একটি চটুল আলোচনার প্রারম্ভিকা

রোমেল চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন রোমেল চৌধুরী [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ২৫/০২/২০১১ - ৩:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


অধ্যাপক সুজা হায়দার ছিলেন আমাদের চারু ও কারুকলার শিক্ষক। প্রতিভাধর অন্যান্য ভাইদের মতো তাঁর ছিলো না ব্যাপক পরিচিতি কিম্বা খ্যাতি। বরং তিনি ছিলেন অনেকটাই নিভৃতচারী। হেমন্তের কোন এক বিকেলে বড়ই খেয়ালি মনে তিনি তুলি হাতে তুলে নিয়ে দাঁড়াতেন ইজেলের সামনে। মগ্নতায় ডুবে যেতে যেতে চালাতেই থাকতেন তুলির আঁচড়। নতুন জন্মের শিহরণে কেঁপে উঠত আনকোরা ক্যানভাস। প্রতিটি তুলির আঁচড়ের সাথে সাথে বিন্দু বিন্দু স্বেদ তাঁর মুখাবয়বে ফোটাতো অনির্বচনীয় তৃপ্তির শুভ্র ফুল। কবিতা ও স্বদেশ বড়ো প্রিয় ছিল তাঁর। আর প্রিয় ছিল শুদ্ধতা।

সপ্তম শ্রেণীতে যেদিন আমাদের ক্লাসে তাঁর প্রথম পাঠদান, সেদিনের বিষয় ছিলো আমাদের জাতীয় পতাকা। স্বদেশ ও শুদ্ধতা তাঁর বড়ো প্রিয় ছিল বলেই হয়তো হাতে কলমে তিনি আমাদের চিনিয়ে দিতে চেয়েছিলেন পতাকার সঠিক মাপ ও রঙ। বেসিক তিনটি রঙের কোনটির সাথে কোনটির কতটুকু মিশিয়ে দিলে প্রুসিয়ন উজ্জ্বল সবুজ আর প্রুসিয়ন উজ্জ্বল লাল মেজাজ ঠিক রেখে প্রতিভাত হবে শিখেছিলাম তাঁর কাছে। মঞ্চনাটকের শিল্প-নির্দেশনা, মুনীরের একক চিত্র প্রদর্শনী, কবিতা-সন্ধ্যার আয়োজন সবখানে অধ্যাপক সুজা হায়দার সর্বসম্মত শেরপা, আমরা তাঁর মুগ্ধ অনুসারী।

তাঁর প্রিয় ছাত্রদের শিল্পকলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তিনি বলতেন দ্য ভিঞ্চির কথা, বলতেন পাবলো পিকাসো, রেমব্রান্ড, মাইকেল এঞ্জেলো, ভ্যান গগ, জয়নুল, সুলতানদের কথা। তাঁর কাছে শুনতাম মোনালিসার রহস্যের কথা, গুয়ের্নিকার বিমূর্ত আর্তনাদের কথা, ভ্যান গগের হলুদ রং ব্যবহারের তাবৎ কাসুন্দি, দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে আঁকা জয়নুলের ছবিতে চারকোলের কাজের মুনশিয়ানার কথা, শস্যের সুরক্ষায় সুলতানের শক্তসমর্থ হাতের পেশী ও পৌরুষের প্রত্যয়ের কথা।

কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা এতটাই বড়ো মাপের যে, কোন ধরণের প্রাপ্তির প্রত্যাশা কখনই ছুঁতে পারেনা তাদের। অধ্যাপক সুজা হায়দার ছিলেন তেমনি একজন মানুষ। বড়ো শখ করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন 'মোনালিসা' আর ছেলের নাম রেখেছিলেন 'পাবলো'। একটি আশ্চর্য সৃষ্টি ও একজন আশ্চর্য স্রষ্টার নামে নাম মিলিয়ে। অধ্যাপক সুজা হায়দার বেঁচে নেই, অনিবার্য গন্তব্যের উদ্দেশ্যে তিনি চলে গেছেন অনন্তের পথ ধরে। চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন বনানী কবরস্থানে।


