ফ্ল্যাশব্যাক

মৃত্তিকা এর ছবি
লিখেছেন মৃত্তিকা [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৯/০৯/২০০৯ - ৬:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে কিছু একটা ভাবছিলাম। কিন্তু ভাবনা ভেঙ্গে দিলো কোথ্থেকে আসা কাঁচা মাছের গন্ধ! নাক কুঁচ্‌কে উহ্‌হু বলবার আগেই টের পেলাম গন্ধ আর কোথাও না, আমার হাত দুটি থেকেই আসছে। পরিচিত পুরানো গন্ধ। মুহূর্তেই ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলাম কয়েক বছর আগের একটি দিনে….সেদিন মা’কে আদর করে জাপ্টে ধরে পরমুহূর্তেই ছেড়ে দিয়ে বলেছিলাম “উহ্‌হু! তোমার গায়ে মাছের গন্ধ!” তারপর আরেক দুপুরে বাবা মায়ের মাঝ বরাবর শুয়ে, বক বক করতে করতে মায়ের হাতদুটি নিয়ে খেলা করতে করতে টের পেয়ে বলেছিলাম, “তোমার হাত এতো খসখসে কেনো মা?” মা অল্প হেসে উত্তর দিয়েছিলো, “তোমার যখন সংসার হবে, তখন বুঝবে কেনো”। আমি তখন ঠোট উল্টিয়ে বলেছিলাম-“জি না, আমি এসব গন্ধ ওয়ালা জিনিস ধরবোই না!”

মাথা থেকে এসব স্মৃতি সরিয়ে ফেলবার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে ফ্ল্যাশব্যাকে এবার ধরা পড়তে লাগলো আমার বাবার মুখ, আমাদের বাসাটা, আমার ঘরটা……..আর জানালার পাশে আমার পড়ার টেবিলটা! কতোদিন ঐ টেবিলে বসে পড়তে পড়তে আপনাই চোখ চলে গিয়েছে জানালা দিয়ে দূরে……চিন্তার রাজ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি ঝড় ওঠা, বৃষ্টি নামা, শত শত বাড়ির ছাদ, বেঁকে চলা চিকন সর্পিল রাস্তা, লোক চলাচল, নীল প্লাস্টিকের ছাদে ঢাকা সারি সারি বস্তিবাড়ি…….আরও কতো কি! শেষে দরজায় মায়ের কড়া স্বরের “এ্যা—ই” আওয়াজে আবার ফিরে এসে পড়া শুরু হতো! উফ! কেনো মনে পড়ছে এসব! মাথা ঝাড়া দেই আমি।

তবুও ফ্ল্যাশব্যাকে এবার ধরা পড়ে যেদিন দেশ ছেড়ে আসছিলাম, সেইদিনটি! খুব তাড়াহুড়োয় শেষ সময় গুলো বাবা মাকে বেশী দিতে পারিনি। তাঁদের ফেলে যাচ্ছি, সেই বোধটাও চাপা পড়েছিলো ব্যস্ততায়। আমাদের অহেতুক কড়া ও ফালতু নিয়মের বিমানবন্দরটির উদ্দেশ্যে যখন রওনা দিলাম, তখন বোধটা চরম হয়ে ধরা দিলো। হু হু করে কাঁদছিলাম, কোন কথা ছিলোনা বলার। গাড়ি থেকে নেমেই বিদায় দিতে হবে! একটা দরজার এপার আর ওপারই হবে শেষ দেখা, শেষ ছোঁয়া! ঢুকবার আগে মা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন, টের পেলাম তিনি শুধুই প্রাণ ভরে আমার ঘ্রাণ নিয়ে চলেছেন! গলা, ঘাড়, গাল সবখান থেকে শেষ ঘ্রাণটুকু নিয়ে নিয়ে তিনি জমিয়ে রাখছেন বুকের কোন এক কোটরে। তারপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাসিমুখে বিদায় দিলেন। কিছুতেই আমি ভুলতে পারিনা সেই স্মৃতিটুকু, যা আমাকে আজও কাঁদায়, দুম্‌ড়ে মুচ্‌ড়ে দেয় আমার ভেতরটাকে!

