে এ শহরে অভ্যর্থনা জানালেন তার নামেই এই সোফিয়া শহরের নামকরণ। সেরদিকা পাতাল-রেল ষ্টেশন থেকে ব্যাগ বোঁচকা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেই যখন এই দেবীরূপী সন্তের সাথে সাক্ষাৎ তখন প্রথমেই যে কথাটি মাথায় এলো তা হল এই দেবীকে বড্ড যেন ঝকঝকে লাগছে। সোফিয়া শহরে সোফিয়ার এই মূর্তিটি কি তবে বহু আগে থেকেই ছিলনা? আমার হোটেল এই সেরদিকা ষ্টেশন থেকে হাঁটা পথে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে। এই জায়গাটিকে বলা চলে সোফিয়ার প্রাণকেন্দ্র। কারণ এই সন্ত সোফিয়া যেদিকে মুখ করে আছেন সেদিকে সড়কের ঠিক উল্টো দিকেই রাষ্ট্রপতি ভবন আর কম্যুনিস্ট পার্টির সাবেক সদর দপ্তর। আর সন্ত সোফিয়ার ডান দিকের ভিতুশা বুলেভার্ডটি হল এ শহরের অন্যতম পুরনো বাণিজ্য কেন্দ্র। কিন্তু এহেন এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সমাজতান্ত্রিক সময়ে অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্মের এক সন্তের মূর্তি থাকবে তাই কি হয়? আসলে সন্ত সোফিয়া আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় পঞ্চাশটি বছর সেখানে পার্টি অফিসের দিকে কড়া নজর রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন লেনিন। সমজাতন্ত্রের পতনের পর সোফিয়া এসে তাকে হটিয়ে তার জায়গাটি দখল করে নেন কেবল।

আমার হোটেলের পাড়াটিকে বড্ড ভালো লেগে গেল। এ পাড়ায় আমার হোটেলটিই একমাত্র আবাসিক হোটেল। আর বাদবাকি সবই দোকান-পাট। তাই বলে হুরমুর করে গজিয়ে ওঠা বাজার নয় এটি। মনিহারি দ্রব্যের নানা দোকান তো আছেই, তার সাথে আবার উপরি হিসেবে ইট বেছানো সরু সড়ক চিড়ে চলে যাওয়া একখানা ট্রাম লাইনও আছে এ পাড়ায়। অর্থাৎ এ শহরে কেবল রাজপথে নয়, গুড়গুড় শব্দে ট্রাম চলে যায় ওক আর লাইম গাছের পাতায় ছাওয়া এমন পাড়াটে গলির মাঝ দিয়েও। সেদিক দিয়ে এ আমার কাছে এক নতুন বিস্ময়।

মারিয়া লুইযা বুলেভার্ডটি আমার হোটেল থেকে এই হাঁটা দূরত্বে। হোটেলে রুম বুঝে নিয়েই ছুটলাম মারিয়া লুইজার পাশে অবস্থিত এক ছোটখাটো মার্কেটে। উদ্দেশ্য কিছুমিছু খেয়ে তখনকার মতো পেটকে শান্ত করা। কিছুক্ষণ এই মার্কেটে ঘুরঘুর করে সদর রাস্তায় বেড়িয়ে একটি ব্যাপার খেয়াল করে তাজ্জব হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা হল এই মার্কেটের এক পাশে হল প্রায় পাঁচশ বছরের পুরনো “বানিয়াবাসি” মসজিদ আর অন্য পাশে “সোফিয়া সিনাগগ”। মাত্র কয়েকশ গজ দূরত্বে মসজিদ এবং সিনাগগ? জেরুজালেম ছাড়া আর কথাও এমন আর আছে কি? তবে জেরুজালেমের সাথে এখানের পার্থক্যটি বোধয় এখানেই যে এই দু’ সম্প্রদায়ের মধ্যে এ এলাকায় দৃশ্যত কোনও বিরোধ নেই। অবশ্য সোফিয়াতে যে খুব বেশি ইহুদী এখন আর অবশিষ্ট আছে তেমন নয়। পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে এখানকার ইহুদীদের একটা বড় অংশই পাড়ি জমায় ইসরাইলে, তাই আজ সোফিয়া শহরে মাত্র কয়েকশ ইহুদীর আবাস। তারাই মূলত পরিচালনা করে এই সুবিশাল সিনাগগটি। এই সিনাগগটি তৈরি হয়েছিলো উনিশ শতকের শুরুতে। ততদিনে অবশ্য অটোমানরা বুলগেরিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। সিনাগগের ভেতরের অষ্টভুজাকৃতি ডোমের সাথে ঝুলছে প্রায় দু’টন ওজনের এক মনোমুগ্ধকর ঝাড়বাতি। সিনাগগটি যে কতটা বিশাল তা এই ঝাড়বাতির ওজন থেকেই খুব সম্ভবত অনুমান করা যায়।

অন্যদিকে ওধারের বানিয়াবাসি মসজিদটি তৈরি হয়েছিলো অটোমানরা বুলগেরিয়া দখলের পর পরই। সে সময়ে এখানে ছিল এক প্রাকৃতিক উষ্ণ প্রসবন। মসজিদটি তৈরি হয়েছিলো সেই উষ্ণ প্রসবনের ধার ঘেঁষেই। পরে সেই উষ্ণ প্রসবনকে ঘিরে তৈরি করা হয় এক হাম্মামখানা। এখন অবশ্য সেই হাম্মামখানাটি বন্ধ করে সংস্কারের কাজ চলছে। একজন বুলগেরিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তা এই কাজ কবে শেষ হবে? জবাবে সে হা হা করে হেসে বলল, “তোমাকে একটা গল্প শোনাই ভায়া। কম্যুনিস্ট সময়ে আমাদের দেশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে মাত্র দেড়শ কিলোমিটার রাস্তা বানাতে সময় লেগেছিল প্রায় পঁচিশ বছর। তাহলে বুঝতেই পারছ আমরা কতো তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করি। এই হাম্মামখানার কাজ যদি ধর আগামী এক দু’বছরে শেষ হয় তাহলে বুঝে নেবে বুলগেরিয়া কিছুটা হলেও বদলেছে”।

শুধু ওই হাম্মামখানাই নয়, তার সাথে কথা হচ্ছিলো অদূরেই চলতে থাকা আরও কিছু নির্মাণ কাজ সম্পর্কে। আসলে সেরদিকা পাতাল-ট্রেন ষ্টেশনে নামার পরই খেয়াল করেছিলাম স্টেশনের এক দিকে কি যেন খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এই ষ্টেশন এবং সন্নিকটে এক হোটেল বানাবার সময় নাকি বেড়িয়ে আসে রোমান সময়ের এক মুক্ত-মঞ্চ, পাওয়া যায় সে সময়কার সভ্যতার নানা নিদর্শন। তারপর সেই দশ বছর ধরেই নাকি খোঁড়াখুঁড়ি চলছে পুরো মুক্ত মঞ্চটিকে মাটির তল থেকে বের করে নিয়ে আসবার জন্যে। আবার ওদিকে সমস্যা হল যে জায়গায় এটি পাওয়া গেল সেটি একেবারেই শহরের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, যার অদূরেই রাষ্ট্রপতির অফিস। জনতার দাবি হল এই পুরাকীর্তিকে আলাদা করে সংরক্ষণ করা হোক, ওদিকে সুবিধাভোগী অংশটি চাচ্ছে পুরাকীর্তিকে বের করে তাকে মাটির নিচে জাদুঘর মতো কিছু বানিয়ে তার উপরই হোটেল, অফিস বানাতে। এ নিয়ে দেখলাম সে স্থানে প্রতিবাদী জনতার বেশ কিছু দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড।

