শহরবন্দী মেঘ

সত্যপীর এর ছবি
লিখেছেন সত্যপীর (তারিখ: রবি, ০১/১১/২০১৫ - ৯:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইস্কুলে থাকতে আমি প্রায়ই এলিফেন্ট রোড হাতিরপুল কি কাঁটাবন থেকে হেঁটে বাসায় ফিরতাম। সন্ধ্যা হয় হয় কিম্বা অন্ধকার ঝপ করে নামার ঠিক পরে। জোর কদমে হাঁটলে সময় বেশী লাগত না। এরকম এক হাল্কা বৃষ্টিমাখা সন্ধ্যায় আমি হেঁটে ফিরছি, এমন সময় পাশে একটা হোন্ডা থামল। হেসে হোন্ডায় বসা তরুণটি জিজ্ঞাসা করল এই তুমি আটান্নো নম্বরের না? ওঠো পিছনে ওঠো আমি ওদিকেই যাচ্ছি নামিয়ে দেব।

আমি ভালো করে তরুণটির দিকে তাকিয়ে দেখি দীপন ভাই। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে ক্লাস নাইনের আমি দীপন ভাইয়ের হোন্ডায় লাফ দিয়ে উঠে বসলাম, আর তিনি বাতাসের বেগে হোন্ডা ছুটিয়ে দিলেন। মিনিট দুয়েক পরেই বাসা এসে পড়ল, আমি সুড়ুৎ করে নেমে পড়ি। দীপন ভাই পিঠ চাপড়ে বললেন ওকে যাও পরে কথা হবে, বলেই উপরে দোতলার দিকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে ধমকে ডাকতে লাগলেন অ্যাই শান্ত। শান্ত। অ্যাই শান্ত বাসায়?

আজকে কুড়ি বছর পরে অনেক চেষ্টা করেও দীপন ভাইয়ের সাথে আমার অন্য কোন স্মৃতি মনে করতে পারলাম না। উনি থাকতেন উনার বন্ধুবান্ধব নিয়ে, আমি থাকতাম আমার সার্কেলে। মাঝে মধ্যে উনাকে দেখতাম মিকু ভাইয়ের সাথে হোন্ডায় যাচ্ছেন, উনাদের বন্ধুমহলে সবচাইতে ঝাকানাকা হোন্ডা সম্ভবত মিকু ভাইয়েরই ছিল। আমার পড়ার টেবিলের ঠিক সামনে ছিল জানালা, সেইখান থেকে শুনতাম মাঝেমধ্যে দীপন ভাই এসে শান্ত শান্ত চ্যাঁচাচ্ছেন। দোতলায় শান্ত ভাই হয়তো গীটার বাজাচ্ছেন, সেইটে থামিয়ে তিনিও বাজখাঁই গলায় উত্তর দিতেন, কী-ই-ই?

ফেসবুক ফীড ভর্তি কোপানোর খবর আজ। আহমেদুর রশিদ টুটুল, রণদীপম বসু, তারেক রহিম। আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি। ঢাকা মেডিকেল। রক্ত, বি পজিটিভ। হঠাৎ আরেক খবর জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সাল আরেফিন দীপনকে তাঁর অফিসে ঢুকে… আমি এই খবর পড়তে পড়তে ছবি দেখে চমকে বলি আরে কিসের কি জাগৃতি প্রকাশন। এইটা তো দীপন ভাই। ফুটবল মাঠের দীপন ভাই। বিকালবেলা ব্রিটিশ কাউন্সিলের উল্টাদিকে ফুচকা স্টলের পাশে আড্ডা দেওয়া দীপন ভাই। হোন্ডায় চড়ায়া বাসায় পৌঁছায় দেওয়া দীপন ভাই। এরে কোপায় মেরে ফেলেছে?

সচল চরম উদাস লিখেছেন তার সাথে দীপন ভাইয়ের কথা হয়েছিল বইয়ের ব্যাপারে। দীপন ভাই নাকি চরম উদাস বই দেবেন শুনে ভারি খুশি হয়ে বলেছিলেন কী খাবেন বলেন। আমি কল্পনা করি শেষ দেখা হওয়ার কুড়ি/পঁচিশ বছর পরে আমি একদিন হয়তো মোগল বাদশা আওরঙ্গজেবের ভণ্ডামি নিয়ে লেখা কোন এক গল্পের পাণ্ডুলিপি নিয়ে গিয়ে বলতাম দীপন ভাই। আপনার মনে হয় আমাকে মনে নাই আমি ফুলার রোডে নতুন বিল্ডিং এ থাকতাম। এখন সত্যপীর নামে সচলায়তনে লিখি, একটা বই ছাপায় দিবেন? আমি ভূমিকায় চরম উদাসের নানান মিষ্টি মিষ্টি মিথ্যা কথা লেখায় আনতে পারব কোন সমস্যা না… ঐ ব্যাটা চাপা মারতে ওস্তাদ। কলিজার সিঙ্গাড়া দিলে স্যাম ভাই বলছে একটা প্রচ্ছদ করে দিবে। দিবেন? দীপন ভাই অবশ্যই হা হা করে হেসে দিয়ে বলতেন আরে সত্যপীর ব্যাটা ভন্ডপীর। দাও কেমন গল্প পড়ে দেখি।

