কার্পেথিয়ান আর ভিভিয়ানা

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: রবি, ০৭/০২/২০১৬ - ১১:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


“কার্পেথিয়ানে স্বাগত জানাচ্ছি আপনাকে। বুঝতেই পারছেন আপনার সাথে সাক্ষাতের জন্যে অধির হয়ে অপেক্ষা করছি আমি। আজ রাতটা কোনোভাবে হোটেলেই কাটিয়ে দিন। আগামীকাল তিনটের দিকে আবার যাত্রা শুরু হবে আপনার। একটা ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়িতে আপনার জন্যে আসন সংরক্ষিত করা আছে। আগামীকাল তিনটেয় বুকাভিনার উদ্দেশ্যয়ে রউনা দেবে গাড়িটা। নির্দ্বিধায় উঠে বসবেন তাতে। বুর্গ গিরিপথের কোনো এক স্থানে ওই ঘোড়ার গাড়ি থেকে আপনাকে তুলে নেবে আমার নিজস্ব টমটম গাড়ি, পৌঁছে যাবেন আমার প্রাসাদ দুর্গে”। ‘ড্রাকুলা’ বইটিতে কাউন্ট ড্রাকুলা এভাবেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো তার আইনজীবী জনাথন হার্কারকে। না, তেমন করে তেমন কোনো আমন্ত্রণ আমাকে কেও দেন নি বটে, তবে এই রুমানিয়া দেশটিতে আমার আগমন মূলত ওই কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদটি দেখবার জন্যেই।

“বড়কর্তা শিগগিরি এখানে আসুন, বাংলাদেশের একটা পাসপোর্ট পেয়েছি”। আমার পাসপোর্টটি হাতে পেয়ে অভিবাসন কাউন্টারের ওপাশে বসা সুদর্শনা কিন্তু আচরণে রুক্ষ যুবতীটির প্রতিক্রিয়া। কিছু দূরের এক কক্ষ থেকে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন রোগা পটকা সেই বড়কর্তা। কিছুক্ষণ আমাকে দেখে পাসপোর্টটি বেশ ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে বললেন, “তুমি তো দেখছি ভিসা নিয়েছে লস আঞ্জেলেস থেকে। তা আমেরিকায় থাকবার ভিসা-টিসা কিছু আছে”? তাজ্জব ব্যাপার, এলাম আমি রুমানিয়ায়, তাও সে মাত্র ক’ দিনের জন্যে। কিন্তু এ ভদ্রলোক আমার আমেরিকার ভিসা আছে কিনা তা জানতে চায় কেন? বিরক্তি চেপে রেখে তাকে আমার মার্কিন মুল্লুকে স্থায়ীভাবে থাকার কার্ড বের করে দেখালাম। এতে যেন কিছুটা স্বস্তি পেল সেই বড়কর্তা, চোখের ইশারায় সেই যুবতীটিকে বলল ছেড়ে দাও একে। বুঝতে অসুবিধে হল না আমার দেশের পাসপোর্টের সাথে এরা মোটামুটি অসুখকর ভাবে পূর্ব-পরিচিত।

বিমানবন্দর থেকে কিছু দ্রুতগামী বাস বুখারেস্ট শহরের ভিড় ভাট্টা এড়িয়ে সোজা নিয়ে যায় ‘গারা দা নরদ’ স্টেশনে, বুখারেস্টের কেন্দ্রীয় প্রধান রেল স্টেশন সেটি। এখান থেকে আমাকে আজই ব্রাসভে যাবার ট্রেন ধরতে হবে। বুখারেস্টে শহরে পরবর্তীতে যাত্রা বিরতি করবো ব্রাসভ থেকে ফিরতি পথে। গথিক কায়দায় নির্মিত বিশাল মহীরুহের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বহির্ভাগের কয়েকটি থামের সম্মুখে ৮২০ নম্বর বাসটি আমাদের নামিয়ে দেবার পর আশপাশে নজর করে বুঝলাম স্টেশনটি আকারে মোটামুটি বিশাল হলেও তেমন আধুনিক নয়। ক্ষয়ে যাওয়া সাদা টাইলসের মাঝে ছড়িয়ে থাকা খাদ্য-কণিকা ঠুকরে ফিরছে কিছু কবুতর আর তার সাথে এখানে ওখানে কিছু ফড়িয়া দালাল ধরণের লোক ঘুরঘুর করছে স্টেশনের মূল ফটকটির কাছে। একজন তো বেশ যেচে এসে জিজ্ঞেস করলো কোন সাহায্য লাগবে কিনা। বুঝলাম কথা বাড়ালে বিপদ আছে। তাই তাকে শুষ্ক ধন্যবাদ জানিয়ে স্টেশনের অভ্যন্তরে পা চালালাম। চেহারা-সুরতে তেমন ঝকঝকে না হলেও স্টেশনটি কিন্তু ইউরোপের প্রাচীন জংশনগুলোর মধ্যে অন্যতম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র-বাহিনীর গোলার আঘাতে পুরোপুরি ধুলোয় মিশে গিয়েছিল এই স্টেশনটি। সেসময়ে রুমানিয়ার তেল খনিগুলো থেকে তেল আহরণের পর নাৎসি বাহিনীকে সরবরাহের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুটি ছিল এই স্টেশন। যার ফলে খুব সহজেই এটি মিত্র-বাহিনীর বোমার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। সেসব অবশ্য বহুকাল আগের কথা। ফিরে আসি বরং বর্তমানে। স্টেশনে ঢুকে আমার কাঙ্ক্ষিত ট্রেনে ওঠা অব্দি এমন কিছু অভিজ্ঞতা হল যা থেকে মনে হল এই রুমানিয়া দেশটির সাথে আর সব পূর্ব ইউরোপের দেশের কোথাও একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছেই আছে। খুলে বলি সে গল্প। আমি যে মূল ফটক দিয়ে স্টেশনে ঢুকেছিলাম টিকেট কাটবার বুথটি কিন্তু ঠিক সেখানে নয়, বরং অন্য এক কোণে। বুথ খুঁজে পাবার পর তার সামনে গিয়ে দেখি সেখানে লাইন নামক ব্যাপারটির অস্তিত্বই নেই। যে যেভাবে পারছে চেপে চুপে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। এই জনসমুদ্র ঠেলে অবশ্য আমিও একসময় জয়ী হলাম টিকেট বিক্রেতার বিরস বদনের সাক্ষাত পাবার। তবে এই টিকেট বিক্রেতার সাথে চোখাচোখি হবার আগেই কাঁচের জানালার সামনে টানানো আরেকটি বিজ্ঞপ্তির দিকে খেয়াল করে মোটামুটি ঘাম ছুটে গেল। ছোট কিন্তু পরিষ্কার করে সেখানে লেখা আছে, ‘পকেট সাবধান’। পেছনের পকেটে হাত দিয়ে দেখি সে জায়গাখানা বড্ড খালি খালি লাগছে, সর্বনাশ আমার ট্যাঁক ঠিক আছে তো?

