তমসো মা জ্যোতির্গময়

ওডিন এর ছবি
লিখেছেন ওডিন (তারিখ: শনি, ১২/১২/২০০৯ - ৬:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঋগবেদের এই শ্লোকটা আমার বেশ প্রিয়। ওপরের অংশটার অর্থ অনেকটা এইরকম- আমাকে আঁধার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাও। পরের অংশগুলো আরও সুন্দর। আমাকে অসত্য থেকে সত্যের দিকে নিয়ে যাও। আমাকে নশ্বরতার থেকে অমৃতের পথে নিয়ে যাও। এইরকম সব ভাল ভাল কথাবার্তা। আমি ধর্মের প্রথাগত কোন আচার মেনে না চললেও মাঝে মাঝে প্রার্থনা করার চেষ্টা করি। আর তখন এই শব্দকয়টাই বেশি ব্যবহার করা হয়। আমাকে অন্ধকার থেকে মুক্তি দাও। আর কিছুই চাই না- আমাকে আলোর পথ দেখাও।

আমি নিজেকে একজন প্রগতিশীল মানুষ বলেই মনে করি। সবসময় চেষ্টা থাকে আলোর পথে হাঁটবার। নিজেকে সমস্ত রংবর্ণধর্মজাতির বাইরে দেখতে চাই। কিন্তু একটা জায়গায় এসে সব থমকে যায়। সব যুক্তিতে, সব বিশ্বাসে ফাটল ধরে। তীব্র ঘৃণায় আমি অন্ধ হয়ে যাই। একটা দেশ, একটা জাতির কাছে আমি পরিণত হই প্রচন্ডরকমের ডানপন্থি বর্ণবাদি এর পশুতে।

আমি তিরিশ লাখ দুই লাখ বুঝি না, এক কোটি শরনার্থী চিনি না। আমি শুধু চিনি পুরোনো ঢাকার এক সরু গলির এক পরিবারকে, যাদের ওপর মার্চের এর বিকেলে নেমে এসেছিলো গাঢ় অন্ধকার। আমি চিনি সেই কিশোরীকে- বিক্রমপুরের জলাভূমি দিয়ে পালানোর সময় যার হাত গলে দুই বছরের ছোট ভাই পড়ে যায়- যাকে পরে আর কখনো পাওয়া যায়নি- সেই কিশোরী, এখন বৃদ্ধপ্রায়, এখনও প্রতি বছর তার হারানো ভাইয়ের জন্মদিন পালন করে যায়। আমি চিনি সেই তরুণকে- যে তার পিতা আর দুই ভাই আর আরো নয় জনকে চোখের সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে- এই দেশেরই কালো মাটিতে, যে নিজের হাতে শত্রু নিধন করেও এখন আর নিজেকে 'মুক্তিযোদ্ধা' বলে পরিচয় দেয় না, কারন শব্দটা এখন একটা প্রহসনের কাছাকাছি।

এই অন্ধকার নামিয়ে এনেছিলো তাদেরই নিজেদের দেশের সুশিক্ষিত সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী- কোন 'কতিপয় বিপথগামি সেনা কর্মকর্তা' না-

আর এই অন্ধকার এখনো মিশে আছে আমার রক্তে।

আমি এই অন্ধকার চাই না। আমি চাই আমার ভেতরটা ভরে উঠুক তীব্র মায়াময় আলোতে। যেই আর্ত পাকিস্তানী আমার কাছে সাহায্যের জন্য আসবেন তাকে যেন আমি সেদিনের মত ফিরিয়ে না দেই, আমার জীবন দিয়ে হলেও সেবা করতে পারি। যেই সেবা করার শপথ আমি নিয়েছি।

তাই আমি ঈশ্বরের কাছে আর কিছুই চাই না, শুধু এই অন্ধকার থেকে মুক্তি চাই।

তবু কেন যেন মনে হয় স্বয়ং ঈশ্বরেরও এই অন্ধকার দূর করার সাধ্য নেই। এই অনন্ত আঁধারের মাঝেই আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।

হে আলোকিত পিতা। কেন তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে-


মন্তব্য

সাইফ তাহসিন এর ছবি

ওরে পাগলা, বাকরুদ্ধ হইয়া গেলাম। এতদিন কই গায়েব হইছিলা বস!
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদ্বপি গরীয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

ওডিন এর ছবি

একটু ঘুরতে গেসিলাম ভাই। এখন ফিইরা দিনে বিশ ঘন্টা করে ঘুমাইতেসি। আপ্নের বাকরুদ্ধ হোক আর যাই হোক আঙ্গুল যেন রুদ্ধ না হয়।
___________________________________________________
আসলে কি ফেরা যায়?

