পাঠকচরিতমানস [দ্বিতীয় পর্ব]

ওডিন এর ছবি
লিখেছেন ওডিন (তারিখ: রবি, ০৩/০৮/২০১৪ - ১:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার এই অতিক্ষুদ্র জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডির ঘটনাটা ঘটে উনিশশো সাতানব্বই সালে। আমরা তখন পাঁচ বছর বরিশাল থেকে ঢাকায় শিফট করছি, হাজার খানিক কার্টন ট্রাঙ্ক স্যুটকেস এর মধ্যে আমার বইভর্তি চারটা কার্টন ছিলো। সেইটার একটাতে আক্ষরিক অর্থেই টিফিন না খেয়ে জমানো টাকায় বরিশাল এর তরুণ লাইব্রেরি থেকে কেনা ততদিন পর্যন্ত বের হওয়া সব তিন গোয়েন্দা, পঞ্চাশটার মতন সেবা অনুবাদ, তখন পর্যন্ত বের হওয়া কিশোর পত্রিকা আর সবগুলো কিশোর ক্লাসিক ছিলো। রাজ্যের যতসব জিনিসপত্র আর আমার তিনটা কার্টন ঢাকায় পৌছালেও অজ্ঞাত কোন এক কারণে সেবার বইভর্তি আমার সেই একটা কার্টন আর ঢাকায় এসে পৌছালো না।

অধিক শোকে নাকি মানুষ পাথর হয়, আমি পুরা জম্বি হয়ে গেলাম।

মোটামুটি হপ্তাখানিক লেগেছিলো আমার সেই শক কাটিয়ে উঠতে। এরপরের কয়েকটা বছরে নূরজাহান রোডের ইসলামিয়া লাইব্রেরীতে প্রায় প্রতি হপ্তায় ঢুঁ দিয়ে দিয়ে তিন গোয়েন্দা আর অনুবাদ আর ক্লাসিক এর অনেক ঘাটতি পূরন করতে পারলেও সেই আশির দশকের টাইপফেসে ছাপা 'আসল' সেবার বই কি আর পাওয়া যায়? এরপরেও মাঝে মাঝে কণ বইয়ের দোকানের গভিরে খুঁড়োলে কিছু রত্ন যে পাওয়া যায় না, তা না। তবে সেইটা একেবারেই যাকে বলে কালেভদ্রে।

ইন্টারনেট জিনিসটা অদ্ভুদ। ইন্টারনেট বিজ্ঞাপন জিনিসটা আরো অদ্ভুদ। হেন কিছু নাই যা ইন্টারনেটে বিক্রি হয় না। ইন্টারনেটে ওয়েপন গ্রেড প্লুটোনিয়াম থেকে শুরু করে কনট্যাক্ট কিলার পর্যন্ত ভাড়া পাওয়া যায়, পুরোনো সেবার বই তো পাওয়া যেতেই পারে। গতকাল বিকেলে হঠাত করেই এইরকম একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়লো। জনৈক ভদ্রলোক তার কালেকশনের অনেক পুরোনো বই বিক্রি করে দিচ্ছেন। বেশিরভাগই তিন গোয়েন্দা, কুয়াশা , মাসুদ রানা আর ওয়েস্টার্ন। কিন্তু কিছু মণিমাণিক্যও আছে। রবিনহুড এর অরিজিনাল এডিশান। পচাব্দি গাজি আর রকিব হাসান এর শিকারকাহিনী। সবকয়টা জুল ভার্ন আর টারজান। মাসুদ মাহমুদ এর ক্রিকেটরঙ্গ। আরো অনেক অনেক দুর্দান্ত সব বই। সব অরিজিনাল আশির দশক এর এডিশানগুলো। একশো পয়ত্রিশটা তিন গোয়েন্দা , একশো বাইশটা ওয়েস্টার্ন, একশো একাত্তরটা মাসুদ রানা আর অনেক কয়টা কুয়াশা সহ পাঁচশ র ওপরে বই। এই সুযোগ হারানো যাবে না।