আমার এক আমেরিকান প্রফেসর একবার গল্পচ্ছলে বলছিলেন তার বিদেশ ভ্রমণে নেয়া বিভিন্ন সতর্কতার কথা। ভদ্রলোক প্রতি বছরই কয়েক মাস করে খণ্ডকালিন শিক্ষক হিসেবে পড়াতে জান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, আর ফেরার পথে ঘুরে আসেন আশেপাশের আর কিছু দেশ। অকৃতদার মানুষ, তাই তেমন কোনো পিছুটানও নেই। গল্পবাজ এই অধ্যাপক আমাদের পড়াতে গিয়ে কখনও টেনে নিয়ে আসেন গুয়েতেমালার কোনো এক ফুল চাষের বাগানে চাষির সাথে তার কথোপকথনের কথা, আবার কখনো তাইওয়ানের সামুদ্রিক মাছের বাজারের অপূর্ব স্বাদের ভাজা মাছের কথা। একবার তিনি বলছিলেন কিভাবে বিভিন্ন ভ্রমণে অসংখ্যবার মানিব্যাগ খুইয়েছেন এবং এ থেকে পরিত্রাণের কী পথ তিনি বাতলেছেন শেষ অব্দি। সোজাসুজি উত্তরটি না দিয়ে তিনি প্রথমে আমাদেরকেই অনুমান করতে বললেন তার বাতলানো পথটি সম্পর্কে। কেও বলল তিনি আসলে সামনের পকেটে মানিব্যাগ রাখা শুরু করেছেন, আবার কেও বলল তিনি মানিব্যাগ ব্যাপারটিকেই ছেটে ফেলে টাকা-পয়সা হয়তো রাখেন বিভিন্ন পকেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। হাসতে হাসতে সেই ক্লাসের ভেতরেই তিনি দেখালেন তারা পন্থাটি। তিনি মানিব্যাগ কে সঙ্গীহারা করেন নি, কিংবা পেছন থেকে সামনের পকেটেও স্থানান্তর করেন নি। যেটা করেছেন সেটা খুব সম্ভবত টিনটিনের বন্ধু জন্সন এবং রন্সন ভ্রাতৃদ্বয় উদ্ভাবিত ফর্মুলা। বলতে চাইলাম ফর্মুলাখানি বহুকাল আগেই সেই কিশোর বয়সে টিনটিনের কমিক বইতে পড়েছিলাম। সে ফর্মুলা অনুযায়ী আমার প্রফেসর মানিব্যাগের সাথে একটি রাবারের সুতো বেঁধে সেটাকে আঁটকে রেখেছেন নিজের কোমরবন্ধের সাথে। উটকো চোর হাতের কারসাজিতে মানিব্যাগ বাগাতে পারলেও সুতোর টানে তাকে ঠিক ফিরে আসতে হবে মূল মালিকের কাছে। ব্যাপার দেখে আমরা তো একেবারে হা। চুরির হাত থেকে বাঁচার যুতসই কারসাজিই বটে। যাকগে, বলছিলাম আমার ট্যাঁকের কথা, যেটির কথা চিন্তা করে রীতিমতো আঁতকে উঠেছিলাম। এ যাত্রায় তো আমি সেই অধ্যাপকের বাতলানো পন্থামতে তেমন কিছুই করিনি। তবে কী মানিব্যাগ গেল হাওয়া হয়ে? সম্বিত ফিরে পাবার পর বুকের কাছে হাত নিয়ে অনুভব করার পর আশ্বস্ত হলাম। না বাছাধন খোয়া যায়নি। হাতের কারসাজি জানা শিল্পীদের ভয়ে ওটিকে আগেই জ্যাকেটের বুক পকেটে চালান করে দিয়েছিলাম। ততোক্ষণে সেই টিকেট বিক্রয়কারী আমাকে প্রশ্ন করছে, তা ভিনদেশীর কোথায় যাওয়া হবে? এখানে মনে হয় ইংরেজির তেমন চল নেই। অনেক কষ্টে-সৃষ্টে কায়দা কসরত করে তাকে বোঝালাম যে আমি যেতে চাই ব্রাসভে আর সম্ভব হলে ঠিক পরের ট্রেনেই। টিকেট বুঝে নেবার সময় তাকে জিজ্ঞেস করলাম, জনাব কোন প্ল্যাটফর্মে গিয়ে আমাকে দাঁড়াতে হবে? আমার প্রশ্নে তিনি কী বুঝলেন জানি না, তবে আমাকে নির্দেশ করলেন পেছনে হেঁটে বাঁয়ের পথ ধরতে। ভদ্রলোকের নির্দেশিত পথে সেখানে গিয়ে এক মলিন ধূলিধূসরিত সময়সূচী বোর্ডের মধ্যে খুঁজে পাবার চেষ্টা করলাম ব্রাসভের ট্রেন এবং তৎসংলগ্ন প্ল্যাটফর্ম নাম্বার। ব্রাসভ নামটির পাশে একটি প্ল্যাটফর্ম নাম্বার ঠিকই খুঁজে পেলাম, কিন্তু সে অনুযায়ী প্ল্যাটফর্মে গিয়ে এক গোল বাঁধল। ট্রেনে উঠবার সময় কোচের দরজার ঠিক নিচের প্ল্যাটফর্মে ঘামে ভেজা টুপি আর রঙচটা নীলচে কোট পরিহিত গার্ডকে যখন আমার টিকেটখানা দেখালাম তখন তিনি টিকেটটি উল্টে-পাল্টে বললেন এ ট্রেন ব্রাসভে যাবার সে ঠিকই আছে, তবে তোমার টিকেটি এ ট্রেনের জন্যে নয়। রীতিমত চোখে সর্ষে ফুল দেখার উপক্রম হল। ব্রাসভের ট্রেনই যদি হয় তবে এটি কিভাবে আমার জন্যে ভুল ট্রেন হয়? তবে কী আমাকে অন্য কোনো শহরে যাবার টিকেট ধরিয়ে দিল? ফিরে এলাম আবার সেই বোর্ডের কাছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আবারও প্রতিটি লাইন পড়ার চেষ্টা করলাম। এবার খেয়াল করলাম সেই বোর্ডের একেবারে নিচের দিকে ব্রাসভে যাবার আরেকটি ট্রেনের অন্য একটি প্ল্যাটফর্মের নাম্বার লিখা। তবে কী সেটিই আমার কাঙ্ক্ষিত ট্রেন? কিছুটা সাত-পাঁচ চিন্তা করে যখন সেই দ্বিতীয় ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে পৌছুলাম ততোক্ষণে ট্রেনের চাকা ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করে চলতে শুরু করেছে। ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে তার পেছনে সে মুহূর্তে ছোঁটা অর্থহীন। ব্যর্থ মনোরথে ভাবছি এবার কী করা যায়? তথ্য-কেন্দ্রে গিয়ে কোনো পরামর্শ বা সহায়তা পাওয়া যাবে কী?

স্টেশনের প্রায় মাঝামাঝি স্থানে খুপরি ঘরের মতো সেই তথ্য-কেন্দ্রের বিশাল ভুঁড়ি-সর্বস্ব লোকটি কারও সাথে সে মুহূর্তে দীর্ঘ এক আলোচনা জুড়ে দিয়েছেন নিজের মুঠোফোনে। এই লোকটি ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়লো না সেই তথ্য কেন্দ্রে। কাঁচের এক ছোট ফোঁকর গলিয়ে মাঝে মাঝেই তার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। আমার দিকে ভ্রুক্ষেপ করবার ইচ্ছে বা সময় কোনটিই তার তখন নেই। ইউরোপের সীমানায় থাকা একটি দেশে এমনতর বাংলাদেশি-সুলভ আচরণে বিরক্তির সাথে সাথে কিছুটা মজাও পাচ্ছিলাম। একবার ভাবছিলাম দেশি কায়দায় হাঁক দেই, “আরে দাদা ফোন নামান, বাকি কথাটুকু না হয় বাড়ি গিয়ে বলবেন”। কিন্তু সে কি আর বলা যায়? নিপাট ভদ্রলোকের মতো মুখ বুজে প্রায় মিনিট পাঁচেক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবার পর তিনি বোধ হয় কিছুটা সদয় হলেন, অথবা হয়তো ওপারের ব্যাক্তিটিই কথা সাঙ্গ করলো। ফোনটি নামিয়ে রেখে বেশ কিছুটা বিরক্তি নিয়ে জানতে চাইলেন তিনি কী করতে পারেন। যথারীতি ইনিও ইংরেজি তেমন কিছুই বোঝেন না, অল্প কয়েকটি শব্দে কাজ চালান। অন্যদিকে আমিও যে রুমানিয়ান বুঝব তেমনতর বহুভাষাবিদ এখনো হয়ে উঠিনি। ওই আকার ইঙ্গিতে তাকে বোঝালাম আরকি, যে ট্রেন ফেল করেছি। এখন উপায় কী? আমাকে কী নতুন করে টিকেট কাটতে হবে নাকি এই টিকেটেই পরের ট্রেনে যেতে পারবো? অবশেষে মহাশয় আমার সমস্যাটি বুঝতে পারলেন। বিশাল ভুঁড়িটি নাড়িয়ে খড়ের ঝাড়ুর অগ্রভাগের মতো পাকা গোঁফের গুচ্ছে তা দিয়ে বললেন, “ গিব ৭ লেই মোর, গেত আনাদার তিকেত”। অর্থাৎ আমাকে আবারও সেই ভিড় ঠেলে আগের সেই কাউন্টারে গিয়ে নতুন টিকেট নিতে হবে কিছু জরিমানা পরিশোধ-পূর্বক। গলদঘর্ম হয়ে সেই নতুন টিকেট নেবার সময় জানতে পেলাম পরের ট্রেনটি ছাড়বে আবার সেই দেড় ঘণ্টা পর। এ ফাঁকে বরং কিছু-মিছু খেয়ে নিলে ভাল হয় না? ওদিকে এই টিকেট-বুথ আর প্ল্যাটফর্মে দৌড়াবার মাঝে জল-তেষ্টাটিও পেয়েছিলো বেশ জাঁকিয়ে। খাবারের দোকানে যাবার আগে তাই প্ল্যাটফর্মের এক বই-ম্যাগাজিনের টং ঘর থেকে কিনে নিলাম দু বোতল জল।

স্টেশনের ভেতরেই একটি বার্গার জাতীয় চটজলদি খাবারের দোকানে ঢুকতে গিয়ে একটু আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম দোকানে ঢুকবার মুখেই দুয়ার আগলে দাঁড়িয়ে আছে এক দ্বাররক্ষী। বাংলাদেশে এমন চিত্র হর-হামেশাই চোখে পড়লেও ইউরোপে এমন চিত্র বিরল। শুধু দ্বার-রক্ষাই নয়, পরে খেয়াল করলাম তার দ্বিতীয় কাজটি হল খাবারের উচ্ছিষ্ট বহনকারী থালাগুলো সরিয়ে ফেলা। এ কাজটি হয়তো তাকে করতে হতোনা, কিন্তু বাধ্য হয়ে হাত লাগাতে হয় কারণ অনেকেই দেখলাম খাবার পর নিজের এঁটো প্লেট নির্দিষ্ট স্থানে না রেখে টেবিলেই ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকার চটজলদি খাবারের দোকানগুলোতে খাবার পর নিজের খাবারের পাত্রটি যথাস্থানে রাখা অথবা ময়লার ঝুড়িতে ফেলা দেয়া ভোক্তার শিষ্টাচারের মাঝে পড়ে।

