প্রিন্সেস! ঘুমিয়ে পড়েছিস?

পরিবর্তনশীল এর ছবি
লিখেছেন পরিবর্তনশীল (তারিখ: বুধ, ১৩/০২/২০০৮ - ৬:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

- আব্বু। স্কুলের টিচাররা আমাকে বকা দিবে?
আমি কোটি কোটি মায়া নিয়ে পাগলটার দিকে তাকালাম। এমনিতে আমার মুখ-খানা কুৎসিত। শুধু সাবা'র দিকে যখন তাকাই- অজস্র মমতা আমার চোখদুটিতে ভর করে। আমার মনে হয়, এই পৃথিবীতে- চোখে এমন মমতা নিয়ে কেউ কারো দিকে তাকায় না। কিংবা তাকাতে পারে না। সাবা আমার মেয়ে। আগামী সপ্তাহ থেকে সে স্কুলে যাবে। এ নিয়ে রাজকন্যা'র চিন্তার শেষ নেই। আমি অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই কোলের ওপর বসে আছে। আর ঘুম ঘুম চোখে নানান রকম প্রশ্ন করছে। '' আব্বু, অংক খুব কঠিন?'' ''আব্বু, স্কুলে আমার অনেক বন্ধু হবে। তাই না?''
আমি সাবা'র ছোট্ট নাকটা টিপে দিই। আর বলি-
- তুই হলি গিয়ে প্রিন্সেস। প্রিন্সেসকে কি কেউ বকা দেয় কোনদিন?
- প্রিন্সেস ডায়ানা।
বলে সে খিল খিল করে হাসে। সত্যিকারের প্রিন্সেসরা এমন সুন্দর করে হাসতে পারে? আমার বিশ্বাস হয় না।
এই মুহুর্তে আমি আর সাবা মিলে টিভি দেখছি। রাজনৈতিক নেতাদের 'আড্ডা' টাইপ একটা অনুষ্ঠান। প্রিন্সেস খুব মনোযোগ দিয়ে টিভি'র দিকে তাকিয়ে আছে। কী বুঝছে? কে জানে? একটু পরে আমি, সাবা আর আমার স্ত্রী ইতি বাইরে খেতে যাব। এমন দিনে নিজেকে খুব বেশি সুখী মনে হয়। মনে হয় না, দামী আইস্ক্রীম খাওয়াতে পারি না বলে সাবা ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদে- কিংবা একটা ফ্রীজ কেনার জন্য ইতি দুই সপ্তাহ আমার সাথে কথা বলে না। ইতি সাবা'র পাশে এসে বসল। দুই রাজকন্যাকে নিয়ে বসে আছি। কে বলবে আমি দুঃখী মানুষ?

ইতি'র সাথে আমার পরিচয় ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের প্রায় কথা হত বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে। আমি বলতাম আমাদের মেয়ে হবে। মেয়ের নাম ঠিক করতাম। আর ইতি বলত ছেলের কথা।
ইন্টার পরীক্ষার পরে ইতিকে বিয়ে করলাম। বিয়ে করেই আব্বুকে ফোন করলাম।
- আব্বু। একটা দুঃসংবাদ আছে।
আব্বু কোন কথাকেই সিরিয়াসলি নিত না। আমাকে বলল
- কি? বুড্ডা।
আব্বু আমাকে বুড্ডা বলে ডাকত।
- আমি একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলছি।
- হুম। বিয়ে তো একটা মেয়েকেই করবি। তাই না? কোন ছেলেকে নিশ্চয় বুড্ডা বিয়ে করবে না।
- আব্বু। আমি সিরিয়াস।
- হুম। আমাকে কি করতে হবে?
- আব্বু। আমি সিরিয়াস আর sorry। আম্মুকে একটু ম্যানেজ কর না।
এরপর ইতি'কে বাসায় নিয়ে আসলাম। আম্মু কিছু বলল না। আব্বু ইতি'র সঙ্গে কোন কথা বলল না। আমি খুব অবাক হলাম। আব্বু তো এমন না। এরপর প্রায় একবছর আব্বু ইতি'র সঙ্গে কথা বলে নি। শুধু মৃত্যুর সময় ইতি'র হাত ধরে অনেক কাঁদল।
- মা। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমাকে মাফ করে দিও, মা।