স্টালিনের শাসনামলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর সমাজতান্ত্রিক ব্লকভুক্ত দেশগুলোতে নতুন এক স্থাপত্য রীতির আবির্ভাব ঘটে। অনেকে একে বলেন স্টালিনিস্ট স্থাপত্য রীতি আবার অনেকে বলেন ‘সমাজতান্ত্রিক ক্লাসিসম’। যে সময়ের কথা বলছি তার কয়েক দশক আগে থেকেই আমেরিকায় শুরু হয়েছিলো কংক্রিট ব্যবহার করে গগনচুম্বী অট্টালিকা তৈরির রীতি। স্টালিনিয় স্থাপত্য ধারায় সেই গগনচুম্বী অট্টালিকার ধারণাটিকে মিশিয়ে দেয়া হল গথিক এবং রাশান বারোক স্থাপত্য রীতির সাথে। যার ফলাফল হিসেবে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তৈরি হয়ে গেল শ্রম, ব্যয় এবং অর্থসাপেক্ষ পাহাড়সম কিছু অট্টালিকা। নিকিতা ক্রুসচেভ ক্ষমতায় আসার পর অবশ্য আচমকাই বন্ধ করে দেন এই ধারাটিকে। এই ধারাটির সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে পোল্যান্ডের ওয়ারশে ঘুরতে গিয়ে। হল কি, ওয়ারশের কেন্দ্রে অবস্থিত ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি ভবন’ দর্শন করতে গিয়ে ঠায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম আরে ঠিক এই রকম আদলেরই আরেকখানা ভবন যেন কোথায় দেখেছি? স্মৃতি হাতড়ে বুঝতে পারলাম আমার এই মনে হওয়াটা অমূলক নয়, আসলে ঠিক একই আদলের আরেকটি ভবন এর আগে দেখেছিলাম লাটভিয়ার রিগায়। লাটভিয়ার বিজ্ঞান একাডেমী ভবনটিও অনেকটা একই নকশার। কিন্তু প্রশ্ন হল রিগার এবং ওয়ারশের এই দুটি ভবন অনেকটা একই স্থাপত্যশৈলীর হল কি করে? তখন এ নিয়ে অনুসন্ধানে জানতে পারলাম ওই দুটি ভবনই আসলে তৈরি হয়েছিলো অনেকটা একই সময়ে সোভিয়েত স্থপতিদের নকশা অনুযায়ী ওই একই সোভিয়েত স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করে। পোল্যান্ডের ভবনটি নাকি ছিল পোল্যান্ডের প্রতি স্টালিনের উপহার। যদিও পোল্যান্ডের তখকার মানুষ এই উপহারকে আসলে উপহার না মনে করে পোল্যান্ডের উপর স্টালিনের কর্তৃত্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখত। তাদের আরও ক্ষোভ ছিল ওয়ারশের পুরনো শহরের গাঁ ঘেঁষে এই ভবনটি তৈরি করায়, কারণ তাতে নাকি পুরনো শহরের মাধুর্য অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় এই গগনচুম্বী ভবনের কারণে। যাক গে, যে কারণে এতো কথা অবতারণা তা হল ওই অনেকটা একই সময়ে স্টালিন কিন্তু একই আদলের আরও একটি ভবন তৈরি করে দিয়েছিলেন আরেকটি দেশকে, সেই দেশটি ছিল বুলগেরিয়া। আর বুলগেরিয়ার তখনকার কম্যুনিস্ট পার্টি অফিসের সদর দপ্তর ভবনটিই হল সেই ভবন। এই ভবনটিও আমার হোটেল পাড়া থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এক সময় এই ভবনের চুড়োয় নাকি ছিল সমাজতন্ত্রের প্রতীক সেই পঞ্চভুজাকৃতির লাল তারা। সমাজতন্ত্রের পতনের পর সেই তারা খুলে ফেলে সেখানে লাগানো হয় বুলগেরিয়ার পতাকা। সেই লাল তারাটিকে অবশ্য আমি পরে খুঁজে পেয়েছিলাম, সে গল্পও বলব অবশ্যই। এখন আর এই ভবনে পার্টি অফিসের সদর দপ্তর আর নেই, বরং এখানে এখন বসানো হয়েছে সরকারী নানা দপ্তরের অফিস।

সেই ‘বার্চবনে ঝড়’ পড়ার সময় থেকেই সোফিয়ার একটা সড়কের নাম মাথায় ঢুকে ছিল, যার নাম ‘নাইনথ সেপ্টেম্বর স্ট্রিট’। এটি নাকি ছিল সেই তৎকালীন পার্টি সদর দপ্তরের সামনের সড়কের নাম। আমি তো সেই ভবনের সামনেই, তবে কি আমার খুঁজে পাবার কথা নয় সেই স্ট্রিট? কিন্তু আতিপাতি করে খুঁজেও আমি সেই স্ট্রীটের কোনও খোঁজ পেলাম না। বরং খুঁজে পেলাম এই ভবনের পাশের “কিং অ্যালেক্সান্ডার দন্দুকভ” স্ট্রীটের। আমার অবশ্য সেই ‘নাইনথ সেপ্টেম্বর স্ট্রিট’ খুঁজে পাবার কথাও নয়। কারণ, সময়টাই যে বদলে গেছে! ‘নাইনথ সেপ্টেম্বর’ হল সেই দিন, যে দিনে ১৯৪৪ সালে সোভিয়েত বাহিনী প্রবেশ করে বুলগেরিয়ায়, শুরু হয় অর্ধশতাব্দী ব্যাপী সমাজতান্ত্রিক শাসনের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে বুলগেরিয়া কিন্তু ছিল জার্মানির মিত্র। যুদ্ধ শেষে কম্যুনিস্টরা ক্ষমতা নেবার পর পরই প্রায় ত্রিশ হাজার লোককে হয় কর্ম শিবিরে পাঠানো হয়, নতুবা সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় ফ্যাসিস্ট সরকারকে সাহায্য করবার জন্যে। এখনকার প্রেক্ষাপটে ‘নাইনথ সেপ্টেম্বর’ কে তাই দেখা হয় একটি কালো দিন হিসেবে। ‘নাইনথ সেপ্টেম্বর’কে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন এমন একটি ছোট দলও আছে, যদিও জাতীয় রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা এখন খুবই সীমিত।

‘নাইনথ সেপ্টেম্বর’ স্ট্রীটের নাম মুছে গেলেও সোফিয়ার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামই দেখলাম কিছু স্মরণীয় তারিখের নামে। এই যেমন- সিক্সথ সেপ্টেম্বর, ফিফটিনথ নভেম্বর, এলেভেন্থ অগাস্ট স্ট্রিট। এই সবগুলো সড়কই ওই একই এলাকায়, তাই মোটামুটি সবগুলো সড়কেই যাওয়া হয়েছে। তবে আমি শুধু এসব সড়কে ঘোরাঘুরি করেই ক্ষান্ত হইনা, চেষ্টা করি এদের এই নামকরণের পেছনের ইতিহাস জানার। এই যেমন জানলাম ফিফটিনথ নভেম্বরের দিনটিতে বুলগেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে সমাজতন্ত্রের পাট চুকিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয় ১৯৯০ সালে। যদিও তার এক বছর আগেই প্রতাপশালী শাসক ঝিভকভের পতন ঘটেছিল। আর সিক্সথ সেপ্টেম্বর দিনটিতে ১৮৬৮ সালে বুলগেরিয়ার পূর্ব অংশের কিছু এলাকা আজকের বুলগেরিয়ার সাথে একত্রিত হয়। তবে শুধু এই সন-তারিখই নয়, নামকরণের বেলায় আরেকটি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বুলগেরিয়ান এবং রাশান জারদের নামের। তা সে এতো এতো জারদের নামে যে মাথা বো বো করে ঘুরবার জোগাড়। জার সিশ্মান স্ট্রিট, জার অসভবদতেই স্ট্রিট, জার দন্দুকভ স্ট্রিট, জার সিমেওন স্ট্রিট, জার স্যামুয়েল স্ট্রিট, জার কাল্যয়ান স্ট্রিট- ভেবে দেখলাম এই প্রতিটি জারের ইতিহাস যদি সেই মুহূর্তে জানার চেষ্টা করি তবে হয়তো বুলগেরিয়ান ইতিহাসের একখানা ছোটোখাটো ক্লাস নিতে হবে। তাই সে প্রচেষ্টাটুকু তখনকার মতো তুলে রাখলাম।