বর্তমানে ফিরে এলাম অবশেষে। নিজের হাতটা শুঁকে হাসতে চেষ্টা করলাম একটু। কিন্তু কিকরে যেনো কোথাও সঞ্চিত হয়ে থাকা অশ্রুরা সব দল বেধে নেমে আসতে লাগলো। কতোদিন রান্না শেষের ক্লান্ত মাকে জড়িয়ে ধরে তাঁর সেই সুবাস নেয়া হয়না! কতোদিন ছোঁয়া হয়না সেই খসখসে হাতজোড়া! আবারও একটা দুপুরে ঠিক আগের মতোই ঠেলাঠেলি করে দখল করে শুতে ইচ্ছে করছে ঠিক বাবা মা’র মাঝখানটায়। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, “অতোদূরে বসে তুমি কি আমার ঘ্রাণ পেয়েছিলে মা?


মন্তব্য

সাইফ তাহসিন এর ছবি

প্রিয় মৃত্তিকা, পড়তে গিয়ে চোখ যেন কেমন কচকচ কোরে উঠল, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল, পরশু ঈদ, এখন মন খারাপ করা লেখা ছাড়লে মন খারাপ

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

_প্রজাপতি এর ছবি

মন ছুয়ে গেল তোমার লেখাটা, সব মা'রাই বোধহয় একরম মমতাময়ী হন।
আমরা শুধু ভালবাসা নিয়েই গেলাম, কিছু করার সুযোগটাও পেলাম না দূরে থাকার কারনে।

-------------------------------------------
ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা ...

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা ...

মৃত্তিকা এর ছবি

ধন্যবাদ সাইফ ভাই সময় নিয়ে লেখাটা পড়ার জন্যে।
মন খারাপ করা এই দিনপঞ্জিটা আজ না লিখলেই ভালো হতো। পাঠকদের আসন্ন ঈদের আনন্দ মাটি করতে চাইনা এক ফোঁটাও। ঈদের শুভেচ্ছা রইলো।

প্রবাসিনী এর ছবি

ঈদের আগে আগে এ রকম লেখা পড়ে বেশ মঅন খারাপ হয়ে গেল।
________________________________________________

হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে

________________________________________________

হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে

মৃত্তিকা এর ছবি

সরি প্রবাসিনী, মন খারাপ করে দেবার জন্য।
আপনার ঈদটি সুন্দর কাটুক এই কামনা রইলো।

অনিকেত এর ছবি

মনটা বড় খারাপ হল---

ভাল থেকো,মৃত্তিকা
তুমি ভালো রইলে তোমার বাবা-মা ও ভাল থাকবেন----

শুভেচ্ছা

মৃত্তিকা এর ছবি

আপনাকেও শুভেচ্ছা......
ভালো থাকুন।

তীরন্দাজ এর ছবি

ভীষন মনছোঁয়া লেখাটি।

আমার বাবা-মা, দুজনেই বিদায় নিয়েছেন অনেক আগে। দেশের বাইরে বসে একান্তে চোখ বন্ধ করে এখনও তাদের কথা শুনি।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

মৃত্তিকা এর ছবি

ধন্যবাদ তীরুদা!

চশমাওয়ালি এর ছবি

সব ছেলেমেয়েরা মায়ের গা থেকে একটা গন্ধ পায়।
খুব ভাল লাগল আপনার লেখা।

---------------------------------------------
ল্যাসিক করাতে ভয় পাই আর লেন্স ভাল লাগে না।

---------------------------------------------
ল্যাসিক করাতে ভয় পাই আর লেন্স ভাল লাগে না।

মৃত্তিকা এর ছবি

ঠিক তাই।
অনেক ধন্যবাদ চশমাওয়ালি।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

সচলে যে ভীষণ মন খারাপ করা লেখা দেওয়ার একটা ধারা তৈরী হয়েছে দেখছি ...

