রঙ্গীন দুনিয়া # ২

অভ্রনীল এর ছবি
লিখেছেন অভ্রনীল (তারিখ: বুধ, ১৭/০৯/২০০৮ - ২:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নেদারল্যান্ডস এর একটা ব্যাপার বেশ অবাক হবার মত; পুরো দেশটা একেবারে সবুজে ছাওয়া। যেদিকেই তাকাই সেদিকেই কেবল সবুজ। চারদিকে কেবল সবুজের সমারোহ। এরা খুবই সবুজ প্রিয় জাতি। খালি জায়গা পেলেই সেখানে গাছ লাগিয়ে দেয়। ডেলফ, হেগ বা লেইডেন এর মত শহরে না গেলে বিশ্বাস করা কঠিন যে কোন শহর গাছগাছালিতে এতটা পরিপুর্ণ থাকতে পারে। আর গ্রামের কথাতো বাদই দিলাম!

বাঙ্গালী ছাড়া আর কোন জাতিকে তেমন একটা কাছ থেকে ভালোভাবে কখনোই দেখি নাই। আইইউটিতে থাকতে অবশ্য ভিন জাতির পোলাপানদের সাথে কিছুটা মেশা হয়েছিলো। কিন্তু তাওতো আবছা’র উপর ঝাপসা করে। একেবারে পুরো একটা জাতিকে একসাথে দেখা – এই প্রথম। জাতি হিসেবে ডাচরা বেশ আড্ডাপ্রিয় বলেই মনে হল। এদের অফিস আদালতে গেলে মনে হবে যেন এরা অফিসে আড্ডা মারতে এসেছে। তবে এদের আসল আড্ডা চলে অফিস ছুটির পর। তখন দেখা যায়, সব লোকজন রেস্টুরেন্ট আর বারে গিয়ে ভীড় করেছে। এরা খাবার টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মেরে যায়। এদের বার মানে সেখানে কেবলই তরল জিনিস পাওয়া যায়। আগে কেবল গল্পের বইয়ে পড়তাম যে পশ্চিমারা ঘন্টার পর ঘন্টা তরল গলায় ঢালতে পারে। এইবার নিজের চোখে দেখলাম। এরা বারে বসে থাকে গড়ে পাঁচ থেকে সাত ঘন্টা। এই পুরো সময়টুকু কেবল মগের পর মগ হয় বিয়ার নয় ওয়াইন নতুবা হুইস্কি একের পর এক টানতে থাকে। অবাক ব্যাপার হল এরা এতটুকু মাতাল হয়না, অন্তত আমি দেখিনি! তরল ছাড়া আরেকটা যে ব্যাপারে এরা সিদ্ধহস্ত সেটা হল ধোঁয়া খাওয়া। সিগারেট টানতে এদের জুড়ি নাই। ছেলে বুড়ো সবাই দেদারসে ধোঁয়া গিলছে। এরা বাতাস টানার মত করে ধোঁয়া টানে।

ইউরোপের যে ব্যাপারটাতে এখনো অভ্যস্ত হতে পারিনি সেটা হল রাস্তার ডান দিকে চলা। সারাজীবন বাংলাদেশে রাস্তার বাম দিক দিয়ে চলে এসেছি, নিজেও গাড়ি চালিয়েছি। কিন্তু এখানকার রাইট হ্যান্ড রুল এখনো কেমন কেমন জানি লাগে। তবে এখানে এসে বুঝেছি, ঢাকার ড্রাইভাররা বিশ্বসেরা। ঢাকায় যে চাপের মধ্যে গাড়ি চালাতে হয় তার কানাকড়ি চাপও এইখানে নাই। কেউ হুটহাট করে লেইন চেঞ্জ করেনা। সাইকেলের জন্য আলাদা লেইন করা। আর রিক্সাতো নাই! একটা জিনিসকে সবাই ভয় পায়, সেটা হল আইন। সামনে পুরা রাস্তা খালি, আশেপাশে কোন জনমানুষ নাই, এই অবস্থাতেও যদি লাল বাতি জ্বলে তবুও গাড়ি থেমে যাবে। এমনকি যদি সময়টা রাত একটাও হয়!