সোফিয়াতে যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় এ শহরের অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান কোনটি তাহলে হয়তো সে চোখ বুজে বলে দেবে অ্যালেক্সান্ডার নভস্কি ক্যাথাড্রালের কথা। এই ক্যাথাড্রালটিকে মূলত বলা যায় এ শহরের অনন্য প্রতীক। সে ওই ফিফটিনথ নভেম্বর স্ট্রীটের উপর, যেতে হয় যদিও জার অসভবতেই স্ট্রিট পেড়িয়ে। এ পথে নভস্কি ক্যাথাড্রাল দেখতে যাবার আগে পথেই আরেক রাশান অর্থোডক্স ক্যাথাড্রালের সন্ধান পেয়ে তাতে একটু ঢুঁ মারলাম। এই রাশান ক্যাথাড্রালটি বড় নয় তেমন, কিন্তু তার স্বর্ণমণ্ডিত চুড়োগুলোও দেখবার মতো। অটোমানদের হাত থেকে মুক্তির পর রাশানরাই এই ক্যাথাড্রালটি নাকি তৈরি করে দিয়েছিল, যেজন্যে এর নাম রাশান চার্চ। তবে আরেকটি বিষয় হটাৎ খেয়াল হল। এই চার্চটি কিন্তু বুলগেরিয়ার গণপরিষদ ভবন থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে, সমজান্ত্রিক সময়ে এ কেমন করে সম্ভব হল? লিথুয়ানিয়ায় দেখেছিলাম এমন অনেক চার্চে রীতিমতো তালা ঝুলিয়ে ভাঁড়ার ঘর বানানো হয়েছিলো সোভিয়েত সময়ে। জানতে পেলাম এই চার্চটি নাকি সেই ঝাঁপটা থেকে কিছুটা বেঁচে গেছে একটাই কারণে, আর তা হল অন্যসব ধর্মীয় বিষয়ে কিছুটা অলিখিত নিষেধাজ্ঞা থাকলেও চার্চে বিয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনও বাধা-নিষেধ ছিলনা। আর এ চার্চটিই ছিল সে সময়ে সোফিয়ায় অর্থোডক্স রীতির বিয়েগুলোর প্রধান অবলম্বন।

আজ থেকে প্রায় এক হাজার পূর্বে এগার শতকের কোনও এক সময় খ্রিস্ট ধর্মে এক নতুন ধারার উদ্ভব হয়। পোপের পতাকা-তল তথা ক্যাথলিক সমাজ থেকে বেরিয়ে এই নতুন ধারাটি নিজেদের পরিচয় দেয়া শুরু করে অর্থোডক্স খ্রিস্টান হিসেবে। কালক্রমে নতুন এই ধারাটিরও আবার তিনটি উপধারার সৃষ্টি হয়। একটি উপধারার উদ্ভব রাশিয়া থেকে, যেটি রাশান অর্থোডক্স ধারা নামে পরিচিতি পায়। দ্বিতীয় ধারাটির উদ্ভব গ্রীস থেকে, যেটি পরে ছড়িয়ে যায় ভূমধ্যসাগর সংলগ্ন অঞ্চল আর বলকানে। এই ধারাটি মূলত পরিচিত ইস্টার্ন অর্থোডক্স ধারা হিসেবে। আর তৃতীয় ধারাটির উদ্ভব আর্মেনিয়া থেকে, যেটি পরে ছড়িয়ে যায় ককেশাস আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। এই ধারাটি পরিচিতি পায় “প্রাচ্যের অর্থোডক্স” রীতি হিসেবে। কালে কালে বুলগেরিয়ায় মূলত ওই ইস্টার্ন অর্থোডক্স ধারাটিই প্রাধান্য বিস্তার করে। অ্যালেক্সান্ডার নভস্কি ক্যাথাড্রালটি সেই অর্থোডক্স ধারারই এক ক্যাথাড্রাল। বুলগেরিয়ার আরও অনেক চার্চ এবং সিনাগগের মতো এই বিখ্যাত ক্যাথাড্রালটিও বানানো হয় অটোমানদের হাত থেকে মুক্তির পর, আঠার শতকের শেষের দিকে। ক্যাথাড্রালের চারপাশে এক ছায়াঘেরা পার্ক, সেখানে কয়েক বুলগেরিয়ান বৃদ্ধা চেয়ার আর সামিয়ানা পেতে উল আর কুশিতে বুনে চলেছেন অপূর্ব সুন্দর কিছু টেবিল ক্লথ। কাছে যাওয়া মাত্রই কয়েক বৃদ্ধা বোনা থামিয়ে ছুটে এলেন আমার কাছে, কিছু নেবো কিনা জানতে। সে মুহূর্তে কিছু নেবার নেই আমার, ওদিকে বৃদ্ধাদের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়েও বড্ড মায়া হচ্ছিলো আমার। তাই কিছুটা লজ্জা সহকারে তাদের সূচি-কর্মের প্রশংসা করে সরে এলাম সেখান থেকে।

এই ক্যাথাড্রালটি তো বটেই, বলকানের আরও কয়েকটি অর্থোডক্স চার্চ ঘুরে একটি ব্যাপার লক্ষ করলাম। তা হল এই অর্থোডক্স চার্চ গুলোতে যীশু কিংবা মেরীর কোনও মূর্তি থাকেনা। তার বদলে যাজকের মূল বেদীর পেছনে আলটার ফ্রেমগুলোতেগুলোতে শোভা পায় যীশুর এবং মেরীর নানা ছবি। শুধু তাই নয় এই অর্থোডক্স গির্জাগুলোর দেয়ালজুড়ে আঁকা হয় যীশুর জীবনের এবং বাইবেলে বর্ণিত নানা কাহিনীর ছবি। অ্যালেক্সান্ডার নভস্কিতেও তেমনি মূল বেদীর কেন্দ্রস্থলে ক্রুশের দু পাশে মোট ছটি আলটার ফ্রেমে শোভা পাছে যীশুর ছটি ছবি। বিশাল এই ক্যাথাড্রালটিতে কোনও আধুনিক বিজলি বাতির ব্যবস্থা নেই। আলোর অভাব মিটাচ্ছে বহু উপরে গুম্বজের দেয়াল আঁকড়ে থাকা সারি সারি জানালার ফাঁক গলে আসা কিছু সূর্যের আলো। কয়েক টন ওজনের যে ঝাড়বাতিগুলো ঝুলছে সেই বিশাল উঁচু গম্বুজের ছাঁদ থেকে, তাতেও ব্যাবহার করা হচ্ছে মোম। সেই মোমের মিষ্টি এক গন্ধ, ভেতরের আলো আঁধারি এই সব মিলিয়ে ভেতরের পরিবেশটা কেমন যেন অপার্থিব পবিত্র। ভেতরের দিকে যে সর্বোচ্চ গম্বুজ তার চুড়োতে আঁকা হয়েছে এক সাধুর ছবি, যিনি দু হাত বাড়িয়ে ডাকছেন নীচের জমিনে থাকা তার অনুসারীদের। শতবর্ষের ব্যবধানে সেই ছবিটি আজ কেমন যেন ঝাপসা। বছরের পর বছর ধরে জ্বলতে থাকা এই মোমবাতিগুলো মনে হয় না এইসব অমূল্য চিত্রকর্মের দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য সহায়ক।