ছেলেটির নাম ছিল ঋত্বিক। সুস্থ, সাবলীল, প্রাণবন্ত এক শিশু। বাবার মতোই লম্বা, একহারা, সুঠাম গড়ন পেয়েছিল সে। হঠাৎ কোথা থেকে কি জানি হয়ে গেল। ঋত্বিক জ্ঞানহারা। ভাইরাস জ্বর থেকে সহসা কোমায়। শয্যাশায়ী হলো ঋত্বিক। বন্ধুরা হারিয়ে গেল। সঙ্গী হলো হুইল চেয়ার। অ্যানসেফালাইটিসের জীবাণুর মারণ প্রকোপে ধুসর থেকে ধুসরতর হতে থাকলো তার পৃথিবী। সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলেও যখন হুইল চেয়ার ছাড়ানো গেল না, তখন সর্বস্ব উজাড় করা আদর-ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে সব শূন্যতা ঢেকে দিতে বাবা-মার কি প্রাণান্ত প্রয়াস! মায়ের কোলছাড়া কখনো হতে হয়নি ঋত্বিককে। কিন্তু বাবাকে তো জীবিকার প্রয়োজনে ছুটতে হয়। ছুটতে হয় টাকার জন্যে। ঐ টাকাই যে একমাত্র ভরসা। খেয়ে পড়ে বাঁচার জন্যে টাকা চাই, টাকা চাই ঋত্বিকের সুচিকিৎসার জন্যে। তাই তাঁকে তো ঘরে বসে থাকলে চলে না। তবু বাবাই যেন ঋত্বিকের সব। সব সময় কাছে পেতে চায় তাঁকে। কিন্তু জীবনে বেঁচে থাকার সমীকরণ এই অবুঝ বালকের দিক হতে ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। ঋত্বিকের ধুসর পৃথিবীতে রং বলতে ছিল শুধু দিনান্তে বাবার প্রাণবন্ত উপস্থিতি। সেই বাবাকেই কেন অসময়ে অফুরন্ত ঘুমের ভেতর ডুবে যেতে হবে, ভাবতে গেল বড় কষ্ট, বড় অভিমান হয় তার। ইস, যদি বাবার কাছে চলে যাওয়া যেত। অনেক রঙিন ইচ্ছের ঝুলি ফেলে ছুটে যায় ঋত্বিক ইচ্ছেপূরণের মোহন নেশায়। গন্তব্য বনানী কবরস্থান। মায়ের বুকের সবটুকু শূন্যতাকে নিয়ে হুইল চেয়ারটি ফাঁকা পড়ে থাকে।


অধ্যাপক সুজা হায়দারের ছেলে পাবলো বড়ো হয়ে তুলি হাতে তুলে নিয়ে শিল্পী হননি। লাল-সবুজের প্রত্যয় বুকে ধারণ করে সৈনিক হয়েছিলেন তিনি। শুনেছি, হৃদয়ের বিশালতায় সহকর্মীদের সবার প্রিয়তম মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। স্বভাবসুলভ আন্তরিকতায় অনন্য বন্ধুবৎসল এই মানুষটিকে চারপাশের সবাই বিমুগ্ধ ঈর্ষা করতেন। তাঁর রাইফেলের ডগায় সর্বদা ফুটে থাকতো লাল গোলাপ। বাবার মতো তিনিও কবিতা ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন মানুষের ভেতরের মানুষকে, প্রগাঢ় ভালোবাসার আস্তরণে ভরে দিতেন নিজের সন্তান ও প্রিয়তমা নারীকে।

দেশকে তিনি ভালোবাসতেন কিনা সেটি অবশ্য আমার জানা হয়ে উঠে নি। বস্তুত সে বিষয়ে আগ্রহী হতে আমার কখনো ইচ্ছেই করে নি। তাছাড়া জলপাই রঙ ভালোবাসার কীইবা মূল্য আছে? সুতরাং সে বিষয় থাক। আমরা বরং আলোচনা করি অন্য বিষয়ে। কিছু অবশ্যম্ভাবী পরিণতি নিয়ে যা এখন আর আমাদের আলোড়িত করে না।

বেয়নেটে ছিন্ন ভিন্ন লাশটা যখন পাওয়া গেল, তখন পাবলো তাকিয়ে ছিলেন অনন্ত আকাশের দিকে। তাঁর প্রিয় কবি রিলকের কবিতার মতো, “lie down again and again among the flowers, face to face with the sky.” পাবলোকে শুইয়ে দেয়া হয়েছে বনানী কবরস্থানে।


পাশাপাশি তিনটি কবর। তিনটি আয়তাকার ছোট জমিনে তিন প্রজন্মের ইতি টেনে দেয়ার উপাখ্যান যেন অচেনা এক এপিটাফ হয়ে হাসিমুখে ফুটে আছে।