দাম-টাম চুকিয়ে সেই খাবারের দোকান থেকে বেরিয়ে ভাবছিলাম ট্রেন ছাড়তে এখনও প্রায় ঘণ্টা খানেক বাকি। বুখারেস্ট থেকে ব্রাসভ ট্রেনে প্রায় তিন ঘণ্টার মতো পথ। পথে যদি আবার খিদে পায় সে জন্যে কিছু বাদাম-মিঠাইয়ের মত হাল্কা খাবার কিনে নেব কী? ওই স্টেশনের ভেতরেই এক মনিহারি দোকানে ঢুকতে গিয়ে এবারেও যথারীতি প্রথমেই মুলাকাত হল ভ্রূ কুঞ্চিত অপ্রসন্ন চেহারার আরেক দ্বাররক্ষীর সাথে। তবে এ দোকানের হালচিত্রটি কিছুটা আলাদা। এই যেমন, এই দ্বাররক্ষীটি প্রথমেই আমাকে থামালেন আমার পিঠে থাকা ঝোলা ব্যাগ থেকে উঁকি মেরে চেয়ে থাকা জলের বোতলটি লক্ষ করে। আমাকে থামিয়ে তিনি সেই জলের বোতলে মেরে দিলেন ‘পূর্বে ক্রয়-কৃত’ ছাপ্পড়। অর্থাৎ ভেতরের কেও যেন পরবর্তীতে আমাকে এই জলের বোতলের মূল্য পরিশোধে পীড়াপীড়ি না করে। সে না হয় মেনে নিলাম। সেই ছাপ্পড় লাগানো শেষে সবে দোকানের ভেতরে পা দিয়েছি, এমন সময় সেই ভদ্রলোক আমাকে আবার পেছন থেকে ডেকে ফেরালেন। এবার এই গোয়েন্দা প্রবরের চোখ পড়েছে আমার বাঁ হাতে থাকা প্রায় নিঃশেষ দ্বিতীয় জলের বোতলটির দিকে। তাই তিনি আবারও দৌড়ে এলেন ওটিতে ছাপ্পড় লাগাবার জন্যে। ব্যাপারটিকে আমার কাছে কিছুটা ছ্যাঁচড়ামো বলেই মনে হল। তাই বেশ কিছুটা বিরক্ত হয়ে তাকে বললাম, “দুঃখিত জনাব আপনার আর এতোটা কষ্ট করে এটা সেটায় ছাপ্পড় লাগাবার প্রয়োজন নেই। আমি আপনার দোকানে না ঢুকে আপনার সেই মেহনত বাঁচিয়ে দিচ্ছি”। বাইরের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষমাণ অবস্থায় ভাবছিলাম তবে কী এই স্টেশনে চোরছ্যাঁচড়দের উপদ্রব এতোটাই বেশি যে দোকান মালিকদের এমন সব অতি সতর্কতামূলক ব্যাবস্থা নিতে হয়? অথচ কাছাকাছি অর্থনীতির প্রতিবেশী দেশ বুলগেরিয়া কিংবা সার্বিয়ায় কিন্তু আমার এমন দেউলিয়াপনা চোখে পড়েনি।

পাঠকদের নিয়ে ব্রাসভগামী ট্রেনে উঠবার আগে আমার সেই প্রথম ট্রেনটি ফেল করার কারণটি একটু খোলাসা করে নেই। আমার টিকেটটি কিন্তু ভুল ছিল না, আর সেই ট্রেনটিও ব্রাসভগামীই ছিল। কিন্তু ঘটনা হল রুমানিয়ায় নাকি একই সাথে একই স্টেশন থেকে দু কোম্পানির ট্রেন চলে। একটি সরকারি রেল কোম্পানির, আরেকটি একটি বেসরকারি কোম্পানির। আমি যে ট্রেনটিতে উঠতে ছেয়েছিলাম সেই ছিল সেই বেসরকারি কোম্পানির, অন্যদিকে আমার টিকেটখানা ছিল সরকারি রেলের। ভাষাগত সীমাবদ্ধতার জন্যে আশেপাশের কেওই ব্যাপারটি আমাকে ঠিক বোঝাতে পারেনি আরকি। এটি জানতে পেরেছিলাম বেশ পরে, ব্রাসভ থেকে বুখারেস্টে ফেরার সময়।

দূরের কল-কারখানার দেয়ালের গায়ে এঁকে রাখা স্লোগান কিংবা ব্যাঙ্গচিত্রের গ্র্যাফিটি, দুপাশের ক্রসিংয়ে ট্রেনের প্রস্থানের অপেক্ষায় সাইকেল হাতে দণ্ডায়মান এক দল মানুষ, ট্রেনের ব্রডগেজের পথটিকে দুপাশ থেকে চেপে ধরা পপলার গাছের সারি- এমনই আরও কত দৃশ্যের যে অবতারণা ঘটে গেল ট্রেন ছাড়বার ঘণ্টা খানেক সময়ের মাঝেই। আমার ঠিক উল্টো দিকে বসেছেন ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধ। ঈষৎ খুলে রাখা জানালার পাল্লা গলিয়ে হু হু করে আসা মধ্য গ্রীষ্মের বাতাস দাবদাহকে পরাস্ত করতে অসমর্থ হয়েছিল বলেই হয়তো বৃদ্ধ বার বার রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছছিলেন। আর এ থেকে নিশ্চয়ই এও বলার অপেক্ষা রাখেনা যে ট্রেনের ভেতরকার পাখা কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যাবস্থা তথৈবচ। তবে সেসবের মাঝেই কিন্তু আবার একটি ব্যাপার দেখে ভাল লাগলো। টিকেট কন্ডাক্টর যখন টিকেট দেখতে এল, তখন বৃদ্ধ টিকেটের বদলে তাকে দেখালেন তার একখানা কার্ড। খুব সম্ভবত এখানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এবং দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারীরা ট্রেনে বিনা ভাড়ায় বা কম ভাড়ায় ভ্রমণের সুযোগ পায়। পাঠকের মনে হয়তো ধারণা জমতে পারে, এই ট্রেনটি যেহেতু ছিল সরকারি কোম্পানির তাই হয়তো এই সুযোগ দেয়া হচ্ছে। সেই ভুল ভাঙাবার জন্যেই বলছি, আমি কিন্তু ফেরার বেলায় ফিরেছিলেম সেই বেসরকারি কোম্পানির ট্রেনে। সে ট্রেনেও বেশভুষনে দরিদ্র এক যুবতীকে আমি টিকেট চাইবার পর এক ধরণের পাশ বই বের করে কন্ডাক্টরকে দেখাতে দেখেছি। কন্ডাক্টর সেটি দেখে যাচাই করে তাকে একটি টিকেট তুলে দেয়। ও হ্যাঁ, আরও একটি মজার ব্যাপার ঘটেছিল সেই ফেরার পথের ট্রেনের টিকেট কাটবার সময়ে। আমি তো জানি যে ট্রেনের ভাড়া বায়ান্ন লেই, সেই বুঝে টাকা দেবার পর টিকেটের সাথে বাড়তি কিছু টাকা ফেরত পেলাম। তাই টিকেট বুথে আবার ফিরে গিয়ে বলেছিলাম আমাকে ঠিকঠাক বুখারেস্টে যাবার টিকেট দিয়েছ তো? আমার এই তাজ্জব বনে যাবার কারণটি ছিল, আমার কাছ থেকে এবার টিকেটের দাম রাখা হয়েছে সাতাশ লেই, অর্থাৎ সরকারি কোম্পানির টিকেটের ভাড়ার প্রায় অর্ধেক। এ কেমন করে সম্ভব? আর যদি সম্ভব হয়ই, তাহলে সরকারি কোম্পানিই বা কেন দ্বিগুণ ভাড়া রাখছে? যতটুকু আন্দাজ করলাম হয়তো আমাদের দেশের মতো মাথাভারি প্রশাসন দিয়েই চলে ওদেশের সরকারি দপ্তর, যাদের পক্ষে বেসরকারি কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতামূলক অভিসন্ধিতে গিয়ে কোষাগারে লাভের অর্থ সঞ্চিত করা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনা।

ব্রাসভে আমার উঠবার কথা “কাসা সামুরাই” হোটেলে। হোটেলটি স্টেশন থেকে মাইল খানেক দূরে। এতটা কম দূরত্বে ট্যাক্সি না নিয়ে হেঁটেই যাব ঠিক করলাম। পথে ভাবছিলাম এই সামুরাই নামটি কোথা থেকে এল? নাম শুনে তো একে প্রাচ্যদেশীয় নামই মনে হয়, রুমানিয়ান ভাষায় তো এ শব্দ থাকার কথা নয়। হোটেলে পৌঁছে বুঝলাম এই নামকরণের পেছনের ব্যাপার। হোটেলটির মালিক এক জাপানিজ। সেই সুদূর জাপান থেকে ভদ্রলোক কিভাবে এই মধ্য রুমানিয়ায় ব্যবসা খুলে বসলেন কে জানে। হোটেলের নিচ তলাটিতে মালিক তার পরিবার নিয়ে বাস করেন আর দোতলাটিতে কয়েকটি কক্ষ ভাড়া দেন। অতিথিদের দেখভাল করার জন্যে রয়েছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েক রুমানিয়ান যুবক-যুবতি। তবে মালিক এসে বসেন রাত আটটার পর। পরদিন সকালে আমার গন্তব্য ড্রাকুলা দুর্গ নামে খ্যাত সেই ব্রান দুর্গে। ব্রান কিন্তু ব্রাসভ থেকে প্রায় আরও ঘণ্টা খানেক দুরের পথ। তবে ড্রাকুলা দুর্গ দেখতে যেসব পর্যটক আসেন তারা এসে ওঠেন এই ব্রাসভেই। ব্রাসভ থেকে বাস বা ট্যাক্সিতে তারপর তারা ঘুরে আসেন ব্রান দুর্গে। রিসেপসনের মেয়েটির কাছ থেকে জেনে নিলাম কিভাবে কোন বাসে আমাকে পরের দিন সকালে ব্রান দুর্গে যেতে হবে।

নিজের ঘরে গিয়ে যখন ব্যাগ-বোঁচকা রেখে স্নানের পর্ব সেরে নিলাম, ততক্ষণে প্রদোষ লগ্ন প্রায় সমাগত। দূরের কার্পেথিয়ান পাহাড়ের ওধারে বিদায় নেয়া শুরু করেছে বৈকালিক আলো। তেমন কিছু তো আর করার নেই সেবেলায়। তাই ভাবলাম একটু বাইরে থেকে হাওয়া খেয়ে এলে কেমন হয়। আর তাছাড়া রাতের খাবারের একটা বন্দোবস্তও তো করতে হবে। হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটছি মূল মার্কেট স্কয়ারের দিকে। পাশ দিয়ে মন্থর গতিতে আমাকে ছাড়িয়ে গেল একটি কী দুটি গাড়ি। এই শহরটি ঘন-বসতিপূর্ণ নয়।