অ্যালেক্সান্ডার নভস্কি থেকে বেরিয়ে সামনের খোলা চত্বরে আসা মাত্র কিছুটা ভড়কে গেলাম। বুলগেরিয়ায় এখনও পর্যটক আসেন অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশের তুলনায় কম, এশিয়ান পর্যটকও তেমন ভাবে চোখে পড়েনি সোফিয়ার পথে। তাই এক সাথে যখন জনা পঞ্চাশেক ভারতীয়কে একই সড়কে দেখলাম তখন একটু কৌতূহল হল বৈকি। একটু ধাতস্থ হবার পর বুঝলাম ইনারা ঠিক পর্যটক নন। এরা সবাই বম্বের এক সিনেমার শুটিং দলের লোক। শাহরুখ এবং কাজল অভিনীত ‘দিলওয়ালে’ ছবির শুটিংয়ের জন্যেই নাকি তারা এসেছে বুলগেরিয়ায়। শাহরুখকে অবশ্য এ স্থানে দেখলামনা, কারণ যে দৃশ্যটির শুটিং চলছে সেটি নাকি খলনায়কের সাথে তার সাঙ্গ পাঙ্গদের এক দৃশ্য। পথ চলতি দু চারজন থেমে এই শুটিং দলের কার্যক্রম দেখছে বটে, কিন্তু তাই বলে এদের নিয়ে কোনও অযাচিত জটলা নেই। অদূরে দাঁড়ানো কিছু পুলিশকে দেখে মনে হল তারাও বেশ মজা পাচ্ছে এই শুটিং এর কার্যক্রমে।

সমাজতান্ত্রিক সময়ে বুলগেরিয়ার প্রতিটি শহর উপশহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে শোভা পেত সমাজতন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ নেতা, সমবায় ফার্মের মেহনতি মানুষ, জাতীয় বীর কিংবা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মহিমাময় ভাস্কর্য। নেতাদের ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে মূলত প্রাধান্য ছিল লেনিন, স্তালিন, গিওরগি দিমিত্রভ, ঝিভকভ এবং দিমিতার ব্লাগএভের। কমুউনিসমের পতনের পর সর্বপ্রথম যে ভাস্কর্যগুলো অপসারণ করা হয় সেগুলো হল এই নেতাদের ভাস্কর্য। ধীরে ধীরে বাকি ভাস্কর্যগুলোও অপসারিত হতে থাকে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের হাত থেকে মুক্তিতে সোভিয়েত বাহিনীর সাহায্যের কারণে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যে ভাস্কর্যগুলো বানানো হয়েছিলো সেরকম অল্প কিছু ভাস্কর্য খুব সম্ভবত সরানো হয়নি রাশিয়ার প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে। কারণ লেনিন-স্তালিনের প্রতি বর্তমান রাশিয়ার তেমন একটা মায়ামোহ না থাকলেও সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার সোভিয়েত সেনাবাহিনীর শৌর্য-বীর্যকে এখনও তারা তাদের সম্মানের অংশ বলেই মনে করে। সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হাঁটা দূরত্বে অবস্থিত সোভিয়েত আর্মি মেমোরিয়ালে দেখা মেলে এমনই কিছু সমাজতন্ত্র-উত্তর সময়ের ঝাঁপটা থেকে বেঁচে যাওয়া ভাস্কর্যের। এই মেমোরিয়ালটি মূলত এই ভাস্কর্যগুলোকে ঘিরে তৈরি করা এক পার্ক। এই পার্ক বা এই ভাস্কর্যগুলির সাথে এখনকার বুলগেরিয়ার সমাজের আদর্শিক সংযোগ আর তেমন নেই। বিকেলের দিকে পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা এখানে এসে কিছুটা সময় নিজেদের মাঝে কাটিয়ে যায় কেবল। তবে সেই তরুণদের দলের একাংশের ক্ষোভ নির্গমনের স্থলও এই পার্কের ভাস্কর্যগুলোই। তাদের কথা বলছি, যারা রাশিয়ার অতীতের এবং বর্তমানের আগ্রাসনবাদী চরিত্র নিয়ে ক্ষুব্ধ। এমন অনেকে গত কয়েক বছরে রাতের আঁধারে এই ভাস্কর্যগুলোকে রাঙ্গানোর চেষ্টা করতো বিভিন্ন প্রতিবাদী রঙে। সে নিয়ে অবশ্য বুলগেরিয়ার সাথে রাশিয়ার কিছুটা মন কষাকষিও হয়েছে। কেবল কয়েকটি ভাস্কর্যও যে দুটি দেশের মাঝে কূটনৈতিক টানাপোড়ন সৃষ্টি করতে পারে এই তার প্রমাণ।

পার্কে ঢুকেই সম্মুখের প্রায় ৩০ মিটার উঁচু বেদীতে চোখে পরে রাশান পেপেশা সাব-মেশিনগান হাতে যুদ্ধজয়ী গর্বিত এক সৈনিকের অবয়ব। এই সৈনিকের বা হাতটি স্পর্শ করে আছে এক বুলগেরিয়ান সহযোদ্ধার স্কন্ধ। আর তার ডান দিকে কোলে শিশু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক বুলগেরিয়ান মা, তার চোখ দুটি যেন তাকিয়ে আছে অনাগত কোনও এক ভবিষ্যতের দিকে। এই বেদীর সামনের চত্বরটি ঢাকা হলুদ আর কমলা গাঁদা ফুলের চাঁদরে। পার্কের আর দু ধারেও রয়েছে দুটি বিশাল ভাস্কর্য, এ দুটি একটু অপেক্ষাকৃত নিচু বেদীতে। এই ভাস্কর্য দুটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যুদ্ধ ফেরত ক্লান্ত-হতশ্রান্ত, গর্বিত সৈনিকদের অভিব্যক্তি। এদের কেও কেও বহুকাল বাদে মিলিত হচ্ছে পিয়ার সাথে, কেওবা ফেলে যাওয়া শিশুটিকে পুনরায় কোলে নিতে পেরে আনন্দে বিহ্বল, কেওবা আনন্দে জড়িয়ে ধরেছেন পাড়ার খুড়োকে। ভাস্কর্যগুলো সাক্ষ্য দেয় শুধু ছেলেরা নয়, রাশান নারীরাও এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিলেন ভারী রাইফেল হাতে, সুদীর্ঘ যুদ্ধ শেষে আজ তাদেরও বাড়ি ফেরবার পালা। মোট কথা, এই প্রতিটি ভাস্কর্যের রুপায়ন এতটাই জীবন্ত যে মনে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে রাশান সৈনিকদের বাড়ি ফেরার কোনও এক মুহূর্তকে জাদুবলে মমি করে যেন ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে এই পার্কে।

বিকেল শেষে হোটেলে ফেরার আগে ভাবছিলাম সেই সকালের দেখা মার্কেটের এক ফলের দোকান থেকে কিছু তাজা চেরি কিনে নিয়ে গেলে কেমন হয়। ঘড়িতে তখন প্রায় সাতটে বাজে। মার্কেটে পৌঁছে দেখলাম ততক্ষণে প্রায় সব দোকানই বন্ধ। আমার সেই ফলের দোকানের সামনে গিয়ে দোকানের মালিককে খুঁজে পেলামনা, যদিও দেখলাম দোকানের ঝাঁপি খোলা। শুধু দেখলাম দোকানের ফলের উপর এক প্লাস্টিকের কাপড়ের আবরণ দেয়া, আর আলোটি নেভানো। ভাবলাম হয়তো মালিক আসেপাশেই আছে। সেই দোকানের উল্টো দিকের দোকানটি তখনও খোলা। সে দোকানের মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলাম এই ফলের দোকানদার কোথায়? “সে তো আজকের মতো দোকান বন্ধ করে চলে গেছে”। বলে কি? এই দোকান বন্ধের নমুনা? পুরো তাজ্জব বনে গেলাম। এ এলাকায় কি তবে চোর ছ্যাঁচোড় নেই? বাংলাদেশ তো দূরের কথা এই খোদ আমেরিকাতেও কেও এভাবে দোকান খোলা রেখে গেলে পরের দিন এসে দোকানের সব জিনিস ভালোভাবে ফেরত পাবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আমি অবশ্য এই ঘটনার মাধ্যমে কোনও উপসংহারে আসতে চাচ্ছিনা যে বুলগেরিয়া বড় দুর্নীতিমুক্ত, সৎ লোকেদের দেশ। আসলে দুর্নীতি, জননিরাপত্তা এই বিষয়গুলো নিয়ে আমার এক বুলগেরিয়ান বন্ধু গিওরগির সাথে বিশাল এক আলোচনা হয়েছিলো। সে কথা পাঠককে না বললেই নয়।

