কিছু মুহূর্ত

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০৫/০৯/২০১১ - ১০:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সকালে ঘুম থেকে উঠা, নাস্তাটা কোনরকমে গলধকরণ করে কাজের উদ্দেশ্যে পড়ি মরি ছুট, যানযটের সুবিশাল যন্ত্রণা পেরিয়ে কর্মস্থলে যথারীতি দেরিতে পৌঁছানো,.............অবশেষে রাতে ঘুম। তারপর আবার, আবার সেই সকালে ঘুম থেকে উঠা, যেন এক পূনপৌনিক সংখ্যার মত একই গৎবাঁধা রুটিনের জীবন। এর মধ্যেও কোন কিছু বুঝে উঠার আগে, না চাইতেই, হুট করে কিছু মুহূর্ত এসেছে জীবনে অসাধারণ হয়ে। মাঝে মাঝে স্মৃতির এলবাম উল্টিয়ে সেগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে টাইম মেশিনে করে যেন চলে যাই ঠিক সেই মুহূর্তটিতে! কিন্তু কে জানতে চায় আমার সে সব মুহূর্ত ফুহূর্তের কথা! যেমন কেউ জানতে চায় না, ফুটপাথে বসা নোংরা ভিক্ষুকটার একদিন হঠাৎ কারো কাছ থেকে পাওয়া ১০ টাকা পাওয়ার পরে কেমন লেগেছিল, সে কথা। অনেক দিন পরে ভাত খেতে পেরে সেদিন তার কত শান্তি লেগেছিল, সে কথা। কেউ তার কাছে জানতে চায় না, স্বামী যে তাকে লাথি মেরে চলে গেল, তারপরে কীভাবে চলছে তার জীবন। কেনই বা জানতে চাইব সে সব কথা আমরা? কী হবে এসব জেনে?

কেউ জানতে চায় না। তবুও আমার যে খুব বলতে ইচ্ছে করে সেই দিনের কথা। যেদিন আমাকে কেউ খেয়াল করে নি। আর আমি অনেক অনেক প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটি করতে করতে একটা প্রজাপতি ঠিক ধরে ফেললাম। অথবা সেই দিনটির কথা, যেদিন সবাই মিলে চিড়িয়াখানায় ঘুরতে ঘুরতে এসে দাঁড়ালাম সাদা ময়ূরের খাঁচাটার সামনে। ছোট্ট আমি খাঁচার বাইরের রেলিং পার হয়ে চলে গেলাম একদম খাঁচের কাছে। আর কী হলো! তক্ষুনি সাদা ময়ূরটা ঝমঝম শব্দ করে তার পেখম মেলে দিল! শিশু মনের একটা প্রবল বিশ্বাস ছিল, ময়ূরটা আমাকে দেখেই পেখম মেলেছিল।

অথবা সেদিনের কথাও বলা যায়, প্রথম যেদিন মেলামাইনের বাটি দেখলাম নিজের চোখে। বারবার বাটিটা মাটিতে সশব্দে ফেলে পরীক্ষা করছিলাম, ভাঙ্গে কিনা। এবং সত্যিই বিজ্ঞাপণে দেখা প্লেটটার মত এটাও ভাঙ্গল না। কী বিষ্ময়! অথবা স্কুলের ক্লাসে টিচারের চোখ এড়িয়ে একটার পর একটা খাতার দেয়াল তুলে পুতুলের জন্য ঘর তৈরি করা। ইরেজারের বালিশে পেন্সিল পুতুলগুলোকে ঘুমুতে দেওয়া। রুমাল দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ, দোলনা, ফুল কত কী বানানো!

অথবা সেদিনের কথা, যেদিন ক্লাস টিচার গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে পড়ানো শেষে বাড়ির কাজ দিলেন, রাতের আকাশে গ্রহ আর নক্ষত্র খুঁজে বের করা। সেদিন সন্ধ্যাই তো প্রথম আমার তারা পর্যবেক্ষণ শুরু। আর সেদিনই এক আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করে ফেলি। তিনটি তারা এক সরলরেখায় পরস্পরের সাথে একই দূরত্ব রেখে কী সুন্দর জ্বলজ্বল করছে! তারপর আরেকদিন, আরেকদিন, আরো একদিন, প্রতিদিন, যখনি তাকিয়েছি রাতের আকাশে সেই তিনটি তারা একইভাবে আমাকে দেখে হেসেছে। আকাশে তাদের অবস্থান মাঝে মাঝে পরিবর্তন হত। এও এক বিষ্ময়! ঐ তিন তারা দেখতে দেখতেই প্রশ্নবোধক আকৃতির সপ্তর্ষিমণ্ডলটা চিনে ফেলি আমি। হঠাৎ ঝাপসা হয়ে, আবার একসাথে হঠাৎ জ্বলে ওঠা এই সাতটি তারা সত্যিই কী যেন একটা প্রশ্ন করে! ঠিক বোঝা যায় না।