ব্রাসভ শহরের টাউন হল চত্বরের কয়েকটি খণ্ডচিত্র

এই সদ্য প্রদোষেই সবাই যেন দরজা জানালা বন্ধ করে সেঁধিয়েছে ভেতর বাড়িতে। রাস্তার ধারের টিমটিমে হলদে আলোয় খেয়াল করে দেখলাম কয়েকটি বাড়ির সদর দরজার পাশের ফলকে এমনকি লেখা আছে সেসব বাড়ির ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপনের সময়ও। সেটি থেকেই মনে হল অর্ধ শতাব্দির কম নয় এই আশেপাশের বাড়িগুলোর বয়স। সিটি হলের কাছের জায়গাটিতে পথের ধারে দূরের গ্রাম থেকে আসা এক বৃদ্ধা তখনও বুনে চলেছেন ছোট ছোট কিছু ফুলের তোড়া সাথে আনা বুনো গোলাপ আর ঝাও গাছের পাতা দিয়ে। যদিবা সন্নিকটের রেস্তোরাঁগুলোতে পয়দলে চলা পর্যটকের দলের কেও পথচলা থামিয়ে তার কাছ একটি তোড়া তুলে নিয়ে বিনিময়ে দেয় কয়েক লেই, সে আশায়।

ওদিকে কমলা রঙের বাড়িগুলোর লালচে টালির ছাদ ছাপিয়ে দূরের এক পাহাড়ে জ্বলজ্বল করা ব্রাসভ নামটি তখন ছড়ানো শুরু করেছে তার সাদাটে আলোকচ্ছটা।

ইউরোপের দেশগুলোতে সাধারণত বাস আর রেল স্টেশন খুব কাছাকাছি হয়ে থাকে। যাতে করে ট্রেন আর বাসের যাত্রিরা খুব সহজেই প্রয়োজনীয় যানটি অদল বদল করে পৌঁছে যেতে পারে গন্তব্ব্যে। ব্যতিক্রম দেখলাম এই ব্রাসভ শহরে। পরদিন সকালে আমার হোটেল থেকে বেরিয়ে হাতের ম্যাপটি দেখেই বুঝলাম গতকাল যেদিকের পথ পেরিয়ে স্টেশন থেকে এই হোটেলে এসেছিলাম, আজ যেতে হবে ঠিক তার উল্টো দিকে। হোটেল থেকে বলেছিল ট্যাক্সি নেবার প্রয়োজন নেই, কারণ হাঁটা পথ নাকি। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে টের পেলাম বাস-স্ট্যান্ডটি একেবারে কম দূরে নয়। অতঃপর প্রায় আধ ঘণ্টা হেঁটে পৌছুলাম সেই বাস-স্ট্যান্ডে।

পাঁচিল ঘেরা এক কম্পাউন্ডের ভেতরে বাস-স্ট্যান্ডটি, তাই দূর থেকে দেখলে মনে হয় কোনো গাড়ির গ্যারাজ বুঝি। মূল অপেক্ষা-ঘরের রঙ চটে গেছে সেই বহু আগেই, সাদা রঙ জৌলুস হারিয়েছে ধুলো আর তার গায়ে আঁকা গ্র্যাফিটির কাছে। তেমন কোনো ব্যস্ত বাস-স্ট্যান্ড নয় এটি। মাত্র দুটি কী তিনটি বাস দাঁড়িয়ে আছে ছাউনির নিচে যাত্রীর প্রত্যাশায়। আমি ছাড়া সেখানে আর বাদবাকি যাত্রি হবে জনা দশ কী পনেরো। তাই মনে মনে একটু শঙ্কিত ছিলাম। পুরো বাস ভরবার অপেক্ষায় থাকলে তো এখানেই অপেক্ষা করতে হবে আরও ঘণ্টা খানেক। সেই দু তিনটে বাসের মাঝে ব্রান যাবার বাসই বা কোনটি?
আমার সেই ঘণ্টা খানেকের ব্রান অভিমুখি যাত্রাপথটা কিন্তু নেহাত একাকী নিরানন্দময় হতে পারতো। কিন্তু সেটা হল না ভিভিয়ানার কল্যাণে। ঠিক কোন বাসটি ব্রানে যাবে সে কথা এই তন্বী তরুণীকে জিজ্ঞাসা করাতে সে মিষ্টি একখানা হাসি উপহার দিয়ে বলল, “ব্রানে ড্রাকুলা দুর্গ দেখতে যাচ্ছ বুঝি? আমিও ওখানেই যাচ্ছি। বাস ছাড়ার সময় হলে আমার সাথেই উঠতে পারো”। শুধু তাই নয়, বাসে উঠে নিজ থেকেই আমাকে ওর সহযাত্রী হবার প্রস্তাব দিয়ে বসলো। আমি তো এমনিতেই চলতি পথের বন্ধু অর্জনে মুখিয়ে থাকি, এমন প্রস্তাবে তাই গররাজি হবার কী কোনো সম্ভাবনা আছে? আলাপচারিতাটি এগোয় ভিভিয়ানাকে জানার মধ্য দিয়ে। ওর জন্ম এ শহরেই। তবে বয়স যখন দশ কী বারো তখন ওর পরিবার কাজের সন্ধানে পাড়ি জমায় গ্রীসে। চসেস্কুর পতনের পরবর্তী যুগ সেটি। চসেস্কু তথা ভঙ্গুর সমাজতন্ত্রের পতন হলেও সেই দুটি দশক ছিল রুমানিয়ার শোচনীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দশক। হাজার হাজার রুমানিয়ান এ সময়ে ছড়িয়ে যায় ইউরোপ এর বাদবাকি তুলনামূলক ধনিক দেশগুলোতে। তা তোমরা গ্রীসে কেন থিতু হলে? “গ্রীসে আগে থেকেই আমাদের আরও কিছু আত্মীয় ছিল, তারাই আমাদের পরিবারকে প্রারম্ভিক সময়ে নানা সাহায্য সহযোগিতা করে। আর তা ছাড়া গ্রীসের সামাজিক সুবিধার পরিমাণগুলো রুমানিয়ার তুলনায় বেশ ভাল”। কেমন একটু বুঝিয়ে বলবে? “এই যেমন ধরো গ্রীসে বেকার ভাতার পরিমাণ ছিল মাসে প্রায় সাড়ে চারশো ইউরোর মত। আর আমাদের রুমানিয়ায় বেকার ভাতার পরিমাণ মাসে দুশো ইউরোরও কম, তাও সেটা অনেক বিষয়ের উপর শর্তাধীন”। তার মানে কী তুমি বলতে চাইছ রুমানিয়ায় এখনকার সরকার-প্রদত্ত সেবা এবং সুবিধের পরিমাণগুলো যৎসামান্য? “সমাজতান্ত্রিক সময়ে প্রদত্ত নাগরিক সুবিধেগুলো যে পরবর্তীকালে পুরোপুরি অবলুপ্ত হয়েছিল তা কিন্তু নয়। এখনও আমাদের শিক্ষা খরচ প্রায় নেই বললেই চলে। এমনকি স্কুলে যারা গরিব শিশু তারা সরকার থেকে বিনামূল্যে বই-খাতা, স্কুলের ব্যাগ এসব পর্যন্ত পায়। এখনও চিকিৎসা সেবা সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় বিনা খরচে দেয়া হয়। আমি অবশ্য ডাক্তার দেখাতে হলে এখানে ডাক্তার দেখালেও মাকে দিয়ে গ্রীস থেকে ওষুধ আনিয়ে নেই”। মাকে দিয়ে ও কিভাবে ওষুধ আনায় সেটা বলার আগে ওদের বর্তমান পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে আরও দুটো কথা বলে নেই। ভিভিয়ানার মা, বাবা আর ছোট বোনটি এখনও গ্রীসেই থাকে। ওরও ওখানেই থিতু হবার কথা ছিল। কিন্তু জীবন তো আর সবসময় বাধা-ধরা নিয়ম মেনে চলে না। দুর্গম গিরিখাত বেয়ে চলা পথের মতো জীবনের পথও চুপ মেরে অপেক্ষা করে থাকে নতুন চমক আর নতুন অজানাকে নিয়ে। তেমনই এক ঘটনাতে এক রৌদ্রকজ্জ্বল সকালে গ্রীসের এক সমুদ্র সৈকতে ভিভিয়ানার সাথে দেখা হয় বাল্যকালের স্কুলের এক সহপাঠীর। ছেলেটি সে সময় বেড়াতে গিয়েছিলো রুমানিয়া থেকে গ্রীসে। সেই থেকেই ওদের মাঝে নতুন করে শুরু হয় বন্ধুত্ব, চিঠি-পত্র আদান-প্রদান, যেটি গিয়ে এক সময় ঠেকে প্রণয়ে। আর এই প্রণয়ের টানেই ভিভিয়ানা এক সময় সিদ্ধান্ত নেয় ঘর ছেড়ে ভালোবাসার মানুষের সাথে সেই ছেলেবেলার শহর ব্রাসভে ফিরে আসবার। শুরুতে এই যুগল ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো ব্রাসভ থেকেও কিছুটা দূরের এক শহরতলীতে। কিন্তু এখন ওরা এসে উঠেছে সেই ছেলেটির মায়ের বাড়িতে। এতে অবশ্য কিছুটা ব্যক্তি-স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়, কিন্তু বাড়ি-ভাড়ার কিছু পয়সা তো বাঁচে। তিল তিল করে ওরা এখন পয়সা জমিয়ে রাখছে ওদের আসন্ন বিয়ের খরচ নির্বাহ করবার জন্যে। ব্রাসভে এখন নাকি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে হল ভাড়া, খাওয়া, আনুষঙ্গিক সবকিছু মিলিয়ে খরচ পড়ে জনপ্রতি প্রায় পঞ্চাশ ইউরোর মত। অর্থাৎ বর আর কনে এ দু পক্ষের মিলিয়ে যদি শ খানেক মানুষ নিমন্ত্রিত থাকে সে অনুষ্ঠানে তাহলে ওদেরকে গুনতে হবে প্রায় পাঁচ হাজার ইউরোর মতো। ভিভিয়ানার ছেলেবন্ধুটি ভালোবাসা কর্মে বেশ পটু হলেও জীবিকা-কর্মে যে তেমন পটু নয় সেটা ভিভিয়ানার কথা থেকে প্রতীয়মান হল। বেচারি মোটামুটি একাই চেষ্টা করছে বিয়ের প্রায় সব খরচ জমাবার। তার জন্যে মেয়েটিকে রীতিমতো অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। ভোর ছটায় উঠে এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে ব্রানে পৌঁছে সেখানে সারাদিন কাজ করে আবার সেই এক ঘণ্টা পথ দাবড়ে ও যখন বাড়ি ফেরে তখন ঘড়ির কাটা পৌঁছে যায় প্রায় আটটার ঘরে। রাতের খাবার আর ঘুমানোর প্রস্তুতি ছাড়া বেশি কিছু সময় আর তখন থাকেনা নিজেকে একান্তভাবে দেবার মতো। তাই নিয়ে অবশ্য কোনো আক্ষেপ নেই ওর মাঝে। ও বরং মত্ত এবং সুখী এই জীবন সংগ্রামে আর ছেলেবন্ধুটিকে নিয়ে। একটু আগে বলছিলো ওর মাকে দিয়ে ওষুধ আনাবার কথা। প্রথমত কথা হল গ্রীস থেকে ওষুধ কেন? ব্যাপারটা কেমন যেন ভজঘট ঠেকলো। মোদ্দা ব্যাপারটি নাকি হল রুমানিয়ায় ডাক্তার দেখাবার খরচ কম কিন্তু ওষুধের দাম তুলনামুলকভাবে বেশি। অন্যদিকে গ্রীসে ডাক্তার দেখাবার খরচ বেশি হলেও সরকারের ভর্তুকির আওতায় ওষুধের দামটি কিন্তু কম। তাই ভিভিয়ানা এখান থেকে প্রেসক্রিপশন পাঠিয়ে দেয়, সেই দেখিয়ে ওর মা ওষুধ জোগাড় করে ওকে পাঠায়। হুম, বুঝলাম কিন্তু তারপরও একটা ব্যাপারে কিন্তু ধোঁয়াশা রয়েই গেল। রুমানিয়ার ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রে তো গ্রীসের সরকারি ভর্তুকির ওষুধ পাওয়া সম্ভব নয়। তা সেটি তোমার মা সম্ভব করেন কিভাবে? “রুমানিয়ায় কিন্তু বেশ কিছু নামী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সেখান থেকে পাস করার পর সেই অর্থনৈতিকক মন্দার সময়ে বিপুল সংখ্যক ডাক্তার পাড়ি জমায় পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে”। গ্রীসে ডাক্তারি বিদ্যা চর্চারত তেমনই দু একজন রুমানিয়ান ডাক্তার ভিভিয়ানার মাকে সাহায্য করেন রুমানিয়ান ব্যবস্থাপত্র দেখে ওষুধের জোগানে।