বিজ্ঞাপনে দেয়া নাম্বার ধরে ভদ্রলোককে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা গেলো। অন্য একটা কাজে তারেক অণু র সাথে কথা হচ্ছিলো। এক্সাইটমেন্টের চোটে ওনাকে সব ফাঁস করে দিয়ে মনে মনে একটু পস্তাতেও লাগলাম। লম্বু বেটা না আমার আগে গিয়ে সব হাপিশ করে দেয়! অণু দা অবশ্য আমার মতো খারাপ লোক না, উনি বেসিকালি অত্যন্ত ভদ্র একজন লোক। উনি আমার সাথে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন, সম্ভব হলে বইগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখবেন আর ওনার প্রজেকট এর জন্য বই এর প্রচ্ছদ এর ছবি তুলবেন। পরে অবশ্য কথাবার্তায় বের হলো উনি মাসুদ রানা আর ওয়েস্টার্ন সিরিজ এর বইগুলো নিতে ইন্টারেস্টেড। আমার এতে কোন সমস্যাই নাই, কারণ আমি রানা ওয়েস্টার্ন কোনটাই পড়ি না।

আজকে সকালবেলা অণু'দা আর ইনাম ভাই এর সাথে ব্রেকফাস্টাড্ডার পরে 'মগবাজার' এর দিকে রওনা দিলাম। অলি গলি এইসব পার হয়ে একটা ফাঁকামতন জায়গায় গাড়ি রেখে তস্য গলি ইত্যাদি পেরিয়ে বড় মগবাজার এর গলি ধরে কার্টন নিয়ে যখন হাঁটছি, পেছনে হাঁটতে থাকা দুই পিচ্চির কথোপকথন কানে এলো।

'-ক'তো, এই বাশকোগুলার ভেতরে কি আছে?'
-টেলিভিশন?'
-'আরে নাহ, কিচ্ছুনাই, ওইগুলা খালি। দ্যাহস না বাশকো লয়া কেমনে বগার মতন যাইতাছে'

'বগার মতন' হেঁটে হেঁটে যখন ভদ্রলোকের বাসায় পৌঁছলাম, তখন একেবারে যাকে বলে গনগনে দুপুর। বইয়ের মালিক খুবই মাইডিয়ার টাইপের একজন মানুষ, দুইজন অতিদুরন্ত দেবশিশুর পিতা। এবং আরো দেখা গেলো যে উনি অনেক দুষ্প্রাপ্য অনুবাদ আর ক্লাসিক এর ফার্স্ট এডিশান নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন। আমাদের শত অনুরোধেও উনি সেইগুলো হাতছাড়া করতে রাজি হলেন না, শুধু হাতে নিয়ে ইট্টু দেখতে দিলেন। (নিষ্ঠুর ছোটলোক আরকি, তবে উনি আমাদের দুর্দান্ত চা আর টা খাইয়েছিলেন অবশ্য)

আমরা অনেক গল্প আর আরো অনেক বই উল্টেপাল্টে দেখার পরে সেবা হরর, কুয়াশা আর তিন গোয়েন্দা বাদে সব বই নেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম। উনি অবশ্য ওনার বিজ্ঞাপনে দেয়া পাঁচশ বইই একসাথে বিক্রি করতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু তিন গোয়েন্দার প্রায় সবই ভলিউম হওয়াতে আমরা আর সেইগুলা নিলাম না। শেষমেষ আমাদের কেনাকাটা দাঁড়ালো প্রায় সাড়ে তিনশো বই।

আর্থিক বেপারসেপার চুকে যাওয়ার পরে কার্টন দুইটায় বই ভরে যখন কোমর বাঁকিয়ে ল্যাগব্যাগ করতে করতে ফিরে আসছি, দেখি দুই পিচ্চি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। নিশ্চই আমাদের ডাকাত ভাবছিলো আরকি। অণুদাকে ওনার ভাগের বই পরে দেবো, এইসব বলে ভুজুংভাজুং দিয়ে ওনার পয়সায় আইসক্রিম খেয়ে ওনাকে বসুন্ধরা সিটিতে ফেলে রেখে বাসায় চলে এলাম।