এখানে আসার পর দ্বিতীয় সপ্তাহে গিয়েছিলাম ডলফিনেরিয়ামে। এইটা হেগ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে হার্ডারবাইক নামের আরেক জায়গায়। ডলফিনেরিয়ামে মুলত সামুদ্রিক প্রাণীদের শো হয়। ডলফিন, সীল - এদের বিভিন্ন খেলা দেখানো হয়। এতদিন কেবল ডিস্কভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতেই কেবল ডলফিন বা সীলের খেলা দেখতাম, এইবার নিজের চোখে লাইভ দেখলাম। এটা ছাড়াও ওখানে থ্রিডি সিনেমা আছে। সিকোয়েন্সের সাথে সাথে একেবারে চেয়ার নাড়িয়ে দেয়। পর্দায় হয়তো দেখা গেলো বোমা ফাটলো, সাথে সাথে বিকট বিস্ফোরনের শব্দ আর চেয়ারে সজোরে ঝাঁকুনি। ডলফিনেরিয়ামে গিয়ে ছিলাম মামা মামির সাথে। আসার পথে মামা লিলিস্টাডের বিশাল বাঁধ ঘুরিয়ে আনলো। যাদের নেদারল্যান্ডস সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা নাই তাদের জন্য ছোট্ট একটা তথ্য- পুরো দেশটার এক তৃতীয়াংশ অংশ এসেছে সাগরের নীচ থেকে। ডাচরা সাগরে বাঁধ দিয়ে তাদের দেশ বাড়িয়েছে। সেরকম একটা বাঁধ আছে লিলিস্টাডে। এটাকে বাঁধ না বলে আসলে বলা উচিৎ সাগরের মাঝ দিয়ে হাইওয়ে। এর উপর দিয়ে একের পর এক গাড়ি চলে যাচ্ছে। রাস্তার একপাশে সাগর আর অন্যপাশে শুকনো সবুজ জমি, দেখে মনেই হয়না যে এই জমি এক সময় সাগরের নীচে ছিল। অপূর্ব দৃশ্য! না দেখলে বোঝানো কঠিন।

ডাচ ভাষাটা বেশ অদ্ভুত। এদের খুব প্রিয় বর্ণ মনে হয় “খ”। ডাচদের সাথে কথা বললে প্রথমেই যে জিনিসটা মনে ধরে সেটা হল এরা সবাই প্রতিটা বাক্যেই খক্‌ খক্‌ করে গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। ইংলিশে কথা বললেও খক্‌ খক্‌! আসলে ডাচ ভাষাটা বেশ অদ্ভুত। এদের খুব প্রিয় বর্ণ মনে হয় “খ”। খুব সম্ভবত এদের প্রতিটা বাক্যেই একাধিক “খ” থাকে। “খ” তাই এদের গলা থেকে খিল খিল করে ঝরে পড়ে।

মারিয়াহোভ ট্রেন স্টেশন আমার প্রতিদিনের পরিচিত জায়গা। ইউনিভার্সিটিতে যেতে এখান থেকেই আমি ট্রেনে উঠি। একদিনের কথা, সবে ট্রেন থেকে নেমে মাত্র স্টেশনের বাইরে আসলাম, এসেই দেখি সামনে বিশাল মার্সিডিজ নিয়ে কালো স্যুট কালো সানগ্লাস পরা সিকিউরিটির এক দামড়া দাঁড়িয়ে আছে! কেবল যে দাঁড়িয়ে আছে তাই-না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুক ধ্বক করে উঠলো, সন্ত্রাসী হিসেবে আবার সন্দেহ করল নাতো! তার উপর আমার পিঠে আবার ব্যাকপ্যাক। আমার ব্যাকপ্যাকের যে সাইজ তাতে এটম বোমা আছে বলে সন্দেহ করাটা মোটেও অমূলক না। সাবধানে আরেকটু এগোতেই ব্যাপারটা চোখে পড়লো। ব্যাটার গাড়ীতে নীল রঙের নম্বর প্লেট লাগানো, তার মানে ব্যাটা ট্যাক্সি ড্রাইভার! এদের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের এই বেশভূষা বেশ কমন। বলা যায় এইটাই এদের ইউনিফর্ম! একেবারে ম্যাট্রিক্স সাজ যাকে বলে। তবে প্রথমবার একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের এই দশা দেখে হজম করতে বেশ কষ্ট হয়েছে।