তার আগে গিওরগির এক ছোটোখাটো পরিচয় দিয়ে নেই। গিওরগি এক সময় ছিল বুলগেরিয়ান সেনাবাহিনীর সৈনিক। বুলগেরিয়া ন্যাটোতে যোগদানের পর যখন সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা সঙ্কুচিত করা হয় তখন গিওরগি সেনাবাহিনী ছেড়ে পাড়ি জমায় মার্কিন মুল্লুকে। সবুজ ডলার কামানো, কিংবা মার্কিন দেশে থিতু হওয়া গিওরগির উদ্দেশ্য ছিলনা। বরং সে চেয়েছিল কিছু টাকা কামিয়ে পুরো উত্তর আমেরিকাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখতে। মানুষের সঙ্গ-পাগল গিওরগি কাজও বেছে নেয় লস আঞ্জেলেসের এক ট্যুর কোম্পানিতে, যাতে করে দেশ বিদেশের শত মানুষের সাথে পরিচিত হবার দুর্লভ সুযোগটি পাওয়া যায়। এভাবেই কেটে যায় প্রায় চার বছর। এই ট্যুর কোম্পানিতে কাজ করার সময়েই এক সময় গিরগির মনে হয় এমন একটি কোম্পানি সোফিয়ায় খুললে কেমন হয়। অতঃপর সেই ভাবনাকে কাজে রুপান্তরের জন্যে সাথের জমান কিছু টাকা নিয়ে সে ফিরে আসে সোফিয়ায়। তারপর এক বাল্যবন্ধুকে সাথে নিয়ে কিছু দিনের মাঝেই দাড় করিয়ে ফেলে নিজের এক ট্যুর কোম্পানি। দিব্যি চলছে এখন তার ব্যবসা। তবে তাই বলে দিনপাত করে কেবল টাকা আর ব্যবসার পেছনে ছুটে বেড়াবার মানুষ নয় সে। গিওরগির কথা হল, “সুন্দরভাবে বাঁচার জন্যে যতটুকু প্রয়োজন সেটুকু হলেই আমার সই। মাসে এই ধর ৮০০ কি ৯০০ ইউরো রোজগার হলেই আমি কাজ কম্ম ফেলে চলে যাই দূরের কোনও পাহাড়ে ক্যাম্পিং এ”। এই হল আমার বন্ধু গিওরগি। ওর জন্ম আশির দশকের শুরুতে, তাই সমাজতন্ত্র তথা ঝিভকভের আমল সম্পর্কে ওর স্মৃতি কিছুটা ঝাপসা। গিওরগির দাদু ছিলেন সোফিয়ার এক নামকরা চিকিৎসক, আর মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। গিওরগিকে তাই আমি বলি ওর মা বা দাদুর কাছ থেকে শোনা ওই আমল সম্পর্কে কিছু কথা আমাকে বলতে। ওর ধারণা ছিল সমাজতন্ত্রও সম্পর্কে এ যুগের, এ কালের মানুষের আগ্রহ শূন্যের পর্যায়ে। তাই আমার প্রশ্ন শুনে গিওরগি যেন বেশ কিছুটা আমোদ পায়। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে ও শুরু করে এভাবে, “দেখ প্রথমেই একটা কটা বলি। অনেকেই এই পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে থাকা সমজাতন্ত্রকে এক কাতারে দাড় করিয়ে দেয়। আসলে কিন্তু ব্যাপারটি মোটেই তা ছিল না। কেদারের হাঙ্গেরি, টিটোর যুগোস্লাভিয়া, চসেস্কুর রুমানিয়া, কিংবা ঝিভকভের বুলগেরিয়া এই প্রতিটি দেশেই সমাজতন্ত্র প্রায়োগিক দিক থেকে ছিল ভিন্ন। বুলগেরিয়ায় ঝিভকভের শাসনামল যেমন চসেস্কুর মতো ততটা খারাপ ছিল না, আবার টিটোর মতো ততটা ভালোও ছিলনা। তবে হ্যাঁ সামাজিক নিরাপত্তা ব্যাপারটি ছিল পুরোদমে। সেটি থাকলেও আজও যদি আমি আমার মাকে জিজ্ঞাসা করি তিনি কি ফিরে যেতে চান কিনা সে আমলে তাহলে মার উত্তর হয় সোজা ‘না’। কারণটি হল সে সময় কিছু জিনিসের বড় অভাব ছিল, যেগুলো পাবার জন্যে মানুষ অনেক সময় দারিদ্র্যকেও মাথা পেতে নেয়। সে জিনিসগুলো হল চিন্তার, কর্মের, যাতায়াতের স্বাধীনতা। আমার দাদু একবার ৭৪ সালে এক গাড়ির অর্ডার দিয়েছিলেন, সে গাড়ি তিনি কবে পেয়েছিলেন জানো? ৮৮ সালে, অর্থাৎ ১৪ বছর পর। তাহলেই বোঝো অবস্থাটা। তুমি জিজ্ঞেস করছিলে না আমার কোনও স্মৃতি আছে কিনা? আছে, আমার একটি স্মৃতি বেশ ভালো ভাবেই মনে আছে। আর সেটি হল কমলা পাবার দিনের স্মৃতি। সে সময় আমাদের বুলগেরিয়ায় কমলা উৎপাদন হতনা। আমদানি করে বছরের মাত্র দু দিন- ইস্টার আর ক্রিসমাসের দিন আমাদের কমলা দেয়া হতো সরকারি দোকান থেকে। নিয়ম ছিল পরিবারের জন প্রতি এক কেজি করে কমলা দেয়া হতো। আমাদের পরিবারে আমরা ছিলাম ছ’ জন মানুষ। ওই দুটো দিনে দোকান থেকে আমি, মা আর ভাই মিলে কাপড়ের পুটুলিতে করে ছ কেজির বিশাল এক কমলার রাজ্য নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। সারা বছর যে ফলের জন্যে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতাম সেই কমলার পচন শেষ পর্যন্ত বিরস বদনে আমাদের দেখতে হতো। এতো কমলা কি দু এক দিনে খাওয়া যায়?”।