আমাকে ভারতীয় ভেবে ভুল করে ভিভিয়ানা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ওর কোনো একদিন ভারতে ভ্রমণে যাবার স্বপ্নের কথা মেলে ধরে, যদিও পরমুহূর্তে ও চুপসে যায় সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে কয়েকজন ভিনদেশী নারী পর্যটকের উপর সহিংসতার কথা উল্লেখ করে। কিছুটা সংশয় আর দ্বিধা নিয়ে ও আমাকে জিজ্ঞেস করে একলা নারী হিসেবে ভারত ভ্রমণে যাওয়াটা কী আদৌ নিরাপদ? আমি ওকে পরামর্শ দিই কোনো কালে গেলে একলা না গিয়ে কোনো পর্যটক দলের সাথে মিলে-ঝুলে যেতে, তাতে হয়ত বিপদের মাত্রাটা কম থাকতে পারে। ভারত নিয়ে এ কথার পরই ও নিজে থেকেই হটাৎ আমাকে বলে, “ আচ্ছা ওই অঞ্চলেই আরেকটা দেশ আছে না? পাকিস্তান নামে? জানো গ্রীসে থাকার সময়েই বেশ কিছু পাকিস্তানিকে কাছ থেকে দেখেছি। এদের অধিকাংশই কোনো না কোনো অপরাধে জড়িত হয়ে শেষ পর্যন্ত ঠাই নিত কারাগারে। আরেকটা বিষয় খেয়াল করতাম এরা সব বিষয়েই কিছুটা যেন গোঁয়ার আর গোঁড়া, তা সে ধর্ম হোক আর অন্য বিষয় হোক”। আমি কিন্তু আগ বাড়িয়ে ভিভিয়ানাকে পাকিস্তানিদের সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করিনি বা নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কোনো ধারণাও দিতে যাইনি। বরং আচমকা এই রুমানিয়ান মেয়ের মুখ থেকে পাকিস্তানিদের সম্পর্কে এমন কথন শুনে কিছুটা আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। পাকিস্তানিদের সুনাম তাহলে দেশে দেশে।

ততোক্ষণে ভিভিয়ানা পেয়ে গেছে এক আগ্রহী শ্রোতা আর আমি পেয়ে গেছি এক স্বতঃপ্রণোদিত উৎসাহী বক্তা। আমি তাই আমার মনের আর সব প্রশ্নগুলোকেও ওর সামনে সাজাতে থাকি। জানতে চাই এখনকার রাজনীতির অবস্থা সম্পর্কে। আর আঞ্চলিক অর্থনীতির অবস্থা সম্পর্কেই বা ওর মতামত কী? যতটুকু জানতে পারি, চসেস্কুর পতন হবার সাথে সাথে তার ক্ষমতার বলয়ে একদা থাকা মানুষগুলো কিন্তু কর্পূরের মত উধাও হয়ে যায়নি। বরং তারা খোলস আর ভোল পাল্টে এ দল সে দলের ছায়াতলে থেকে ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছে তার পরেও প্রায় দু দশক। আর সে দু দশকে দেশের প্রকৃত উন্নতি তেমন একটা হয়নি। অবস্থা এমন যে রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তরুণ সমাজের আর কেও ওপথে পা বাড়ায় না। আর সে সুযোগে রাজনীতির ময়দানে ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছে দুর্নীতিবাজ সেই পুরনো ঘুণে ধরা রাজনীতিবিদরাই। তবে গত অর্ধ দশকে নাকি কিছু উন্নতি হয়েছে আগের তুলনায়। এই যেমন ভিভিয়ানা যখন বছর দুয়েক আগে তার এই শহরে ফিরে আসে তখন নাকি তার পক্ষে ছোটবেলার সেই শহরকে চিনে নেয়াটা ছিল একটু কষ্টসাধ্য। কারণ সেই আগের কালের মতো তখন আর শহরের এখানে সেখানে নেই জঞ্জালের স্তূপ, সেসব সাফ করে সড়ক দ্বীপ সাজানো হয়েছে নতুন ভাবে, যেখানে শুধুই গোলাপের ছড়াছড়ি। ওদিকে শহরের ছোট্ট স্টেশনটিতে দলে দলে আসছে পশ্চিমা পর্যটকেরা। শুধু তাই নয়, এই ব্রাসভে সমসাময়িককালে নতুন একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার কথাও উঠেছিল। কিন্তু পরে বুখারেস্ট বিমানবন্দরের কথা মাথায় রেখে সেটি আর করা হয়নি, বিমানবন্দরটি চালু হলে হয়তো অনেক পর্যটক বুখারেস্টকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি উড়ে আসতো ব্রাসভে। ফলে বুখারেস্টের রাজস্ব হয়তো কিছুটা কমে যেত। সবই বুঝলাম, কিন্তু রুমানিয়া তো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ঢুকেছে বেশ ক বছর আগে। তার সম্পূরক হিসেবে ইউরো জোনে ঢোকার ব্যাপারে সাধারণ রুমানিয়ানরা কী ভাবছে? ভিভিয়ানার প্রায় পুরো পরিবারটি এই মুহূর্তে গ্রীসে থাকায় একটা বেশ কাছাকাছি ধারণা পাওয়া যায় ওর মুখ থেকে। গ্রীসে নাকি আগে যেখানে একজনের মাসে গড়-পড়তা আয় ছিল মাসে সাড়ে সাতশো ইউরোর মত, সেটা এই মন্দার সময়ে নেমে এসেছে আড়াই শ কি তিনশ ইউরোর কাছে। অথচ জীবনযাত্রার ব্যয় কিন্তু কমেনি। ওর বাবা-মারও তাই নাকি ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। অর্থাৎ ইউরো গ্রহণ করেও গ্রীস কিন্তু নিজেদের অবস্থা রাতারাতি বদলে ফেলতে পারেনি, বরং অবস্থা হয়তো আরও শোচনীয় হয়েছে। যদিও এর পেছনের ব্যর্থতার কার্যকারণ হিসেবে গ্রীকদের কর্মবিমুখতাকে ভিভিয়ায়া দায়ী করে বসে, আর গ্রীসের ফলাফল দেখে নিজ দেশে ইউরোর আগমনকে ও দেখে ‘ভিক্ষে চাই না মা কুকুর সামলা’ হিসেবে। রুমানিয়া প্রায় দশ বছর আগেই ইউরো জোনে ঢোকার প্রাথমিক অভিসন্ধি হিসেবে নিজের মুদ্রার পেছনে থাকা চারটি বাড়তি শূন্যকে ছেঁটে ফেলেছিল। তবে এই দশ বছরে জনতা বেশ বুঝে গেছে এই চার শুন্য থাকা আর না থাকার মাঝে তেমন কোনো বিশাল তফাত নেই। যৎসামান্য সুবিধেটুকু যা কিছু সরকার থেকে মিলছে, ততটুকুও যেন উধাও না হয়ে যায় সেটাই এখনকার মানুষের প্রত্যাশা।
ভিভিয়ানার সাথে আমার এই নানামুখী বাতচিতের মাঝেই আমাদের বাস এসে থামে এক্কেবারে সেই ব্রান দুর্গের দুয়ারে। আমাকে বিদায় জানিয়ে ভিভিয়ানা আমাকে বাতলে দেয় দুর্গের প্রবেশ পথের দিশা। নামার আগে অবশ্য পথের এই লাবণ্যময়ি সুবন্ধুর সাথে একখানা ছবি ফ্রেম-বন্দি করতে ভুলিনা।
আচ্ছা ইউরোপের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা এত দুর্গ থাকতে ব্রাম স্ট্রোকার রুমানিয়ার এই নিভৃত পল্লীর এক দুর্গকে তার গপ্পের প্রধান জায়গা হিসেবে বেছে নিলেন কেন? কেও কেও বলেন জুল ভার্ন তার বেশ কয়েক বছর আগেই প্যারিসে তার চিলেকোঠার ঘরটিতে বসে লিখে ফেলেছিলেন ‘কার্পেথিয়ান দুর্গ’ বইটি। আর সে বইতে এই ট্রানসিলভানিয়া অঞ্চলের কথা পড়েই নাকি ব্রাম স্ট্রোকারের মাথায় আসে এই অঞ্চলের এক দুর্গকে ঘাঁটি বানিয়ে গপ্প ফাঁদবার। তবে ব্রাম স্ট্রোকার যে ড্রাকুলা চরিত্রটির অবতারণা করেছেন সেটি একেবারে আকাশ থেকে পড়ে পাওয়া কোনো চরিত্র নয়। বরং এ অঞ্চলের ‘ভ্লাদ’ রাজ-বংশের এক নিষ্ঠুর রাজপুত্রের লোককথার সাথে কিছুটা কল্পনা মিশিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন শ্বেত-দন্ত, লম্বাটে কান, সূচালো নাক আর ফ্যাঁকাসে মুখের সেই ড্রাকুলাকে। যে নিষ্ঠুর রাজপুত্রের কথা উল্লেখ করলাম সে ছিল যুবরাজ ভ্লাদ ড্রাকুলের পুত্র, চতুর্থ ভ্লাদ। স্থানীয়ভাবে তাকে ডাকা হত ড্রাকুলা বলে। এই চতুর্থ ভ্লাদ ওরফে ড্রাকুলা তুর্কীদের বিরুদ্ধে বিজয়ী সেনানায়কের ভূমিকা নিলেও অচিরেই প্রকাশিত হয়ে হয়ে তার চরিত্রের নৃশংস আর মনোবৈকল্যকর প্রতিকৃতি। বন্দিদের চরম নির্যাতন আর কষ্ট দিয়ে তিলতিল করে মারবার পৈশাচিক আনন্দ পেতেন তিনি। হবে হয়তো সেই ইতিহাসের খলনায়ক ভ্লাদ ড্রাকুলা অথবা জুল ভার্নের বর্ণিত কার্পেথিয়ান অঞ্চল, এ সবই ব্রাম স্ট্রোকারকে চিন্তার খোরাকি জুগিয়েছে।

