জলের নেকড়ে - পিরানহা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৬/০৮/২০১১ - ৮:১৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘পিরানহা’ সম্বন্ধে অনেকেই হয়ত জানে, তবে বেশিরভাগ মানুষ হয়ত জানে না। কারন এটা আমাদের দেশে কম পাওয়া যায়। আমার এক বন্ধু কে জিজ্ঞেস করেছিলাম পিরানহা চিনে কিনা? ও বলল নাম শুনেছে তবে জানেনা। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, “এটা কি একটা পোকা?” এরকম ভুল ধারনা হইত অনেকেরই আছে। তাই আমি পিরানহা সমন্ধে কিছু বলতে ও জানাতে চাই।

না। পিরানহা কোন পোকা নয়, এটা একটা মাছ যা খুবই হিংস্র এবং ক্ষিপ্র। হিংস্র ও ক্ষিপ্র স্বভাবের কারনে পিরানহাকে বলা হয় “Wolf Of Water” বা “জলের নেকড়ে”।

পিরানহা সম্বন্ধে আমি জানি দশম শ্রেণীতে পরার সময়। তখন রাকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা প্রচুর পরতাম। এইরকম ই একদিন একটা গল্প পরার সময় ‘পিরানহা’ শব্দটা দেখি এবং গল্পেই পিরানহা সম্পর্কে দুই লাইন ছিল্ যে, পিরানহা ভয়ঙ্কর একটা মাছ। একটা আস্ত মহিষ সাবার করতে পিরানহার ২-৩ মিনিট সময় লাগে। পিরানহা সম্পর্কে আমার ধারণা এটুকুই ছিল। একদিন এক খবরের কাগজে দেখলাম , রুপচাদার নামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে নিসিদ্ধ পিরানহা। তখন থেকে পিরানহা নিয়ে জানার চেষ্টা করি। আমি যা জানতে পারলাম তাই দিয়ে লেখা শুরু করছি।

পিরানহা Animalia জগতের Chordata পর্বের প্রাণী। এটা স্বাদু পানির মাছ। পিরানহা সাউথ আমেরিকায় পাওয়া যায়। ভেনেজুএয়ালাতে এদের Caribes বলা হয়। এছাড়া পারাগুয়ে, আমাজন বেসিন অরিনক তে, গুয়ানুস এর নদীতেও পিরানহা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের কাপ্তাই লেকেও পিরানহার সন্ধান পাওয়া গেছে।

পিরানহার প্রজাতির সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছেনা, কারন এখনও নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হচ্ছে। তবে পিরানহার প্রজাতি আনুমানিক ৩০-৬০ বা তারও উপরে বলে মনে করা হয়। Pritobrycon, pygocentrus, pygopristis, serrasalmus এই চারটা প্রজাতি কে আসল পিরানহা বলা হয় তাদের বিশেষায়িত দাঁতের কারণে।

পিরানহা ঠাণ্ডা পরিবেশে বাঁচতে পারেনা। এরা অন্ধকার পরিবেশ পছন্দ করে। একারনে এরা পানির নিচে অন্ধকার জায়গাগুলোতে নিজেদের আড়াল করে রাখে। যদি কোন কারনে এরা নিজেদের আড়াল করতে না পারে বা আলোর মধ্যে এসে পরে তখন তারা বিব্রত হয়ে পরে ।
পিরানহারা এদের তীক্ষ্ণ দাঁত এবং মাংসের প্রতি ক্ষুধার্ততার জন্য বেশি পরিচিত। তবে গবেষণায় দেখা গেছে পিরানহারা শুধু মাংসাশী নয়, এদের মধ্যে কিছু শাকাসিও রয়েছে। আসলে Red bullies এর মত অল্পসংখ্যক প্রজাতি হল মাংসাশী। বাকিগুলো শাকাশি এবং এদের বলে herbivorses.

পিরানহা লম্বায় ২৫ সেমি. হয়ে থাকে। কিছু কিছু প্রজাতি ১ ফিট ৭ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। এদের উভয় চোয়ালে তীক্ষ্ণ দাঁতের একটি করে সারি রয়েছে। এদের দাঁত ত্রিকোণাকৃতির এবং ধারালো ব্লেডের মত যা দিয়ে এরা সহজে শিকারের মাংস ছিরে ফেলতে পারে। পিরানহারা সাঁতরায় একসাথে এবগ শিকারও করে একসাথে। পিরানহা এবং হাঙ্গরের একই অনুভূতি সিস্টেম। হাঙ্গর যেভাবে অনেক দূর থেকেও একবিন্দু রক্তের ঘ্রান বুজতে পারে ঠিক তেমনি পিরানহাও তা পারে। পিরানহার ক্ষিপ্র গতির একটি মাছ। এক নিমিষে এরা মানুষের হাতের আঙ্গুল ছিনিয়ে নিতে পারে!