গিরগির সাথে কথা হয় এখনকার সময়ের রাজনীতি নিয়েও। শুরুটা করি বুলগেরিয়ার রাজবংশ নিয়ে। বলশেভিকরা বুলগেরিয়ার ঢোকার পর পরই রাজা প্রাণ নিয়ে পালান বুলগেরিয়া ছেড়ে। এই রাজা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজ দেশের ইহুদীদের জার্মানদের হাতে তুলে দেননি। বুলগেরিয়ান ইহুদী এবং স্পেনের সেফারডিক ইহুদীরা একই গোত্রের। তাই শোনা যায় স্পেনের সেফারডিক ইহুদীরা রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রাজাকে স্পেনে পুনর্বাসিত হতে সাহায্য করে। সমাজতন্ত্রের প্রারম্ভে ক্ষমতাচ্যুত এমন অনেক রাজারাই আজকাল ফিরছেন নিজ দেশে। রুমানিয়ার রাজা ফিরেছেন, ফিরেছেন সার্বিয়ার রাজা। তাহলে বুলগেরিয়ার রাজা কোথায়? গিওরগির কাছ থেকে শুনলাম সেই রাজার পুত্র, অর্থাৎ রাজত্ব থাকলে হয়তো তিনিও হয়তো রাজ মুকুট মাথায় পরতেন, নাকি ফিরে এসেছিলেন বুলগেরিয়ায় বছর পনের আগে। ফিরে এসে তার খায়েশ হয় রাজনীতিতে নামার। ইউরোপের আর কোনও রাজা হয়তোবা এভাবে সরাসরি রাজনীতিতে আসেননি। আগেকার সেই রাজাকে বুলগেরিয়ার জনগণ কিন্তু বেশ ভালোবাসত। আর তাই সেই রাজার ছেলেকে তারা বিপুল ভোটে জয়ী করে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। কিন্তু অল্প দিনের মাঝেই দেখা যায় এই বৃদ্ধ রাজপুত্রের রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান খুবই সীমিত। ক্ষমতায় এসেই তার নাকি প্রাথমিক উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় সরকারের হাতে থাকা রাজ সম্পত্তিগুলোকে নিজ পরিবারের জিম্মায় পুনরায় নিয়ে আসা। তাও হয়তো ঠিক ছিল। গোল বাঁধে যখন এই রাজপুত্র রাষ্ট্রীয় খাতের লোকসানি খনি আর মিল-কারখানাগুলোকে ব্যাপকভাবে বিদেশি ক্রেতাদের হাতে নাম মাত্র মূল্যে হস্তান্তর করতে থাকেন। সন্দেহ আর ক্ষোভ দানা বাঁধে জনতার মাঝে। আর এভাবেই দ্বিতীয় বারের মতো দেশান্তরিত হয় রাজ পরিবার। এর পর আসে বাম-ডানের এক জগাখিচুড়ি কোয়ালিশন সরকার। কিন্তু তারাও নাকি আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয় দুর্নীতিতে। তাই মেয়াদের আগেই তাদেরকেও পগাড়-পার হতে হয়। এখনকার রাষ্ট্রপতির প্রতি অবশ্য গিওরগির কিছুটা সমর্থন লক্ষ করলাম। অবকাঠামো আর যোগাযোগ খাতে নাকি বর্তমান রাষ্ট্রপতি এই ক বছরেই বেশ উন্নতির স্বাক্ষর রেখেছেন। ইনিও যে দুর্নীতিবাজ নন তা নয়, তবে ইনি নাকি পকেটে টাকা রাখেন উন্নয়নকাজ কিছুটা করবার পর। আরও মজার ব্যাপার হল মধ্য ডানপন্থী দলের এই রাষ্ট্রপতি এক সময় নাকি ছিলেন ঝিভকভের দেহরক্ষী বাহিনীর সদস্য এবং চ্যালা।

৯৪ এর বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালীন সময়ে এক রাতে আমি আর বাবা রাত জেগে খেলা দেখছি। সেদিনের খেলা বুলগেরিয়া আর ইটালির মধ্যে। সে বারের বিশ্বকাপে দারুণ খেলছিল বুলগেরিয়া, এমনকি শক্তিশালী দল জার্মানিকে হারিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলো সেমি-ফাইনাল অব্ধি। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম আজ কোন দলকে সমর্থন করবে তুমি? বাবা একটু ভেবে বলল, “স্বাধীনতার পর পর এই বুলগেরিয়া দেশটি আমাদের বেশ কিছু পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাকে সে দেশে নিয়ে গিয়েছিলো চিকিৎসার জন্য। সে কথা আমি ভুলে যাইনি। সে জন্যই আমার আজকের সমর্থন থাকবে বুলগেরিয়ার প্রতি”। সেদিনের খেলায় কিন্তু বুলগেরিয়া জয়ী হতে পারেনি, তবে অনবদ্য খেলার স্বাক্ষর রেখেছিলেন বুলগেরিয়ান কিছু খেলোয়াড়। আজ এতো দিন বাদে তাদের সবার নাম মনে না থাকলেও টেকো মাথার একজনের নাম বেশ খেয়াল আছে, তার নাম লেচকভ। গিওরগির কাছে তাই আমার কৌতূহল কি হল বুলগেরিয়ান ফুটবল দলের? কেন তারা হারিয়ে গেল বিশ্ব ফুটবলের রঙ্গমঞ্চ থেকে? আর সেই লেচকভই বা কোথায় এখন? যেটুকু বুঝলাম এখানেও সেই একই সমস্যা- দুর্নীতি। সেই ৯৪ এর বিশ্বকাপের পর তখনকার তারকা খেলোয়াড়দের বানানো হয় বিভিন্ন ফুটবল সম্পর্কিত দল বা কমিটির কর্তাব্যক্তি। কিন্তু তারা তখন মন দেন কেবল নিজেদের পকেট ভারী করতে। জার ফলে পরের প্রজন্মগুলোয় বুলগেরিয়ান ফুটবল আর তেমন উন্নতি করতে পারেনি। আর সেই লেচকভ? সেও নাকি তার খ্যাতি কাজে লাগিয়ে এক সময় মেয়র বনে যায় তার নিজ শহর স্লিভেনের। কিন্তু অচিরেই সেও নাম লেখায় দুর্নীতির খাতায়, ফলাফল স্বরূপ তাকেও কয়েক বছরের মাথায় সরে দাঁড়াতে হয় মেয়রের পদ থেকে।

সেদিন হোটেলে ফিরে এসে লবিতে এক গাইড বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে জানতে পারলাম এক নতুন তথ্য। বছর চারেক আগে নাকি এই সোফিয়াতেই সমজাতন্ত্রের পতনের পর সরিয়ে ফেলা বিভিন্ন ভাস্কর্য আর চিত্রকর্ম নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এক জাদুঘর। বুদাপেস্টে গিয়েও জেনেছিলাম সেখানও বুদা অংশে এক পার্ক মতো বানানো হয়েছিলো শুধুমাত্র সেই কম্যুনিস্ট সময়ের বিভিন্ন ভাস্কর্য দিয়ে। সময়ের অভাবে অবশ্য বুদাপেস্টের জাদুঘর পার্কে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই এবার ভাবলাম সোফিয়ার এই জাদুঘরটি না দেখলেই নয়। ও আচ্ছা এই জাদুঘরের প্রসঙ্গ যখন এলোই তখন আরেকটি কথা জানিয়ে রাখি। বুলগেরিয়া সরকারের এই কম্যুনিস্ট সময়ের স্মৃতিকে জাদুঘরের মাঝে স্থান দেয়া দেখে আমি কিন্তু ভীষণ মাত্রায় অবাক না হয়ে পারিনি। কারণ এই সোফিয়ায়াতেই এক সময় ছিল বুলগেরিয়ার লেনিন গিওরগি দিমিত্রভের এক মমি-সমাধি ভবন, অনেকটা যেমন ক্রেমলিনে আছে লেনিনের মমি-সমাধি তেমন। দিমিত্রভের প্রয়াণ ঘটে ১৯৪৯ সালে মস্কোতে। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন স্বাস্থ্য সারাতে। এ নিয়ে অবশ্য মেলা সন্দেহ কথা প্রচলিত আছে। কেও কেও বলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দিমিত্রভ টিটোর প্রস্তাবিত বলকান ফেডারেশনে যোগ দিতে চেয়েছিলেন, আর তাতেই তিনি পরে যান স্তালিনের নিকেশ-খাতায়। কে জানে হয়তো মস্কোতে স্বাস্থ্য সারাতে গিয়ে দিমিত্রভ প্রাণটাই খোয়ান স্তালিনের পাঠানো আততায়ীদের হাতে। কিন্তু সে যাই হোক, এর পর দিমিত্রভের দেহ বুলগেরিয়াতে আনার আগে মাত্র ক দিনের মাঝেই তৈরি করা হয় এক শ্বেত পাথরের সমাধি ভবন যেখানে দিমিত্রভের মমিকৃত দেহটি শায়িত ছিল পরবর্তী প্রায় চল্লিশ বছর। ৮৯ সালে সমাজতন্ত্রের পতনের পর দিমিত্রভের সেই মমিকৃত দেহটিকে অন্যত্র সমাধিস্থ করা হলেও এই ভবনটি কিন্তু অক্ষত ছিল। কিন্তু কোনও এক কারণে তখনকার সময়ের সরকার চাচ্ছিল সমাজতান্ত্রিক সময়ের এই সুবিশাল চিহ্নটিকে রাজধানীর বুক থেকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতে। একবার দুবার নয়, মোট তিনবারের চেষ্টায় ৯৯ সালে এই সমাধি ভবনটিকে ডিনামাইট দিয়ে ধ্বসিয়ে দেয়া হয়। এই ভবনটিকে হয়তো করা যেত কোনও জাদুঘর বা অন্য কোনও স্থাপনা, কিন্তু ঠিক কি কারণে সমাজতন্ত্রের পতনের প্রায় দশ বছর পর বহু চেষ্টা চরিত্র করে এই ভবনটিকে গুঁড়িয়ে দেয়া হল তা আমকে কৌতূহলী করে তোলে। ওই দশকের বুলগেরিয়ার অর্থনীতি সম্পর্কে জানতে গিয়ে আমি পাই এক তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। আর তা হল ৯৫-৯৬ সালের দিকে বুলগেরিয়া পতিত হয় এক নিদারুণ অর্থনৈতিক মন্দার কবলে। সাধারণ জনতার বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে সোফিয়া। হতাশ বিক্ষোভরত সেই জনতার মনোভাব যেন কিছুতেই আর সেই অতীতমুখী না হয় সেজন্যেই কি তড়িঘড়ি করে ভেঙে ফেলা হয়েছিলো বিশাল সেই শ্বেত পাথরের সমাধি ভবন? ভবনটি পুরোপুরি ধুলোয় মিশিয়ে দেবার হয়তো বিবিধ কারণ থাকতে পারে, তবে আমার কাছে কিন্তু মনে হয় অনেক কারণের এটিও একটি। জাদুঘরের কথা বলবার সময়ে এই সমাধি ভবনের কথা তুললাম কারণ যে শহরে প্রায় দেড় দশক আগে এমন একটি ভবন নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছিলো অতীতের সময়কে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করে, সে শহরেই আবার কিনা পর্যটকদের উদ্দেশ্যে বানানো হল এমন একটি সমজাতান্ত্রিক সময়ের স্মৃতি নিয়ে জাদুঘর, এ কি কিছুটা আশ্চর্যময় নয়?