আব্বু মারা যাওয়ার কয়েক মাস পরেই ইতি'র সাথে খেলায় জিতলাম। ইতি'র কোলে একটা প্রিন্সেস এল। নাম রাখলাম সাবা।

সাবা'র স্কুলে প্রথম দিন আমরা তিনজনই গেলাম। মোটর সাইকেলে'র সামনে সাবা- মাঝখানে আমি- পেছনে ইতি। আমার মনে হচ্ছিল- মায়া আর ভালোবাসার বাঁধনে আমি মারাই যাব। স্কুলে গেটের কাছে গিয়েই সাবা কান্না শুরু করল।
- আব্বু। আমার ভয় লাগছে।
- গাধা। ভয় কীসের?
- টিচাররা আমাকে যদি মারে?
- বললেই হল। আমার মেয়েকে মারার সাহস আছে কারো?
ইতি সাবা'কে কোলে নিল। পৃথিবীর সব থেকে মধুর দৃশ্য। মায়ের কোলে শিশু। আমি বুকভর্তি সাহস নিয়ে সাবা আর ইতির জন্য দুইটা চকবার আইস্ক্রীম কিনে ফেললাম। সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য আমি আমার ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারব না? ইতি বলল।
- তুমি খাবা না?
- আমি আইস্ক্রীম খাই না।
- তাইলে আমিও খাই না।
হঠাৎ করে সাবা কান্নাভেজা কন্ঠে বলে উঠল।
- তাইলে আমিও খাই না।
আমরা তিনজনই হেসে উঠলাম। বোধহয়- আকাশটাও।

অফিসে গিয়েই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কি ফাইল নাকি হারিয়ে গেছে। দোষটাও নাকি আমার। অথচ ফাইলটা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য জিনিস। শ্রেণী বৈষম্য। ফাইলের জন্য সমস্ত অফিস খোঁজাখুঁজি করছি। বারোটা'র দিকে ইতি ফোন করল।
- সাবাকে আনতে যাবা না?
আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে নিলাম। মেয়েমানুষের বুদ্ধিশুদ্ধি এত কম?
- একটু সমস্যায় আছি। তাছাড়া যখন ইচ্ছা তখন তো অফিস থেকে চলে যেতে পারি না। আমি তো আর অফিসের বস না। কর্মচারী।
- প্লীজ আসো না। আজ সাবা'র স্কুলে ফার্স্ট দিন। একটা প্ল্যান আছে আমার। কিছু জমানো টাকা আছে। আজকে তোমাদেরকে লাঞ্চ করাব।
- ন্যাকামি রাখো তো।
কথাটা বলার সাথে সাথেই ইতি ফোন কেটে দিল। মনটা কিছুটা খারাপ হল। ইতি'র সঙ্গে অনেকদিন পর খারাপ ব্যবহার করলাম।

তিনটার দিকে বাড়ি ফিরলাম। দেখি দরজায় তালা লাগানো। পাশের বাড়ির জয়নাল সাহেব আমার দিকে ছুটে আসল।
- আরে সোহান। তুমি কই ছিলা?
জয়নাল সাহেবের মুখ দেখেই আমার বুক ধ্বক করে উঠল। ইতি আর সাবার কিছু হয় নি তো?
- কি হয়েছে? আংকেল?
- তুমি এক্ষণি 'রাজমণি ক্লিনিকে চলে যাও। তোমার বউ-বাচ্চা একসিডেন্ট করছে।
আমার পৃথিবী কাঁপতে লাগল। পাগলের মত ছুটলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমার পাপের কোন প্রায়শ্চিত্ত নেই।

উপসংহারঃ

একটা ট্রাক ওদের রিকশায় ধাক্কা মেরেছিল। সাবা সাথেই সাথেই মারা যায়। আমি কেন ওকে স্কুল থেকে আনতে যাই নি- সেটা বলে কাঁদছিল তখন। আর বলছিল আমার সাথে আর কখনো কথা বলবে না- আমার সাথে আড়ি নিবে। এসব কথা আমাকে বলেছে ইতি। তিনদিন পর রাজমণি ক্লিনিকেই ইতি মারা যায়।

আমার এখনো মনে হয়- ওরা ফিরে আসবে। আমরা তিনজন বিকেল বেলা বুড়িগঙ্গার তীরে বসে থাকব। ইতি আমার গান শুনতে চাইবে। আর সাবা ছুটাছুটি করবে।
এখনো গভীর রাতে আমি বালিশে মুখ চেপে ধরি। আর সাবা'কে বলি।
- প্রিন্সেস! ঘুমিয়ে পড়েছিস?

[সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে এখন একটা নিয়মিত ঘটনা। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই এসব সংবাদ চোখে পড়ে। মানব জীবন খুবই সীমিত। এ ধরণের ঘটনা যখন সীমিত জীবন আরো সংক্ষিপ্ত করে দেয়- তখন স্বভাবতই মন ভারী হয়ে আসে।
এর বিচার আমরা কার কাছে চাইব?]


মন্তব্য

পুতুল এর ছবি

খুব সুন্দর করে লেখা। একটু শৃংখলা হয়তো এমন কষ্টের হাত থেকে কিছু মানুষকে বাঁচাতে পারত। কিন্তু এতটুকু দায়বদ্বতা আমরা কার কাছে চাইব!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

হুম ...
................................................................................

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

মনটা খারাপ করে দিলেন তো.....

.....................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

রুহি এর ছবি

অসাধারণ লেখা! শুরুর দিকে সুন্দর ছোট্ট একটা সুখী পরিবার দেখতে পেয়ে মন ভরে যাচ্ছিলো; শেষটায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। বিশ্বাস না করতে পারলেই ভালো হত। ঘটনাটা কি সত্য? আমার বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

প্রতিদিন খবরের কাগজে এসব দুর্ঘটনার খবর এতটাই নিয়মিত হয়ে গেছে যে পরে মনটা কিছুক্ষনের জন্য খারাপ লাগে, একটু পরেই সব ভুলে যাই। কিন্তু সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যে বেঁচে থাকে, সে-ই জানে বেঁচে থাকা কত কষ্টের! এই কষ্ট আর কাউকেই যেন পেতে না হয়!

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

শুরুটা পড়তে পড়তে খটকা লাগলো। খুব সুখ সুখ ভাব।
ওপরে গিয়ে আবার দেখলাম ক্যাটেগরি গল্প।
সুতরাং লেখক যে স্বাধীণতার যথেচ্ছা ব্যবহার করবেন সেটা ধরেই নিলাম।

বাচ্চাটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম ভাই। শুধু শুধু মারলেন।
রাজকণ্যের শোকটা বেশী ছিল বলেই ইতির মৃত্যু আমাকে স্পর্শ করলো না।

অনেক ভালো লিখেন আপনি। সেটা আবারও প্রমান করলেন।

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

অতিথি লেখক এর ছবি

একটু ছোট, কিন্তু কাঁদানোর মত গল্প। আপনার লেখার ভংগীটি আরামদায়ক।

-জাহিদ হোসেন
_______________________________ যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

সমাজসচেতনতামূলক গল্প।ভালো হয়েছে।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমরা তিনজনই হেসে উঠলাম। বোধহয়- আকাশটাও।

আমি লিখলে গল্পটা এখানেই শেষ হতো। চকচকে একটা সুখী গল্প!

গল্পে সরাসরি সামাজিক কমেন্টারি করা ব্যক্তিগতভাবে আমার অপছন্দ। তাতে গল্প আর গল্প থাকে না। কিছু না বলেও সামাজিক কমেন্টারির উদাহরণ চাইলে নজমুল আলবাবের বউ বাটা বলসাবান গল্পটি পড়ে দেখবেন। সমাজ-সংসার নিয়ে একটি বাক্যও নেই, অথচ কী ভয়াবহ এক সামাজিক কমেন্টারি!

দুঃখিত, যদি আমার মন্তব্যে আহত বোধ করেন। আসলে আপনার লেখার হাত ভালো, আপনাকে সচেতন করার জন্যেই বলা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

পরিবর্তনশীল এর ছবি

সত্যি কথা বলব?
আপনার মন্তব্য সবসময় নতুন কিছু শেখায়
নতুন কিছু শিখতে বাধ্য করে।
--------------------------------
চোখের পাতায় হাত রেখে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখার যন্ত্রণা দেয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।