একুরিয়াম মাছ হিসেবে পিরানহা ব্যবহার করা যায়। এর জন্য red belied, pygocentrus nattereri বেশ জনপ্রিয়। তবে এর কিছু মজার নিয়ম আছে। পিরানহা সবসময় এক গ্রুপ এ ৪, ৬, ৮, ১০ টা করে রাখা হয়। কারন ২ টা রাখলে তারা পরস্পর মারামারি করবে এবং যেটি দুর্বল ওটা মারা পড়বে। আবার বেজোড় সংখাও রাখা যাবে না। যদি ৩ টা রাখি তাহলে ২ টা মিলে একটা গ্রুপ হয়ে বাকি ১ টা কে মেরে ফেলবে। আর একটা ব্যাপার হল একুরিয়াম এর জন্য আনা এই মাছগুলো আনতে হই বাচ্চা আথবা পূর্ণবয়স্ক আবস্থায়। পিরানহাকে প্রতিদিন খাওয়াতে হয় টা না হলে তাদের মাঝের বন্ধুত্ত জানালা দিয়ে পালাবে এবং বেঁচে থাকার জন্য একে অপরের সাথে যুদ্ধ করবে।

পিরানহা কিভাবে সেকেন্ডের মধ্যে মানব দেহ অথবা পশুর দেহ নিজেদের আহারে পরিণত করে এ নিয়ে অনেক গল্প, কল্পনা আছে। Through The Brazilian Wilderness বইয়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট পিরানহা সম্পর্কে লিখেছেন--- “বিশ্বের সবচেয়ে হিংস্র মাছ হচ্ছে পিরানহা। সবচেয়ে ভয়ংকর মাছ- হাঙ্গর বা বারাকুডাস- সাধারানত তাদের চেয়ে আকৃতিতে ছোট প্রাণি আক্রমনকরে, কিন্তু পিরানহার দল অভ্যাসগতভাবেই তাদের চেয়ে আকৃতিতে বড় প্রাণি আক্রমন করে। অসতর্কভাবে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হাতের আঙ্গুল তারা মুহুর্তেই ছিনিয়ে নিতে পারে; তারা সাতারুদের কেটে ছিড়ে খেয়ে ফেলে। প্যারাগুয়ের প্রায় প্রতিটি নদীমাতৃক শহরে এমন লোক রয়েছে যাদেরকে এই পিরানহারা ছিড়ে নিয়েছে অল্প পরিমানে হলেও। কোন দূর্বল বা আঘাতপ্রাপ্ত মানুষ বা প্রাণিকে তারা একেবারে ছিড়ে খেয়ে ফেলবে মুহুর্তেই; কারণ পানির মধ্যে রক্তের উপস্থিতি তাদেরকে প্রায় পাগল করে দেয়। তারা আঘাতপ্রাপ্ত কোন পক্ষী বা প্রাণিকে একেবারে টুকরো টুকরো করে ফেলবে, অথবা মাছের কোন বড় লেজকে ছিড়ে ফেলবে; কিন্তু পিরানহারা হচ্ছে ছোট্ট শরীরওয়ালা ক্ষুদ্র মাছ যাদের রয়েছে বড় বড় দাঁতওয়ালা চোয়াল যা দিয়ে তারা খুব সহজেই যেকোন কিছু তাদের মুখের মধ্যে নিয়ে নিতে পারে। তাদের ব্লেডের মত ধারালো দাঁতগুলো হাঙ্গরের দাঁতের মত তীক্ষ্ণ আর তাদের চোয়ালের মাংশে রয়েছে অপরিসীম শক্তি। উম্মত্ত, ক্রোধান্বিত হলে এই মাছগুলো তাদের
দাঁতগুলো পরম গতিতে মাংশ ও হাড়ের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারে। ছোট্ট জালিসম্বলিত মাথা, তীক্ষ্ণ ভয়ংকর রক্ত চোখ আর নিষ্ঠুর শক্তিশালী চোয়াল নিয়ে এই মাছগুলো যেন দানবীয় শক্তির প্রতিরুপ। তীক্ষ্ণ ভয়ংকর চোখের মতই ধূর্ত এর গতি। এমন শক্তিশালী, হিংস্র, ক্রোধান্বিত প্রদর্শণী আমি পিরানহা ছাড়া আর কারো মাঝে দেখিনি। …”

তবে রক্তের গন্ধ না পেলে এরা কখনও মানুষ কে আক্রমন করেনা। যে নদীতে পিরানহা পাওয়া যায় ওইখানের স্থানীয়রা ওই নদীতেই দাড়িয়ে মাছ ধরে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আক্রমনের শিকার হয়নি। পিরানহারা বরং মানুষ এড়িয়ে চলে। তবে কাটা হাত বা পা নিয়ে বা শরীরের কোন অংশ নিয়ে পানিতে নামলে আক্রমন হতে পারে।