পরদিন বিকেলে এই জাদুঘরের কাছের পাতাল রেল ষ্টেশনে যখন পৌঁছাই তখন ঘড়িতে পাঁচটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি। ষ্টেশনে যখন অন্তত চার-পাঁচ জনকে জিজ্ঞাসা করেও জাদুঘরের সঠিক দিশা পেলাম না তখন ভাবছিলাম ঠিক ষ্টেশনে এলাম তো? জানামতে এই ষ্টেশন থেকে জাদুঘরের দূরত্ব হবার কথা আধ মাইলের মতো। তাহলে কেওই এর হদিস জানেনা কেন? ফিরে যাবার জন্য আমার টিকেটটি মেশিনে ঢোকাচ্ছি, কিন্তু কি এক কারণে বার বারই সেটি এই টিকেট ফিরিয়ে দিচ্ছে। পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে যাওয়া এক তরুণী হটাৎ থেমে এগিয়ে এলো আমার দিকে, তারপর আমাকে দেখিয়ে দিল আমার ভুল। ত্রস্ত পায়ে ফিরে যাবার আগে তাকে ধরলাম, উপকার যখন করলেই আরও একটি উপকার করনা। প্রায় মিনিট দশেক ধরে নানা জনকে জিজ্ঞাসা করেও কোনও ফল পেলাম না, তা তুমি কি ওই কম্যুনিস্ট জাদুঘরটা কোন দিকে বলতে পারো? “ ও জাদুঘরটা আসলে মাত্র ক বছর আগে চালু হয়েছে, তাই হয়তো এখনও অনেকেই সেটির কথা জানেনা। কিন্তু আমি চিনি ওটা কোথায়। তুমি ওই ডান ধারের রাস্তা ধরে সোজা চলে যাও, ওই যে দেখছ দুটো বিশাল ভবন পাশাপাশি সেখানে পৌঁছে আবার ডান দিকে মোড় নেবে। তাহলেই পাবে ওই জাদুঘর”। তাকে অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে যখন জাদুঘরের ফটকের সামনে পৌঁছুলাম ততোক্ষণে সেখানে বিশাল এক তালা ঝুলছে। ফটক বন্ধ হলেও পাশের গার্ড রুমের জানালা খুলে দু জন গার্ড বেশ চুটিয়ে গপ্প করছে। আমার আসলে এই জাদুঘরে আসার মূল আকর্ষণ ছিল এর চত্বরে রাখা ভাস্কর্যগুলো দেখা। তাই গার্ডদ্বয়কে ইশারায় বললাম একটু কি খুলে দেয়া যায় প্রধান ফটক? আমি তো আর মূল ভবনে ঢুকবনা, শুধু এই চত্বরে কিছু ছবি তুলবো। তা দু জনের একজন আমাকে সাথেসাথে ফিরিয়ে দেয় আর কি, অন্য জন কি মনে করে বলল আচ্ছা যাও ঢুকতে পারো তবে ওই যে দেখ ওদিকের বোর্ডে লেখা আছে ছবি তুলতে গেলে কিন্তু তিন লেভা দিতে হয় এখানে। বুঝতে পারলাম আসলে সেই তিন লেভা যাবে তার পকেটে।

জাদুঘরের সেই আগাছায় ভরা চত্বরটিতে এখানে সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে রাখা প্রায় সত্তরটি ভাস্কর্য। সমবায় ফার্মের মেহনতি নারী, নবান্নের আনন্দে উদ্বেলিত কৃষাণী, কাঁধে কোদাল নিয়ে কাজের পানে হেঁটে চলা দু’ বান্ধবী, এক হাতে কুড়ুল আর এক হাতে রাইফেল নিয়ে পার্টিজানদের একটি দল, যুদ্ধে যাবার আগের শেষ মুহূর্তটিতে কোলের শিশুটিকে চুম্বনরত সৈনিক – এমনই আরও বহু চিত্রের ছোট বড় ভাস্কর্য স্থান পেয়েছে এই চত্বরটিতে। এ ছাড়াও আছে দিমিত্রভ আর লেনিনের কিছু প্রমাণ আকারের ভাস্কর্য, এর অনেকগুলো যদিও নাকি পুরোপুরি অক্ষত ছিলনা যখন এদের সংগ্রহ করা হয়। আমার অবশ্য মূল আগ্রহ ছিল সেই সেরদিকা স্কয়ারের সন্ত সোফিয়ার বর্তমান ভাস্কর্যের স্থলে লেনিনের যেই ভাস্কর্যটি ছিল সেটি এবং পার্টি অফিসের মাথায় যে লালচে খয়েরি তারাটি ছিল সেটি খুঁজে বের করা। এই তারাটি নাকি বহুকাল অযত্নে অবহেলায় লোকচক্ষুর অন্তরালে পরে ছিল বানিয়াবাশি মসজিদ লাগোয়া সেই হাম্মামখানার চত্বরে, এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হলে সেখান থেকে এটি বের করে এনে সংস্কার করে স্থান দেয়া হয় এই জাদুঘর প্রাঙ্গণে। এই জাদুঘরের ভেতরের গ্যালারিতে নাকি প্রদর্শিত হয় সমাজতান্ত্রিক সময়ের সাথে সম্পর্কিত বেশ কিছু বিখ্যাত তৈলচিত্র। কিন্তু সেগুলো দেখার সৌভাগ্য এবার আর হলনা।