শুয়োরের বাচ্চারা মানুষটাকে মেরে ফেলল।

ভালোই অবশ্য। আমাদের শুদ্ধস্বর জাগৃতির দরকার নাই। মোখছেদুল মোমেনিন পাবলিশারই যথেষ্ট।


মন্তব্য

আয়নামতি এর ছবি

...........

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালোই অবশ্য। আমাদের শুদ্ধস্বর জাগৃতির দরকার নাই। মোখছেদুল মোমেনিন পাবলিশারই যথেষ্ট।

আমাদের দেশ ছেয়ে গেছে এই মোখছেদুল মোমেনিন টাইপ পাবলিশারের বইয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ট্রেনে চেপে কচি
-কদাচিৎ সৈয়দপুর-রাজশাহী করতাম; প্রথমদিকে বেশকিছু বই কিনেছিলাম ট্রেন থেকে, বাজে প্রিন্টের বইগুলো থেকে খুঁজেপেতে ভালো ভালো প্রিন্টের বইও বের করা যেত। ক্যামাপাস ছাড়বার মোটে চার বছর হলো, তাতেই এখন ট্রেনে চড়লে হতাশ লাগে, ‘বারো চান্দের ফজিলত’ টাইপ বই ছাড়া কিচ্ছু পাওয়া যায় না। এই দুঃখ আমি ক’দিন পর পর করি সবার কাছে।

জাগৃতি, শুদ্ধস্বর দিয়ে আমরা কী করব, বলুন? ঘরে ঘরে মোকছেদুল মোমেনিনের জয়জয়কার হোক। মানুষ মরে যাক সমানে চাপাতির কোপে, কার কী আসে যায়?

দেবদ্যুতি

তিথীডোর এর ছবি

আমাদের শুদ্ধস্বর জাগৃতির দরকার নেইই তো।

আমাদের যাবতীয় আগ্রহের উৎস সেলফিময় ফেসবুক, প্রোফাইল ফিকচার, হানিবানি, হিঃহিঃ, ভাইটু, সুইটিময় কমেন্ট চালাচালি, গ্লোরিয়া জিন্সে চেক-ইন আর সুপার ট্রেন্ডি#আই সাপোর্ট গাজা, ঐটুকু-ই। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ভুলেও কোন বই তো পড়ি-ই না, ব্লগ কী সেটাও ঠিকমতো জানি না। হেপিকে নিয়ে দিনের পর দিন ধরে চরম অশালীন রঙ্গরসিকতার সময় তেল আর সময়ের অভাব হয় না, শুধু এতোটাই অসংবেদনশীল বাঙালির ঘিলুহীন মগজ, একের পর এক মানুষকে দিনে-দুপুরে কুপিয়ে মারা হয় বা মারার চেষ্টা করা হয়, দুটা মিনিটের জন্য কোথাও একটা টুঁ শব্দ করে না কেউ।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

দ্রোহী এর ছবি

দীপন ভাই ব্লগিংয়ের স্বর্ণযুগে "অন্ধকার" নাম নিয়ে লিখতেন। লিখতেন খুব কম। মনে পড়ে তার একটা লেখা পড়ে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। কালের আবর্তে ভুলে গেছিলাম "অন্ধকার" নাম নিয়ে কেউ ব্লগে লিখতো।

কে জানতো নয় বছরের মাথায় আবার নামটা নতুন করে মাথায় গেঁথে যাবে সারাজীবনের জন্য!

সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে। ফেরার কোন পথ নেই আর। স্বপ্নালু হয়ে বড় বড় কথা বলা যায়। বিদেশ বিভূইয়ে বসে বলতে পারি "কলম চলবে"। কিন্তু বুঝে গেছি, জেনে গেছি - একে একে সবাইকেই চাপাতির নিচে মাথা পেতে দিতে হবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমাদের শুদ্ধস্বর জাগৃতির দরকার নাই

আসলেই দরকার নাই। এক বইয়ের পাঠকরা তাদের কাজ করুক। মডারেট পাবলিকরা ধোয়ামোছা চালিয়ে যাক। একদিন এক বইয়ের পাঠকরা যখন মডারেট পাবলিকদের জীবনাচার নিয়েও মাথা ঘামাবে তখন দেখবে তাদের জন্য শুদ্ধস্বর কেন, কোন স্বরই আর অবশিষ্ট নাই।

আমি তোমাদের কেউ নই-> আতোকেন

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালোই অবশ্য। আমাদের শুদ্ধস্বর জাগৃতির দরকার নাই। মোখছেদুল মোমেনিন পাবলিশারই যথেষ্ট।

আমাদের যোগ্যতা এতোটুকুই...এর বাইরে যা ভাবি তা আসলে বিভ্রম...