বইয়ের পাতায় থাকা সেকালের দুর্গগুলোর যে ছবি পাঠকের মনে আঁকা থাকে, তাতে দেখা যায় বাইরের পৃথিবীর কাউকে সে দুর্গে ঢুকতে হলে অধিকাংশ সময়েই এক কাঠের সেতু পেরিয়ে তবেই ঢুকতে হয়, যে সেতুটি আবার সময়ে সময়ে উঠিয়ে রাখা যায়। এ দুর্গটি কিন্তু তেমন নয়। এক উদ্যান মত জায়গায় শুরু হয়েছে দুর্গের প্রাঙ্গণ। সেখান থেকেই কিছুটা পাহাড় বেয়ে উঠে যেতে হয় দুর্গের মূল ফটকে। সেদিনের দিনটি ছিল কুয়াশা, মেঘ আর ঝিরঝিরে বৃষ্টির বাষ্পে ভরা আর্দ্র এক দিন। সেই প্রাঙ্গণের পল্লবিত চেস্টনাট আর পাইন গাছগুলো সেদিন সবুজের এক অপার সমারোহ নিয়ে হাজির হয়েছে। যেন তাদের সাথে তাল মেলাবার জন্যেই সে প্রাঙ্গণে থাকা দুটি কাঠের কুটিরের ছাঁদও ঢাকা পড়েছে সবুজাভ শেওলায় আর ফার্নের চাদরে।

সবুজের এই মাহামহ কাটিয়ে সেই পাহাড় চুড়োয় পৌঁছে কিঞ্চিত হতাশ হতে হল। যতটা বিশাল ভেবেছিলাম আদতে দুর্গটি ততটা বিশাল নয়।

এক যুবরাজের মুখচ্ছবি সম্বলিত কড়া নেড়ে ভেতরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ে বিস্তর নকশা করা বিশাল এক কাঠের সিন্দুক। ছোটখাটো ঘরগুলোর খুপরি গবাক্ষ দিয়ে দৃশ্যমান দূরের উপত্যকায় ছড়িয়ে থাকা এক গ্রামের প্রতিচ্ছবি। এ দুর্গের কক্ষগুলো এতটাই ছোট যে দু তিনজনের বেশি একই কক্ষে দাঁড়ালে ঘরটিকে রীতিমত গমগমে মনে হয়। ওক কাঠের মেঝে এখানে সেখানে ঢাকা রুমানিয়ান গালিচায়। নিচ তলার একটি ঘরের পাশেই আবিষ্কার করলাম ওপরের তলায় যাবার গুপ্ত সিঁড়ি। সিঁড়িটি খুঁজে পাওয়া যায় ১৯২৭ সনে, এক মেরামতের সময়ে। তার আগে পর্যন্ত এটি চাপা পড়ে ছিল ফায়ার-প্লেসের ছদ্মাবরণে।

এই সিঁড়ি বেয়েই কী তবে ড্রাকুলা অদৃশ্য হয়ে যেতো মাঝে মাঝে? তেমন ভাবতে দোষ কি? যদি সেই ভাবনা মনে জাগায় শিহরণ, আতঙ্কের সাগরে অবগাহন করে কেও যদি পায় লুক্কায়িত আনন্দ, তবে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ওই সিঁড়ির দু পাশে ঝুলে থাকা লোহার সুতোকে অবলম্বন করে উঠে যাওয়া যায় দুর্গের ওপরের তলার এক পরিপাটি শোবার ঘরে।

সে ঘরের এক দিকে ছাদ থেকে ঝুলছে ধুনি রাখবার পাত্র আর অন্যদিকে চেরি কাঠের ভারি টেবিল। টেবিলের লাগোয়া ওই পাশের উঁচু হেলানের চেয়ারটিতে বসেই কি ড্রাকুলা জনাথান হার্কারকে চিঠি লিখতো? বইয়ের কাহিনির সাথে আত্ম-কল্পনা যখন ধূমায়িত হয়ে উঠছে ঠিক সে সময়েই আবার সেই টেবিলের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রক্ত একেবারে হিম হয়ে যাবার উপক্রম হল। কারণ এর মাঝেই কালো আলখাল্লা আর সেই কামড়ে রক্ত চুষে নেয়া তীক্ষ্ণ দাঁত নিয়ে এক জলজ্যান্ত এক ড্রাকুলা এসে বসে গেছে সেই চেয়ারে। ওদিকে রসুনের কোনো মালাও তো আনিনি সাথে করে। আতঙ্ক কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলে নিজের মনেই না হেসে পারিনা। হায়রে, এই পৃথিবীতে কত রকমের ভক্ত আর পাগলই না আছে। সেই ড্রাকুলা আসলে এক জার্মান। কৈশোরে ড্রাকুলার গল্প পড়ে এখন বুড়ো বয়সে স্ত্রীকে সাথে করে এসেছে কল্পনার সেই ড্রাকুলা দুর্গ দেখতে। আসবার সময়ে আবার সাথে করে নিয়ে এসেছে ড্রাকুলার পোশাক-আশাক আর নকল এক পাটি ড্রাকুলা দাঁত। নাকি এই বেশে এই ড্রাকুলার টেবিলে বসে ছবি তুলে বন্ধুদের দেখিয়ে চমকে দেবে।