আজ সকাল থেকে অনেকের পোস্ট পড়ছি, সচল জাহিদ লিখেছেন বাবাকে নিয়ে- আপনি মা'কে নিয়ে...। কে জানে, বাতাসে -ঈদের গন্ধ বলেই হয়তো আপনারা প্রবাসীরা স্বদেশ-স্বজনদের মিস করছেন...

সুন্দর লেখা, ভালো থাকুন- শুভ কামনা।
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

মৃত্তিকা এর ছবি

ঠিকই বলেছেন সুহান। অনেকদিন দেখা নেই বলেই মনের খালি ভাবগুলো দূর হয়না আমাদের কারও।
আপনিও ভালো থাকুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগা প্রকাশের অনুভুতিটা হারিয়ে ফেললাম। এমন সুন্দর লেখা পড়তে কার না চোখে জল আসে? বিশেষ করে যারা মা-বাবা থেকে দূরে আছে।

আপনার ঈদ সুন্দর হোক, আনন্দের হউক।

দলছুট।
=========
বন্ধু হব যদি হাত বাড়াও।

মৃত্তিকা এর ছবি

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ দলছুট ভাই।

দ্রোহী এর ছবি

এ ধরণের লেখা পড়তে ইচ্ছা করে না। এমনিতেই অনেক দুঃখ কষ্টের ভেতর থাকি। তারপর আবারো নতুন করে দুঃখ পেতে কার ভালো লাগে।

নিঃসন্দেহে লেখাটা ভালো হয়েছে।

মৃত্তিকা এর ছবি

হুম, কেনো যে লিখে ফেললাম। ঠিক হয়নি। এরপর হাসির কিছু লিখবো ইনশাল্লাহ।
ভালো থাকুন।

এনকিদু এর ছবি

আমি তখন ঠোট উল্টিয়ে বলেছিলাম-“জি না, আমি এসব গন্ধ ওয়ালা জিনিস ধরবোই না!”


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

মৃত্তিকা এর ছবি

তখন যদি জানতাম, এসব শুধু ধরবোই না, রেধে আবার খাবোও!

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

একাকীত্ব অনেক কিছু শেখায়! তবে সবচেয়ে বেশি শেখায় আপনজনকে চিনতে!

---------------------------------------------
আয়েশ করে আলসেমীতে ২৩ বছর পার, ভাল্লাগেনা আর!

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

একাকীত্ব অনেক কিছু শেখায়! তবে সবচেয়ে বেশি শেখায় আপনজনকে চিনতে!

ভাল থাকুন মৃত্তিকাপু! ঈদ ভালো কাটুক!

---------------------------------------------
আয়েশ করে আলসেমীতে ২৩ বছর পার, ভাল্লাগেনা আর!

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

মৃত্তিকা এর ছবি

হুম ঠিক বলেছো.........
ঈদ মোবারক বালিকা।

রেনেট এর ছবি

দীর্ঘশ্বাস ছাড়া বলার আর কিছুই নেই। ভালো থাকুন।
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

মৃত্তিকা এর ছবি

ভালো থাকুন আপনিও, ঈদের শুভেচ্ছা রইলো।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

মন খারাপ করা লেখা... প্রিয়জনের গন্ধ আমার খুব প্রিয়। আনমনে বসে প্রায়ই কল্পনা করি। বিষণ্ণতাটা কেন ছুঁয়ে গেলো বুঝতেই পারছেন... মন খারাপ

মৃত্তিকা এর ছবি

আপনারা সকলে আমার বিষন্নতা শেয়ার করে কমিয়ে দিয়েছেন কিছুটা।
ঈদের শুভেচ্ছা রইলো......

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

খুবই মনছোঁয়া লেখা। বিষাদটুকু স্পর্শ করে গেলো...

ঈদের শুভেচ্ছা আপনাকে।

মৃত্তিকা এর ছবি

ধন্যবাদ প্রহরী। আপনাকেও ঈদের অনেক শুভেচ্ছা!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।