স্বয়ম

এক লহমা এর ছবি

"ভালোই অবশ্য। আমাদের শুদ্ধস্বর জাগৃতির দরকার নাই। মোখছেদুল মোমেনিন পাবলিশারই যথেষ্ট।"
- বাংলাদেশ এই পরিণতির দিকে এগেয়ে চলেছে! সারা দেশ জুড়ে এত মানুষ, তবু!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

কল্যাণ এর ছবি

মন খারাপ

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

ধুসর জলছবি এর ছবি

দীপনদার বাবা বলেছে সে বিচার চায় না, বন্যা আপু বলেছে সে বিচার চায় না। বিচার আমিও চাই না। কি হবে বিচার চেয়ে? বিচার পাব? পেলেই বা কি হবে? একটা খুনি কে ধরে ফাঁসিতে লটকালেই এদেশের মানুষ বুঝে ফেলবে ব্লগ কি জিনিস, নাস্তিক আর ব্লগার সমার্থক শব্দ না অথবা কেউ নাস্তিক হলেই তাকে মেরে ফেলা যায় না অথবা মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা কেন দরকার একটা দেশে, মুক্ত চিন্তাটাই বা আসলে কি জিনিস? বন্ধ হবে সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ, ধর্মের নাম দিয়ে অধর্মের প্র্যাকটিস বন্ধ হবে?

যে দেশে ৯৫% মানুষ মনে করে লেখালেখির জন্য মানুষ খুন করা স্বাভাবিক সে দেশে লেখালেখির জন্য মানুষ খুন হবে না তো কোথায় হবে?মানুষ কি ভাবে মানুষ কি চায় তাই নিয়েই তো সমাজ। আমাদের সমাজ এরকমটাই তো চায়, অন্তত গত কয়েক বছর ধরে চারপাশ দেখে দেখে আমার এই ধারনাই শক্ত পোক্ত হচ্ছে।

এই দেশে কয়জন মানুষ বই পড়ে? শতকরা ১০ ভাগ। তাদের মধ্যে কতজন মানুষ হুমায়ূন আজাদ বা অভিজিৎদার বই পড়ে? ১ ভাগও তো না। তাহলে? এই কয়টা লেখক প্রকাশক মেরে ফেললে কার কি আসে যাবে? কয়টা ভোট কমবে? এই অল্প কিছু পাঠকদের ধরে ধরে মেরে ফেললেই বা কি এসে যাবে?

যেই দেশের বাচ্চাদের বাবা মারা বই পড়ার জন্য ধমকায়, যেখানে লেখালেখি করা মানে সময় নষ্ট সেই দেশের মানুষ লেখার স্বাধীনতা বুঝবে, মানবে এই সপ্ন দেখাটা আসলে আমাদের জন্যই বোকামি ছিল। বাচ্চাদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কিনে দেয়া বাবা মাদের দেশে মাথা উচু করে কথা বলার সাহস করা, ভাবতে বলা, ভাবনা প্রকাশ করতে বলা গাধা কিছু মানুষ কেন জন্মাবে? অভিজিৎ, অনন্ত, নিলয়, বাবু, দীপনদাদের জন্মানোটাই ভুল ছিল। এরা মরে গিয়ে সেটা প্রমান করে দিল।

খুব অচিরেই নিশ্চয়ই একদিন সময় আসবে সব বই পুড়িয়ে ফেলার, আমি আমরা দেখে যাব। খুব অচিরেই হয়ত এদেশের শিশুরা মুখস্ত করবে ‘লেখাপড়া করে যে, অনাহারে মরে সে”
চোখের সামনে একটু একটু করে দেশটাকে মরে যেতে দেখছি প্রতিদিন মন খারাপ

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

মন খারাপ

____________________________

কৌস্তুভ এর ছবি

আমাদের শুদ্ধস্বর জাগৃতির দরকার নাই। মোখছেদুল মোমেনিন পাবলিশারই যথেষ্ট।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

মন খারাপ

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

কর্ণজয় এর ছবি

মাথার ভেতরে জীবননান্দ দাশ জন্ম নিচ্ছেন।
কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। পৃথিবীটা মনে হচ্ছে ঠিক আমার নয়। কুয়াশা মাখা বিকেল মাথার ভেতরে ডাকছে।।।

রানা মেহের এর ছবি

জাগৃতি নিয়ে কাজ করার মতো কেউ কি নেই আর?
কেউ একজন যদি প্রকাশনীটিকে চালিইয়ে নিয়ে যেত।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।