জাদুঘর থেকে বেরুবার সময় সেই দারোয়ানের হাতে যখন সেই তিন লেভা তুলে দিলাম, তা পেয়ে বেচারার সে কি বিগলিত হাসি। পাশের সেই অন্য দারোয়ানটির দিকে তাকিয়ে এমন এক দৃষ্টি দিল যেন বোঝাল, “দেখলি কেমন মুফতে তিন লেভা পকেটে পুরলাম, তুইতো একে প্রায় বিদেয় করেই দিচ্ছিলি”। কথা সেটি নয়, কথা হল আমি থ মেরে ভাবছিলাম তিন লেভা অর্থাৎ মাত্র দেড় ডলার পেয়েই বেচারা এতো খুশি? আসলে সোফিয়া তথা বুলগেরিয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় এখনও ইউরোপের অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশ সাশ্রয়ী। কিছু উদাহরণ দিই। সোফিয়ার কাছের এক রিসোর্টে ট্রাউট মাছ সহযোগে ব্যাপক এক ভুঁড়িভোজনের পর বিল দিলাম বারো লেভার অর্থাৎ ছ’ ডলারের। সোফিয়া এয়ারপোর্ট থেকে আমার হোটেলটি ছিল বারো কি তের মাইলের পথ, এয়ারপোর্ট পাতাল রেল ষ্টেশন থেকে টিকেট কিনলাম মাত্র এক লেভা দিয়ে। অর্থাৎ এই বার-তের মাইল পাতাল রেলে যেতে খরচ হল মাত্র আধ-ডলারের মতো। সেদিন টাইম ম্যাগাজিনের এক নিবন্ধে পড়ছিলাম সোফিয়ায় এখনও গড়-পড়তা একটি তিন বেড রুমের ফ্ল্যাটের ভাড়া নাকি সাড়ে তিনশ ডলারের কাছাকাছি, অর্থাৎ টাকার হিসেবে প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা। এ টাকায় এখন ঢাকার কোনও মধ্য অভিজাত পাড়াতেও এমন একটি ফ্ল্যাট ভাড়া পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। আমি যখন সোফিয়ায়, ঠিক সে সময়ে গ্রীসে অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে এক উত্তাল সময় চলছে। গ্রীস কি আদৌ ইউরো জোনে থাকতে পারবে কি পারবে না সেই নিয়ে জল্পনা কল্পনা সবার মাঝে। বুলগেরিয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকলেও এখনও ইউরো জোনে প্রবেশ করেনি। কিন্তু তারা কি প্রবেশ করতে চায়? কি ভাবছে এ নিয়ে তাদের জনগণ? মজার ব্যাপার হল যত জনকেই এই প্রশ্নটি করলাম, উত্তর পেলাম মোটামুটি একই। সবার কথা হল, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা ন্যাটো ঠিক আছে, কিন্তু ইউরো জোনের ব্যাপারে তাদের ঘোর আপত্তি। গ্রীসের সংকট তাদের যেন আরও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এ ব্যবস্থার চোরা ফাঁদ। তাদের শঙ্কা হল ইউরো জোনে ঢুকলে জীবনযাত্রার ব্যয় যে বৃদ্ধি পাবে সে নিয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু সে অনুপাতে যদি আয় রোজগার না বাড়ে তবে তবে জনমানুষের অবস্থা বর্তমানের চেয়েও খারাপ হতে বাধ্য। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কাটি কিন্তু মিথ্যে নয়। গত বছর যখন লাটভিয়া গেলাম, তার ঠিক এক মাস আগেই লাটভিয়া ইউরো গ্রহণ করেছিল তাদের মুদ্রা হিসেবে। জানতে পেরেছিলাম এর মধ্য দিয়ে নাকি জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়েছিলো ক্ষেত্র বিশেষে দশ শতাংশ অবধি। তখনই আমার মনে হয়েছিলো স্থানীয় অর্থনীতির গতিশীলতার চাকা যদি তেমন মজবুত না হয় তবে ইউরোর সফলতা মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য, সে জন্যেই হয়তোবা বুলগেরিয়ানদেরও ইউরো নিয়ে এই বর্তমান দ্বিধা এবং শঙ্কা।

পরের ক’দিনে গিয়েছিলাম বুলগেরিয়ার প্রাচীন কিছু শহর, গ্রাম, মনাস্টেরি আর চার্চ দেখতে। সে গল্প না হয় বলবো অন্য আরেক দিন।


মন্তব্য

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

পুরোটা পড়লাম। খুব ভালো লাগলো। ইতিহাসের উপস্থাপনে ভ্রমণকাহিনী আরো অর্থবহ হয়ে উঠেছে। তবে কিছু কিছু বানান আর বাক্যের শুরুতে ‌'তো' শব্দের বহুল ব্যবহার দারুণ এই লেখাটার কিছুটা শ্রীহানি ঘটিয়েছে। আপনার কাছ থেকে ভ্রমণ বিষয়ক আরো লেখা আশা করছি।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ আখতারুজ্জামান ভাই সময় নিয়ে পড়বার এবং মন্তব্যের জন্যে , পরবর্তী লেখায় আপনার পরামর্শটি মাথায় রাখবো।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভালো লাগলো লেখা আর ছবি। মুফতে ঘুরে আসলাম চোখ টিপি

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ

অতিথি লেখক এর ছবি

বরাবরের মতোই চমৎকার। ভ্রমনের সাথে ইতিহাসের পাঠ খুব সাবলীল ভাবে মিশিয়েছেন । কিছু টাইপো আছে, তাতে অবশ্য স্বাদ নিতে কষ্ট হয় নি । পরের পর্বের জন্য অপেক্ষাই রইলাম।

অঃ টঃ সন্ত সোফিয়া-র ছবিটা দেখে সন্তর চাইতে ক্লিওপেট্রা বেশে সোফিয়া লরেন মনে হচ্ছে; নাকি আমারই দুষ্ট মন।

- কাজী

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

কি আশ্চর্য আমারও কিন্তু এই একই ব্যাপার মনে হয়েছিলো, ধন্যবাদ

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

হে হে হে

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

[ এমন সেজমামা পেলে সারাদিন ঘাড় গুঁজে রচনাই লিখতাম চাল্লু ]

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

স্যাম এর ছবি

চলুক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
তানিম এহসান এর ছবি

ভাল লাগলো। আরও লিখুন হাসি

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার প্রতিটি লেখাই বড় এবং ইতিহাস, বর্তমান আর ভ্রমণের খুব সুন্দর সহাবস্থান থাকে তাই পড়েও অনেক মজা পাওয়া যায়।

ছোট্ট একটা ভুল আছে মনে হয়

আমার দাদু একবার ৭৮ সালে এক গাড়ির অর্ডার দিয়েছিলেন, সে গাড়ি তিনি কবে পেয়েছিলেন জানো? ৮৮ সালে, অর্থাৎ ১৪ বছর পর।

এটা মনে হয় ১০ বছর হবে, তাই না?

ফারাসাত

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

আরে ঠিক ধরেছেন তো, ওটা আসলে ১০ বছর না হয়ে শুরুর সালটা ৭৪ হবে, ঠিক করে দিচ্ছি। ধন্যবাদ আপনাকে

নজমুল আলবাব এর ছবি

একটানে পড়া হয়ে গেলো। ভালো লেগেছে। হাসি

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ নজমুল ভাই

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার ছবি সেই সাথে বর্ণনা। খুব ভাল লাগলো।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার এই সুন্দর মন্তব্যের জন্যে

তারেক অণু এর ছবি

'বার্চ বনে ঝড়' কিশোরবেলার প্রিয় বই। বুলগেরিয়া যেয়ে বইটি অনেক মিস করেছি।

লেখায় ইতিহাস ধরার প্রচেষ্টা ভাল লাগল-

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

হ্যা আমারও অসম্ভব প্রিয় বই ছিল সেটি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।