বিদেশে এসে আবিষ্কার করলাম যে বাংলা পড়ার জন্য প্রাণ রীতিমত আঁইঢাঁই করে। দেশে আমার পিসিতে মোটামুটি সব বাংলা ব্লগগুলো বুকমার্ক করা ছিলো। সেই বুকমার্কগুলোকে স্থায়ী রূপ দেবার চিন্তা মাথায় আসলো। যেন সমস্ত বাংলা ব্লগগুলো শুধু আমি না আরো অনেকে যাতে পড়তে পারে। সেই চিন্তা থেকে নতুন একটা সাইট বানালাম। সাইটের নাম দিলাম “বিডিব্লগারস”। আমার কাছে যেকটা বাংলাদেশী ব্লগের ঠিকানা ছিলো সবগুলো সেখানে টুকে দিয়েছি। অনেক সাইট এখনো বাকী। তাই সবার কাছে আমার আহবান যেন সব বাংলাদেশী ব্লগাররা এই সাইটটাতে নিজেদের সাইটের নামটা সাবমিট করে। তবে এই সাইট করার আগে আমি অনেক খোঁজ করেছি কিন্তু কোথাও কোন বাংলাদেশী ব্লগের কোন সেই অর্থের ডিরেক্টরী খুঁজে পাইনাই। যাই হোক, সাইটটা গঠনে সবার সহযোগীতা কামনা করি।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

নোট: লেখকের নিজের ব্লগে প্রকাশিত - http://maqtanim.blogspot.com/2008/09/addthisurl-addthistitle.html

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

মাহবুব লীলেন এর ছবি

চমৎকার
এবার যদি একটা একটা করে এদের কালচারাল ইভেন্টগুলোর উপর একেকটা পোস্ট তৈরি করেন তাহলে কমপ্লিট একটা আর্কাইভ তৈরি হয়ে যাবে

আপনার বিডি ব্লগার্সটা দারুণ

মুশফিকা মুমু এর ছবি

“খ” তাই এদের গলা থেকে খিল খিল করে ঝরে পড়ে।

হাহাহাহাহা আমার এক প্রোজেক্টের ক্লায়েন্ট ছিল ডাচ, আমিও ব্যপারটা খেয়াল করেছি। খাইছে
লেখা পড়ে খুব ভাল লাগল আর আমিও মনে করি আমাদের দেশের ড্রাইভার রা বিশ্বসেরা। আমি জীবনেও বাংলাদেশে গাড়ি চালাতে পারব না। খাইছে
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

কনফুসিয়াস এর ছবি

আমার একটা ব্লগ আছে বহু পুরানো, আপনারটার মতন এমন সুন্দর না অবশ্য, তারপরেও দেখেন, কাজে লাগতে পারে-

http://banglaunicode.blogspot.com/

-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

রায়হান আবীর এর ছবি

অন্যরকম প্রবাসের সিরিজ। আরও দেখেন। আরও লিখেন।

=============================
তু লাল পাহাড়ীর দেশে যা!
রাঙ্গা মাটির দেশে যা!
ইতাক তুরে মানাইছে না গ!
ইক্কেবারে মানাইসে না গ!

শিক্ষানবিস এর ছবি

থ্রিডি সিনেমা হলের ব্যাপার স্যাপার জানতাম না। জেনে খুব অবাক হলাম। মরার আগে একবার থ্রিডি হলে সিনেমা দেখে নিতে হবে।
আপনার বিডিব্লগার্সে এখনই কিছু সাইটের নাম দিচ্ছি।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মগের পর মগ হয় বিয়ার নয় ওয়াইন নতুবা হুইস্কি একের পর এক টানতে থাকে। অবাক ব্যাপার হল এরা এতটুকু মাতাল হয়না, অন্তত আমি দেখিনি!
তাইলে খায় কেন?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