অধ্যাপক সুজা হায়দার
মেজর হুমায়ুন হায়দার পাবলো
তাসীন ঋত্বিক হুমায়ুন

পুরো বনানী কবরস্থান জুরে এক বিশাল কবরে আমি আমার বিবেককে মাটিচাপা দিয়ে এসেছি। আসুন, এখন আমরা বরং অন্য কোন চটুল আনন্দদায়ক বিষয়ে আলোচনা করি।


মন্তব্য

ফাহিম হাসান এর ছবি

খুব মন খারাপ করা লেখা।

১ থেকে ২ এ যাওয়াটা একটু খাপছাড়া লাগলো। আমার বোঝার ভুলও হতে পারে কিন্তু মনে হচ্ছে আচমকা প্রসঙ্গের পরিবর্তন হচ্ছে।

guest writer rajkonya এর ছবি

মন খারাপ

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

কাল রাত থেকেই মনটা ভাল নেই। দুই বছর আগের এই কয়টা দিন কেবল মনে পড়ে যাচ্ছে। অনেক কথা বুকের মধ্যে চেপে রাখি, খালি খালি মানুষের সাথে তর্ক করতে ভালো লাগে না। যে কোনও মৃত্যুই বেদনাদায়ক, তার পরও স্বাভাবিক-আস্বাভাবিক বলে কথা। আমার অনেক বন্ধুই জলপাই মরেছে বলে খুশিতে নেচেছেন। সিপাইদের হাতে আফিসারদের হত্যার মাঝে গভর্ণেন্সের বিপ্লবী উত্থান দেখেছেন। জলপাই মরলে যেমন তাদের উল্লাস হয় তেমনি জলপাইএর বাবা বা বাচ্চা মরলেও তাদের কোনও শোকতাপ হয়না। এইসব লিখে শুধু আমাদের মনটাই খারাপ করে দেয়া হয়।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমারও একই কথা ঘুরে ফিরে মনে পড়ছে। পিছনের মানুষগুলো ধরাছোয়ার বাইরেই থেকে গেল শেষ পর্যন্ত। -রু

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়েছি আগেই, মন্তব্য করা হয়নি। মন খারাপ হয়ে গেল। -রু

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মন খারাপ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

রোমেল ভাই,

ম্যাচ দেখার মাঝে লেখাটা পড়ছিলাম। খারাপ লেগেছে তাদের কথা শুনে, আর ভালো লেগেছে লেখাটা পড়ে।
ভালো থাকবেন।

____________________________________________________
মেঘদুত

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমি বাকরুদ্ধ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

ভাষাহীন।
অনন্ত যাত্রায় আত্মাত্রয় শান্তি পাক।

দ্রোহী এর ছবি

মনটা খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ

কনীনিকা এর ছবি

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি সচলায়তনের নীরব পাঠক, শুধু পড়েই যাই, মন্তব্য করি না। আপনার লেখাটা পড়ে লগিন না করে পারলাম না। এই হত্যাকান্ডে আমিও আমার এক ভাইকে হারিয়েছি, লেঃ কঃ এনশাদ ইবন আমিন। দুটো বছর হয়ে গেল, কিন্তু আমাদের হৃদয়ের ক্ষত এখনো শুকোয়নি, কোনদিন শুকোবে কিনা জানি না।

------------------------------------------------------------------
It is impossible to be a mathematician without being a poet in soul.

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মন খারাপ

অতিথি লেখক এর ছবি

কিছু রক্তের দাগ কখনই মুছে যাবার নয়। নিজেকে যতই আড়াল করার চেষ্টা করিনা কেনো। শ্রদ্ধা

-অতীত

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

কোন দিন যেন আমার চোখের কিনারে
আকাশের চাঁদ, সন্ধ্যানদীর অভিজ্ঞান কিংবা রাত্রিরহস্যের গাঢ় ভাষা কেঁপে না উঠে
কেঁপে না উঠে পৃথিবীর দিগন্তের দীপ্যমান তারা
আগুন তাতা সাঁড়াশী দিয়ে তোমরা উপরে ফ্যাল আমার দুটি চোখ
সেই দুটি চোখ; যাদের প্রাজ্ঞ দৃষ্টির মৃত্যুহীন বিদ্রোহী জ্বালায়
দেখেছি নির্মম আকাশের নিচে মানবিক মৃত্যুর তুহিন স্তব্ধতা

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

..........

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

কৌস্তুভ এর ছবি

বিষয়টার সম্পর্কে অল্পই জানি। তবুও আপনার লেখাটা... বড় নীরব করে দেয়...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।