এই দুর্গ নিয়ে আরও কিছু কথা বলবার আগে এর সাথে জড়িয়ে থাকা এক জনপ্রিয় রানীর গল্প বলে নিই। ব্রিটেনের রাজকন্যা মেরি বিয়ে করেছিলেন রুমানিয়ার রাজা ফার্দিনান্দকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই রানি নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকদের চিকিৎসায়। অল্প সময়েই দেশ-বিদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এই রানি। কিন্তু জীবনের শেষ ভাগটা ততটা সুখময় হয়নি তার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মেঘ তখন সবেমাত্র ঘনিয়ে উঠেছে। আপন ছেলে তার মায়ের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে মায়ের রাজনৈতিক ক্ষমতা খর্ব করে মাকে পাঠিয়ে দেয় দূরের এক দুর্গে। আর আমাদের এই ব্রান দুর্গটিই ছিল সেই নির্বাসনের দুর্গ। এখানে মেরি কাটিয়ে গেছেন তার জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ সেই শেষ কটা বছর। সে সময়ে পড়েছেন অজস্র বই, লিখেছেনও কিছু। আর তাই মেরির শোবার ঘরটির পাশেই আরেকটি ছড়ানো ঘরের একদিকে খোঁজ মেলে এক ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের। গ্রন্থাগারের বইয়ের আলমারির সাথেই কাঠের বেঞ্চ মত লাগানো। যাতে বই নিয়ে আর দূরে কোথাও যেতে না হয়, সেখানে বসেই ওল্টানো যায় বইয়ের পাতাগুলো। এই ঘরটি গোছানো আছে মেরি যেভাবে ঠিক এ ঘরটি ব্যবহার করতেন ঠিক সেভাবেই। অন্য আর ঘরগুলোর তুলনায় কিছুটা বিশাল এ ঘরটিতে আরও আছে ইটালিয়ান সেলুন আসবাবপত্রের সেট, আছে জার্মানির ড্রেসডেন শহর থেকে আনানো এক সুবিশাল পিয়ানো, ভালাসিয়ান মাদুর, মেঝেতে পাতা এক ভালুকের চামড়া, ব্রোঞ্জের মূর্তি, আরও কিছু সেসময়কার জিনিস। মেরীর পরিবারের কেও কেও যে বেশ শিল্পগুণে গুণান্বিত ছিলেন তার প্রমাণ মেলে ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে ঝোলানো মেরির কন্যা রাজকুমারী ইলানার এক বিশাল ছবি দেখে, ছবিটি নাকি রাজকুমারীর নিজেরই আঁকা। এ ঘরটির ওপাশে যে এক চিলতে ব্যাল্কনি, সেটি বোধ করি এ দুর্গের সবচেয়ে মনোহর একটি স্থান। কারণ ভেতরের আলো আধারিতে ভরা কক্ষগুলো পেড়িয়ে এ ব্যাল্কনিতে আসা মাত্র চোখ ঝলসে যেতে পারে দূরের কার্পেথিয়ানের ভাঁজে দাঁড়িয়ে থাকা পাইন বনের সবুজের দ্যুতিতে। শুধু পাইনের বনই নয়, এই পাহাড় আর বনের মাঝে সততই খেলে বেড়ায় দলছুট এক মেঘের দল। হটাৎ এই পরাবাস্তব দৃশ্যের মুখোমুখি হলে মনে হয় এ যেন ইজেলে আঁকা বিখ্যাত কোন চিত্রশিল্পীর ছবি।

দোতলার খাবার ঘরটি অবশ্য তেমন আহামরি কিছু নয়। মাঝারি আকারের এক টেবিলের তিন পাশে চারটি চেয়ার পাতা। নেহায়াতই সাধারণ গদিমোড়া চেয়ার, নিরাভরণ সেই টেবিলের চারদিকে বিন্যস্ত। এই ঘরটি দেখা শেষ করে সিঁড়িমুখে ঢোকবার সময়ে মাথাটা কিছুটা কুঁজো করে নিচ তলার নামার মুখে আরেকটি ছোট কক্ষে থামতেই হল। সেই বইতে পড়া ড্রাকুলা কোনো অস্ত্র ব্যবহার করেছিলো বলে তো মনে পড়েনা। কল্পনার সেই ড্রাকুলা তার পৈশাচিকতা দিয়ে তিলে তিলে মানুষকে খুন করলেও বাস্তবের ড্রাকুলার ততটুকু সময় বা ধৈর্য্য ছিল বলে মনে হয়না। অন্তত এ ঘরের নানা ধাতব অস্ত্র, শিরস্ত্রাণ, যুদ্ধের রকমারি পোশাক তেমনই সাক্ষ্য দেয়।

দুর্গের ভেতর বাড়ির চাতালে অল্প এক টুকরো জায়গার নিউক্লিয়াস হয়ে আছে বাঁধানো এক কুয়ো। কুয়ো দেখে যদিও একটু ধন্দে পড়ে গেলাম। এক দুর্গ কম করে হলেও নিচের ভূসমতল থেকে শ খানেক ফুট উঁচু পাহাড়ের মাথায়। তা এখানে কূপ খনন করে মাটি থেকে জল বের করে আনা তো চাট্টিখানি কথা নয়। সে কী করে সম্ভব হল?

এই লেখাটি পড়ে কোনো আগ্রহী পাঠকের যদি দুর্গটিকে কিনে ফেলতে ইচ্ছে হয় তবে তার জন্যে কিছুটা আশার বাতি জ্বালিয়ে রাখি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কম্যুনিস্টরা ক্ষমতায় এলে আর সব রাজ-সম্পত্তির মত এই দুর্গটিকেও তারা নিয়ে যায় সরকারি জিম্মায়। রাজ-পরিবারটি পালিয়ে যায় পর্তুগালে। তারপর প্রায় অর্ধ শতাব্দী বাদে এই বছর দশেক আগে সরকার এই সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয় রাজ-পরিবারকে। শুরুতে এই দুর্গকে কেন্দ্র করে পর্যটন ব্যবসার প্রয়াস থাকলেও বয়সের ভারে ন্যুব্জ রাজপরিবারের শরিকরা এখন আর দুর্গটিকে ধরে রাখার ব্যাপারে ততটা মরিয়া নন। সমঝদার এবং মালদার কোনো ক্রেতা পেলে অদূর ভবিষ্যতে যে তারা দুর্গের মালিকানা হাতবদল করবেন না সে বিষয়ে ভবিষৎবাণী করাটা একটু দুরূহ।

দুর্গ প্রাঙ্গণের সেই মূল ফটক থেকে বেরুলেই ডান দিকে চোখে পড়ে চৈত্র সংক্রান্তির মেলার মত নানাবিধ রঙচঙয়ে পণ্যের পসরা নিয়ে বসা দোকানিদের। কাঠের বাঁশি, কাঠের পুতুল, ঝলমলে রঙের বাহারি উলের টুপি, ড্রাকুলার মুখোশ- কী নেই সেখানে। এমন জায়গায় এলে কী কিনে ব্যাগে ভরি সে চিন্তাটা বেশ কিছুক্ষণ কুরে কুরে খায়। কিছুটা ভেবে বার করলাম আমার যে জিনিসটি প্রয়োজন তেমন কিছু একটা কেনা যাক। কিছুদিন ধরেই আমার এক কালচে টেবিলে ধুলোর আস্তরণ জমছে, কালচে বিধায় ধুলোগুলো আরও চোখে প্রকট হয়ে দেখা দেয়। সেই ধুলো মোছার চেয়ে এবার মাথায় এলো সহজ এক বুদ্ধি। সামনের দোকান থেকে অসাধারণ কুশির কাজের এক জোড়া টেবিল-ক্লথ কিনে নিলেই তো হয়। তাতে টেবিলে ধুলো পরুক আর নাই পরুক, অন্তত আমার চোখে তো আর পড়বে না।

ব্রানে আরও কিছু ক্ষণ টই টই করে ঘুরে ফিরে আসি ব্রাসভে। আজ সন্ধ্যের ট্রেনেই আমার ফিরবার কথা বুখারেস্টে। তেমন তাড়াহুড়োর কিছু নেই। হোটেলের চেক-আউট কাউন্টারে গিয়ে দেখি সেদিনের দায়িত্বে আছে জরিনা। জরিনা? নামটি ঠিক শুনতে পেলাম কি? হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছি। হয়তো দীর্ঘকালের তুর্কী শাসনে বেশ কিছু তুর্কী শব্দও ঢুকে গেছে এ অঞ্চলের মানুষের নামে। শুধু কিন্তু তুর্কী নয়। এই ব্রাসভের একসময় প্রায় অর্ধেক অধিবাসীই ছিল জার্মান। কয়েক শতাব্দী পূর্বে বাণিজ্যের সূত্র ধরে ট্রানসিলভানিয়ার বিরাট অংশ জুড়ে এই জার্মানরা বসত গেড়েছিল। এমনকি জার্মানরা এ শহরকে তাঁদের ভাষায় “ক্রোন স্টাডট” বা “ রাজমুকুট শোভিত শহর” হিসেবে ডাকতো। পঞ্চাশের দশকের পর অবশ্য অবস্থা পাল্টে যায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই জার্মানদের অধিকাংশই পাড়ি জমায় পশ্চিম জার্মানিতে। জরিনার কথা বলছিলাম। হাতে যেহেতু কয়েক ঘণ্টা সময় আছে, তাই ভাবি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বিরস সময় কাটাবার চেয়ে জরিনার সাথে কথোপকথনে কিছুটা সময় পার করি। জরিনার মা এখানকার এক স্কুলের শিক্ষিকা, বাবা রুমানিয়ার সেনাবাহিনীর হয়ে এই মুহূর্তে আছেন আফগানিস্তানে। জরিনা ব্রাসভে থালেও তার প্রাণ ভোমরাটি রয়ে গেছে জার্মানির হামবুর্গে। জরিনার ছেলে-বন্ধুটির কথা বললাম আরকি। জরিনারও ইচ্ছে সেই ছেলে বন্ধুটির অনুগামী হয়ে হামবুর্গে থিতু হবার। এ জন্যে এখন সে প্রাণপণে জার্মান শিখছে। বল কী? তুমি তো বেশ ইংরেজি জানো, এর পর জার্মানও শিখছ? মিষ্টি লাজুক হেসে জরিনা বলে, “এ দুটো বিদেশি ভাষাই নয়। আমি কিন্তু স্কুলে ফরাসিও শিখেছিলাম। শুধু যে শিখেছিলাম তাই নয়, উচ্চ-মাধ্যমিকে পদার্থ-বিদ্যা আর রসায়ন এ দুটো বিষয় নিয়েছিলাম ফরাসি ভাষায়”। থ মেরে গেলাম রীতিমতো। ওর কাছ থেকে শুনলাম শুধু জরিনাই নয়, ওর সমবয়েসি আরও অনেক ছেলেমেয়েই এমন দু তিনটে বিদেশি ভাষা শেখে। কারণ বলা তো যায়না, কোন দেশে শেষপর্যন্ত ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি দিতে হয়। আমার মনে হচ্ছিলো আমেরিকার এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কথা, বিশেষত অভিবাসী বাবা-মায়ের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কথা। এমন অনেকের সাথেই কথা বলে দেখেছি বাড়িতে বাংলার ব্যবহার থাকায় তারা বাংলা বোঝে ঠিকই, কিন্তু বলতে বড় অনীহা, আর বাংলা লিখতে পারার তো কোন প্রশ্নই আসেনা। আমেরিকার কিছু কিছু স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে কয়েকটি ক্লাসে স্প্যানিশ শিখানো হয় যদিও, কিন্তু ব্যাপক ভিত্তিতে এখানকার ছেলে-মেয়রা কোন বিদেশী ভাষা রপ্ত করেনা। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে অনেকেই কিছুটা দাম্ভিকতা আর উন্নাসিকতা নিয়ে উত্তর দেয়, আমরা আমেরিকান। কি হবে আমাদের অন্য ভাষা শিখে? পৃথিবীর যেখানেই আমরা যাই না কেন সেখানকার মানুষদেরই বরং আমাদের ভাষা শিখে ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। অথচ একের অধিক ভাষা শেখা মানে তো ভবিষ্যতের জন্যে কিছুটা সম্পদ সিন্দুকে জমিয়ে রাখা, সে কথা এদের কে বোঝাবে? এমনকি আজকাল কিছু গবেষণায় দেখা গেছে একাধিক ভাষায় দখল থাকাটা স্মৃতিশক্তি এবং বুদ্ধিমত্তার উচ্চমাত্রা বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়ক। আসলে আমেরিকার এই প্রজন্মটি জীবন-সংগ্রাম কি সেটাই খুব ভাল করে বোঝেনা অথবা বোঝার প্রয়োজন বোধ করেনা। আবার কখনো বুঝলেও যে সময়ে বোঝে ততদিনে বড্ড দেরি হয়ে যায়।