আমার আম্মাজান এইসব দেখলে ফিট হয়ে যেতেন। ফরচুনেটলি আজকে উনি আশেপাশে ছিলেন না। তবে ওনার বদলে বছরখানিক ধরে আরেকজন আবির্ভূতা হয়েছেন। ওনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দারোয়ান ড্রাইভার ইত্যাদির সাহায্যে দুইমণি দুইটা কার্টন নিয়ে লিভিং রুম কাম আসন্ন লাইব্রেরিতে ফেলা গেলো।

রাত দশটা থেকে এখন পর্যন্ত বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখলাম। নিজের জন্য যেগুলো রেখেছি সেগুলো তো আছেই, এখন কেনো যেনো মনে হচ্ছে মাসুদ রানা আর ওয়েস্টার্নগুলোও নিজের কাছেই রেখে দেই। অণু'দা তো ছন্নছাড়া মানুষ। ওনাকে এইসব বইপত্তর এর মায়ার জড়িয়ে ফেলাটা একদম ঠিক হবে না হাসি
_______________________________________________________________________________
তিন অগাস্ট, রবিবার , রাত দেড়টা


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

শেষ লাইনটা পড়ে হা-হা-হা-হা করে হেসে গেছি যতক্ষণ পেরেছি। শয়তানী হাসি
প্রবল উৎকন্ঠা নিয়ে পড়েছি লেখাটা। ভাল লাগল যে আপনি বইগুলো কিনতে পেরেছেন।
শেষবারের আগের বার দেশ থেকে আসার সময় বাছাই করা নানা রকমের বই ভর্তি বাক্সটা শিকাগো বিমানবন্দর পর্যন্ত আসার পর আর আমাদের শহরের বিমানবন্দরে এসে পৌঁছালনা। পরের বার অসুস্থ ছিলাম, কিছু আনতে পারিনি। আমার পক্ষে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে রয়ে গেছে। ঘনাদা সমগ্র - ও হো হো , আর পাব না কোনদিন ওঁয়া ওঁয়া

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ওডিন এর ছবি

হেহেহেহেহে বইগুলো যখন একবার আমার ঘরে আসতে পেরেছে, অণু'দার হাতে এইগুলার যেতে খবরই আছে দেঁতো হাসি

বই হারানোর যে দুঃখ, এইটা আসলে এইরকম অবস্থায় যে না পড়েছে, তারা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না

তারেক অণু এর ছবি

বই সংগ্রহের মজাই আলাদা, যার সাথে অন্য কোন কিছুরই তুলনা হয় না। তবে সেবার পুরাতন বইতে প্রছদ ঠিক না থাকলে ভাল লাগে না, সেই প্রচ্ছদগুলোর সাথেই না জড়িয়ে আছে কত রঙিন স্মৃতি আর ধূসর দীর্ঘশ্বাস।

ওয়েস্টার্ন পড়েন মিয়াঁ, না হলে বোহেমিয়ান হবেন কীভাবে?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

হারিয়ে যাওয়া বই, পোকায়/ইঁদুরে কেটে ফেলা বই, পানিতে ভিজে নষ্ট হওয়া বই, বাড়ি বদলের সময় বেহাত হওয়া বই, না বলে নিয়ে যাওয়া বই, পড়ার নাম করে নিয়ে ফেরত না দেয়া বই - এই সবগুলোর জন্য যদি কাঁদতে বসি তাহলে আমার চোখের পানিতে বুড়িগঙ্গার সব ময়লা দূর হয়ে নদীর বুক টলটলে নোনা জলে ভরে উঠবে।

বাংলাদেশের পুরনো বইয়ের দোকানের বেশির ভাগ 'নাই' হয়ে গেছে, আর বাকিগুলো গাইড বইয়ের দোকান হয়ে গেছে। শেষ বার কোলকাতা গিয়ে দেখি সেখানকার অবস্থাও তথৈবচ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নির্ঝর অলয় এর ছবি