অথবা সেদিনের কথা, গ্রামে বনের পথে হাঁটতে হাঁটতে এমন জায়গায় পৌঁছে যাওয়া, যেটা অনেকদিন আগেই আমার স্বপ্নে দেখা ছিল! অথবা, সেইদিন, যেদিন বড়মামার বিয়ে উপলক্ষে সব কাজিনরা একসাথে হৈ হল্লা করে বেড়াচ্ছি। এমন সময় সেই মামা আমাদের জন্য নিয়ে এলেন এক আশ্চর্য খেলার সামগ্রী। এক প্যাকেট ভর্তি ভোমড়া। এগুলোর লেজে সুতো বেঁধে, এক নিষ্ঠুর খেলা খেলে সে সময় খুব আনন্দ পেতাম। কিন্তু ভোমড়া উড়ে চলে যেত বলে আমরা ধরতে পারতাম না সব সময়। ঠিক ঐ সময় হাজার হাজার ভোমড়া পেয়ে আমাদের মুহূর্তটা মামা কীভাবে হাজার রঙ্গে বর্ণিল করে দিয়েছিলেন। অথচ এতদিনেও মামাকে জিজ্ঞেসই করা হলো না, এত ভোমড়া তিনি কোত্থেকে কীভাবে যোগাড় করলেন!

অথবা সেদিনটির কথা বলি, যেদিন এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি হয়েছিলাম, আমরা দুই কাজিন। সম বয়সী দুই ছোট্ট কাজিন। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলার জুড়ি নেই আমার বোনটার। এত মিথ্যা কথা বলতে পারে! আর আমিও এমন হাঁদারাম সব বিশ্বাস করতাম। ওর কাছে প্রতি রাতেই নাকি পরীর রানী আর পরীরা আসে। রাত হলেই ও আমাকে দেখাবে। কিন্তু প্রতিরাতেই ও এমন মরার মত ঘুমাতো যে আমার আর পরী দেখা হত না।ছুটি শেষ হয়ে যেত বলে ওর কাছ থেকে বিদায় নিতে হত। এই করতে করতে আমরা দুজনেই শৈশব পার হয়ে কৈশরে পা রাখলাম। অনেকদিন পরে আবার দেখা হলো আমাদের। আজ কঠিন এক বোঝাপড়ার দিন, আমাকে এতদিন ধরে এত মিথ্যা কথা বলেছে ও! কোন পরীই আসলে ওর কাছে আসে নি। এদিকে এতদিন আমার কাছে বলা মিথ্যা যদি আমি টের পেয়ে যাই, এই লজ্জায় আর ভয়ে আমার অপরাধী বোনের মুখ গেছে শুকিয়ে।

এমনই সহজ, সরল, সুন্দর কতগুলো মুহূর্ত এসে ধরা দিয়েছে আমার কাছে। সে মুহূর্তগুলো আসলে যে কত সুন্দর তা শুধু অনুভব করতে পারি আমিই, আর কেউ নয়।

৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১

রাজকন্যা


মন্তব্য

নিটোল. এর ছবি

বাহ! সুন্দর লিখেছেন। ভালো লাগল।

guesr_writer rajkonya এর ছবি

বড়ই শরমিন্দা হইলাম। :''>
ধন্যবাদ, লেখাটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য। হাসি