হাসিব এর ছবি

শব্দটা কি ঋকবেদ নাকি ঋগবেদ ?

ধুসর গোধূলি এর ছবি
ওডিন এর ছবি

নিচে উত্তর পাইসেন আশা করি। আর প্রবাব্লি আমি ভুল বানান লেখসি। 'ঋগ্বেদ' হবে হয়তো...আবার 'ঋগবেদ' ও তো লেখা দেখি প্রায়ই। কি জানি।
______________________________________
আসলে কি ফেরা যায়?

হিমাদ্রি শেখর রায় এর ছবি

ক অথবা গ এর গায়ে হসন্ত দিলে দুটোই ঠিক। তবে সংস্কৃতের দৃষ্টিতে ঋগ্বেদ এটাই ঠিক।

সাবিহ ওমর এর ছবি

সত্যজিৎ রায়ের 'যখন ছোট ছিলাম' বইটাতে এই মন্ত্রের একটা মজার স্মৃতিচারণ আছে। ওটা নাকি এভাবে পড়া হত, "অসত্য হইতে সত্যে-তে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে আলোকে-তে লইয়া যাও।"

গৌরীশ রায় [অতিথি] এর ছবি

রামকৃষ্ণ মিশনের একটি প্রভাত সঙ্গীত মনে পড়ল ।

অসৎ হইতে মোরে সৎ পথে নাও ।
জ্ঞানের আলোক জ্বেলে আঁধার ঘুচাও ।।

ঝরিয়া পরুক শান্তি চরাচর ময় ।
চিরশান্তি পরিমলে ভরুক হৃদয় ।।

তুলিরেখা এর ছবি

অসাধারণ লেখা। অসংখ্য স্যালুট।

ধূ গো র প্রশ্নের জবাবে-এই বেদের মন্ত্রগুলোকে ঋক বলে, ঋকের সমাহার বলে এই বেদ ঋক বেদ, সন্ধি করে হয় ঋগ্বেদ। ঋক + বেদ= ঋগ্বেদ

পরের বেদ সামবেদ, এটা গানের অংশের সমাহার।
তার পরের অংশ যজু, যজুর্বেদ। এটা যাগযজ্ঞের নিয়ম কানুন নিয়ে।
চতুর্থবেদ হলো অথর্ববেদ, এটা নানারকম জাদু বশীকরণ মারণ উচাটন চিকিৎসাবিদ্যার রুডিমেন্টারি কিছু জিনিস এইসব নিয়ে। এর থেকে ভালো আর জীবনোপযোগী জিনিসগুলো নিয়ে পরে আরো উন্নতি হয়ে আয়ুর্বেদ হয়, সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান।

বেদ কথাটার অর্থ হলো জ্ঞান, জানা, জানতে পারা।

আগে এরকম সুন্দর চারখানা কোর কোর্সে ভাগ করা জিনিস ছিলো না, সব মিলেমিশে ঘন্ট পাকিয়ে ছিলো। একে একে দক্ষ লোকেরা ভাগ করেছেন। বেদ বিভাজনকারীদের বলা হতো ব্যাস। একজন ব্যাস খুব বিখ্যাত, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, যিনি মহাভারত লেখেন। বেদ বিভাজন করে চারখানা নিটোলভাগে ভাগ করার ক্ষেত্রে ইনি সবচেয়ে সফল।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- খাইছে, কতো বেদ দেখছো নি। আয়ূর্বেদ বলে কোনো বেদ নাই? যা অধ্যয়ন করলে আয়ু আসমানে গিয়া ঠেকে! চিন্তিত
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি
আছে। ডাক্তারি(প্রাচীনকালের ডাক্তারিবই ছিলো আয়ুর্বেদ।)। এখন ডাকাতি আর ডাক্তারিতে তফাৎ কম। তবে কিনা পয়সা আসমানে ঠেকলেও আয়ু কখনো আসমানে ঠেকে না, ভাগ্যিস ঠেকে না!
সুস্থ সুন্দর নাচগান খানাপিনা ওয়ালা যৌবন কাটিয়ে ছেলেপিলেনাতিপুতি দেখে খানিকটা বুড়া হয়ে মরে যাওয়াই তো ভালো। নতুন আরো ভালো নাকমুখচোখমাথা নিয়ে আবার জন্মানো, পুরানো ভুলগুলো রেক্টিফাই করে ফেলার একটা সেকেন্ড চান্স। হাসি

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ওডিন এর ছবি

আয়ু আসমানে ঠেকলে খবরই ছিলো! নাচগানখানাপিনাওয়ালা জীবন কাটিয়ে বুড়ো হবার আগেই পালাতে চাই। দেঁতো হাসি
______________________________________
আসলে কি ফেরা যায়?

