যদি বিশ্বজিৎের জন্য একটা হরতাল ডাকতেন

মূর্তালা রামাত এর ছবি
লিখেছেন মূর্তালা রামাত (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৩/১২/২০১২ - ১২:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে একটি ভাঙচুরের মামলায় সরকার গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। গত সোমবার বিএনপির অবেরাধ কর্মসূচী শেষ হবার খানিক বাদেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিএনপি বৃহস্পতিবারে আধবেলা হরতালের কর্মসূচী দেয়। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়,বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মঙ্গলবারে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার এই কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, ‍“ ‍আগামীকাল বুধবারের মধ্যে মির্জা ফখরুলকে মুক্তি না দিলে পরদিন বৃহস্পতিবার সারা দেশে আধা বেলা (সকাল ছয়টা থেকে বেলা দুইটা) হরতাল করবে বিএনপি।”

সোমবার বিএনপির অবরোধ কর্মসূচী চলাকালেই নৃশংস একটি ঘটনা ঘটে।ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে নিহত হন সাধারণ পথচারী বিশ্বজিৎ দাস। তাকে মধ্যযুগীয় কায়দায় পিটিয়ে কুপিয়ে হত্যার দৃশ্য নানা টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করে শিউরে ওঠে। আলোচনা সমালোচনার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে টেকনাফ থেকে তেুতলিয়া পর্যন্ত। তারই রেশ ধরে হত্যাকাণ্ডের পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, নিহত বিশ্বজিৎ বিএনপির সক্রিয় কর্মী ছিল।

বিশ্বজিৎ বিএনপি কর্মীই হোক আর সাধারণ একজন দর্জিই হোক না কেন, তাকে যেভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের নাকের ডগায় শত শত লোকের সামনে খুন করা হয়েছে তাতে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে উচ্চবিত্ত সবাই এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এমনকী সরকারের নানা সমর্থক গোষ্ঠীগুলোও এই হত্যাকাণ্ডের দায় সরকার এড়াতে পারে না বলে সরব হয়ে ওঠে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো থেকে শুরু করে দেশী বিদেশী নানা মহলও এই হত্যাকণ্ডের নিন্দা জানায়।

এক কথায় বলা যায়, বিশ্বজিৎের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশের স্বাভাবিক বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন আপামর সকলের ভেতরই সরকারবিরোধী একটা জনমত গড়ে ওঠে। বিশ্বজিৎের মৃত্যু মানুষকে কতোটা ব্যথিত করেছে তা গত দুদিনের পত্রপত্রিকা, টকশো, ইন্টারনেট, ব্লগজগত ঘাটলেই দেখতে পাওয়া যায়।১৭ ডিসেম্বর ২০১০ আফ্রো-আরব রাষ্ট্র তিউনিসিয়ায় এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল। সরকারী নিপীড়নের প্রতিবাদ জানিয়ে সেখানকার ব্যস্ততম রাস্তায় মোহম্মদ বোআজিজি নামের এক ক্ষুব্ধ অপমানিত ফলবিক্রেতা নিজের গায়ে তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করে। এই মৃত্যু বারুদে আগুন ধরিয়ে দেয়। তিউনিসিয়ার জনগণ নেমে আসে রাস্তায়। মাত্র এক মাসের মাথায় প্রেসিডেন্ট বেন আলীর ২৪ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়। তিউনিসিয়ান বিপ্লব নামে পরিচিত এই ঝড় থেকে জন্ম নেয় আরব বসন্ত। যাতে কুপোকাত হয় লিবিয়া, ইয়েমেন, মিসরের তথাকথিত লৌহমানব শাসকেরা।

বিশ্বজিৎের মৃত্যুটাও বোআজিজির আত্মহত্যার চেয়ে কম কিছু নয়। বরঞ্চ যেভাবে তাকে খুন করা হয়েছে তাতে তার মৃত্যুর আবেদন মানুষের হৃদয়কে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়ে গেছে।সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে যারা সরকার বিরোধী আন্দোলন করছেন তাদের কাছে বিশ্বজিৎ হত্যার ইস্যুটি হওয়া উচিত ছিল সবচেয়ে মূল্যবান। এক বিশ্বজিৎকে নিয়েই দুর্বার আন্দোলনের পর আন্দোলন গড়ে তোলা যেতো। সরকারকে বিশ্বজিৎের খুনিদের গ্রেফতারের আলটিমেটাম দিয়ে হরতাল ডাকা যেতো। অবরোধ করা যেতো। সেইসব কর্মসূচীতে অবশ্যই গণমানুষের প্রবল সমর্থন থাকতো ।বিরোধী দলের অন্দোলনকে মানুষ নিজের যৌক্তিক আন্দোলন মনে করে স্বেচ্ছায় রাজপথে এসে দাঁড়াতো। জনগণের এ্ই আবেগকে পায়ে ঠেলে বিএনপি কীনা হরতাল ডাকলো তাদের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের মুক্তির আল্টিমেটাম দিয়ে! কী অবাক ব্যাপার! এ যেন হাতে মুক্তো পেয়েও মাটিতে ফেলে দেয়া!

অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলবেন দেশের বিরোধী দলের মহাসচিবের মতো একজন মানুষকে সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী গাড়ি ভাঙচুরের হাস্যকর মামলায় গ্রেপ্তার করা হলো- এটা কি কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়? অবশ্যই এটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই মুহূর্তে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বিশ্বিজিৎ হত্যার বিচার চেয়ে মাঠে নামা। যতোই অস্বীকার করা হোক না কেন সরকারের জন্য এটি একটি চরম বিব্রতকর ব্যাপার। এই ইস্যুতে চেপে ধরলে সরকার হাঁসফাসঁ করতে বাধ্য হতো, বাধ্য হতো বিশ্বজিৎের খুনিদের ধরতে। আর তাতে জনগণের কাছে বিএনপিই বাহবা পেতো।তাদের কাছে সামনে বিএনপির ভাবমূর্তি বাড়তো বই কমতো না। বিএনপিও এ সুযোগে প্রমাণ করতে পারতো যে তারা শুধু তারেক রহমান, ইলিয়াস আলী বা ৭১ এর কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের জন্যই মাঠে নামে না, তারা সাধারণ মানুষের কথা ভাবে। সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়েই তারা সত্যিসত্যিই ভুল শুধরে নিয়ে দেশ বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখে।

আফসোসের কথা হলো আমাদের দেশে না সরকারী দল না বিরোধী দল জনগণের অনুভূতি বোঝার চেষ্ট করে। তারা সবাই নিজের নিজের ক্ষমতালিপ্সু ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত।আর তাই বিশ্বজিৎের হত্যাকাণ্ড অন্য আর সব হত্যাকাণ্ডের মতোই ধামাচাপা পড়ে যাবে, বিশ্বজিৎের খুনিরা আগামীতে সরকার বদলালে আবারও সরকারী দলের হয়ে বরাবরের মতো ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।মির্জা ফখরুলের মুক্তির দাবীতে হরতাল হবে। হরতালে আবারও কোন মায়ের কোল খালি হবে। মির্জা সাহেব গলায় ফুলের মালা পরে জেল থেকে এসে দাবী করবেন নিহত মানুষটি তাদের দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিল। সরকার বলবে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা!

এ্ইতো বহুবার দেখা নাটক। সেই পুরোনো বস্তাপচা স্ত্রিপ্ট। আমাদের সবার মূখস্ত। তারপরও আমরা আশা ছাড়ি না। বিশ্বজিৎের মৃত্যুতে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে আমরা স্বপ্ন দেখি একদিন না একদিন অবশ্যই আমরা বিশ্বজিৎদের মৃত্যুতে হরতাল ডাকতে পারবো; বিশ্বজিৎকে না বাঁচাতে পারায়, তার হত্যার বিচার না করতে পারায় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে একদিন না একদিন আমরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবোই পারবো । একজন মোহম্মদ বোআজিজি যদি ১ কোটি আট লাখ তিউনিসিয়ানকে জাগাতে পারে, একের পর এক বিশ্বজিৎ ১৬ কোটি বাঙালিকে জাগাতে পারবে না- তা কি হয়?

তথ্যসূত্র:

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-12-11/news/312461
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-12-10/news/312066
http://en.wikipedia.org/wiki/Tunisia

১২/১২/১২
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।


মন্তব্য

সাবেকা  এর ছবি

বিএনপির মত দলের কাছে এসব আশা করা যায় কি? বিএনপি নেত্রী যেন তেন ভাবে তার চোর পুত্রদের বাঁচাবার জন্য যুদ্ধপোরাধীদের নিয়ে হলেও ক্ষমতায় বসতে চান । তার এ আশা কোনভাবেই যাতে পূর্ণ হতে না পারে আমাদের সেভাবেই কাজ করা উচিৎ । বিশ্বজিৎ এর বিচার আমাদের চাইতেই হবে তবে সেটা বি এন পি কে দিয়ে হবে মনে করলে আমরা খাল কেটে কুমির নয় শুধু এক্কেবারে দেশ সুদ্ধ কুমিরের পেটেই চলে যাব এবার । অতএব যা কিছুই করি না কেন খুবই সতর্কতা র সাথে করতে হবে ।

অতিথি লেখক এর ছবি

বিএনপি তো কুমীরের পেটে অনেক আগেই চলে গিয়েছে। এটা এখন জামাতে ইসলামীর নপুংসক শাখা নামেই পরিচিত।

ফারাসাত

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

বিশ্বজিতের রক্ত আমাদের নেতাদের রসদ যোগাবে ঠিকই কিন্তু বিশ্বজিতদের নিয়ে তাদের ভাবনা কমই আছে।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

বিশ্বজিৎের মৃত্যু মানুষকে কতোটা ব্যথিত করেছে তা গত দুদিনের পত্রপত্রিকা, টকশো, ইন্টারনেট, ব্লগজগত ঘাটলেই দেখতে পাওয়া যায়।

কিন্তু ব্যাপারটা কি হবে তা আপনিও জানেন । ক’দিনের মধ্যেই সবকিছু “স্বাভাবিক” হয়ে যাবে । আমাদের নেতা নেত্রীরা আমাদের "কল্যান কামনায়" রাজনীতির খেলায় মেতে থাকবে । তাদের লেলানো গুন্ডারা আবার আরেক বিশ্বজিৎকে ধাওয়া করবে...এক দল আরেক দলকে দোষারোপ করবে...চলতেই থাকবে এই চক্র ।

কত বড় নৃশংসতা ! প্রকাশ্য দিবালোকে স্বাধীন দেশের এক জন নাগরিককে এভাবে স্রেফ মেরে ফেলল তারই আশেপাশের মানুষ ?

জানি না, কিভাবে এই “নৃশংস” অন্ধকারের শেষ হতে পারে । আদৌ কি আসবে কোনদিন সেই ভোর ?

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।