ড্যানিয়েল এর ছবি

নির্মল ভাবে হৃদয় ছুঁয়ে, গেলো

guesr_writer rajkonya এর ছবি

ধন্যবাদ।

সাইফ জুয়েল এর ছবি

অনেক সুন্দর কিছু মুহুর্তের কথা বললেন। অনেক সুন্দর করে লেখেনতো আপনি? পড়ে বেশ ভাল লাগল। লেখালেখি চলুক।

guesr_writer rajkonya এর ছবি

ধন্যবাদ, আপনাকেও লেখাটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য।

মিলু এর ছবি

এটাই কি আপনার প্রথম লেখা? ভালো হয়েছে। লিখতে থাকুন হাত খুলে। শুভকামনা।

guesr_writer rajkonya এর ছবি

জ্বী, সচলে এটা আমার প্রথম লেখা। ধন্যবাদ আপনাকেও।
------------------------------------------------------------------------------------------------
http://www.somewhereinblog.net/blog/eijeduniya/29428746

রুমঝুমা এর ছবি

চলুক হাসি

guesr_writer rajkonya এর ছবি

হাসি

আশালতা এর ছবি

বাহ্‌, টিপসে কাজ হয়েছে দেখছি। রাতারাতি আপনার লেখা পেয়ে গেলাম। হাসি লেখা ভালো হয়েছে, আরও লিখুন।

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

guesr_writer rajkonya এর ছবি

হাসি সে আর বলতে বলতে! ধন্যবাদ, লেখাটি পড়ে সময় নষ্ট করার জন্য। হাসি

guesr_writer rajkonya এর ছবি

আরেকটি টিপস দিতে পারেন কি, আশালতা আপু? ফেসবুকের নোটস ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ করা হয় নি এমন কোন লেখা কি সচলে দেওয়া যাবে?

আশালতা এর ছবি

আমি ঠিক মত জানিনা রে ভাই, সচলের 'নীতিমালা' পড়ে দেখতে পারেন, অথবা contact at sachalayatan এ মেইল করে জিজ্ঞাস্য জেনে নিতে পারেন। যদ্দুর মনে হয়, যাবে।

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

guesr_writer rajkonya এর ছবি

হাসি ধন্যবাদ আপু।

ইস্কান্দর বরকন্দাজ এর ছবি

যাবে

(যদিও আমি আশালতা’পু না, তারপরও বললাম। তবে মডুরা প্রকাশ করবে কিনা জানিনা। চোখ টিপি )

guesr_writer rajkonya এর ছবি

আচ্ছা, দেখি তাহলে...ধন্যবাদ।

অরিত্র অরিত্র এর ছবি

খুব ভাল লাগল।

guesr_writer rajkonya এর ছবি

হাসি খুব ভাল লাগার মত কোন লেখা কি সত্যিই এটা? আমিও তো পড়ি বিভিন্ন লেখা। এটা গড়ে ভালো একটা লেখা। এই চলে আর কি!
তবে এটা পড়েই যদি কারো খুব ভাল লাগে, তবে আমারও যে খুব ভাল না লেগে যায় না!
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ইস্কান্দর বরকন্দাজ এর ছবি

হাসি

guesr_writer rajkonya এর ছবি

হাসি

ঘুম কুমার এর ছবি

মুহূর্তগুলো যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম।
চলুক

guesr_writer rajkonya এর ছবি

হুম, আপনি হলেন ঘুম কুমার। হো হো হো মুহূর্তগুলো আপনি চোখের সামনে দেখতে পাবেন না তো কে দেখতে পাবে?
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

যুমার এর ছবি

'কিছু মুহূর্ত' তুলোবীজ ওড়া শৈশবের মতই স্বপ্নালু হয়েছে।

guesr_writer rajkonya এর ছবি

শৈশবের দিকে তাকালে মনে হয় আসলেই কি ঐ দিনগুলি সত্যি ছিল আমার? নাকি ঘুমের মাঝে দেখা স্বপ্ন ছিল?

পাগল মন এর ছবি

ভালো লাগল। চলুক
লিখতে থাকুন।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

guesr_writer rajkonya এর ছবি

স্মৃতিচারণমূলক লেখাগুলো সাধারণত ভালই হয়। হাসি কারণ স্মৃতি সব সময়ই মধুর। কিন্তু শুধু

ভালো লাগল।

বলে চলে গেলে চলবে না। কেন ভাল লাগলো, সেটাও বলতে হবে। ব্যাখ্যা চাই হো হো হো

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত জন্ম দেয় নতুন নতুন বিস্ময়ের! সে জন্যেই তো বেঁচে থাকা।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

guesr_writer rajkonya এর ছবি

যত দিন যায় বিস্মিত হবার ক্ষমতা তত কমে। মন খারাপ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।