জরিনার সাথে ওর জীবন পরিকল্পনা, ব্রাসভের সমসাময়িক গল্প- এমন নানানতর আড্ডার মাঝেই আমার হাত ঘড়িটি নির্দেশ করে এবার যে বিদায় নেবার সময় হয়ে এলো। এবার যেন কোনোভাবেই ভুল ট্রেনে না চড়ি, তাই জরিনা আমাকে ট্রেনের নাম সময়সূচীসহ এক চিরকুটে লিখে দিলো। বলে দিলো টিকেট কাটবার বুথে গিয়ে সরাসরি এই চিরকুটটি দেখাতে, তাহলেই নাকি সঠিক ট্রেনের টিকেট পেয়ে যাবো। সেদিন ফেরার পথে আর তেমন কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটেনি, মোটামুটি নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গিয়েছিলাম বুখারেস্টে। বুখারেস্টের বিস্তারিত গল্প বলছি পরের কিস্তিতে।


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

পোস্টের শিরোনাম দেখে প্রথম মনে পড়লো শাহরিয়ার কবিরকে। 'কার্পেথিয়ানের কালো গোলাপ'। হাসি

চমৎকার লেখা! চলুক

আপনাকে বড়ো হিংসে হয় রে ভাই!

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ওটা কিন্তু আমার প্রিয় একটা বই, এই গল্পের নামকরণের ক্ষেত্রে অবচেতনভাবে হয়তো ওই বইটির নামের একটি ভূমিকা ছিলো।
আমি একজন সাধারণ মানুস, আমাকে হিংসা করে কী হবে? হেহে

যাকগে অশেষ ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্যে, টেক্সাস কেমন লাগছে এখন অব্দি?

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ঠিক আমার অনুভূতিটা তিথীডোর লিখে ফেলছে! মন খারাপ

দারুন লাগছে, চলুক ঘোরাঘুরি! পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

সাক্ষী,
ধন্যবাদ, তা তাক থেকে কি আরো কিছু বই নামলো?

সত্যপীর এর ছবি

খুব চমৎকার চলুক

আপনার লেখাগুলো বই কোয়ালিটির, পরে ছাপা বা অন্ততপক্ষে ইবই বের করার কথা বিবেচনা করতে পারেন।

..................................................................
#Banshibir.

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

পীরের দোয়া যখন পেলামই তখন আর অপেক্ষা করি কেনো? ছাপার অক্ষরে না হয় ছড়িয়ে যাক কিছু গল্প, কিছু কথা.

পীর দা, এবারের বইমেলায় "পাললিক সৌরভ" এর ষ্টল ১২৫ এ পাওয়া যাবে আমার প্রথম বই "রিগা থেকে সারায়েভো", ১১ ফর্মার বই. বইয়ের প্রচ্ছদের ছবিটা এখানে দিলাম।

হিমু এর ছবি

সময় করে আপনার বইয়ের একটা ভুক্তি www.goodreads.com যোগ করে দিন। প্রচ্ছদ, প্রকাশক, প্রকাশকাল, পৃষ্ঠাসংখ্যা আর আইএসবিএন নাম্বার লাগবে।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ হিমু ভাই, গুডরিডসে যোগ করে দিয়েছি , এই হলো লিংক, https://www.goodreads.com/book/show/28965455-riga-theke-sarajevo

হিমু এর ছবি

গুডরিডসে বন্ধুতালিকার লোকজনকে রেকমেন্ড করলাম।

আপনি চমৎকার লেখেন। লিখে চলুন।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

হিমু ভাই, আপনার এই এতটুকু কথাই আমার কাছে অনেক কিছু, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

সত্যপীর এর ছবি

বাঃ খুব চমৎকার খবর। অশেষ শুভকামনা।

..................................................................
#Banshibir.

এক লহমা এর ছবি

চমৎকার উপভোগ করলাম, যেমন প্রতিবার করি আপনার লেখায়। আপনার বইয়ের প্রকাশ উপলক্ষে অনেক শুভেচ্ছা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে, বাহামার পরের পর্ব কোথায়?

এক লহমা এর ছবি

আসবে। আমি ফিরে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়ে ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেছি। মন খারাপ

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

এতো ভালো লিখেন আপনি! হাততালি

অর্ণব

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ অর্ণব, আপনাদের ভালো লাগাই আমার পাথেয়

কৌস্তুভ এর ছবি

আবারো সুন্দর ছবির সঙ্গে কর্তব্যনিষ্ঠ (অর্থাৎ কিনা বিস্তারিত এবং সুলিখিত) বর্ণনা। হাততালি

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ কৌস্তুভ দা

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
তাহসিন রেজা এর ছবি

আপনার লেখা ভালো লাগে। এইটিও ভাল লাগল খুব।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

শুনে খুব ভালো লাগলো, ভালো থাকবেন
ধন্যবাদ

অনুসন্ধিৎসু এর ছবি

আমি আপনার লেখার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত । তার অন্যতম প্রধান একটি কারণ হলো পূর্ব ইউরোপ নিয়ে আপনার মোহগ্রস্থতা, সাথে আপনার লেখনীশক্তি । পূর্ব ইউরোপ নিয়ে আমিও আপনার মতো মোহগ্রস্থ । এই মোহ টা আমার মাঝে তৈরী হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর "ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ" বই টা পড়ে, আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর আগে । বই টা পড়েছেন নিশ্চয়ই? আপনার সাম্প্রতিক পূর্ব ইউরোপ বিষয়ক ভ্রমন কাহিনীগুলো পড়ে সেই অসাধারণ বইটার কথা বারবার মনে পড়ছে । সেই কৈশোরে ভেবেছিলাম, আমিও যাবো একদিন সেই দেশগুলোতে ; সুনীলের মতো করে । এখনো সুযোগ হয়নি কিন্তু আপনার লেখাগুলো যেন আমার অপূর্ণ আশা খানিকটা ঘুচালো । আরো ঘুরতে থাকুন এবং লিখতে থাকুন.....
পুনশ্চঃ ১। হাঙ্গেরী গিয়েছেন?
২। আপনার বইটা ঠিক কতো তারিখে বইমেলাতে আসবে?

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনুসন্ধিৎসু
অনেক ধন্যবাদ আপনার এই মন্তব্যের জন্যে। "ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ" আমারও খুব প্রিয় একটি বই. আপনার মতো করেই সেই বইটি পড়ে আমার পূর্ব ইউরোপে যাবার সাধ জাগে, মাঝে বইটি হারিয়ে ফেলেছিলাম। গত বছর বাবাকে দিয়ে আবার নতুন করে বইটি আনালাম। হাঙ্গেরি গিয়েছিলাম, সেই নিয়ে এই বইতে একটি বিশাল লেখাও আছে.

বইটি মেলাতে চলে এসেছে ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখেই। পাললিক সৌরভের ১২৫ নম্বর স্টলে পাবেন। যদি মেলায় যান আর বইটি কেনেন তবে খানিক কষ্ট করে বইটির ফেসবুক/গুডরিডস পেজে যদি পাঠক মন্তব্য/ছবি সংযুক্ত করে দেন তবে প্রীত হই (https://www.facebook.com/rigathekesarajevo/, https://www.goodreads.com/book/show/28965455-riga-theke-sarajevo)

ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন

অনুসন্ধিৎসু এর ছবি

আপনার বইটা সংগ্রহ করেছি বইমেলা থেকে । যে লেখাগুলো আগে পড়িনি সেগুলো পড়ছি আগে । পুরোটা শেষ করে, ফেসবুক/ গুডরিডস পেজে মন্তব্য করবো অবশ্যই ।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা, ভালো থাকবেন

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

শুভকামনা। চলুক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটি বেশ ভালো হয়েছে।

বিদেশী বাঙালী

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ বিদেশী বাঙালী

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ লেখনি। আপনার বইটা গতকাল সন্ধ্যায় বইমেলা থেকে কিনেছি। অনেক অনেক শুভকামনা।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

রূপক ভাই,
মন্তব্যের জন্যে এবং বইটি কেনার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। সচলের কেও মনে হয় এই প্রথম আমার এই বইটি কেনার কথা জানালো।
পারলে গুডরিডসে আপনার মতামতটা যোগ করে দিয়েন।

অতিথি লেখক এর ছবি

৫ তারা রেটিং দিলাম আপনার বইতে।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

আবারও ধন্যবাদ রূপক ভাই

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।