" সেরকম একটা বাঁধ আছে লিলিস্টাডে। এটাকে বাঁধ না বলে আসলে বলা উচিৎ সাগরের মাঝ দিয়ে হাইওয়ে। এর উপর দিয়ে একের পর এক গাড়ি চলে যাচ্ছে। রাস্তার একপাশে সাগর আর অন্যপাশে শুকনো সবুজ জমি, দেখে মনেই হয়না যে এই জমি এক সময় সাগরের নীচে ছিল। অপূর্ব দৃশ্য! না দেখলে বোঝানো কঠিন। "
একটা ছবি তো দিয়ে দিতে পারতেন ! মন খারাপ

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

তানবীরা এর ছবি

এদের অফিস আদালতে গেলে মনে হবে যেন এরা অফিসে আড্ডা মারতে এসেছে। তবে এদের আসল আড্ডা চলে অফিস ছুটির পর। তখন দেখা যায়, সব লোকজন রেস্টুরেন্ট আর বারে গিয়ে ভীড় করেছে। এরা খাবার টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মেরে যায়।

ভাই আমি বারো বছর নেদারল্যান্ডসে আছি, আমার কর্মজীবন আট বছরের, এরকম অফিসতো আমি পাইনি। আমাকে একটু আলো দেখান, আমি এরকক অফিসে কাজ করতে চাই।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

অভ্রনীল এর ছবি

আলো দেখতে চান? মাত্র মাসখানেকের অভিজ্ঞতা, তাও দেখি চেস্টা করে...

হেগের খেমেন্তিতে (Gemeente) আমি প্রায় দুসপ্তাহ ধরে ঘুরাঘুরি করসি রেসিডেন্ট পারমিটের জন্য। যে কাজটা দুইবারেই হয়ে যায় সেটার জন্য আমাকে টানা আটবার যেতে হয়েছে। খেমেন্তি পাঠায় টাউনহলে আবার টাউনহল পাঠায় খেমেন্তিতে। পুরা পিং পং বলের মত আরকি! তবে দুই জায়গাতেই আমার মনে হয়েছে যে এরা কাজ ফেলে বেশ আড্ডা মারছে... অন্তত নিজের চোখে দেখসি।

এবিএনাম্রো ব্যাঙ্ক প্রায় তিনদিন ঘুরানোর পরে আমার ডেবিড কার্ড এক্টিভ্যাট করল, যেই কাজ কেবল মাত্র কার্ড নিয়ে অদের কাউন্টারে গেলেই হয়ে যাবার কথা। এইটা আরেকটা আড্ডা মারার জায়গা। স্লিপ কেটে কাউন্টারে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর কাউন্টারের মালিক সামনে এসে দাঁড়ায়। কারন নিজের চেয়ার ছেড়ে অন্য চেয়ারে গিয়ে আড্ডাবাজি হচ্ছিলো।

আমার বাসার কাছেই এক বাংলাদেশি ভদ্রলোক থাকেন যিনি ওপিসিডব্লিউ (Organisation for the Prohibition of Chemical Weapons) তে কাজ করেন। বেচারার ফোন লাইন একমাস ধরে ডেড, অথচ কেপিএনের কোন খবর নাই। ওদের ফোন করলে আবার সবসময় পাওয়া যায়না। যখন পাওয়া যায় তখন বলে লোক পাঠাচ্ছি তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সেসব লোকের কেউই আর আসেনাই! হয়ত আড্ডা মারতে মারতে ভুলে গেছে...

তবে আপনি পুরনো লোক। আপনি ভালো বলতে পারবেন। হয়ত আমি মাত্র মাসখানেক হয়েছে দেখে এখনো ভাও বুঝতে পারিনাই দেখে আমি এদেরকে এখনো আড্ডাবাজ হিসেবেই দেখছি। যাই হোক নেদারল্যান্ডের বাঙ্গালী লোক পেয়ে ভালো লাগল। আশাকরি নিয়মিত মন্তব্য পাব।

_________________________________
| ছোট্ট রাজকুমারের আরো ছোট্ট জগৎ |
_________________________________

আনন্দ  এর ছবি

TU Delft এর পরিবেশ আসলেই অসাধারণ , delft শহর টাই একেবারে ছবির মত | সুন্দর লিখেছেন |

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।