তুলিরেখা এর ছবি

যদি দোষ না ধরেন, বলি চারখানা লাইন। "অসদো মা সদ্‌গময়/ তমসো মা জ্যোতির্গময়/ মৃত্যোর্মা অমৃতম্‌ গময়/ আবীরাবীর্ম এধি।"

"অসত্য হইতে মোরে সত্যে লইয়া যাও/ আঁধার হইতে মোরে আলোকে লইয়া যাও/ মরণ হইতে মোরে অমৃতে লইয়া যাও/ হে আবি:, হে প্রকাশ, তুমি তো চিরপ্রকাশ, একবার তুমি আমার হও, আমার হইয়া প্রকাশিত হও।"

এটা উপনিষদেও আছে। রবীন্দ্রনাথের অনেক প্রবন্ধে এই কথাগুলি এসেছে। উপরের অনুবাদটা আমি ওঁরই একটা লেখা থেকে দিলাম।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ওডিন এর ছবি

হায় হায় দোষ ধরার কেম্নে কি? আমি দ্বিতীয় লাইনটা ব্যবহার করেছি কারন এটাই আমার সবচে পছন্দ।
______________________________________
আসলে কি ফেরা যায়?

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

লেখাটা পড়ে বেদ পড়তে মঞ্চায়।

ওডিন এর ছবি

অথর্ববেদ পড়ে দেখতে পারেন। খুবই ইন্টারেস্টিং।
______________________________________
আসলে কি ফেরা যায়?

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ওডিন এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ নজরুল ভাই।
______________________________________
আসলে কি ফেরা যায়?

ওডিন এর ছবি

পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। আমার প্রায় সব লেখার মতই এটাও একটানে লেখা- তাই এখন পড়তে গিয়ে দেখছি অনেকটাই স্বার্থপরের মত কিছু কথা বলে ফেলেছি, এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আর কিছু বানান ভুলও চোখে পড়লো। লেখাটা আমার হারানো প্রিয়জনদের জন্য, যাদের আমি কখনও দেখি নি। ডিসেম্বরের বারো তারিখে শেষ মৃত্যুটা হয়। তারা ঘুমোক শান্তিতে। স্লিপিং ফিল নো মোর পেইন, অনলি দ্য লিভিং আর স্কারড।

_________________________________________

আসলে কি ফেরা যায়?

মৃত্তিকা এর ছবি

আমাদের ভেতর আর বাহির উভয়-ই আলোকিত হোক, এই প্রার্থনা...........

দময়ন্তী এর ছবি

ভাল লেখা৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

দ্রোহী এর ছবি

লেখা ভালো হয়েছে।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

জোস্!!

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ওডিন এর ছবি

জোস্ কি না জানি না কিন্তু নোবডি উইল রিয়েলাইজ হোয়াট উয়ি হ্যাড টু গো থ্রু। তারপরেও।

ধন্যবাদ মুর্শেদ ভাই।
______________________________________
আসলে কি ফেরা যায়?

সুরঞ্জনা [অতিথি] এর ছবি

ভাল লাগলো ভাই।
হাসি

ওডিন এর ছবি

সাবিহওমরভাই, গৌরীশদা, দময়ন্তীদি, মৃত্তিকা, দ্রোহীভাই, মুর্শেদভাই, সুরঞ্জনা- সবাইকে ধন্যবাদ। প্রার্থনা করি এইরকম ঘৃণা যেন আপনাদের বয়ে বেড়াতে না হয়। ভালো থাকবেন সবাই।

______________________________________
আসলে কি ফেরা যায়?

সাফি এর ছবি

ওডিন চমৎকার লেখা, খুব ভাল লাগলো। বেদ যে এতগুলো এটাও জানা হয়নি। আপনার ধর্মশালা পরবর্তী ভ্রমণের কি হল?

হরফ এর ছবি

তমসো মা জ্যোতির্গময়
এই শ্লোকটা মনে হয় বৃহদারণ্যক উপনিষদদে আছে। বেদে স্পেসিফিক দেব/দেবীর বর্ণনা আছে আর উপনিষদে নিরাকার। বেশ লাগছে আপনার ভ্রমণ বৃত্যান্ত।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

তমসো মা জ্যোতির্গময় চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।