চলুক

নির্ঝর অলয় এর ছবি

আপনার এই সিরিজটা দুর্দান্ত।
তিন গোয়েন্দার মজাটা আমি নিতে পারি নি। ক্লাস টু থেকে আমি প্রদোষ মিত্তিরের ভক্ত, ফোর-ফাইভ থেকে শার্লক। আমার দাদা খুবই তিন গোয়েন্দা পড়ত। আমার বন্ধুরাও। কিন্তু আমার বই কেনা ছিল একান্তই উপেন্দ্রকিশোরের বংশে সীমাবদ্ধ! উপেন্দ্রকিশোর দিয়েই পড়ার শুরু এবং তারপরই এলেন লুৎফর রহমান রিটন তাঁর "শেয়ালের পাঠশালা" নিয়ে! সেবার কিছু ওয়েস্টার্ন আর অনুবাদ পড়তাম। রকিব হাসানের অনুবাদে "ট্রেজার আইল্যান্ড মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। আরেকটা বই খুব দাগ কেটেছিল, "চিলড্রেন অফ দ্য নিউ ফরেস্ট।" মাসুদ রানার বই আমি বেশ কিছু পড়েছি সেটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। তার আগে অবশ্য রাহুল সাংকৃত্যায়নের প্রধান সব বইই পড়ে ফেলতে হয়েছিল।

সেবার বই ভালো লাগে, কিন্তু পড়েছি খুব কম। আমার বন্ধুদের কাছে ছিল সেবার বইয়ের খনি। আরেকটা মজার বিষয় হল- ফেলুদার বই জনপ্রিয় হল বন্ধুমহলে টিভিতে সন্দ্বীপের "ফেলুদা ৩০" আসার পর। আমার বন্ধুদের মধ্যে নিষ্ঠাবান সত্যজিৎ পাঠক শুধু আমিই ছিলাম। টিভিতে আসার আগে আমাদের ক্লাসে ১-২ জনই শুধু ফেলুদার দু-একটা বই পড়েছিল। সেদিক থেকে বলব টি,ভি ভীষণ উপকার করেছিল। জুল ভার্নের প্রেমে পড়েছিলাম বিসাকে থেকে "আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ" পড়ে। তখন ক্লাস সেভেন, ভূগোলে যেটা পড়ছি সেটা নিয়ে এই চিরায়ত উপন্যাস!

এই সিরিজটা চলুক।

নজমুল আলবাব এর ছবি

তুমি মাসুদ্রানা পড়োনা!!! কিসের পাঠক মিয়া তুমি? ফাউল

তারেক অণু এর ছবি
অন্যকেউ এর ছবি

চলুক

_____________________________________________________________________

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।

অন্যকেউ এর ছবি

আহা! মাইনষের সুখ দেখতেও ভাল্লাগে!‍

_____________________________________________________________________

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

এ্ত বই একসাথে কিনেছেন? দাম কত নিয়েছে গুপুনে গুপুনে যদি বলতেন চোখ টিপি । বই হারানো নিয়ে আমারও নীরব দীর্ঘশ্বাস আর কষ্ট আছে। বছর দুয়েক ধরে হারিয়ে যাওয়া বইগুলো আবার সংগ্রহ করছি দেখাযাক কতদূর যেতে পারি।

মাসুদ সজীব

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক হাততালি পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

অণু'দা তো ছন্নছাড়া মানুষ। ওনাকে এইসব বইপত্তর এর মায়ার জড়িয়ে ফেলাটা একদম ঠিক হবে না

কস্কি মমিন! হো হো হো গড়াগড়ি দিয়া হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

বিক্রয় বিজ্ঞপ্তি কোন সাইটে পেয়েছিলেন ভাইডি? একটু যদি জানাতেন!!

এই তথ্য নিয়ে কি করব সেটা আর বলছি না, বললে আপনি চেপে যেতে পারেন দেঁতো হাসি

হাসিব এর ছবি

অত্যান্ত নিন্দাজনক একটা পুস্ট রেগে টং

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

নিতান্ত অভদ্রলোকের মত জানতে চাই - বিজ্ঞাপন কোথায় দেখেছিলেন, আর বই পিছু দাম কত পড়লো?

____________________________

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।