যদিও পিরানহা মানুষ আক্রমন করতে চায় না তবে সুযোগ পেলে ছাড়ে না। আর এরকম সুযোগ এসেছিলো ১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালের সকাল ৩.৩০ এ, ব্রাজিলে। একটা স্টিমার Sobral Santos II ৫৩০ জন যাত্রী এবং ২০০ টন মালামাল নিয়ে যাচ্ছিল। এবং বন্দর O’bidos Para এর কাছে স্টিমারটা ২৬০ ফিট গভীর পানিতে উলটে গেল। বন্দরের কাছেই ছিল আমাজন নদীর একটা অংশ যা পিরানহায় ভরা ছিল। স্টিমারটা উল্টানোর ফলে যাত্রীরা আঘাত পায়, তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে যায়। স্থান আর সময়ের যথাআর্ত সমন্বয়। পিরানহারা তাদের খাবার পেয়ে গেল। শুধু ১৮২ জন বাঁচতে পারল। বাকি ৩৪৮ জন জীবন্ত খাওয়া হয়ে গেল। মাত্র ৪ টা লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। আমাজনের রেকর্ড করা সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। তাহলে আপনারা বুঝতেই পারছেন কতটা ভয়ঙ্কর হলে ৩৪৮ টা মানব দেহ জীবন্ত খেয়ে ফেলা যায়।

আফ্রিকার কঙ্গোতে এমন পিরানহা পাওয়া যায় যেটা এক কামরে আপনার একটি পা শরীর থেকে বিছিন্ন করে নিজের মুখে পুরে নিবে। তাহলে কখনও কঙ্গোতে গেলে সাবধান। কঙ্গোর নদীতে সাঁতার অথবা প্যাডলিং এর জন্য যাবেননা। তাহলে কিন্তু সৎকারের জন্য আপনার দেহ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সম্প্রতি আমাদের দেশে একুরিয়াম এ রাখার জন্য পিরানহা আমদানি করা হয়। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যাবসায়ি এই ভয়ঙ্কর পিরানহা চাষ করছে যা আমাদের দেশের বাস্তুতন্ত্রকে নস্ত করে দিতে পারে। আমাদের দেশের জলীয় পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। এই পিরানহা চাষ ও বিক্রি আমাদের দেশে নিষিদ্ধ হলেও ঢাকার বাজারে এই মাছ পাওয়া যাচ্ছে এবং স্থানীয় ভাবে এদের বলা হয় ‘পিরানহা চান্দা’। পিরানহার ব্যাবসা যতই লাভজনক হোক এই ভয়ঙ্কর মাছ যাতে আমাদের দেশে আস্তে না পারে এদিকে সরকারের দৃষ্টি দিতে হবে।

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03am
24/08/2007 - 2:03am
24/08/2007 - 2:03am
24/08/2007 - 2:03am

মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আপনার এই লেখা কি অনুবাদ? অনুবাদ হলে মূল লেখার লিংক দিন। না হলে আর্টিকেলে ব্যবহৃত উদাহরণগুলোর সুত্র উল্লেখ করবেন প্লিজ। অনেক ক্ষেত্রেই একটু অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে।

লিঙ্কন এর ছবি

ধন্যবাদ মন্তব্য করার জন্য। এটা অনুবাদ না। যা লিখেছি প্রায় wikipedia থেকে।
www.vincelewis.net/piranha.html থেকেও কিছু কথা লিখেছি।

ধৈবত(অতিথি) এর ছবি

জলের নেকড়ে? জলের হায়না বললেই তো মনে হয় সবচেয়ে যুতসই হত।

লিঙ্কন এর ছবি

এটাকে বলা হয় "wolf of water". Wolf কে ত আমি হায়েনা বলতে পারিনা, যেহেতু কথাটা আমার না। ধন্যবাদ।

লিঙ্কন এর ছবি

এটাকে বলা হয় "wolf of water". Wolf কে ত আমি হায়েনা বলতে পারিনা, যেহেতু কথাটা আমার না। ধন্যবাদ।

ফাহিম হাসান এর ছবি

দেশে পিরানহা চাষের ব্যাপারে আপনার সাথে একমত। কিন্তু বাকি লেখাটুকু অতটা মনে ধরে নাই।

The piranha's reputation as a fearsome predator may not be fully deserved, scientists in the UK have announced.

- BBC

Piranhas have a fierce reputation - but it's a myth, say researchers who claim that the species shoals to evade predators not to engage in feeding frenzies.

- Cosmos

নিটোল ( অতিথি) এর ছবি

সূচনা হিসেবে ভালো। চালিয়ে যাও। হাসি

লিঙ্কন এর ছবি

ধন্যবাদ বন্ধু।

স্বপ্নহারা এর ছবি

পিরানহা থ্রিডি দেখেন চোখ টিপি

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

স্বপ্নাদিষ্ট এর ছবি

আমি দেখেছি..দেখে ভীতু পাইছি পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

-স্বপ্নাদিষ্ট
=======================
যে জাতি নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করে না, আল্লাহ তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।